স্রষ্টা ও সৃষ্টি

সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন?

পূর্বের অংশ পড়ুন: আল্লাহ কেন এরকম করলো? আল্লাহ থাকতে এসব হয় কিভাবে?

“আল্লাহ আমাকে কেন বানিয়েছে? আমি কি আল্লাহকে বলেছিলাম আমাকে বানাতে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠাবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করল না কেন আমি এরকম জীবন চাই কিনা?“

“আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্টের জীবন দিল, যেখানে অন্যরা কত শান্তিতে আছে? আমি কি বলেছিলাম আমাকে এতো কষ্ট দিতে?”

“আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানালো কেন, আমিতো মেয়ে হতে চাইনি? আল্লাহ আমাকে কালো কিন্তু অন্যদেরকে ফর্সা বানাল কেন, এটা তো ঠিক হল না? আমি খাট কেন, লম্বা না কেন? আমার কপালে এরকম শয়তান স্বামী পড়ল কেন? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি, রোযা রাখি, কোনদিন ঘুষ খাইনি, কিন্তু তারপরেও আমার ক্যান্সার হল কেন?”

আপনি যদি প্রথম পর্বটি পড়ে না থাকেন তবে অনুরোধ করবো সেটা আগে পড়ার, কারণ এই পর্বটি ধরে নেয় আপনি প্রথম পর্বের উত্তরগুলো বুঝেছেন এবং প্রভু-দাস ব্যপারটি ঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন।

আমি এবার ‘দার্শনিক ক্যাটাগরির’ জটিল প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করি।

“সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন?”

আপনার যদি এই ধারণা থাকে যে – সত্যিই যদি কোন ‘পরম করুণাময়’ সৃষ্টিকর্তা থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, কষ্ট, যুদ্ধ, অভাব, অসুখ থাকতো না – তার মানে এই না যে কোন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা নেই। এর মানে এটাই যে আল্লাহ কি উদ্দেশে পৃথিবী তৈরি করেছেন, তা আপনি বুঝতে পারেন নি। পৃথিবীতে কোন সমস্যা থাকার মানে এই না যে কোন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা নেই বরং এটাই প্রমাণ হয় যে আপনি সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা সম্পর্কে নিজে নিজেই কিছু একটা ধারণা করে নিয়েছেন, যা সঠিক না। একটা পিঁপড়া যদি মানুষকে চ্যালেঞ্জ করে – “তোমাদের না এত বুদ্ধি? তাহলে তোমরা মাটির উপরে বাড়ি বানাও কেন? আমাদের মত মাটির নিচে থাকলেই তো পারো?” এখানে পিঁপড়া ধরে নিচ্ছে বুদ্ধিমান হলেই মাটির নিচে থাকতে হবে, যা হাস্যকর। ঠিক একই ভাবে এটা হাস্যকর যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার এক সংজ্ঞা নিজে নিজে বানিয়ে, সেই সংজ্ঞা ব্যবহার করে নিজেরাই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।

দ্বিতীয়ত, আপনাকে কে শেখাল করুণা কি? পৃথিবীতে যদি কোন সমস্যা না থাকতো, কোন অন্যায় না হত, কোন খারাপ কিছু না থাকতো, তাহলে আপনি বুঝতেন কি করে ‘খারাপ’ কি এবং তখন ‘ভালো’ বলতেই বা কি বোঝাতো? করুণা করার প্রশ্ন তখনই আসে যখন কোন মন্দ ঘটনা ঘটে। কোন মন্দ না থাকলে তো করুণার অস্তিত্ব থাকতো না। বরং আপনার মনে করুণার ধারনাটি যে আছে সেটাই তো প্রমাণ করে যে কেউ একজন আছে যে আপনাকে করুণার ধারনাটি দিয়েছে! না হলে এই ধারণাটি আপনার মনে আসলো কিভাবে? এটা তো ক্ষুধার মত কোন শারীরবৃত্তীয় ধারণা না যে আপনি বিবর্তনের মাধ্যমে বানর থেকে মানুষ হবার সময় এই ধারণাটি পেয়েছেন!

