যেদিন তোমার রব আসবেন সারি সারি ফেরেশতাদের নিয়ে —আল-ফাজর ১৫-৩০
মানুষের অবস্থা হচ্ছে: যখন তার প্রতিপালক তাকে সম্মান, সামর্থ্য বাড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেন, তখন সে বলে, “আমার প্রতিপালক আমাকে সম্মানিত করেছেন!” আর যখন তিনি জীবিকা কমিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেন, তখন সে আফসোস করে, “আমার প্রতিপালক আমাকে অপমানিত করেছেন।” —সেটা কখনই নয়। বরং তোমরাই তো এতিমদের সম্মান করো না। অভাবীদের খাবার তাদেরকে দিতে উৎসাহ পর্যন্ত দাও না। উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ গোগ্রাসে আত্মসাৎ করো। সম্পদের প্রতি তোমাদের মাত্রাতিরিক্ত মোহ।—আল-ফাজর ১৫-২০
যখন তার প্রতিপালক তাকে সম্মান, সামর্থ্য বাড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেন
যখন কারও বেশ টাকা পয়সা হয়, তখন সে অনেক সময় এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভোগে যে, আল্লাহ تعالى তাকে এখন ভালোই পছন্দ করেন। আল্লাহকে تعالى খুশি রাখার জন্য সে মসজিদে কিছু দান করে। গরিব আত্মীয়দের মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা বিলিয়ে দেয়। কিন্তু ওদিকে আলিশান রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে ব্যাপক খাওয়া-দাওয়া। প্রত্যেক মাসে জাঁকজমক করে পার্টি। বাসায় বিশাল টেলিভিশন, দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি, অভিজাত এলাকায় আলিশান বাড়ি। কয়েক মাস পর পর বিদেশে বেড়াতে যাওয়া। লক্ষ লক্ষ টাকা আমোদে উড়িয়ে আসা। পাঁচ তারা হোটেলে গিয়ে সন্তানের জন্মদিন, বিয়ের অনুষ্ঠান।
মাঝে মধ্যে তার মনে হতে থাকে যে, জীবনটা বাড়াবাড়ি রকমের বিলাসিতা হয়ে গেছে। আশে পাশে মানুষ কত কষ্টে আছে। তাদের জন্য কিছু করা দরকার। তখন সে বিবেকের দংশন কমাতে মসজিদের দান বাক্সে একশ টাকা দিয়ে আসে। তারপর পরদিন লক্ষ টাকা খরচ করে সপরিবারে ফুর্তি করতে যায়, আর মনে মনে ভাবতে থাকে, “আল্লাহ আমার উপর কত রহমত করেছেন! উনি আমাকে কত সম্মান দিয়েছেন! আলহামদুলিল্লাহ!” —কিন্তু সে জানে না যে, এই সবই ছিল পরীক্ষা। যেই পরীক্ষায় সে প্রতিদিন ফেল করছে।
আর অন্যদিকে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম যখন কঠিন বিপদে পড়েন, অনেক সময় তিনি ভাবতে থাকেন, “আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার উপর রাগ করেছেন। না হলে তিনি কেন আমাকে এত কষ্টে ফেলবেন। পাশের বাড়ির চৌধুরী সাহেব ঠিকমত নামাজও পড়ে না। কিন্তু তারপরেও সে কত আরাম-আয়েশের আছে। আর আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, যাকাত দেই, কিন্তু তারপরেও আমার এত অভাব, এত কষ্ট। সমাজে মাথা নিচু করে চলতে হয়। চৌধুরী সাহেবদের কথা মত উঠবস করতে হয়। আমার জীবনটা কেন এত অপমানের?”
অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে যে, আল্লাহ تعالى যখন কাউকে সম্পদ, সম্মান, প্রতিপত্তি দেন, তার মানে নিশ্চয়ই আল্লাহ تعالى তাকে এখন পছন্দ করেন? আর আল্লাহ تعالى যাকে গরিব বানিয়ে দেন, মান-সম্মান কেড়ে নেন, নিশ্চয় তাকে তিনি تعالى এখন অপছন্দ করেন?
