বেশি-বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে—আত-তাকাছুর
বেশি-বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।
না! তোমরা একদিন জানতে পারবে।
আবারো বলছি, না! তোমরা একদিন জানতে পারবে।
সত্যিই, তোমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে কী ঘটবে।
তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখতে পাবে। আবারো বলছি, তোমরা অবশ্যই নিজের চোখে তাকে দেখতে পাবে।
তারপর, সেদিন সুযোগ-সুবিধাগুলোর ব্যাপারে তোমাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে। —আত-তাকাছুর
বেশি-বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে
“বন্ধুবান্ধব সব এতদিনে নিজের বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে। আমি এখনও ভাড়াটিয়া বলে মানুষের কথা শুনছি। ওদের বাসায় বেড়াতে গেলে নিজেকে ফকির-ফকির মনে হয়। আর না। এবার বাড়ি কেনার ঋণটা নিতেই হবে।”
“অনেক হয়েছে, আর না। পুরনো গাড়িটা ফেলে দিয়ে এবার একটা নতুন গাড়ি কিনবোই। প্রতিবেশির বড় গাড়িটার পাশে আমার গাড়িটাকে একটা টেম্প্যু মনে হয়।”
“আমার পুরনো আমি-ফোনটা মানুষের সামনে বের করতে লজ্জা লাগে। সবাই যেন কেমন-কেমন করে তাকায়। আজকাল সবার হাতে আমি-ফোন ৭। পাশের বাড়ির কাজের মেয়েটার হাতেও আমার থেকে নতুন মডেলের ফোন!”
এই যে লোক দেখানোর প্রতিযোগিতার মানসিকতা—অন্যদের থেকে ভালো বাড়ি, গাড়ি কিনতে হবে। সব দামি ব্রান্ডের জিনিস ব্যবহার করি দেখাতে হবে—বেশি-বেশি পাওয়ার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে আত-তাকাছুর (التَّكَاثُر)।[১][৪]
একসময় আমরা অনেক কাটখোর পুড়িয়ে বাড়ি কিনি। মানুষকে গর্ব করে দেখাই নতুন কেনা দামি আসবাবপত্র, ঝকঝকে বাথরুম। কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই সেই স্বপ্নের বাড়ির উপর থেকে মন উঠে যায়। বেড়াতে গিয়ে অন্যের বাড়ির আসবাবপত্র, বাথরুম দেখে আফসোস শুরু হয়। আবার হয়তবা একদিন শখের ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনি। মানুষকে বলে বেড়াই, “এবার গাড়িটা কিনেই ফেললাম। বেশি না, মাত্র ৩৫ লাখ। সস্তায় পেয়ে গেছি, কী বলেন?” তারপর কয়েক বছর না যেতেই বন্ধুর নতুন গাড়ির সামনে সেটাকে লক্কড় মনে হয়। একসময় সবাইকে গর্ব করে দেখিয়ে বেড়ানো নতুন মোবাইল ফোনটা দুই বছর না যেতেই টেবিল থেকে সরিয়ে পকেটে লুকিয়ে রাখতে হয়। এত চেষ্টা করে এতসব পাওয়ার পরেও বেশিদিন প্রাপ্তির সুখ ধরে রাখা যায় না। শুরু হয় আবার প্রতিযোগিতার দৌড়।
আল-হা أَلْهَا হচ্ছে: কিছু একটা আমাদেরকে এমনভাবে ব্যস্ত রাখে যে, আমাদের যা করার কথা তা করতে আমরা ভুলে যাই। বিনোদন হচ্ছে লাহউ لَهْو , কারণ বিনোদন আমাদেরকে বাস্তবতা ভুলিয়ে রাখে। আমাদের যা করার কথা, তা না করে আমরা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় কাজে বুঁদ হয়ে থাকি। অনেকের বেলায় কাজ হয়ে গেছে লাহউ, কারণ যেটুকু কাজ করলে তার ভালোভাবে চলে যেত, সে তার দ্বিগুণ কাজ করছে তার নিজের বাড়ি, গাড়ি, দামি ফোন, বিদেশ বেড়াতে যাওয়ার জেদ পূরণ করার জন্য। কারও বেলায় লাহউ হয়ে গেছে মাস্টার্স, পিএইচডি ডিগ্রির পেছনে ছোটা। তার অমুক বন্ধু, তমুক আত্মীয় পিএইচডি করে ফেলল। অথচ সে একটা ব্যাচেলর্স ডিগ্রি নিয়ে অশিক্ষিত হয়ে বসে আছে? তাছাড়া এখন যে বেতন পাচ্ছে তা দিয়ে একটা মাত্র বাড়ি হবে। ছেলে-মেয়ের জন্য আলাদা বাড়ি, কয়েকটা জমি রেখে যেতে হবে না? —এই আরও বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় তার কাজ, পড়াশুনা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাকে কী ভুলিয়ে দিয়েছে?