তৃতীয়ত, আল্লাহ পরম করুণাময় হলেই যে তিনি কাউকে কোন অন্যায় করতে দিবেন না, তা আপনাকে কে বলেছে? বাবা-মা তাদের বাচ্চাদেরকে অত্যন্ত ভালবাসে, কিন্তু তাই বলে তারা নিশ্চয়ই তাদের বাচ্চাদের চিন্তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না এবং প্রত্যেকটা কাজে বাধা দেয় না। বাচ্চারা অন্যায় করে, তারপর তার জন্য শাস্তি পায়। বাবা-মা সবসময় চেষ্টা করে বাচ্চাদেরকে যতটুকু সম্ভব ভুল না করতে দেওয়ার, অন্যায় থেকে দূরে থাকার জন্য উপদেশ দেবার। আল্লাহও সেটাই করেন আমাদের সাথে।

চতুর্থত, আপনি ধরে নিচ্ছেন, পৃথিবীতে যাবতীয় দুঃখ কষ্টের জন্য শুধু আল্লাহ দায়ী। এখানে মানুষের কোন হাত নেই। মানুষের হাত থাকলেও কেন আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করলো না যার জন্য মানুষ যেন কখনও অন্য মানুষকে কষ্ট দিতে না পারে। আমরা অনেক সময় ঠিকভাবে সময় নিয়ে চিন্তা করে দেখিনা আমরা আল্লাহকে কি নিয়ে দোষ দেই। যেমন আপনি হয়তো আফ্রিকার গরিব মানুষদের কষ্ট দেখে ভাবছেন কেন আল্লাহ তাদেরকে এত কষ্ট দেয়? আল্লাহ আফ্রিকার দেশগুলোকে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাদের তেল ছিল, হীরা ছিল, সোনা ছিল। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তাদের ব্যবসায়ী সরকার নিজেদের পকেটে টাকা ঢোকাবার জন্য পশ্চিমা দেশের কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করে সব তেল, গ্যাস, হীরা, সোনা পশ্চিমা দেশে পাচার করে দিয়েছে। যার ফলে নিজের দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে দেশের মানুষগুলো চরম গরিব হয়ে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আফ্রিকার গরিব দেশগুলোর সরকারগুলো যদি পররাষ্ট্র নীতিতে স্বচ্ছ এবং দক্ষ হত, তারা নিজেদের কমিশনের কথা চিন্তা না করে দেশের মানুষের জন্য ভাবতো, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে গোপন রাখত, যতক্ষণ না তারা নিজেদের দেশে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে সেই প্রাকৃতিক সম্পদগুলো নিজেরাই ভোগ করতে না পারছে, তাহলে আজকে তাদের এই অবস্থা হত না। আল্লাহ সেই দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়েছিলেন, যেরকম কিনা তিনি মালয়েশিয়াকে দিয়েছেন। কিন্তু মালয়েশিয়া তাদের সম্পদকে নিজের দেশে রেখে নিজেরাই ভোগ করে বিরাট বড় লোক হয়ে গেছে। অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলো অল্প কমিশনের বিনিময়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সেই প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়ে ফকির হয়ে গেছে।

আল্লাহ কখনও কোন জাতির উপরে দেয়া তাঁর অনুগ্রহকে বদলান না, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেদেরকে বদলিয়ে না ফেলে। (৮:৫৩)

এখন আপনি দাবি করবেন, “আল্লাহ তাহলে তাদেরকে এমন সরকার হতে দিল কেন? কেন সেই সরকারের সদস্যগুলোর মাথায় বাজ পড়লো না, যখন তারা বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করে নিজের দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছিল? কেন  বিদেশি দেশগুলোকে আল্লাহ  টর্নেডো, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দিয়ে আটকিয়ে রাখল না, যাতে করে তারা আফ্রিকাতে গিয়ে সম্পদগুলো চুরি করতে না পারে?” সমস্যা হচ্ছে আপনি চাচ্ছেন পৃথিবীর মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যায় করে যাবে, আর আল্লাহ অলৌকিক ভাবে প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় করা থেকে আটকিয়ে রাখবেন। যদি আল্লাহ তাই করতেন তাহলে এই পৃথিবী তৈরি করে মানুষকে পাঠিয়ে পরীক্ষা নেবার কোন দরকার ছিল না, যদি তাঁর উদ্দেশই থাকতো মানুষকে যেভাবেই হোক অন্যায় করা থেকে আটকিয়ে রাখার। মানুষ অন্যায় করবে, তার জন্য শাস্তি পাবে। মানুষের অন্যায়ের কারণে যারা ভুক্তভুগি, তাদের সাথে আল্লাহ যথার্থ ন্যায় বিচার করবেন এবং তাদের কষ্টের জন্য যথাযথ প্রতিদান দিবেন। মনে রাখবেন, আল্লাহ হচ্ছেন ‘পরম ন্যায় বিচারক’ – তিনি সামান্যও অন্যায় করেন না। সুতরাং মানুষের কষ্ট দেখে আল্লাহর উপর ভরসা হারিয়ে না ফেলে আল্লাহর গুণ গুলো নিয়ে ভালভাবে চিন্তা করুন। আপনার মনে আল্লাহর সম্পর্কে যত ধরণের সংশয়, দ্বিধা, সন্দেহ আছে, তা চলে যাবে। কু’রআন নিজে মনোযোগ দিয়ে বুঝে পড়লেই এধরনের সংশয়ের সমাধান পেয়ে যাবেন। যখনি মনে কোন সন্দেহ জাগবে, সেই সন্দেহের উত্তর খোঁজার জন্য কু’রআন পড়া শুরু করবেন। দেখবেন আল্লাহ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রেখেছেন। সবসময় মনে রাখবেনঃ

