কুরআনের কথা

আপনার কাছেই যে আমরা ফিরে যাব —আল-বাক্বারাহ ২৮৫

রাসূল বিশ্বাস করেন যা তার প্রভু তাকে পাঠিয়েছেন। পরিপূর্ণ বিশ্বাসীরাও তা-ই করে। তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদের, তাঁর ধর্মগ্রন্থগুলো, তাঁর বার্তাবাহকদের বিশ্বাস করে। তারা বলে, “আমরা তাঁর রাসুলদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আমরা শুনলাম। মানলাম। আমাদের ক্ষমা করুন প্রভু। আপনার কাছেই যে আমরা ফিরে যাব।” [আল-বাক্বারাহ ২৮৫]

মুসলিমদের জন্য একটি খুব সুন্দর একটা দু’আ রয়েছে এই আয়াতে, “আমরা তাঁর রাসূলদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করি না। আমরা শুনলাম। মানলাম। আমাদের ক্ষমা করুন প্রভু। আপনার কাছেই যে আমরা ফিরে যাব।”

মুসলিমদের মধ্যে সমস্যা নেই “আমরা শুনলাম”-এই অংশটাতে, কিন্তু যাবতীয় সমস্যা হচ্ছে “মানলাম”-এ। যেমন কেউ বলেন, “কুর‘আন পড়তে ভালোই। অনেক নীতি কথা আছে। সুন্দর সুন্দর কাহিনী আছে। জাহান্নামের কীসব বাজে কথা লেখা আছে। কিন্তু তাই বলে এগুলো সব মানতে হবে নাকি? কুর‘আনের সব কথা আজকাল চলে না। হাজার বছর আগের আরবদের জন্য এটা ঠিক ছিল। আজকাল যুগ পাল্টেছে। আমাদেরকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।” — এই হচ্ছে আমাদের আসল সমস্যা।

এই আয়াতে দেখতে পাই যে, আমরা যদি নিজেদেরকে বিশ্বাসী বলে দাবি করি, তাহলে আমাদের অবস্থা হতে হবে, “আমরা শুনলাম। মানলাম।” —কোনো ধরনের ভণিতা, অজুহাত দেখানো যাবে না। দাবি করা যাবে না যে, “এই আয়াতের কোনো যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখাও, তারপরে মানবো।” — বিশ্বাসীরা যখন মেনে নেয় কুর‘আন বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আসা বাণী, তখন তা মানতে কোনো ধরনের সন্দেহ দেখানো, অজুহাত দাঁড় করানোর প্রশ্নই আসে না। তবে এর মানে এই না যে, আমরা অন্ধভাবে ধর্মকে মেনে নেবো। যে যা বলবে তাই শুনব এবং মানবো। এর মানে হলো: যখন আমরা নিশ্চিত হয়ে যাবো যে, কুর‘আন সত্যিই আল্লাহর تعالى বাণী, তখন আর কোনো ধরনের টালবাহানা করা যাবে না। শুনবো, সাথে সাথে মানবো। এই শর্ত শুধু কুর‘আনের বেলায় প্রযোজ্য।

যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর تعالى নির্দেশ শুনবে এবং সাথে সাথে তা মানবে। মানার মধ্যে আমাদের অনেক ভুল হয়ে যায়। সবসময় আমরা আল্লাহর تعالى আদেশ-নিষেধ মানতে পারি না। আল্লাহর تعالى বাণীর যথাযথ মর্যাদা দিতে পারি না। একারণে আমরা আকুলভাবে বলি, غفرانك ربنا  -গুফরানাকা রাব্বানা অর্থাৎ “আমাদের ক্ষমা করুন প্রভু”। غفرانك গুফরানাকা হচ্ছে চরম পর্যায়ের ক্ষমা চাওয়া।[১৯] আমরা আল্লাহর تعالى কাছে শুধুই ক্ষমা চাচ্ছি না, তাঁর কাছে পাপগুলো একদম গোপন করে ফেলার জন্য আকুল অনুরোধ জানাচ্ছি। মাগফিরাহ এবং গুফরান এই শব্দগুলো শুধুই ক্ষমা চাওয়া নয়, একইসাথে পাপগুলোকে ঢেকে রাখা, গোপন রাখার আবেদন। আমরা যেসব অন্যায় করি, সেগুলো মাঝে মাঝে এত নোংরা হয় যে, আল্লাহ تعالى যদি সেগুলোকে দুনিয়াতে মানুষের কাছে গোপন করে না রাখেন, তাহলে আমাদের মানসম্মান শেষ হয়ে যাবে। অপমানিত হয়ে মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হবে। একইভাবে কিয়ামতের দিন এগুলো সব প্রকাশ করে দিলে আমরা লজ্জায়, অপমানে শেষ হয়ে যাবো। একারণে আমরা আল্লাহর تعالى কাছে আমাদের অন্যায়গুলোকে গোপন করে রাখার জন্য মিনতি করি। কিয়ামতের দিন তাঁর تعالى সামনে দাঁড়িয়ে বার বার লজ্জিত না হওয়ার জন্য আকুতি করি।