ফিরাউনের বিপুল সম্পদ এবং সম্মান ছিল। কিন্তু সে ছিল আল্লাহর تعالى দৃষ্টিতে নিকৃষ্টতমদের একজন। রাসুল عليه السلام এর স্ত্রী মারা গেলেন। বিপদের দিনে আশ্রয়দাতা চাচা মারা গেলেন। একটি সন্তান বাদে অন্য সবকয়টি সন্তান মারা গেলো। তিনি عليه السلام পুরো জীবনটাই অভাবে, কষ্টে, মানবেতর জীবন পার করলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আল্লাহর تعالى সবচেয়ে পছন্দের একজন।
তাই, অমুকের এত বাড়ি-গাড়ি-টাকা দেখে ভাবছেন, কেন তার মতো এমন নামে-মুসলিম কাজে-কাফিরের জীবন এত আরামের?
ওদের এত ধনসম্পত্তি, সন্তানসন্ততি তোমাকে অবাক করতে দিয়ো না। এগুলো দিয়ে আল্লাহ শুধুমাত্র ওদেরকে এই দুনিয়াতে পরীক্ষা নিতে চান, যেন তাদের আত্মা কাফির অবস্থায় এখান থেকে চিরবিদায় নেয়। [আত-তাওবাহ ৯:৮৫]
চাকরি হারিয়ে আপনার মাথায় হাত: কেন আপনার সাথেই এমনটা হলো? কেন আপনার সন্তান এত গুরুতর অসুস্থ হলো? কেন আপনার বাবা এই দুঃসময়ে মারা গেলেন?
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও। [আল-বাক্বারাহ ১৫৫]
মনে রেখো, তোমার যা ধনসম্পদ আছে এবং তোমার সন্তানরা, এগুলো শুধুই তোমার জন্য পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। আর মনে রেখো, আল্লাহর কাছে রয়েছে অপরিসীম পুরস্কার। [আল-আনফাল ৮:২৮]
তারা কি লক্ষ্য করে দেখে না যে, প্রতিবছর তাদের উপর দুই-একবার বিপদ আসছে? এরপরও ওরা তওবাহ করে না, উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। [আত-তাওবাহ ৯:১২৬]
আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই দুনিয়াতে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষা নেবেনই, নেবেন। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারো বেলায় সেই পরীক্ষা হয়তো চাকরি হারিয়ে ফেলে অভাবে, কষ্টে জীবন পার করা। কারো বেলায় হয়তো বাবা-মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তানদের জটিল অসুখের চিকিৎসায় দিনরাত সংগ্রাম করা। কারো বেলায় হয়তো নিজেরই নানা ধরনের জটিল অসুখ। কারো বেলায় আবার জমি-জমা, সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সাথে শত্রুতা, শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার, দুশ্চরিত্র স্বামী, পরপুরুষে আসক্ত স্ত্রী, মাদকাসক্ত ছেলে, পরিবারের মুখে কালিমা লেপে দেওয়া মেয়ে —কোনো না কোনো সমস্যায় আমরা পড়বোই। এই সমস্যাগুলো হচ্ছে আমাদের জন্য পরীক্ষা।
পৃথিবীতে আমরা এসেছি পরীক্ষা দিতে —এটা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। হিন্দি সিরিয়াল, মিউজিক, ভিডিও গেম, রংবেরঙের পানীয়, হাজারো বিনোদন সবসময় আমাদেরকে চেষ্টা করে এই বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দিতে। আমরা নিজেদেরকে প্রতিদিন নানা ধরনের বিনোদনে বুঁদ করে রেখে জীবনের কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আমরা বিনোদনে যতই গা ভাসাই, ততই বিনোদনের প্রতি আসক্ত হয়ে যাই। যতক্ষণ বিনোদনে ডুবে থাকি, ততক্ষণ জীবনটা আনন্দময় মনে হয়। তারপর বিনোদন শেষ হয়ে গেলেই অবসাদ, বিরক্তি, একঘেয়েমি ঘিরে ধরে। ধীরে ধীরে একসময় আমরা জীবনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। “কেন আমার নেই, কিন্তু ওর আছে?” “কেন আমারই বেলায় এরকম হয়, অন্যের কেন এরকম হয় না?” —এই সব অসুস্থ প্রশ্ন করে আমরা আমাদের মানসিক অশান্তিকে জ্বালানী যোগাই। এত যে অশান্তি, তার মূল কারণ হলো: আমরা যে এই জীবনে শুধু পরীক্ষা দিতে এসেছি —এই কঠিন বাস্তবতাটা ভুলে যাওয়া।