আল্লাহ কখনই মানব জাতির কোন ক্ষতি করেন না, বরং মানুষরাই মানুষের ক্ষতি করে। (১০:৪৪)

কিছুদিন আগে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আল্লাহ কেন গরিব মানুষগুলোকে মান্না এবং সালওয়া পাঠায় না, যে রকম কিনা ওই বদ ইহুদিগুলোকে দিয়েছিল।” এ ধরণের অলৌকিক ঘটনা ঘটলে তার ফলাফল কি ভয়াবহ হবে চিন্তা করে দেখুন। ধরুন বসনিয়াতে নির্যাতিত মুসলিমদের উপর একদিন হঠাৎ করে আকাশ থেকে মান্না এবং সালওয়া আসা শুরু হল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই খবর ইন্টারনেটএ ছড়িয়ে যাবে এবং বিবিসি, সিএনএন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি চ্যানেল থেকে শত শত হেলিকপ্টারে করে হাজার হাজার সাংবাদিক গিয়ে সেখানে হাজির হবে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সারাদিন বসে টিভিতে দেখতে থাকবে এই অসম্ভব ঘটনা। সাড়া পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অলৌকিক ঘটনা নিজের চোখে দেখার জন্য প্লেনে করে বসনিয়াতে যাবার জন্য বিরাট লাইন দিয়ে দিবে। বসনিয়ার আসে পাশের দেশগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ গরু, ঘোড়া, গাধায় করে রওনা দিবে বসনিয়ার উদ্দেশে এই বিনামুল্যে পাওয়া খাবারে ভাগ দেবার জন্য। কয়েক দিনের মধ্যে পৃথিবীর একটা বড় জনগোষ্ঠী বসনিয়াতে গিজ গিজ করতে থাকবে। বসনিয়ার বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে কোন জায়গা পাওয়া যাবে না। শহরের পানি, খাদ্য, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি আলেমদের মধ্যে বিরাট ঝগড়া লেগে যাবে যে এই অলৌকিক ঘটনার জন্য কে দায়ী – আল্লাহ, নাকি যীশু, নাকি ইহুদিদের খোদা এল্লাহি। কয়েকদিনের মধ্যে পশ্চিমা দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের আর্মিকে হাতিয়ে, বসনিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে কাটা তারের বেড়া দিয়ে সবাইকে বের করে দিবে, মান্না এবং সালওয়া নিয়ে গবেষণা এবং ব্যবসা করার জন্য।

আল্লাহ জানেন এ ধরণের কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটালে মানব জাতির লাভের থেকে ক্ষতি হবে। একারণেই তিনি তা করেন নাঃ

 অলৌকিক নিদর্শন পাঠাতে আমার কোন বাঁধা নেই, কিন্তু আগের প্রজন্মগুলো সেগুলো অমান্য/অস্বীকার  করেছে। আমি থামুদের লোকদেরকে পরিস্কার নিদর্শন হিসেবে এক উট দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও তারা সেটার সাথে অন্যায় করেছিল। আমি অলৌকিক নিদর্শন পাঠাই মানুষকে শুধুমাত্র সাবধান করতে। (১৭:৫৯)

“আল্লাহ কেন শয়তানকে বানালো? শয়তান না থাকলে তো আমরা সবাই বেহেস্তে যেতে পারতাম”

আসলে প্রশ্নটা হচ্ছে, আল্লাহ কেন “মন্দ” সৃষ্টি করলো? কেন শুধুই ‘ভালো’ থাকলো না?

