কুরআনের কথা

তাই তুমি তোমার প্রভুর প্রতি সালাত পড়ো, আর বড় কুরবানি করো —আল-কাউছার

আমি তোমাকে আল-কাউছার উপহার দিয়ে দিয়েছি, তাই তুমি তোমার প্রভুর প্রতি সালাত পড়ো, আর বড় কুরবানি করো। তোমার শত্রুরাই তো নির্বংশ। [আল-কাউছার]

একদিন আমাদের বাবা-মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসতে হবে, এই নিয়তি মেনে নেওয়াটা বড় কষ্টের। প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য সেদিন এক ভীষণ কষ্টের দিন। কিন্তু নিজের সন্তানকে কোনোদিন নিজের হাতে কাফনে জড়িয়ে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবো, এই চিন্তা কোনো বাবা-মা’র পক্ষে করা সম্ভব নয়। আদরের ছোট শিশু সন্তানকে কবর দেওয়ার মত কষ্টের অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। রাসুল عليه السلام এর সাতটি সন্তান ছিল। ছয়টি সন্তানই অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল, শুধুই ফাতিমা (রা) বেঁচে ছিলেন। রাসুল عليه السلام নিজের হাতে ছয়-ছয়টি সন্তানকে কবর দিয়েছেন।

আমরা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবো না সেটা কত কষ্টের অভিজ্ঞতা হতে পারে। একজন বাবা-মার পক্ষে সারাজীবনেও কোনোদিন সেই অভিজ্ঞতা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। একটি সন্তানের মৃত্যু হয়ত সামলানো যায়। দুটো, তিনটে হলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়। আর ছয়-ছয়টা সন্তানের মৃত্যু কী ভয়ংকর কষ্টের ব্যাপার হতে পারে, আমরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবো না। বিশেষ করে তার শিশু সন্তান আব্দাল্লাহ এর মৃত্যুর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি কষ্টের।

তখন তিনি মক্কায় ছিলেন। ইসলামের প্রচারে বাঁধা দেওয়ার জন্য কাফিররা তার জীবন দুর্বিষহ করে ফেলেছিল। এমনকি তার নিজের প্রতিবেশী চাচা আবু লাহাব যখন জানলো শিশু সন্তানটি মারা গেছে, তখন সে রাস্তায় বের হয়ে রসূলকে عليه السلام শুনিয়ে আনন্দ করা শুরু করলো যে, রসূলের عليه السلام বংশ শেষ। নিজের আত্মীয়দের কাছ থেকে এত জঘন্য ব্যবহার পেয়ে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। এই ভয়ংকর কষ্ট থেকে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ تعالى তাকে সূরাহ আল-কাউছার পাঠালেন।

এত বড় একটি কষ্টে কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই অনেক সময় নিয়ে, অনেক কথা বলা দরকার? আল্লাহ تعالى যদি একটি বড় সূরাহ নাজিল করে তাকে অনেক সান্ত্বনা দিতেন তাহলে কী ভালো হতো না? কিন্তু আল্লাহ تعالى কুর‘আনের সবচেয়ে ছোট সূরাহ, মাত্র তিনটি আয়াতে তাকে এমন কী সান্ত্বনা দিলেন যে, শিশু সন্তানকে হারানোর কষ্ট রসূল عليه السلام সামলে উঠলেন?

এখান থেকে আমরা একটা শিক্ষা পাই যে, কাউকে কষ্টের সময় বেশি কথা বলার দরকার নেই। অল্প কথায় যথাযথ উপদেশ দিয়ে তাকে তার মত থাকতে দিতে হবে। মানুষের কিছু সময় দরকার হয় নিজের মত একাকী থেকে কষ্ট সামলে নেওয়ার। বেশি কথা বললে বরং বেশি সমস্যা তৈরি হয়।

আমরা অনেকেই এই সূরাহ মুখস্ত করি কারণ এটা সবচেয়ে ছোট সূরাহ, তিলাওয়াত করাও অনেক সহজ। আমরা যদি এই সূরাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানি, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো এই ছোট সূরাহতেও কত গুরুত্বপূর্ণ বাণী আছে, যা একজন বাবাকে শিশু সন্তান হারানোর শোক সামাল দিতে পারে।

ধর্ম প্রচারকের জীবন এত কষ্টের হলে সেটা সত্য ধর্ম হয় কীভাবে?