আল্লাহ تعالى নির্দিষ্ট করে বলে দেননি তাকে কী ভুলিয়ে দিয়েছে। আরও বেশি পাওয়ার এই প্রতিযোগিতায় আমরা কী ভুলে বসে আছি, তা যেন আমরা নিজেরা চিন্তা করে বের করি।[১] মানুষ যেন দৌড়ানো বন্ধ করে একটু থামে। পেছনে ফিরে তাকায়। তাকিয়ে যেন দেখে সে কী সর্বনাশ করে ফেলেছে। তাহলে সে নিজেই বুঝতে পারবে সে কী ভুলে গেছে।
কেউ যখন আমাদেরকে বলে, “ভাই, চলেন না, নামাজ পড়তে যাই?” অথবা, “ভাই, কালকে আসেন না একসাথে কিছুক্ষণ কুর‘আন পড়ি, ইসলাম নিয়ে একটু পড়াশুনা করি?” অথবা, নামাজের পরে মুসল্লিরা যখন অনুরোধ করেন, “ভাই একটু বসবেন? কিছু জরুরি আলোচনা হবে। আপনার অনেক কাজে লাগবে।” — তখন আমরা বলি, “সরি ভাই, আজকে খুব ব্যস্ত আছি। আরেকদিন হবে।” —আমরা মনে করি যে, আমরা আসলে অনেক ব্যস্ত। আমাদের জরুরি কাজ আছে। অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এগুলো আসলে আমাদের আসল-কাজ, আসল-দায়িত্ব থেকে ভুলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু না। আমরা নিজেরাই এমন সব কৃত্রিম ব্যস্ততা, কৃত্রিম দায়িত্বের মধ্যে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছি যে, খেয়াল করে দেখার সুযোগই পাচ্ছি না, আমাদের আসলে কী নিয়ে এবং কাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিত ছিল। নিজেদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই সব কৃত্রিম মোহ সবার আগে আমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহকে تعالى। এগুলো হয়ে গেছে আল্লাহর تعالى থেকে আমাদেরকে দূরে রাখার ফাঁদ মাত্র।
বাবা-মা ভুলে গেছে সন্তানদের কথা। সন্তানেরা বড় আশা নিয়ে তাদের কাছে আসে একটু সময় পাওয়ার জন্য। কিন্তু তারপর, “আমার এখন কাজ আছে”, “আমার সামনে পরীক্ষা, পড়তে হবে” —এই সব শুনে মন খারাপ করে বার বার ফিরে যায়। কারও সন্তানেরা সপ্তাহে একদিন মাত্র বাবাকে দেখতে পায়, কারণ বাকিদিনগুলো বাবা সকালে চলে যায়, গভীর রাতে আসে। আরও বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা এই বাবা-মা’দেরকে সন্তানদের অধিকার, সন্তানদের সঠিকভাবে বড় করার দায়িত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে। এদের সন্তানেরা তাদের জন্য ভবিষ্যতে শান্তি এবং সওয়াবের উৎস না হয়ে, বরং একেটা টাইমবোম-এ পরিণত হচ্ছে। এখন শুধু ফেটে যাওয়ার অপেক্ষা। তখন হাজার কপাল চাপড়িয়েও তাদেরকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তখন শুধুই আফসোস হবে, “হায়! যদি একটু বাচ্চাদের সময় দিতাম! তাদেরকে ইসলাম শেখাতাম, কুর‘আন পড়াতাম, নামাজ পড়তে ডাকতাম, শালীনতা শেখাতাম!” —তারপর বাকি জীবন শুধু আফসোস করে, মানুষের কটু কথা শোনা থেকে পালিয়ে বেড়াতে হবে।
কেউ আবার নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভুলে গেছে। কাজের ব্যস্ততায়, পড়াশুনার চাপে কয়েকদিন পর পর ওষুধ খেয়ে নিজেকে কোনোভাবে ঠিক রাখতে হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, তত তার শরীর খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। দেহ তেল-চর্বিতে ভরে যাচ্ছে। হার্টে কলেস্টরেল জমে ব্লক তৈরি হচ্ছে। আরও বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা এদেরকে তাদের দেহের অধিকার ভুলিয়ে দিয়েছে। একদিন তাদের দেহ বিদ্রোহ করবে। তারপর তারা বাকি জীবনটা আফসোস করে ধুঁকে ধুঁকে পার করবে। হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