অভাবীদের খাবার তাদেরকে দিতে উৎসাহ দাও না
মিসকিন مسكين হচ্ছে খুবই গরিব মানুষরা, যাদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, কাপড় যোগাড় করা খুবই কঠিন। এরা সবসময় অভাবী। একজন এতিমের হয়ত উত্তরাধিকার সুত্রে সম্পত্তি থাকতে পারে। কিন্তু এদের কোনো সম্পত্তি থাকা তো দুরের কথা, মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মতো সামান্য অবস্থাও নেই। এরা হচ্ছে সমাজের ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা।
আজকে আপনার-আমার পরিবার নিয়ে থাকার জন্য বাসা আছে। রাতে খাওয়ার মতো খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। কালকে বাইরে পড়ার মতো কাপড় আছে। কিন্তু মিসকিনদের এসব কিছুই নেই। তারা প্রতিটা দিন কষ্টে, ভয়ে থাকে: কীভাবে তারা আগামীকাল কিছু খাবার, পড়ার মতো পরিষ্কার কাপড়, থাকার মতো জায়গা জোগাড় করবে। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করা ছাড়া আর কিছু নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থা তাদের নেই।[১][১১]
আজকে এমন কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেই, যা বাধ্যতামূলকভাবে দেশের সকল মিসকিনদের অভাব দূর করে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। একমাত্র একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে, জনগণের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত সংগ্রহ করে, একটি তহবিল গঠন করে, দেশের মিসকিনদের অভাব দূর করার ব্যবস্থা করা।
যতদিন ইসলামিক আইন প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে, ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতি ধনীদেরকে আরও ধনী বানিয়ে যাবে এবং গরিবদেরকে আরও গরিব বানাতে থাকবে। আজকে পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, যা সম্পত্তি সুষমভাবে বণ্টন করে ধনী-গরিবের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, তা দূর করতে পারে। যার ফলে সবসময় এমন কিছু মানুষ থেকে যায়, যারা তাদের প্রয়োজনের চেয়ে হাজার গুণ বেশি সম্পত্তি নিয়ে থাকে, যা তারা আমোদ ফুর্তিতে নষ্ট করে। অন্যদিকে এমন কিছু মানুষ সবসময় থেকে যায়, যারা দুই বেলা খাবারও জোগাড় করতে পারে না। সম্পদ সুষমভাবে বণ্টনের এমন কোনো পদ্ধতি কোনো সরকার যদি তৈরি করার চেষ্টাও করে, তখন দেশের বড় বড় ধনকুবেররা ব্যবস্থা করে দিবে, যেন সেই সরকার বেশিদিন টিকে থাকতে না পারে।
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, যারা অভাবে পড়লে হাঁ-হুতাশ করতে থাকে যে, আল্লাহ تعالى তাদেরকে অপমানের জীবন দিয়েছেন, তারা তো অভাবীদেরকে খাবার দিতেই উৎসাহ দেয় না, নিজেরা দেওয়া তো দূরের কথা। কারণ এরা যদি অন্যদেরকে খাবার দিতে বলে, তাহলে তো মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করবে, “তুমি কোথায় দান করছ? তুমি কাদের খাওয়াও?” — তখন তো তাদের ভেতরের খবর বেড়িয়ে যাবে। এজন্য তারা নিজেদের গা বাঁচাতে কাউকে গিয়ে গরিব লোকদের জন্য কিছু করার কথা বলতেও যায় না।