অনেকে বলেন, কীভাবে একজন দয়াময় স্রস্টা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে এত কষ্ট দিতে পারেন? সাতটি সন্তান দিয়ে ছয়টিকেই নিয়ে যাওয়া? ইসলাম কীভাবে সত্য ধর্ম হতে পারে, যার প্রচারকের জীবনই ছিল এমন ভয়াবহ কষ্টের?

এটা একটা কুযুক্তি। অনেকটা ‘ডাক্তারের এত অসুখ হলে সে ভালো ডাক্তার হয় কীভাবে?’ —এধরনের কথা। এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, একজন ধর্ম প্রচারকের দুনিয়ার জীবন হবে আরাম, আয়েসের। কিন্তু এই ধরে নেওয়ার পেছনে কোনো ভিত্তি নেই।

নবী-রসূলরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মান না। তারা নিজেরা আরাম আয়েসে জীবন পার করে ধর্ম প্রচার করে যান না। বরং আমরা দেখতে পাই, সবচেয়ে ভয়ংকর সব পরীক্ষা, চরম কষ্টের জীবন নবী-রসূলদেরই হয়ে থাকে। কেউ বলতে পারবে না যে, নবী-রসূলরা তো আরামের জীবন পার করে গেছেন। তারা কীভাবে বুঝবেন সাধারণ মানুষের জীবন কত কষ্টের? গরিব মানুষের কষ্ট, সন্তান হারা বাবার কষ্ট, স্ত্রী হারা স্বামীর কষ্ট, শত্রুর শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, যুদ্ধ করার কষ্ট, কারাবন্দী থাকার কষ্ট —এই সব কি আর নবী, রসূলরা বোঝেন নাকি? আরামে থাকলে অনেক নীতি কথা বলা যায়। —কারও সুযোগ নেই এধরনের কথা বলার, কারণ এই মহান মানুষেরা জীবনের কঠিনতম সব কষ্ট এবং ত্যাগ পার করে গেছেন। জীবন যুদ্ধে তাদের মত অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা মানুষের অভাবের কষ্ট বোঝেন, না খেয়ে থাকার জ্বালা জানেন, যুদ্ধের ভয়ংকর মানসিক এবং শারীরিক চাপ বোঝেন, প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করেন।

একইসাথে কেউ আল্লাহর تعالى বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আল্লাহ تعالى পৃথিবীতে কিছু মানুষ পাঠান যারা দুনিয়াতেও আরামের জীবন পার করে যায়, আবার আখিরাতে গিয়েও আরাম করে। কেউ বলতে পারবে না যে, স্রস্টা আমজনতার প্রতি অবিচার করেন: একদিকে তাদের এই জীবনে অনেক কষ্ট দেন, আবার আখিরাতেও কষ্ট দেন। নবী, রসূলরা এই জীবনে কত কষ্ট করেছেন, সেগুলো দেখলে তাদের জান্নাতে যাওয়া নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকবে না। তাদের মত ভয়ংকর কষ্টের জীবন যদি কাউকে সাধা হয় নেওয়ার জন্য, কেউ রাজি হবে না।

হতে পারে নবী, রসূলদের ভীষণ কষ্টের জীবন তাদের প্রস্তুতির অংশ। তারা যেন মানুষের কষ্ট বোঝেন, কষ্টের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন, সঠিক উপদেশ দিতে পারেন, সেই জন্যই হয়ত আল্লাহ تعالى নবী, রসূলদের কঠিন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। তাদের কষ্টের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিঃসন্দেহে তাদের অনুসারীদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে।

আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তাহলে দেখবো যে, ফাতিমা (রা) নিয়ে অনেক দলাদলি, অনেক সমস্যা হয়েছে। শিয়া সম্প্রদায় গত হাজার বছরে বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। রসূলের عليه السلام নাতি হাসান এবং হুসাইনকে নিয়ে গত হাজার বছরে যা হয়েছে তা বড়ই দুঃখজনক। যদি আরও বেশি সন্তান থাকতো, তাহলে কী ভয়াবহ ব্যাপার হতো আমরা চিন্তাও করতে পারি না। রসূল عليه السلام এর মত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং তার পরিবারকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি থেকে দলাদলি, মতবিরোধ, বড় ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা হবেই। সেদিক থেকে চিন্তা করলে একজন সন্তান থাকাটাই আল্লাহ تعالى অসীম প্রজ্ঞা থেকে যথার্থ সিদ্ধান্ত। বরং একজন সন্তানও যদি না থাকত,তাহলে হয়ত আজকে শিয়া সম্প্রদায় সৃষ্টিই হতো না। কিন্তু তাহলে আমরা রসূলের عليه السلام জীবনের অনেক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারতাম না। যা হোক, আল্লাহ تعالى তার অসীম প্রজ্ঞায় যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মুসলিমরা সেটাই মেনে নেবে। যারা মুসলিম না, তারা নানা ধরনের সমস্যা খুঁজবে।

তাহলে তাকে এতগুলো সন্তান দেওয়ারই বা কী দরকার ছিল? একজন সন্তান দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখলেই হতো না? —আমরা মৃত্যু ব্যাপারটাকে বিধর্মীদের প্রভাবে পড়ে বেশি কঠিন করে ফেলেছি। মৃত্যু মানে আল্লাহর تعالى সম্পত্তি আল্লাহর تعالى কাছে ফিরে যাওয়া —এর বেশি কিছু নয়। এর থেকে বেশি কিছু বানালেই অশান্তি, হতাশা, বেদনা, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি নানা জটিলতা হয়। বিধর্মীদের মৃত্যু নিয়ে বিকৃত সব ধারণা, নাস্তিকদের জীবনকে আঁকড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা এবং জীবনটাকে খুব বেশি বড় করে দেখা — এগুলোর প্রভাব মুসলিমদের উপর পড়ে আজকে এই সব জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ইসলামের সহজ শিক্ষা, বাস্তবতাকে ভুলে গেছি। নিজেরাই নিজেদের উপরে প্রিয়জনদের মৃত্যু নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সমস্যা তৈরি করেছি।

একজন মুসলিম বিশ্বাস করেন, যদি আল্লাহ تعالى তার শিশু সন্তানকে নিয়ে যান, এবং সে এই পরিস্থিতিতে কদরকে মেনে নিয়ে, সবর করে —এই অবর্ণনীয় শোককে অতিক্রম করে বলে, “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি র-জি’উন”— আল্লাহ تعالى তখন তাঁর সেই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ী তৈরি করার নির্দেশ দেন। তাছাড়া মৃত শিশু সন্তানটি জান্নাতে গিয়ে বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষা করে। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা আল্লাহর تعالى কাছ থেকে এসেছি এবং আল্লাহর تعالى কাছেই আমরা ফিরে যাবো। তিনি تعالى তাঁর কিছু বান্দাকে সন্তান হারানোর শোক দিয়ে পরীক্ষা করবেন। কেন করবেন, সেটা শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু যার পরীক্ষা যত কঠিন তার উপহারও তত বড় হবে। এবং তিনি কাউকে তাঁর বহনের অতিরিক্ত বোঝা দেন না —এটা তার ওয়াদা।

আমি তোমাকে আল-কাউছার উপহার দিয়ে দিয়েছি

আরবিতে কিছু দেওয়ার জন্য দুটো শব্দ আছে – آتَى আ-তা এবং أعطى আ’ত্বা। প্রথমটা হচ্ছে কাউকে কিছু দেওয়া। যেমন, আমি তোমাকে কলম দিয়েছি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কাউকে সম্মান করে কোনো বিরাট কিছু উপহার হিসেবে দেওয়া। আল্লাহ تعالى দ্বিতীয় শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কারণ রসূলকে عليه السلام শুধুই তার কাজের প্রাপ্য দেওয়া হচ্ছে না, বরং আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে এটা বিরাট একটা উপহার, অকল্পনীয় সম্মান।