আবার কেউ দিনরাত নিজেকে বিনোদনে বুঁদ করে রেখেছে। প্রতিদিন এরা ঘণ্টাখানেক টিভি দেখে। ঘণ্টাখানেক মোবাইলে ফেইসবুক, চ্যাট, গল্প করে। তারপর কম্পিউটারে মুভি, কার্টুন, ভিডিও গেমে বুঁদ হয়ে থাকে। কয়েকদিন পর পর রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। —এভাবে প্রতিমাসে শত শত ঘণ্টা এরা ব্যয় করে বিনোদনের পেছনে। এই বিপুল পরিমাণের সময় এরা কাজে লাগাতে পারত নতুন কিছু শিখে, নিজের কর্ম দক্ষতা বাড়িয়ে, নতুন যোগ্যতা অর্জন করে, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে, আল্লাহর تعالى সাথে সম্পর্ককে সুন্দর করে, পরিবারকে সময় দিয়ে। কিন্তু না, বিনোদন এদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে জীবনে কী করলে আসলেই সত্যিকারের কিছু অর্জন হতো। কী করলে নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ, সম্মানের এবং সুখের হতো। মাত্রাতিরিক্ত বিনোদন এদের দৃষ্টিকে ঘোলা করে দিয়েছে। এরা দেখতে পাচ্ছে না যে, সামনে এক গভীর খাঁদের দিকে এরা হেঁটে যাচ্ছে। আরেকটু পরেই এর ভেতরে পড়ে যাবে। তারপর বাকি জীবনটা সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য আফসোস করতে থাকবে। “হায়! একটু যদি ঠিকমতো পড়াশুনা করতাম! একটু যদি কাজ শিখতাম! বাবা-মা, সন্তানদের আরো সময় দিতাম! নামাজ পড়তাম, কুর‘আন পড়তাম!” —কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই।
যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও
কিছু মানুষের চোখ কোনোদিন খোলে না, যতক্ষণ না তারা কবরে পৌঁছে যায়। আবার কিছু মানুষের যখন এক পা কবরে চলে যাওয়ার অবস্থা হয়, তখন তারা উপলব্ধি করে সারাজীবন কী ভীষণ ভুল করে ফেলেছে। তখন আর নিজের জীবনে এবং কাছের মানুষদের জীবনে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। নিয়তি মেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কবরে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। তাদের সেই কান্না কেউ দেখতেও পায় না।
এই আয়াতে আল্লাহর تعالى শব্দ চয়ন লক্ষ্য করার মতো। আয়াতটির আরবির অর্থ আসলে “যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও” নয়, বরং অর্থ হচ্ছে “যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থান ঘুরতে যাও”।[১][৫] —কবর আমাদের স্থায়ী ঠিকানা নয়। যদি হতো তাহলে বিচারের দুশ্চিন্তা থাকত না। দুনিয়ার ভুলের মাশুল দেওয়ার দরকার হতো না। বরং কবর হচ্ছে কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যাওয়া। তারপর একসময় সেখান থেকে আমাদেরকে বের করে ফেলা হবে। তখন শুরু হবে আসল বাস্তবতা। মানুষ সেদিন জানতে পারবে তার পৃথিবীর জীবনটা আসলে বাস্তবতা ছিল না, শুধুই একটা মায়া ছিল। একটা পরীক্ষা। আসল বাস্তবতা কেবল শুরু হলো বলে!
