আদব ও আমল

কুরআন তিলাওয়াত করার নিয়ত

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার জন্য কোনো নিয়তের প্রয়োজন হয় না, যেভাবে তিলাওয়াত করা হোক ইবাদাত হিসেবে সংগঠিত হয়; যদি তিলাওয়াতের পশ্চাতে রিয়া তথা প্রদর্শনেচ্ছা ও উজব বা অহংকার না থাকে। রিয়া কখনো আমলের সাওয়াব বিনষ্ট করে, কখনো সাওয়াবের পথে প্রতিবন্ধক হয়, ফলে আদতে কোনো সাওয়াব হয় না।

গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদাত আঞ্জাম দেওয়া, অথবা আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ উভয়ের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত সম্পাদন করাকে রিয়া বলা হয়। রিয়া যুক্ত আমলে কখনো শুধু গায়রুল্লাহ উদ্দেশ্য  হয়, কখনো আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ উভয় উদ্দেশ্য হয়। এ জন্য রিয়ার অপর নাম হচ্ছে ‘আশ-শির্কুল খাফি’ বা গোপন শির্ক। রিয়া কোনো ব্যক্তির আমল ও শ্রম উভয় বিনষ্ট করে এবং ব্যক্তিকে আল্লাহর গোস্বা ও শাস্তিতে নিক্ষেপ করে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَه »

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন, শরীকদের মাঝে আমি অংশীদারিত্ব থেকে সবচেয়ে বেশী অমুখাপেক্ষী, যে এমন আমল করল, যাতে আমার সাথে অপরকে শরীক করেছে, আমি তাকে ও তার শির্ককে ত্যাগ করি”।[1] রিয়াকারী ও তার আমল আল্লাহর নিকট পরিত্যক্ত ও প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ তা‘আলা শুধু তাই গ্রহণ করেন, যা একমাত্র তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা হয়। তিনি ইরশাদ করেন:

﴿قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ يُوحَىٰٓ إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠﴾ [الكهف:١١٠]

“বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে”।[2] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنَ الْمَسِيحِ الدّجّالِ؟» قَالوا: بَلَىَ. فَقَالَ: «الشّرْكُ الْخَفِيّ: يَقُومَ الرّجُلُ يُصَلّي فَيُزَيّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ إليه»

“আমি কি তোমাদেরকে সেটা সম্পর্কে সংবাদ দিব, যা আমার দৃষ্টিতে তোমাদের উপর মাসীহ-দাজ্জাল থেকেও বিপদজনক? তারা বলল: অবশ্যই, তিনি বললেন: ‘আশ-শির্কুল খাফি’, ব্যক্তি সালাত আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়, অতঃপর সে সালাতকে খুব সুন্দর করে আদায় করে, কারণ সে জানে মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে”।[3] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ سَمَّعَ، سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِي، يُرَائِي اللَّهُ بِهِ »

“যে শোনাতে চায়, আল্লাহ তা শুনিয়ে দেন এবং যে দেখাতে চায় আল্লাহ তা দেখিয়ে দেন”। খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “এ হাদিসের অর্থ হচ্ছে, যে ইখলাস বিহীন আমল করল, অর্থাৎ মানুষ দেখবে ও শুনবে এ উদ্দেশ্যে আমল করল, তাকে অনুরূপ প্রতিদান দেওয়া হয়। উদাহরণত আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন, তাকে লাঞ্ছিত করেন ও তার অন্তরের গোপন নিয়ত সবাইকে জানিয়ে দেন”।[4]

অপর সহি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ لِيُعَرِّفَهُ نِعَمَهُ، فَعَرَفَهَا، فَقَالَ: مَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَال: تَعَلَّمْتُ فِيكَ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ، وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، فَقَال: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ لِيُقَالَ: هُوَ عَالِمٌ، فَقَدْ قِيلَ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أَمَرَ بِهِ، فَيُسْحَبُ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ»