আয়াতের শেষ অংশটি আমাদেরকে চরম বাস্তবতা সম্পর্কে মনে করিয়ে দেবে —

“আপনার কাছেই যে আমরা ফিরে যাব।”

আজকে যদি আপনাকে ডাক্তার বলে, “আপনার রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং আপনি আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবেন, সিঙ্গাপুরে গিয়েও লাভ হবে না” —আপনি তখন কী করবেন? আপনি কি তখন কাঁথা জড়িয়ে টিভির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফালতু তারকা শো, টক শো, সিরিয়াল দেখবেন? আপনি কি পরদিন অফিসে গিয়ে কলিগদের সাথে শেষ বারের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবেন? আপনি কি আপনার ছেলেমেয়েকে শেষ বারের মতো একটু খুশি করার জন্য ভিডিও গেম কিনে দিবেন, যেখানে তারা রামদা-ছুরি নিয়ে একপাল অর্ধ মৃত, রক্তাক্ত জম্বিকে মেরে কোনো এক বিকৃত কারণে বড়ই আনন্দ পায়? আপনি কি এই অবস্থায় আপনার মেয়েকে নৃত্য শিল্পী বানাবেন, ছেলেকে ব্যান্ডের দলে যোগ দেওয়াবেন, যেন তারা সেগুলো করে আপনার মৃত্যুর পরে আপনার জন্য ‘অশেষ সওয়াব’ অর্জন করে?

না, আপনি তখন এগুলোর কিছুই করবেন না। অথচ আজকে আপনি ঠিকই সেগুলো করে যাচ্ছেন, এটা ভালো করে জেনে যে: আপনি আজকে হোক, কালকে হোক, একদিন না একদিন মারা যাবেনই। তারপর একসময় আপনাকে আবার জাগিয়ে তোলা হবে। তারপর আপনাকে ধরে নিয়ে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানের সামনে দাঁড় করানো হবে: আপনার জীবনের প্রতি মুহূর্তের হিসাব দেওয়ার জন্য। সেদিন তাঁর সামনে মাথা নিচু করে আপনি তাঁকে কী বলবেন—সেটা কি ঠিক করে রেখেছেন?

কোনো কারণে আমরা মৃত্যু নিয়ে বেশি চিন্তা করতে চাই না। এরকম চিন্তা মাথায় এলেই আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমরা দ্রুত চিন্তার বিষয় পাল্টে ফেলি। যদি আমাদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় আমাদেরকে এই ব্যাপারটি নিয়ে কিছু বলা শুরু করে, আমরা জলদি তাকে বলি, “কী বলছেন এইসব! এই সব মরা-টরার কথা শুনতে ভালো লাগছে না। বাদ দেন। আসেন অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”

আমরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদেরকে একধরনের সেলফ ডিলিউশনে (মতিবিভ্রমে) ডুবিয়ে রাখি যে, আগামি কয়েক সেকেন্ড পরে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাব না, বা কালকে আমি যে বাসায় ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে মারা যাব না—এ ব্যাপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত। আল্লাহর تعالى সাথে আমার একধরনের চুক্তি আছে: তিনি আমাকে সত্তর-আশি বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেনই। তাই জীবনে অনেক সময় আছে ধর্ম-টর্ম করার। এখন আগে যত পারি চাকরি, ব্যবসা, পার্টি করে; মুভি, সিরিয়াল দেখে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কেটে ঘুরে, লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশে বেড়িয়ে এসে, যত পারি জীবনটা উপভোগ করে নেই। বলা তো যায় না, যদি মরে যাই? তাহলে তো এসব আর করা হবে না।