এই আয়াতে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আল্লাহ تعالى বলেননি যে, তারা অভাবীদের খাবার দেয় না। বরং তিনি বলেছেন, তারা ‘অভাবীদের খাবার’ তাদেরকে দিতে উৎসাহ দেয় না। খাবারটা আমাদের না যে, আমরা দয়া করে তাদেরকে দিচ্ছি। বরং খাবারটা অভাবীদেরই। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। আজকে আমরা যে ব্যাংক ব্যলান্সের পাহাড় নিয়ে বসে আসি, সেটা ভর্তি হচ্ছে হাজারো অভাবীর খাবার। আমরা হাজারো অভাবীর খাবার ব্যাংকের মধ্যে তালা বন্ধ করে রেখেছি। তারপর সেই অভাবীদের খাবার থেকে লাভ, সুদ খাচ্ছি। আজকে আমরা যে জমি-জমা করে নিশ্চিন্ত মনে বসে আছি, সেই জমি-জমার মধ্যে অভাবীদের খাবার রয়েছে। বিরাট বাড়ি, আলিসান গাড়ি, ব্যাংক ভর্তি কোটি কোটি টাকা, শহরে, গ্রামে জমি-জমা, এগুলোর মধ্যে অভাবীদের ভাগ লুকিয়ে রয়েছে। আমরা যদি তা বের করে তাদেরকে না দেই, তাহলে একদিন আমাদেরকে প্রচণ্ড মার দিয়ে, ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছ থেকে গুণে গুণে সব বের করা হবে।
উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ গোগ্রাসে আত্মসাৎ করো
“ভাবি, শুনলাম ভাই সাহেব মারা যাওয়ার আগে কিছু জমি রেখে গেছেন। আপনারা কবে বসছেন সেগুলো ভাগ-বাটোয়ারা করতে? ভাইয়ের গ্রামে যে আত্মীয়রা আছে, তাদেরকে ডাকার দরকার নেই। তারা গ্রামের মানুষ, শহরের জমি দিয়ে করবে কী? এগুলো বরং আপনার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য বেশি দরকার। চলেন আমরা নিজেরাই ভাগ বাটোয়ারা করে নেই। আপনিও বেশি পাবেন, আমিও কিছু পেলাম।” — যাদের সম্পদ পাওয়ার কথা, তাদেরকে না দিয়ে কীভাবে নিজেরা হাতানো যায়, এই ফন্দিফিকিরে এরা ব্যস্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য শ্রেণী হলো তারা, যারা কেউ এতিম হয়ে গেলে, নানা রকম ধান্ধাবাজি করে সেই এতিমদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিজেরা দখল করে নেয়। তারপর এতিমদের একটা মাদ্রাসায় রেখে দিয়ে আসে। এতিমরা জানতেও পারে না তারা কী হারাল।
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى একটি কল্পচিত্র দিয়েছেন। একদল লোভী মানুষ গোগ্রাসে সম্পত্তি হাপুস হুপুস করে খাচ্ছে। এরা শুধু নিজেদেরটাই খাচ্ছে না, আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে, সেঁটাও চেটেপুটে খাচ্ছে। لمّ হচ্ছে সব, পুরোটা, নিজের এবং অন্যেরটাও।[৫] এদের লোভের পরিমাণ যেন ফুটে উঠেছে এই আয়াতে।
সম্পদের প্রতি তোমাদের মাত্রাতিরিক্ত মোহ
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে চৌধুরী সাহেব গভীরভাবে চিন্তা করছেন। গতকাল কন্ট্রাক্টররা এসেছিল একটা প্রজেক্টের জন্য তদ্বির করতে। তাকে গুলশানে দুইটা ফ্লাট দেবে বলে কথা দিয়েছে। তিনি মনে মনে হিসেব করছেন প্রজেক্টের মূল্য কতখানি এবং সেখান থেকে তিনি কত কমিশন নিতে পারেন। আর দুইটা ফ্লাটে তার পোষাবে না। কমপক্ষে চারটা লাগবে। শতকোটির টাকার প্রজেক্ট বলে কথা!