প্রশ্ন হচ্ছে যদি মন্দ না থাকে, তাহলে আপনি বুঝবেন কি করে ভালো কি? যদি অসুন্দর না দেখে থাকেন, তাহলে সুন্দর দেখলে তা বুঝবেন কি করে যে সেটা সুন্দর? যদি কখনও কষ্ট পেয়ে না থাকেন, তাহলে আরাম কি সেটা বুঝবেন কি করে? যদি অসুস্থতা না থাকে, সুস্থতা অনুভব করবেন কিভাবে?

সুখ হচ্ছে দুঃখের অভাব। যখন আমরা কম দুঃখে থাকি, তখনি আমরা সুখ অনুভব করি। আমাদের দুঃখ কখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় না।

একবার রোবট বানানোর সময় বিজ্ঞানীরা চিন্তা করছিলেন, কিভাবে রোবটকে সুখের অনুভুতি দেওয়া যায়? তারা চিন্তা করে দেখলেন, রোবটকে সবসময় কোন একটা কষ্ট দিতে হবে, যাতে করে রোবট চেষ্টা করবে সেই কষ্টটা কমানোর, কারণ কষ্ট কম মানেই ‘সুখ’। যখনি রোবট বুঝবে এই কাজটা করলে তার কষ্ট কমে যায়, তখনি সে ‘সুখ’ পাবার জন্য সেই কাজটা বেশি করে করবে। এজন্য বিজ্ঞানীরা রোবটের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ‘কষ্ট’ তৈরি করে তাকে ‘দুঃখে’ রাখলেন এবং তার মধ্যে সেই দুঃখ কমানোর উপায় প্রোগ্রাম করে দিলেন। রোবট তারপর সবসময় চেষ্টা করে ‘দুঃখ’ কমাবার এবং যখনি তার ‘দুঃখ’ কমে যায়, সে ‘সুখি’ অনুভব করে।

আমরা জানি সুখ হচ্ছে দুঃখের বিপরীত অনুভুতি। ধরুন আপনাকে আমি যদি বলি আমি এখন ‘কস্টানন্দে’ আছি, আপনি কি বুঝবেন ‘কস্টানন্দ’ অনুভূতিটা কি? যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি কস্টানন্দ অনুভব না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি কি করে তার বিপরীত অনুভুতি ‘আনন্দুঃখ’ অনুভব করবেন? আল্লাহ যদি মানুষকে আনন্দুঃখ দিতে চান, তাহলে কি তিনি মানুষকে প্রথমে কস্টানন্দ অনুভব করাবেন না?

আল্লাহ আমাদের উপরে একটা বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে আমাদেরকে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, অশান্তি খুব বেশি হলে ১২০ বছর সহ্য করতে হবে এবং তারপর আমরা হাজার বছর, লক্ষ বছর, কোটি কোটি বছর আনন্দ, সুখ, শান্তি অনুভব করবো। চলুন আমরা সেটা অর্জন করার জন্য সব রকম চেষ্টা করি। আপনাকে যদি কেউ বলে আপনাকে আজকে সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং তার বিনিময়ে আপনাকে বাড়ি, গাড়ি, জমি, টাকা সব দেওয়া হবে – আপনি কি চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে যাবেন না?

দ্বিতীয়ত, আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, যা কিছুই ভালো তা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যা কিছুই খারাপ তা হয় শয়তানের কারণে, এতে আমাদের কোন হাত নেই। ভুল ধারণা। ভালো মন্দ সবকিছুই আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের জীবনে ভালো যা কিছু হয়, তা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে এবং যা কিছু খারাপ হয়, তা আমাদেরই দোষে, আল্লাহ্‌র অনুমতিতেঃ

… যখন ভালো কিছু হয়, তারা বলে, “এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে”, আর যখন খারাপ কিছু হয়, তারা বলে, “এটা তোমার (মুহম্মদ) কারণে হয়েছে।” তাদেরকে বলো, “দুটোই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে।” এই মানুষগুলোর সমস্যা কি যে তারা কিছুতেই বোঝে না তাদেরকে কি বলা হচ্ছে? তোমার উপরে ভালো যা কিছু হয়, তা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে, আর যা কিছু খারাপ হয়, তা তোমার কারণে। …(৪:৭৮-৭৯)

আমার অনুসারীদের উপরে তোমার (শয়তান) কোন ক্ষমতা থাকবে না , কিন্তু ওই সব পথভ্রষ্টরা ছাড়া যারা তোমাকে অনুসরণ করে।  (১৫:৪২)