আমরা কেউ নিজেদের যোগ্যতায় জান্নাত অর্জন করি না, বরং আল্লাহ تعالى অনুগ্রহ করে আমাদেরকে দেন। যদি আমাদের সব কাজের হিসেব নিয়ে ন্যায্য বিচার করা হতো, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আমরা কেউ জান্নাতে যেতাম না। আমাদের নামাজগুলো বেশিরভাগই বাতিল হয়ে যেত, কারণ নামাজে এমন কিছু নেই যা আমরা ভাবি না। আমাদের রোজা বাতিল হয়ে যেত, কারণ রোজা রেখে আমরা মিথ্যা বলি, গীবত করি, আজেবাজে জিনিস দেখি। আমাদের ইবাদতগুলো এত ত্রুটিপূর্ণ যে, আল্লাহ تعالى যদি দয়া করে আমাদের ভুলগুলো  উপেক্ষা না করেন, তাহলে খুব কম ইবাদতই কবুল হতো। আমরা কেউ আর জান্নাত পেতাম না। একারণে জাহান্নাম হচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি, কিন্তু জান্নাত হচ্ছে আল্লার تعالى পক্ষ থেকে উপহার।

কাউছার শব্দ এসেছে কাছুরা থেকে। আরবিতে ‘বেশি’ বোঝানোর জন্য কয়েকটি শব্দ আছে। কাছরহ كَثْرَة অর্থ প্রচুর। কাছি-র كَثِير অর্থ অনেক বেশি। কাছুর كَثُر অর্থ অনেক-অনেক বেশি। আর আল-কাউছার الكوثر হচ্ছে এগুলোর চরম পর্যায়। এর অর্থ অকল্পনীয় বেশি, যার সাথে কিছুর তুলনাই হয় না।[১] রসূলকে عليه السلام আল্লাহ تعالى  বলছেন যে, তিনি তাকে ইতিমধ্যেই অকল্পনীয় বেশি কিছু উপহার হিসেবে দিয়েছেন। তার কোনো চিন্তাই করতে হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে অনেক বেশি কী দেওয়া হয়েছে তাকে?

সব কিছু। যা কিছু ভালো পাওয়া সম্ভব, তার সব কিছুই তাকে অকল্পনীয় পরিমাণে দেওয়া হয়েছে।[১৪] এই আয়াতের মধ্যে তাকে জান্নাতের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে।

এখন, এত বড় একটা সুখবর পাওয়ার পর তিনি কী করবেন? আনন্দ উৎসব করবেন? দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে পরিবার নিয়ে বিদেশ বেড়াতে চলে যাবেন? বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যাপক খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করবেন? না—

তাই তুমি তোমার প্রভুর প্রতি সালাত পড়ো, আর বড় কুরবানি করো

এত বড় একটা সুসংবাদ পাওয়ার পর নির্দেশ হচ্ছে সালাত পড়ো এবং বড় কুরবানি দাও। ছোটখাটো দান বা কুরবানি করলেও হবে না। আন্‌হার এসেছে নাহ্‌র থেকে, যা গরু, ভেড়ার মত সাধারণ কিছু কুরবানি দেওয়া নয়, বরং উটের মত মূল্যবান কিছু কুরবানি দেওয়া। আগেকার আমলে উট ছিল মূল্যবান সম্পত্তি, যা একাধারে তাদের বাহন, খাবার এবং পানীয় উৎস। উট কুরবানি দেওয়া মানে বহু বছর ধরে কাঠখড় পুড়িয়ে বড় করা একটি মূল্যবান উপকারী সম্পদকে কুরবানি করে দেওয়া।

আজকের যুগে আমরা যদি চিন্তা করি, তাহলে এর তুলনা হবে: আপনি বহু বছর ধরে কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটা দামি মডেলের গাড়ি কিনলেন। সেই গাড়ি আপনি অনেক যত্ন করে নিয়মিত মুছে রাখেন। গাড়ি চড়ে বেড়াতে যান, অনুষ্ঠানে গিয়ে মানুষকে দেখিয়ে গর্ব করেন। এখন আপনাকে সেই দামি গাড়ি বিক্রি করে গরিবদের সব টাকা দান করে দিতে হবে। এরকম বড় ধরনের কুরবানি বা ত্যাগ হচ্ছে আনহার। আল্লাহ تعالى রসূলকে শুধু কুরবানিই করতে বলেননি, বরং তিনি বড় ধরনের কুরবানি করতে বলেছেন।