মৃত্যু নিয়ে কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায় বসে গভীরভাবে চিন্তা করে: মৃত্যুর পরে তার কী হবে? সে কোথায় যাবে? সে কি সত্যিই আল্লাহকে বোঝাতে পারবে কেন সে জীবনটা এভাবে পার করেছে? —এগুলো নিয়ে কেউ যদি একটু মনোযোগ দিয়ে, ধিরস্থিরভাবে বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করে, তাহলে তার জীবন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা বদলে যেতে বাধ্য। আজকাল আমরা জীবন শৃঙ্খলায় এত বেশি জড়িয়ে পড়েছি যে, সেগুলো থেকে নিজেকে বের করে এনে, চুপচাপ কিছুক্ষণ একাকী বসে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। যদিও বা মাঝে মধ্যে চিন্তা করতে বসি, তখন চিন্তা হয়: আমার স্বামী/স্ত্রীকে কে দেখবে? আমার সন্তানদের কী হবে? আমার বাড়ি, গাড়ি, জমি, ব্যাংকের টাকার ভাগবাটোয়ারা কীভাবে হবে? আমার ব্যবসা কে চালাবে? — নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। মৃত্যুর পরে আখিরাতে আমার নিজের কী অবস্থা হবে, সেটা নিয়ে চিন্তা না করে,  বরং চিন্তা করি মৃত্যুর পরে দুনিয়াতে বাকি সবার কী অবস্থা হবে।

কুর‘আনে আমাদেরকে শত বার মৃত্যু এবং আখিরাতে নিজের কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। কারণ কেউ যখন মনোযোগ দিয়ে তা ভেবে দেখবে, পরিকল্পনা করবে, তখন সে দেখবে যে, সে জীবনে বহু দায়িত্ব নিয়েছে, বহু কাজে জড়িয়ে পরেছে, বহু দুশ্চিন্তা ঘাড়ে নিয়েছে, যেগুলো আসলে তার আসল ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। সেগুলো তার কোনোই কাজে লাগবে না। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে ভুল লক্ষ্য থাকার কারণে আজকে সেগুলোই তাকে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত রেখেছে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় জর্জরিত করে ফেলেছে।

তারা বলে, “আমরা তাঁর রাসুলদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করি না।”

এই আয়াতের অর্থ কি এই যে, আমাদেরকে আগের সব রাসুলদের প্রচার করা ধর্ম মানতে হবে? ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্ম কি তাহলে সঠিক ধর্ম?

ইহুদি বা জুডাইজম ধর্মের নাম নবী ইয়াকুবের عليه السلام ১২ জন সন্তানের একজন ‘জুডা’-এর নামের অনুসরণ করে রাখা। আল্লাহ تعالى এই ইহুদি ধর্ম পাঠাননি।[২৪১] এই ধর্মে ইহুদি রাবাইদের (ধর্মীয় পুরোহিত) হালাল-হারাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে। তারা যা বলেন, সেটাই সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত। তাদের লেখা তালমুদ গ্রন্থ (আমাদের যেরকম হাদিস গ্রন্থ) হচ্ছে সর্বোচ্চ শারিয়াহ। তাদের মতের বিপরীতে তাওরাতে পরিষ্কার বাণী থাকলেও কিছু যায় আসে না।[৩] এই ধর্ম অনুসারে: আল্লাহ تعالى কী বলেছেন, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাবাইরা কী বলছেন। রাবাইদের নিজেদের মতো শারিয়াহ নির্ধারণ এবং পরিবর্তন করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে, যেখানে ইসলামে শারিয়াহ একমাত্র আল্লাহ تعالى এবং তাঁর রাসুলের عليه السلام বাণী থেকে নির্ধারিত, যা কোনো ইমাম, মাওলানা, মুফতির বাণী থেকে নেওয়া যায় না।