“… এবং ঐ ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, যে ইলম শিখেছে, অপরকে শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ স্পষ্ট করার জন্য তাকে উপস্থিত করা হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি বলবেন: তার (নিয়ামতের) বিনিময়ে তুমি কি করেছ? সে বলবে: আপনার জন্য ইলম শিখেছি, শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। তিনি বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ; তুমি ইলম শিখেছি যেন বলা হয় সে আলেম, আর তা বলা হয়েছে। তুমি কুরআন তিলাওয়াত করেছ, যেন বলা হয় সে কারি, আর তা বলা হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে নির্দেশ জারি করবেন, ফলে তাকে চেহারার উপর টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে”।[5]

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃত তিলাওয়াত ইবাদত, হোক সালাতের ভিতরে কিংবা বাইরে, তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়তের প্রয়োজন নেই। তবে কেউ যদি নির্দিষ্ট নিয়তে কুরআন তিলাওয়াত করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই, বরং ভালো। কারণ, নির্দিষ্ট নিয়ত কুরআনুল কারিমে চিন্তা করা, তার রঙে রঙিন হওয়া ও তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার শামিল, যার নির্দেশ শরীয়তে রয়েছে। এ জাতীয় নিয়ত প্রশংসনীয়। হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَافْتَتَحَ الْبَقَرَةَ، فَقُلْتُ يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَةِ، ثُمَّ مَضَى، فَقُلْتُ: يُصَلِّي بِهَا فِي رَكْعَةٍ، فَمَضَى، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ بِهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ النِّسَاءَ فَقَرَأَهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ فَقَرَأَهَا، يَقْرَأُ مُتَرَسِّلًا، إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيهَا، تَسْبِيحٌ سَبَّحَ، وَإِذَا مَرَّ بِسُؤَالٍ سَأَلَ، وَإِذَا مَرَّ بِتَعَوُّذٍ تَعَوَّذَ»

“আমি কোনো একরাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করি, তিনি সূরা বাকারা আরম্ভ করেন। আমি মনে করলাম একশত আয়াত শেষে রুকু করবেন, কিন্তু তিনি পড়তে থাকলেন; আমি মনে করলাম এক সালাতে তা পূর্ণ করবেন, কিন্তু তিনি পড়তে থাকলেন, আমি মনে করলাম তার দ্বারা এক রাকাত পূর্ণ করবেন; অতঃপর তিনি সূরা নিসা আরম্ভ করেন এবং তা শেষ করেন। অতঃপর আলে-ইমরান শুরু করেন এবং তা শেষ করেন। তিনি বিরতি দিয়ে-দিয়ে পড়ছিলেন, যখন তাসবীহ এর কোনো আয়াত পড়তেন তাসবীহ পাঠ করতেন; যখন প্রার্থনার কোনো আয়াত পড়তেন প্রার্থনা করতেন; যখন আশ্রয় চাওয়ার কোনো আয়াত পড়তেন আশ্রয় চাইতেন”।[6]

ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘আউফ ইবন মালিক আশজা‘য়ি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

«قُمْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً ” فَقَامَ فَقَرَأَ سُورَةَ الْبَقَرَةِ لَا يَمُرُّ بِآيَةِ رَحْمَةٍ إِلَّا وَقَفَ فَسَأَلَ، وَلَا يَمُرُّ بِآيَةِ عَذَابٍ إِلَّا وَقَفَ فَتَعَوَّذَ»

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একরাত কিয়াম করেছি, তিনি দাঁড়ালেন এবং সূরা বাকারা শেষ করলেন। তিনি রহমতের এমন কোনো আয়াত পড়েননি যেখানে বিরতি নেননি, আর আযাবের এমন কোনো আয়াত তেলাওয়াত করেন নি যেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করেননি”।[7]