না! তোমরা একদিন জানতে পারবে। আবারো বলছি, না! তোমরা একদিন জানতে পারবে
সেদিন থেকে শুরু হবে মানুষের সত্যিকারের অস্তিত্ব। যেই অস্তিত্বের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই অস্তিত্ব নিয়ে সে চিরকাল থাকবে। পৃথিবীর জীবনটা যে একটা সামান্য সময়ের পরীক্ষা ছিল, সেদিন মানুষ সেটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করবে। ভীষণ লম্বা সময় ধরে সেই নতুন বাস্তবতা তার চোখের সামনে খুলতে থাকবে। শুরু হবে কঠিন, লম্বা এক বিচার পর্যায়। সেই প্রক্রিয়াটা এত লম্বা সময় ধরে হবে যে, পৃথিবীর ৭০-৮০ বছরের জীবনও তার কাছে তখন একদিন বা কয়েক ঘণ্টার সমান মনে হবে। সেদিন আমরা এক নতুন বিশ্বজগত, মহাবিশ্ব চলার নতুন সব পদ্ধতি, সময়-এর এক নতুন রূপ দেখতে পারবো।
সত্যিই, তোমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে কী ঘটবে
হায়! মানুষ যদি জানত যে সেদিন কী হবে, তাহলে তারা আজকে এইভাবে নিজেদের জীবনটাকে শেষ করত না। কেউ যদি উপলব্ধি করত যে, কীভাবে সেদিন তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মহাশক্তিমানের সামনে দাঁড় করানো হবে: প্রতিটা কাজের হিসেব দেওয়ার জন্য, তাহলে আজকে সে বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অন্ধের মতো দিনরাত দৌড়াতো না। নিজেকে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অর্থহীন কাজে ডুবিয়ে রাখত না। আরও টাকা, আরও সম্মান, আরও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় আল্লাহকে تعالى ভুলে থাকত না।
অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম দেখতে পাবে। আবারো বলছি, তোমরা অবশ্যই নিজের চোখে তাকে দেখতে পাবে
প্রতিটি মানুষ জাহান্নামের ভয়ংকর রূপ, সেখানকার প্রচণ্ড শাস্তি নিজের চোখে দেখবে। শুরু হবে বিচার। কিছু মানুষ বিচারে হেরে যাবে। তাদেরকে তখন সেই ভয়ংকর জায়গায় ফেলে দেওয়া হবে। আর কিছু মানুষ বিচারের পর পার পেয়ে যাবে। আল্লাহ تعالى তাদের উপর দয়া করবেন। তাদেরকে ছেড়ে দেবেন।
আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কল্পনা করতে বলছেন যে, আমরা প্রত্যেকে জাহান্নামের ভয়ংকর রূপ একদিন নিজের চোখে তাকিয়ে দেখবো। সেই ভীষণ দৃশ্য দেখে আমাদের কেমন লাগবে, সেটা যেন এখনি আমরা কল্পনা করি। কারণ আমরা যত গভীরভাবে কল্পনা করবো, আশা করা যায় আমাদের তত তাড়াতাড়ি হুশ ফিরবে। আমরা বুঝতে পারবো যে, দুনিয়াতে আমরা এমন সব কাজে ডুবে আছি, যেগুলো শুধুই আমাদেরকে সেইদিনের চরম বাস্তবতা থেকে ভুলিয়ে রেখেছে। আমাদের জলদি জেগে ওঠা দরকার।
তারপর, সেদিন তোমাদেরকে সুযোগ-সুবিধাগুলোর ব্যাপারে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে
সেদিন আমাদেরকে আন-নাঈম النَّعِيمِ অর্থাৎ যাবতীয় সুখ, আনন্দ, সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ تعالى কাউকে মেধা দিয়েছেন। কাউকে স্বাস্থ্য দিয়েছেন। কাউকে সম্পদ দিয়েছেন। কাউকে আবার অফুরন্ত সময় দিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে: যে যা নিয়ামত পেয়েছি জীবনে, সেটাকেই কাজে লাগানো। যাদের মেধা আছে কিন্তু টাকা-পয়সা নেই, তারা তাদের মেধাকেই কাজে লাগাবে ভালো কাজে। ইসলামের জন্য নিজে পড়াশুনা করবে, অন্যদের শেখাবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, লেখালেখি করবে।