একইভাবে খ্রিস্টান ধর্ম এসেছে যীশুখ্রিস্টের নাম থেকে। আল্লাহ تعالى এই খ্রিস্টান ধর্ম পাঠাননি। এই দুটি ধর্মের নাম হয়েছে হয় কোনো মানুষের নামে, না হয় কোনো গোত্রের নামে। এগুলোর কোনোটাই আল্লাহর تعالى দেওয়া নাম নয়। খ্রিস্টান ধর্মেও নানা পর্যায়ের ধর্মীয় গুরু রয়েছে, যেমন পোপ, বিশপ, ফাদার। পোপ হচ্ছেন সর্বোচ্চ পদের। তিনি যদি বাইবেলে কিছু বাদ দিতে বলেন, সেটা বাদ হয়ে যাবে। তিনি যদি বাইবেলে কোনো সংশোধন করতে বলেন, তাহলে সেই সংশোধন করে, নতুন বাইবেল প্রকাশ করা হবে। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮৫ সালে বাইবেলে প্রায় ৩০,০০০ সংশোধন করা হয়েছে।[২৭০] স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে: বাইবেল যদি সত্যিই স্রষ্টার বাণী হয়ে থাকে, তাহলে তা এত বার সংশোধন করার দরকার কেন হয়? কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ যদি মানুষ সংশোধন করতেই পারে, তাহলে সেই ধর্মীয় গ্রন্থ তো গোঁড়াতেই ভুল। সেটা মানুষ মানতে যাবে কেন?

আল্লাহর تعالى দেওয়া একমাত্র ধর্মের নাম হচ্ছে ইসলাম, যার অর্থ: স্রস্টার প্রতি পূর্ণ সমর্পণ। নাম থেকেই বোঝা যায়: অন্য সব ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের মধ্যে মুল পার্থক্য কোথায়। একজন স্রস্টা এমন একটি ধর্ম পাঠাবেন, যেটি সারা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে, অথচ তার নাম তিনি দেবেন কোনো এক ব্যক্তির নাম অনুসারে, বা কোনো এক দলের নাম অনুসারে —এটা দাবি করাটা হাস্যকর।

আল্লাহ تعالى কখনই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পাঠাননি। তাওরাত, ইনজিল, যবুর, কু’রআন—সব ধর্মগ্রন্থ একটাই ধর্ম প্রচার করে গেছে: ইসলাম। মানুষই ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে ইহুদি, খ্রিস্টান নাম দিয়ে নিজেদের সুবিধামত ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। একারণে মুসলিম হিসেবে আমরা আগের সব রাসুলদের মেনে নেই, কারণ তারা এক ইসলাম ধর্ম প্রচার করে গেছেন। কিন্তু আমরা আজকের ইহুদি, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মগুলোকে মেনে নেই না, কারণ সেগুলো মানুষের বিকৃত করা ধর্ম।

একইসাথে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, কু’রআনই আল্লাহর تعالى পাঠানো একমাত্র ঐশীবাণী নয়। আল্লাহ تعالى মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য -এর আগেও বাণী পাঠিয়েছেন। নবী মুসা عليه السلام -এর কাছে তাওরাত এসেছিল, নবী ঈসা عليه السلام -এর কাছে ইনজিল এসেছিল। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ تعالى আমাদের আগেও মানুষকে পথ দেখিয়েছেন বিভিন্ন নবী এবং বাণীর মাধ্যমে। একদম প্রথম মানুষ আদম عليه السلام থেকে শুরু করে আজকে আমাদের সভ্যতা পর্যন্ত সব জাতি আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পথ নির্দেশ পেয়েছে।

এই বিশ্বাসের মধ্যে দুটো ব্যাপার রয়েছে—

১) প্রথমত, এটা মানা যে: আজকে যে তাওরাত এবং ইঞ্জিল বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও আল্লাহর تعالى বাণী রয়েছে এবং আমাদেরকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। আমেরিকার কোনো এক পাদ্রী তার দলবল নিয়ে প্রতি বছর কু’রআন পোড়ায় দেখে[১১৭], আমরাও তার মতো বাইবেল পুড়িয়ে দেখিয়ে দেব না যে, আমরাও সাচ্চা মুসলিম। আমরা সকল ধর্মের বইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি। খ্রিষ্টানরা কু’রআন পুড়িয়ে নিচে নামতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমরা বাইবেল পুড়িয়ে তাদের মতো নিচে নামব না।