এসব হাদিস প্রমাণ করে, তিলাওয়াতের সময় কুরআনুল কারিমের অর্থ ও বিষয়-বস্তুতে চিন্তা করা, তার রঙে রঙিন হওয়া, দোয়ার আয়াতে দোয়া করা ও শাস্তির আয়াতে প্রার্থনা করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। এ সুন্নতের উপর আমল করার জন্য নির্দিষ্ট নিয়তে তিলাওয়াত করা অধিকতর সাওয়াবের কাজ।

বর্তমান যুগে মুসলিমরা সাওয়াবের নিয়ত ব্যতীত কোনো উদ্দেশ্যে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করে না বললেই চলে, তাই তিলাওয়াতের সময় কুরআনুল কারিমের ইলম ও জ্ঞানের দিকে তাদের মন ধাবিত হয় না। অথচ ইলম, হিদায়াত ও রহমত লাভের নিয়তে তিলাওয়াত করে সাওয়াবসহ অনেক উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى»

“নিশ্চয় প্রত্যেক আমল নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত, আর প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে-যা সে নিয়ত করেছে”।[8]

কিয়ামতের দিন নিয়তের কারণে আমলের সাওয়াবে অনেক ব্যবধান হবে। এ জন্য নিয়তকে জ্ঞানীদের ব্যবসা বলা হয়। নিম্নে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার কয়েকটি নিয়ত উল্লেখ করছি:

১. কুরআনুল কারিম ইলমের ভাণ্ডার ও হিদায়াতের উৎস, তাই ইলম ও হিদায়াত লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء : ٨٢]

“তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত”।[9] অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীস্বরূপ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”।[10]

২. মানব জাতির জীবন বিধান স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারিম নাযিল করেছেন, তাই তিলাওয়াত করার সময় তার উপর আমল করার নিয়ত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ ٣ ﴾ [الاعراف: ٣]

“তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না”।[11] অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ يَهۡدِيهِمۡ رَبُّهُم بِإِيمَٰنِهِمۡۖ ٩﴾ [يونس: ٩]

“নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে, তাদের রব ঈমানের কারণে তাদেরকে পথ দেখাবেন”।[12]

৩. কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার ফলে ঈমান বৃদ্ধি হয়, তাই ঈমান বৃদ্ধির নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ فَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمۡ زَادَتۡهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنٗاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَزَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَهُمۡ يَسۡتَبۡشِرُونَ ١٢٤ التوبة:124].

“আর যখনই কোন সূরা নাযিল করা হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, ‘এটি তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অতএব যারা মুমিন, নিশ্চয় তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়”।[13]

৪. কুরআনুল কারিম আল্লাহর কালাম, যে কুরআন তিলাওয়াত করে সে আল্লাহর সাথে কথা বলে, আল্লাহ তার কথা খুব শ্রবণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَا أَذِنَ اللَّهُ لِشَيْءٍ، مَا أَذِنَ لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ »

“আল্লাহ কোনো বস্তু এভাবে শ্রবণ করেননি, যেভাবে কুরআনের ক্ষেত্রে সুন্দর আওয়াজ সম্পন্ন নবীর জন্য শ্রবণ করেছেন, যিনি উচ্চস্বরে কুরআন মাজিদ পড়েন।”[14]

৫. কুরআন শিফা ও রোগ থেকে মুক্তির উপায়। কুরআন তিলাওয়াতের ফলে শরীর ও আত্মার রোগ দূরীভূত হয়। অতএব রোগ থেকে মুক্তি ও ঝাড়-ফুকের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ ﴾ [يونس : ٥٧]

“হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত”।[15]

  1. কিয়ামতের দিন উঁচু মর্যাদা লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗاۖ وَكَانُواْ لَنَا خَٰشِعِينَ ٩٠ ﴾ [الانبياء: ٩٠]

“নিশ্চয় তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, আর আমাকে আশা ও ভীতিসহ ডাকত, আর তারা ছিল আমার নিকট বিনয়ী”।[16]