কিছুক্ষণ পর ফোন আসল। তার ব্যবসার পার্টনার উত্তেজিত হয়ে আছেন। এক বড় কাস্টমারের শত কোটি টাকার মাল কাস্টমস আটকে দিয়েছে। জলদি না ছাড়ালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। চৌধুরী সাহেবের চোখ চকচক করে উঠলো। তিনি জলদি কাস্টমসের দায়িত্বে থাকা মামা-শ্বশুরকে ফোন দিয়ে একটা ভাগা-ভাগি চুক্তি করে ফেললেন। মামা-শ্বশুর মাল ছাড়াতে দুই কোটি টাকার ঘুষ নেবেন। চৌধুরী সাহেবের কাজ ব্যবসার পার্টনারদের রাজি করানো সেই টাকা ঘুষ দিতে, আর মামা-শ্বশুরের কাজ গোপনীয়তা রক্ষা করে সেই ঘুষের অর্ধেক চৌধুরী সাহেবের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে দিয়ে দেওয়া।
চুক্তি শেষে তিনি দ্রুত অফিসের দিকে বেরিয়ে পড়লেন। গাড়িতে থাকতে কয়েকটা জরুরি ফোন করতে হবে। তার এক আত্মীয় সম্প্রতি মারা গেছেন। জলদি তার সন্তানদের দায়িত্ব তিনি নিয়ে নেবেন এবং বিনিময়ে আত্মীয়ের সব জমিজমা তার নামে লিখে নেবেন। তিনি এক মাদ্রাসার মুহতারামের সাথে কথা বলে রেখেছেন। জমিজমা হাতবদল হয়ে গেলেই আত্মীয়ের সন্তানদের তিনি গ্রামে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেবেন। আরেকটা ফোন করতে হবে তার উকিলকে। তার দুশ্চরিত্র শালার নামে নাকি শ্বশুর বিরাট সম্পত্তি লিখে রেখেছেন। সেটাতে কোনোভাবে একটা ঝামেলা পাকানো দরকার। শালাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তার জমিজমা স্ত্রী আর তার নামে নিয়ে নিতে হবে। স্ত্রীর সই করা ছবি তিনি পকেটে নিয়েই ঘোরেন, যেন যে কোনো সময় দরকার পরলে স্ত্রীর সম্পত্তি …
—সম্পদের প্রতি এদের মোহ হচ্ছে جمّ —সর্বগ্রাসী, প্রচণ্ড মোহ। একবার সম্পত্তির গন্ধ পেলে কতখানি সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে গোগ্রাসে গিলবে, সেই ক্ষুধায় পাগল হয়ে যায়।
না, বরং সাবধান! যেদিন পৃথিবীকে পিষে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হবে। এবং তোমার প্রতিপালক আসবেন সারি সারি ফেরেশতাদের নিয়ে। সেদিন জাহান্নামকে সামনে নিয়ে আসা হবে, আর মানুষের সব মনে পড়তে থাকবে। কিন্তু সেদিন মনে করে আর কী লাভ হবে। তারা হাহাকার করতে থাকবে, “হায়! এই জীবনের জন্য যদি কিছু করে রাখতাম!” সেদিন তিনি এমন শাস্তি দেবেন, যা কেউ দিতে পারে না। এমনভাবে আটকাবেন, যেভাবে কেউ আটকাতে পারে না।
হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসো, তুমি সন্তুষ্ট, তিনিও তোমার উপর সন্তুষ্ট। আমার বান্দাদের মাঝে চলে এসো। আমার জান্নাতে প্রবেশ করো। — আল-ফাজর ২১-৩০
যেদিন পৃথিবীকে পিষে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হবে
পৃথিবীতে সবকিছু পাওয়ার মোহে যারা অন্ধ, তারা একদিন দেখবে তাদের সাধের পৃথিবীর সব কিছু গুড়া গুড়া করে ফেলা হয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘর, জমি-জমা, বিশাল ব্যবসা, সুইস ব্যাংকে মধ্যে লুকিয়ে রাখা কোটি কোটি টাকা সব নিশ্চিহ্ন।
সেদিন আল্লাহ تعالى আসবেন। ফেরেশতা বাহিনী এসে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। জাহান্নামকে টেনে আনা হবে। জাহান্নামের ভীষণ রূপ দেখে মানুষের সব মনে পড়ে যাবে। সারাজীবন জাহান্নাম সম্পর্কে শুনে যা কিছু হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছিল, সব তখন সত্যি হয়ে চোখের সামনে দেখতে পারবে। তখন যতই হা-হুতাশ, বিলাপ করুক, কোনো লাভ হবে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সব সুযোগ শেষ। কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে।
সেদিন তিনি এমন শাস্তি দেবেন, যা কেউ দিতে পারে না