কাউকে জান্নাত গ্যারান্টি দেওয়ার পর তাকে যদি এই নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা যারা জান্নাত পাওয়ার জন্য দিনরাত চেষ্টা করছি, আমাদের তাহলে কী পর্যায়ের ইবাদত এবং কুরবানি করতে হবে জান্নাত পাওয়ার আশা করার জন্য, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আল্লাহ تعالى যাদেরকে দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, তাদের কাউকেই তিনি এরপরে দুনিয়াতে যা ইচ্ছা করার লাইসেন্স দেননি। জান্নাতের নিশ্চয়তা উপহার হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলে বান্দাকে বাকি জীবন আল্লাহর تعالى প্রতি বড় ধরনের আনুগত্য দেখাতে হবে।

এখানে চিন্তার ব্যাপার হয়েছে, কেন আল্লাহ تعالى শুধুই নামাজ আর কুরবানি করতে বললেন? তাহলে রোজা, হাজ্জ, যাকাত সহ অন্যান্য ইবাদতের কী হবে?

নামাজ হচ্ছে শারীরিক এবং আত্মিক ইবাদত যার মধ্যে কুর‘আন তিলাওয়াত এবং যিকর অন্তর্ভুক্ত। আর আনহার অর্থাৎ বড় কুরবানি হচ্ছে সম্পদের ইবাদত যার মধ্যে যাকাত এবং সাদাকা অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ تعالى রসূলকে এই দুটি ইবাদত করতে বলে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সার্বিক ইবাদত করতে বলেছেন। কারণ আমরা দেখতে পাই যে, কিছু মানুষ আছে যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, কিন্তু তাদের ঈমানের আসল পরিচয় বের হয়ে যায় যখন তাদেরকে কিছু দান করতে বলা হয়। নিজের পকেট থেকে কিছু বের করে দান করতে তাদের বুক ছিঁড়ে যায়। আবার অনেক দানবীর আছেন যারা নিয়মিত দান করেন। তাদের অঢেল সম্পদ মানুষকে দিতে তাদের খুব একটা কষ্ট হয় না, বরং সেটা করে তারা একধরনের আত্মতৃপ্তি পান। কিন্তু তাদেরকে দিয়ে নামাজ পড়ানো যায় না। হয়ত জুমুআহ’র নামাজ তারা পড়েন। অনেকটা লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। কিন্তু দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়ার চিন্তাই তারা করতে পারেন না। নামাজ এবং কুরবানি এই দুই ইবাদত যিনি করতে পারেন, তিনি অন্তরে এবং বাইরে দুই দিকেই গভীর বিশ্বাস আনতে পেরেছেন। এই দুই ইবাদত প্রমাণ করে দেয় আল্লাহর تعالى অস্তিত্বে, তাঁর বাণীতে, কুর‘আনের সত্যতায়, দুনিয়ার পরীক্ষায় এবং আখিরাতের প্রতিদানে তার বিশ্বাস দৃঢ়। যাদের ভেতরে এই জিনিসগুলো দৃঢ় ভাবে আছে, তাদেরকে আর বাকি ইবাদতগুলো করার জন্য বলতে হয় না, তারা নিজে থেকেই করেন।

তোমার শত্রুরাই তো নির্বংশ

আজকে আমরা কেউ জানি না আবু লাহাবের বংশের কী হয়েছে, আবু জাহল এর নাতি-নাতনিরা কোথায় গেছে। যেই মানুষগুলো একসময় দুর্দান্ত প্রতাপশালী ছিল, তারা সবাই হারিয়ে গেছে। রসূলের عليه السلام শত্রুরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কারও কোনো খবর নেই। আল্লাহ تعالى তাদের নির্বংশ করে দেবেন ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, তা-ই সত্যি হয়েছে। আর অন্য দিকে রসূল عليه السلام এর মেয়ে ফাতিমা (রা) এর মাধ্যমে রসূলের বংশ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। রসূল عليه السلام ইতিহাসের পাতায় অন্যতম প্রভাবশালী এবং সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অমর হয়ে রয়েছেন।

 


[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্‌শাফ।

মন্তব্য করুন

Back to top button