২) আমাদেরকে এটা সবসময় মনে রাখতে হবে যে, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা যা-ই করছে সেটাই ভুল না। তাদের বিশ্বাস ভুল হতে পারে, তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস না করতে পারেন, বা মুহাম্মাদকে عليه السلام রাসূল হিসেবে বিশ্বাস না করতে পারেন। তবে তাদের পার্থিব সকল কাজই ভুল নয়। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ভাই বোনেরা কিছু প্রতারকের পাল্লায় পড়ে ভুল রাস্তায় চলে গেছে। আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে ডাক দিয়ে এনে, ভালো করে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসা। ভালো করে বোঝানোর পরেও তারা যদি না আসে, তাহলে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা কোনোভাবেই তাদের উপর জবরদস্তি করতে পারব না। আল্লাহই তাদের বিচার করবেন। তাছাড়া, তাদেরকে বোঝালে তারা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তখন তাদের মধ্যে যে আগ্রহ, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ত্যাগ দেখা যায়, সেটা অনেক সময় জন্মগত মুসলিমদের লজ্জায় ফেলে দেয়।

একই সাথে আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, রাসূল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর জন্মের অনেক আগে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে তাওরাত এবং ইঞ্জিল পাওয়া যায়, সেগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এবং বিকৃতি করা হয়েছে, যার কারণে সেগুলো আর মৌলিক, অবিকৃত অবস্থায় থাকেনি। সেগুলোর ব্যাপারে আমরা কেবল মৌলিকভাবে ঐশী গ্রন্থ হওয়ার বিশ্বাস করব, তবে সেগুলো পড়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছান যাবে না।

অধুনা কিছু মুসলিম আছেন, যারা শখের বসে তাওরাত বা ইঞ্জিল কিনে পড়েছেন। কিন্তু তারপরে তাদের মাথা গেছে একদম তালগোল পাকিয়ে। তারা কোনটা ইসলাম, কোনটা ইহুদি, কোনটা খ্রিষ্টান ধর্ম—সেসব নিয়ে গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। যেমন: কু’রআন, তাওরাত এবং ইঞ্জিলে আপনি নবী ইব্রাহিম عليه السلام -এর তিন ধরনের জীবনী পাবেন। আপনি যদি তিনটাই পড়েন, তাহলে তার সম্পর্কে আপনার ধারণা একেবারে গোলমাল পাকিয়ে যাবে। আপনি মনে করা শুরু করবেন যে, তিনি হয়তো ইহুদি ছিলেন। তিনি হয়তো একসময় মূর্তিপূজারি ছিলেন এবং পরে আল্লাহ তাকে পথ দেখিয়েছিলেন।[১] আজকাল অনেক আধুনিক মুসলিম তাওরাত, ইঞ্জিল পড়ে দাবি করা শুরু করেছে যে, আজকের মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা সবাই আসলে এক নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام উম্মত এবং আমরা তার ধর্মের উপরেই আছি। সুতরাং খ্রিষ্টান এবং ইহুদিরা কেউই ভুল পথে নেই, তারা সবাই জান্নাতে চলে যাবে। সুতরাং, তাদের কারো ধর্ম পরিবর্তন করার কোনোই দরকার নেই।

এ ধরনের মানুষরা কখনো কু’রআন ঠিকমতো বুঝে পড়েনি—

তোমরা (বিশ্বাসীরা) কি আশা করো যে ওরা তোমাদেরকে বিশ্বাস করবে যখন ওদের মধ্যে একদল আল্লাহর বাণী শুনত এবং তারপর তা বোঝার পর তারা তা জেনে বুঝেই বিকৃত করত, যখন ওরা তা ঠিকই জানত? [২:৭৫]

কুর‘আন স্পষ্টভাবে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আজকে যে তাওরাত, ইঞ্জিল পাওয়া যাচ্ছে, এগুলোর কোনটাই শুদ্ধ নেই। ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতারা জেনেশুনে এগুলোকে বিকৃত করে ফেলেছে। পুরুষদের মাথায় যত নোংরা ফ্যান্টাসি আছে, তার সব আপনি বাইবেলে পাবেন, কিছুই বাকি নেই। আপনি কখনই বাইবেলের বইগুলো আপনার ছোট বাচ্চাদের সাথে বা কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে একসাথে বসে পুরোটা পড়তে পারবেন না।