যখন সব ফয়সালা হয়ে যাবে (কিয়ামতের দিন), তখন শয়তান বলবে, “আল্লাহ তোমাদেরকে সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো ছিল সব মিথ্যা। তোমাদেরকে শুধু ডাকা ছাড়া আমার আর কোন ক্ষমতা ছিল না তোমাদের উপরে। তোমরাই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। তাই আমাকে কোনো দোষ দিয়ো না বরং নিজেদেরকে দোষ দাও।”… (১৪:২২)

সুতরাং অন্যায় করে বলেন না যে সব শয়তানের দোষ, শয়তান না থাকলে আপনি সেই অন্যায়গুলো করতেন না। শয়তান শুধুই আপনাকে আইডিয়া দেয়, আপনি নিজে জেনে শুনে অন্যায়গুলো করেন। আপনার সিদ্ধান্তের স্বাধীনতার অপব্যবহারের জন্য আপনি দায়ী, শয়তান নয়। আপনার টেবিলে একটা কম্পিউটারের ম্যাগাজিন পড়ে আছে, আর সামনে টিভিতে এমটিভি চ্যানেলে একজন শিক্ষিত, বয়স্ক, দুই সন্তানের মা, নামমাত্র কাপড় পড়ে লাফালাফি করছে। আপনি টিভি বন্ধ করে ম্যাগাজিনটা না পড়ে যদি হা করে তাকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সেটাতে শয়তানের দোষ নেই, পুরোটাই আপনার দোষ।

“আল্লাহ কি জানে না কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি? আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি?”

প্রথমত, আপনি যদি এই ধরণের প্রশ্ন করেন তাহলে আপনার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে – আপনি দোযখে যাবার জন্য সব দোষ আল্লাহকে দিতে চান। আপনি আপনার দোষের জন্য নিজে কোন দায়িত্ব নিবেন না, পুরোটাই আল্লাহর দোষ। আপনার আসল সমস্যা হচ্ছে আপনি প্রভু-দাস এই ব্যপারটি ঠিকমত বোঝেনি। একারণে আপনাকে অনুরোধ করবো প্রথম পর্বটি বার বার পড়ার।

দ্বিতীয়ত, আপনি ধরে নিচ্ছেন আপনি জাহান্নামে যাবেনই। কে বলেছে আপনাকে যে আপনি জাহান্নামে যাবেন এবং আপনার আর ভালো কাজ করে লাভ নেই? বরং আল্লাহ বলেছেনঃ

… ও আমার বান্দারা, তোমরা যারা নিজেদের উপরে চরম অন্যায় করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহের উপর কখনও আশা হারিয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন।  কোন সন্দেহ নেই, তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর করুণাময়। (৩৯ঃ৫৩)

তখন আপনি প্রশ্ন করবেন, “আমার কি পরিণতি হবে সেটা তো আল্লাহ জানেই? যদি আল্লাহ জানেই আমি দোযখে যাচ্ছি, তাহলে আর ভালো কাজ করে লাভ কি?”

এটা একটা জটিল প্রশ্ন কারণ এর সাথে ‘কদর’ বা ‘পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের’ ধারণা জড়িত। এটি একটি ব্যাপক ব্যপার যার জন্য বেশ কয়েকটি বই পড়া প্রয়োজন। আমি যদি একটা ছোট সারাংশ দেই তাহলে দাঁড়ায়ঃ

আল্লাহর কোন কিছু জানার অর্থ এই না যে আপনার কোন স্বাধীনতা নেই। আল্লাহ মানুষকে ‘সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা’ দিয়ে পাঠিয়েছেন। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ কিছু ব্যপার পূর্ব নির্ধারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু বাকি অনেক কিছু মানুষের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ কোন পরিস্থিতে পড়ে যদি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে তার জন্য পুরস্কার পাবে, যদি খারাপ সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তার জন্য শাস্তি পাবে। পরিস্থিতিগুলো আল্লাহ তৈরি করেন। প্রতিটি পরিস্থিতে মানুষ কতগুলো সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে পারবে সেটাও আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন। মানুষের কাজ হচ্ছে ভাল সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া এবং নিজের রাগ, লোভ, কামনা, বাসনা, ইগো ইতাদির বশবর্তী হয়ে অন্যায় সিদ্ধান্ত গুলো না নেওয়া।

যেই কিনা সৎ কাজ করবে, সে তা নিজের উপকারেই  করবে; আর যেই কিনা অসৎ কাজ করবে, তা সে নিজের বিরুদ্ধেই করবে। তোমার প্রভু তার বান্দাদের উপরে কখনই অবিচার করেন না। (৪১:৪৬)