যাদের স্বাস্থ্য আছে, কিন্তু মেধা, টাকা-পয়সা নেই, তারা তাদের স্বাস্থ্য দিয়েই ইসলামের জন্য কাজ করবে। মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা বানাতে বিনামূল্যে পরিশ্রম দেবে। গরিবদের জন্য বাড়ি মেরামত করে দেবে। এলাকার উন্নয়নে কাজ করবে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
যাদেরকে আল্লাহ تعالى অঢেল সম্পদ দিয়েছেন, তারা তাদের সম্পদ দিয়ে ইসলামের চর্চা, প্রসার, প্রচারে অর্থনৈতিকভাবে সবরকম সাহায্য করবে। মসজিদে টাকা দেবে, মাদ্রাসা বানিয়ে দেবে, এতিমখানা তৈরি করবে। গরিব আত্মীয়, এতিমদের ভরণপোষণ দেবে।
আর যাদের মেধা, স্বাস্থ্য, সম্পদ কিছুই নেই, আছে শুধুই সময়, তারা তাদের সময়কে কাজে লাগাবে নিজে ইসলাম শিখে এবং আশেপাশের মানুষকে ইসলামের দিকে ডেকে। তারা হয়ে যাবে সমাজের বিবেক। সমাজে ঘটে যাওয়া নিত্যনতুন অনাচার, অপসংস্কৃতির প্রবেশ, কিশোর-তরুণদের উচ্ছন্নে যাওয়ার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে কাজ করবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝাবে, ফিরে আসতে বলবে। যেসব জায়গায় গিয়ে মানুষ অপকর্ম করে, সেখানে গিয়ে সশরীরে বাঁধা দেবে।
আল্লাহ تعالى যাকে যতটুকুই সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, যা কিনা আল্লাহর تعالى আরও কাছে যাওয়ার জন্য সে কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগাতে পারত, সেগুলোর ব্যাপারেই তাকে জবাব দিতে বলা হবে। দুনিয়াতে সে যত আরাম-আয়েসের উপকরণ পেয়েছে, যত বিনোদন করে গেছে, যতটুকু সময় সুখে থেকেছে, তার জন্য তাকে সেদিন জিজ্ঞাসা করা হবেই। লাতুসআলুন্না لَتُسْأَلُنَّ —দুই বার জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, জিজ্ঞেস করা হবেই হবে, কোনো ছাড় নেই। মানুষ কি সেগুলো পেয়ে আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছিল? তারপর, কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য কী করেছিল সে?
উপসংহার
সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি অর্জনে চেষ্টা করা দোষের কিছু নয়। দোষ হচ্ছে যখন তা আমাদেরকে আল্লাহর تعالى কথা ভুলিয়ে দেয়। আল্লাহর تعالى প্রতি অকৃতজ্ঞ করে দেয়। যখন সেগুলোর পেছনে ছুটতে গিয়ে ইসলাম ভুলে যাই। পরিবারকে ভুলে যাই। সন্তানদের ঠিকভাবে সময় দেই না। বাবা-মা’র সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখি না। সময়মত নামাজ পড়তে ভুলে যাই। সমাজের অন্যায়-অনাচার দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকি। এলাকার এতিম, গরিবদের দিকে তাকাই না। আত্মীয়দের আবেদন উপেক্ষা করি। যখন আমাদের যাবতীয় চেষ্টা হয়ে যায় মানুষকে দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতা। অন্যের থেকে নিজেকে সম্পদশালী বলে জাহির করার মানসিকতা। তখনি তা আমাদেরকে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
একারণে আমাদের লক্ষ্য হতে হবে: আমাদের এখন যা কিছুই আছে এবং যা কিছুই আমরা পাওয়ার চেষ্টা করছি, তার সবকিছুই আল্লাহকে تعالى খুশি করার জন্য পাওয়ার চেষ্টা করা। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের চেষ্টা এবং যোগ্যতাগুলো পরিবার, বাবা-মা, আত্মীয়, এতিমদের উপকারে লাগবে। ইসলামের প্রচার এবং প্রসারে অবদান রাখবে। তখনি আমরা বলতে পারবো যে, সেগুলো পেয়ে আমরা সত্যিই আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলাম।
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।