অথচ কু’রআন পড়ে দেখুন। পুরো কু’রআনে কোনো জায়গায়, কোনো ধরনের গোপন অঙ্গের কথা, নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গতার সরাসরি বর্ণনা খুঁজে পাবেন না। আল্লাহ تعالى অত্যন্ত মার্জিত শব্দ ব্যবহার করে, সর্বোচ্চ শালীনতা বজায় রেখে আমাদের যৌনতা সম্পর্কে ইসলামের বিধিনিষেধগুলো শিখিয়েছেন। একজন আরব কিশোর-কিশোরীর কখনোই কু’রআন পড়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একজন আরব বাবা-মা রমজানের তারাবীতে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সাথে নিয়ে গিয়ে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুরো কু’রআন খতম শুনে আসতে পারেন, কিন্তু কখনোই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন না।

তাই মুসলিমরা বিশ্বাস করে না যে, আজকের ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে যে বাণী পাওয়া যায়, তা অবিকৃতভাবে আল্লাহর تعالى বাণী। কু’রআনের ভাষা এবং আজকালকার তাওরাত, ইঞ্জিলের ভাষার মধ্যে এতই আকাশ পাতাল পার্থক্য যে, সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে, আজকে প্রচলিত এই তিন ধর্মগ্রন্থের উৎস একই সত্তা নন।

কেন আল্লাহ্‌ تعالى আদমকে عليه السلام একবারে কু’রআন দিয়ে পাঠালেন না?

প্রথমে কু’রআন দিয়ে পাঠালেই তো এত ধর্ম তৈরি হতো না? বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে এত মারামারি হতো না?

আল্লাহ تعالى মানুষকে পথ নির্দেশ তখনি দেন, যখন সেই পথ নির্দেশের প্রয়োজন মানুষের হয় এবং মানুষের তা বুঝে বাস্তবায়ন করার মতো অবস্থা থাকে। যেমন, আদমকে عليه السلام যে ধর্মীয় নিয়মকানুন দেওয়া হয়েছিল, সেই নিয়ম অনুসারে মাহরাম-অমাহরাম সংজ্ঞা আজকের মতো ছিল না। যদি তাকে আজকের কু’রআন দেয়া হতো, তাহলে আদম عليه السلام-এর ছেলেমেয়েদের পর আর কোনো বংশধর আসত না। মানব জাতি এক প্রজন্মের পরেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।[১০৫] একারণেই মানব সভ্যতার জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষকে নতুন আদেশ-নিষেধ দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। যার কারণে এক রাসূলের পর আরেক রাসূলে ইসলাম ধর্মের বিবর্তন হতে দেখা যায়। কিন্তু এর মানে এই না যে, ইসলাম ধর্মে আমূল পরিবর্তন এসেছে, বা আগে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিয়েছেন।

সূত্র:

[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্‌শাফ।

[১০৫] The reason for the differences between the rulings of the Torah and of the Qur’aan – islamqa.info. (2017). Islamqa.info. Retrieved 13 May 2017, from https:/islamqa.info/en/159831 [১১৭] খ্রিস্টান পাদ্রীর কু’রআন পোড়ানো — http:/www.christianpost.com/news/florida-residents-tell-quran-burning-pastor-terry-jones-not-in-our-town-102644/ [১১৯] বাইবেলে ইয়াকুব নবীর স্রষ্টার সাথে হাতাহাতির জঘন্য মিথ্যাচার — http:/biblehub.com/genesis/32-28.htm [১২০] বাইবেলে স্রষ্টার মানুষ সৃষ্টির পরে দুঃখ প্রকাশের মিথ্যাচার — http:/biblehub.com/genesis/6-6.htm [১২১] বাইবেলে লুত নবীর অন্যায় আচরণের মিথ্যা কাহিনী — http:/biblehub.com/genesis/19-35.htm
[২৪১] ইহুদি ধর্মের নামের উৎপত্তি — http:/www.jewfaq.org/whoisjew.htm

মন্তব্য করুন

Back to top button