  1. সাওয়াব ও মহান প্রতিদান লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। উকবাহ ইবনে ‘আমের আল-জুহানি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ فِي الصُّفَّةِ، فَقَالَ: أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ، أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِيَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ، فِي غَيْرِ إِثْمٍ، وَلَا قَطْعِ رَحِمٍ؟ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، نُحِبُّ ذَلِكَ، قَالَ: ” أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ، أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ؟ »

“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে আসলেন, আমরা তখন সুফফায় ছিলাম, তিনি বললেন: তোমাদের থেকে কে পছন্দ করে প্রতিদিন বুতহান অথবা আকিক স্থানে যাবে, অতঃপর সেখান থেকে উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট দু’টি উট নিয়ে আসবে, অপরাধ সংগঠন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ব্যতীত? আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তা পছন্দ করি। তিনি বললেন: তাহলে কেন তোমাদের কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাব থেকে দু’টি আয়াত শিখে না, অথবা তিলাওয়াত করে না, যা তার জন্য দু’টি উট থেকে উত্তম, এবং তিনটি আয়াত তিনটি উট থেকে উত্তম, এবং চারটি আয়াত চারটি উট থেকে উত্তম, অনুরূপ আয়াতের সংখ্যা উটের সংখ্যা থেকে উত্তম”।[17]

  1. কিয়ামতের দিন কুরআনুল কারিম তার তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে, তাই সুপারিশ লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ، فَإِنَّهُ شَافِعٌ لِصَاحِبِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، تَعَلَّمُوا الزَّهْرَاوَيْنِ: سُورَةَ الْبَقَرَةِ، وَآلِ عِمْرَانَ، فَإِنَّهُمَا يَجِيئَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ غَيَايَتَانِ أَوْ كَفِرْقَيْنِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ، يَشْفَعَانِ لِصَاحِبِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، تَعَلَّمُوا الْبَقَرَةَ، فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ، وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ، وَلا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ »

“তোমরা কুরআন শিখ, কারণ কিয়ামতের দিন কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হবে। তোমরা দু’টি উজ্জ্বল বস্তু শিখ: সূরা বাকারা ও সূরা আলে-ইমরান, কারণ কিয়ামতের দিন এ দু’টি সূরা দু’টি মেঘের মত, অথবা দু’টি ছায়ার মত, অথবা সারিবদ্ধ উড়ন্ত পাখির দু’টি ডানার মত, কিয়ামতের দিন তারা উভয়ে তাদের পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে, তোমরা সূরা বাকারা শিক্ষা কর, কারণ তা শিক্ষা করা বরকত ও ত্যাগ করা অনুশোচনা, কোনো জাদুকর তা শিখতে সক্ষম নয়”।[18]

  1. আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَقُصُّ عَلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ أَكۡثَرَ ٱلَّذِي هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَ ٧٦ وَإِنَّهُۥ لَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٧٧ [النمل:76-77]

“নিশ্চয় এ কুরআন তাদের কাছে বর্ণনা করছে, বনী ইসরাইল যেসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছে তার অধিকাংশই; আর নিশ্চয় এটি মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত”।[19]

প্রিয়পাঠক, আল্লাহর রহমত লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন। কখনো চিন্তা করেছি, কি পরিমাণ রহমতের মুখাপেক্ষী আমরা, আমরা কত পাপ করেছি, কত অপরাধ ও অন্যায়ে জড়িত হয়েছি; সমাজে আমরা দুর্বল, দেশে আমরা নিগৃহীত, বিশ্বে আমরা কর্তৃত্বশূন্য, আল্লাহর রহমত ব্যতীত যার থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। সে রহমত আমাদের সামনেই রয়েছে, অথচ তার থেকে আমরা গাফিল। কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা রহমত, তার তিলাওয়াত অপর থেকে শ্রবণ করা রহমত এবং তার উপর আমল করা রহমত। আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَقَدۡ جِئۡنَٰهُم بِكِتَٰبٖ فَصَّلۡنَٰهُ عَلَىٰ عِلۡمٍ هُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٥٢﴾ [الاعراف: ٥١]