আজকাল প্রায়ই আমরা খবরের কাগজে পড়ি পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে কি ভয়ংকরভাবে অত্যাচার করে সাক্ষ্য বের করে। গোপন কারাগারে মুসলিমদের বন্দী করে রেখে কী নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এগুলো হচ্ছে মানুষের সীমিত ক্ষমতা এবং কল্পনা থেকে তৈরি করা অত্যাচার করার ব্যবস্থা। আল্লাহ تعالى যখন তার অসীম ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করেন, তখন সেই শাস্তির কঠোরতার পর্যায় কোথায় যেতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না।
জাহান্নামে শাস্তির কোনো বিরতি নেই। প্রচন্ড মার খাওয়ার পর যদি হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, “এক মিনিট দাঁড়াও। একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই।” সাথে সাথে শুরু হবে আবার মার। একটুও বিরতি দেওয়া হবে না। এক শাস্তির উপর আরেক শাস্তি চলতেই থাকবে। কোথাও পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আজকাল পুলিশ, র্যাব, দুদকের মামলা থেকে পালানো যায় উপরের লেভেলে তদ্বির করে। কিন্তু আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। তিনি এমনভাবে আটকাবেন, যেভাবে কেউ আটকাতে পারে না।
হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসো, তুমি সন্তুষ্ট, তিনিও তোমার উপর সন্তুষ্ট। আমার বান্দাদের মাঝে চলে এসো। আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।
—এই কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় অধির আগ্রহে দিন গুনছে প্রতিটি মুমিন বান্দা। তাদের সারাজীবনে কত চেষ্টা আল্লাহকে تعالى পাওয়ার জন্য। জীবনে কত ত্যাগ, কত কঠিন পরীক্ষা ধৈর্য ধরে পার করা। তারপর কিয়ামতের বিভীষিকার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ বিচারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রতিটি ভালো, মন্দ কাজের জবাবদিহিতা করা —এই সবকিছু শেষ করার পর যখন একজন মুমিন বান্দা বুঝতে পারবে যে, সে বিচার পাশ করেছে! তার আর কোনো ভয় নেই! তখন সে শুনতে পাবে আল্লাহ تعالى তাকে ডাকছেন, “হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসো. তুমি সন্তুষ্ট, তিনিও তোমার উপর সন্তুষ্ট”— এটা আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে বান্দার অর্জনের এক বিরাট স্বীকৃতি। আল্লাহ تعالى নিজে তাকে অভিবাদন জানাবেন। তাঁর পছন্দের বান্দাদের দলে ভিড়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন। তাঁর تعالى জান্নাতে প্রবেশ করতে দেবেন। এই সেই জান্নাত, যেখানে যাওয়ার জন্য হাজার-হাজার বছর ধরে লক্ষ কোটি বান্দা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত করে যাবে।
কেন “প্রশান্ত আত্মা”-কে উদ্দেশ্য করে এই আহ্বান দেওয়া হবে? আমরা কয়েকটি আয়াত আগে দেখেছি, কিছু মানুষ আছে যারা একটু সম্পদ, আরাম আয়েসের জীবন পেলে অহংকার, দম্ভে, নিজেকে বিরাট কিছু মনে করা শুরু করে। আবার কিছু বান্দা আছে যারা অভাবে পড়লেই তাদের ঈমানের নড়বড়ে ভিত্তিতে ফাটল ধরা শুরু হয়। আল্লাহর تعالى প্রতি অভিযোগ শুরু হয়। কিন্তু যারা এই প্রশান্ত আত্মা, তারা সম্পদ, সামর্থ্য পেলে বুঝতে পারে যে, তাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তারা তখন অভাবীদের পাশে দাড়ায়, মানুষের কষ্টের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, আল্লাহর تعالى রাস্তায় যতভাবে সম্ভব সম্পদ দান করে। তারা সবরকম চেষ্টা করে যেন কিয়ামতের দিন আল্লাহর تعالى সামনে দাড়িয়ে তাদের সম্পদ, সামর্থ্য নিয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়। একইভাবে তারা যখন অভাবে পড়ে, তখন হাঁ-হুতাশ না করে ধীর-স্থিরভাবে, ঈমান বজায় রেখে পরীক্ষা পার করে। সচ্ছলতা এবং অভাব, দুই অবস্থাতেই এরা আল্লাহর প্রতি আস্থাবান, নিজেদের অবস্থার প্রতি তুষ্ট থাকে। এরাই প্রশান্ত আত্মা। এরাই জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার যোগ্য।[৭]
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।