“আর আমি তো তাদের নিকট এমন কিতাব নিয়ে এসেছি, যা আমি জ্ঞানের ভিত্তিতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। তা হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ এমন জাতির জন্য, যারা ঈমান রাখে”।[20] অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿هَٰذَا بَصَآئِرُ مِن رَّبِّكُمۡ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٢٠٣ ﴾ [الاعراف: ٢٠٢]

“এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ। আর তা হিদায়াত ও রহমত সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে”।[21] অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন:

﴿ وَهَٰذَا كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ مُبَارَكٞ فَٱتَّبِعُوهُ وَٱتَّقُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ١٥٥ ﴾ [الانعام: ١٥٥]

“আর এটি কিতাব- যা আমি নাযিল করছি- বরকতময়। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও”।[22] অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন:

﴿ وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤ ﴾ [الاعراف: ٢٠٣]

“আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর”।[23]

লক্ষ্য করুন কুরআনুল কারিম তিলাওয়াতের সময় চুপ করে থাকাও রহমত লাভ করার উপায়। তিলাওয়াতকারীকে আল্লাহর রহমত বেষ্টন করে নেয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু  থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ »

“আর আল্লাহর ঘরসমূহ থেকে কোনো ঘরে যখনই কোনো কওম একত্র হয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে ও নিজেদের মাঝে তার পঠন-পাঠন করে, তবে অবশ্যই তাদের উপর সাকিনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, মালায়েকাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেয় এবং আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করেন, যারা তার নিকটে আছে তাদের মাঝে”।[24]

হে আল্লাহ, কুরআন দ্বারা আমাদের উপর রহম করুন, যেন অন্য কারো রহমতের প্রয়োজন না হয়। নিশ্চয় আপনার রহমত সর্বোত্তম।

﴿ لَمَغۡفِرَةٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَحۡمَةٌ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ١٥٧ ﴾ [ال عمران: ١٥٧]

“নিশ্চয় আল্লাহর মাগফেরাত ও রহমত অধিকতর উত্তম, তোমরা যা জমা কর তার চেয়ে”।[25]

– সানাউল্লাহ নজির আহমদ


[1] মুসলিম: (২৯৮৮)

[2] সূরা কাহাফ: (১১০)

[3] আহমদ: (১০৮৫৯), ইবনে মাজাহ: (৪২০৪)

[4] ফাতহুল বারিসহ সহি বুখারি, হাদিস নং: (৯৪৭৪)

[5] আহমাদ: (৮২৭৮)

[6]  মুসলিম: (৭৭৫)।

[7] আবু দাউদ: (৮৭৩)।

[8] বুখারি: (১)

[9] সূরা নিসা: (৮২)

[10] সূরা বাকারা: (১৮৫)

[11] সূরা আ‘রাফ: (৩)

[12] সূরা ইউনুস: (৯)

[13] সূরা তাওবা: (১২৪)

[14] সহি বুখারি ৭৫৪৪, ৫০২৩, ৫০২৪, ৭৪৮২, ৭৫২৭, মুসলিম ৭৯৪,

[15] সূরা ইউনুস: (৫৭)

[16] সূরা আম্বিয়া: (৯০)

[17] মুসলিম: (৮০৬), আবু দাউদ: (১৪৫৬)

[18] আহমদ: (৮৮২৩)

[19] সূরা নামল: (৭৬-৭৭)

[20] সূরা আ‘রাফ: (৫২)

[21] সূরা আ‘রাফ: (২০৩)

[22] সূরা আন‘আম: (১৫৫)

[23] সূরা আ‘রাফ: (২০৪)

[24] মুসলিম: (২৭০২),

[25] সূরা আলে-ইমরান: (১৫৭)

মন্তব্য করুন

Back to top button