কিন্তু এর মানে এই না যে আল্লাহ জানেন না আমরা কি সিদ্ধান্ত নিব, বা আল্লাহ যদি জানেনই আমরা কি সিদ্ধান্ত নিব, তার মানে এই না যে আমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত পূর্ব নির্ধারিত। আমরা যখনি বলি – “আল্লাহ তো সব জানেন” – আমরা ধারণা করে নেই যে আল্লাহর জানাটা হচ্ছে অতীত কালের ঘটনা এবং যেহেতু আল্লাহ ‘অতীত কালে’ জেনে গেছেন, তার মানে বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই পূর্ব নির্ধারিত। এটা ভুল ধারণা। আল্লাহ সময়ের উর্ধে। তাঁর জন্য কোন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নেই। কোন সত্তা যখন সময়ের বাইরে চলে যায়, তখন সে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই একই সময়ে, একই মুহূর্তে জানতে পারে। সুতরাং, আমি জাহান্নামে যাবো এটা যদি আল্লাহ জানেন, তার মানে এই না যে আল্লাহর জানাটা অতীত কালে ঘটে গেছে এবং আমার আর ভালো কাজ করে কোন লাভ নেই, আমার ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত। আল্লাহ এই মুহূর্তে আমি কি করেছি, কি করবো এবং তার ফলে আমার পরিণতি কি হবে তা সব দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি কি করবো, কি করবোনা, সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আল্লাহ আমাকে দেন নি।

কিভাবে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখা যায় তার একটা উপমা দেই। ধরুন আপনি সিনেমা হলে গিয়ে একটি চলচ্চিত্র দেখছেন। যেহেতু আপনি একটা একটা করে দৃশ্য দেখছেন, আপনি জানেন না সামনে কি হতে যাচ্ছে। আপনি শুধুই অতীতে কি হয়েছে জানেন এবং বর্তমানে কি দৃশ্য হচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ধরুন চলচ্চিত্রটির পুরো ফিল্মের রোলটাকে যদি মাটিতে সমান করে বিছিয়ে রাখা হত এবং আপনি দশ তলা বাড়ির ছাদ থেকে পুরো ফিল্মটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবারে, এক পলকে দেখতে পেতেন, তাহলে আপনি একই সাথে, একই মুহূর্তে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই দেখতে পেতেন। আপনার কাছে তখন আর চলচ্চিত্রটি একটা একটা দৃশ্য করে আগাতো না বরং পুরো চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠত। এটা শুধুই একটা উপমা, আল্লাহ্‌ই জানেন সময় তাঁর কাছে কিভাবে কাজ করে।

এবার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের একটা উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গাড়িতে করে যাচ্ছেন। আপনি একটা রাস্তার মোড়ে এসে দেখলেন একটা রাস্তা বায়ে গেছে, আরেকটা ডানে গেছে। আপনি বায়ের রাস্তা নিলেন এবং চট্টগ্রামের বদলে সিলেটে গিয়ে পৌঁছালেন। এখন যারা রাস্তা বানিয়েছে – বিআরটিএ, তারা ভালো করেই জানে কোন রাস্তায় গেলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে। প্রত্যেকটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে কোন দিকে ঘুরলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে তারা তা সবই জানে। তার মানে এই না যে আপনি সিলেটে গিয়ে পৌঁছাবেন তা পূর্ব নির্ধারিত, কারণ বিআরটিএ ইতিমধ্যেই জানে রাস্তাগুলো সিলেটে গেছে। আপনি আপনার জীবনে যত মোড় নিবেন, তার প্রত্যেকটির পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ জানেন কারণ জীবনের রাস্তার প্রতিটা মোড় তাঁরই বানানো।

যেমন ধরুন আপনার যখন দশ বছর বয়স ছিল, আপনার স্কুলে দুজন বন্ধু ছিল। রহিম – যে একজন ভালো ছাত্র, সারাদিন পড়াশুনা করে, ভালো ঘরের ছেলে; আর রকি – যে বিরাট বড় লোকের ছেলে, যার ভিডিও গেমের অভাব নেই, সারারাত মুভি দেখে, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন – রহিম এবং রকি। আপনি রকির ভিডিও গেমের লোভকে সামলাতে না পেরে রকির পিছনে লেগে গেলেন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন সময় নষ্ট করে বেড়ালেন। স্কুল শেষ করলেন একটা বাজে রেজাল্ট নিয়ে। জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেললেন। সারাজীবন আল্লাহকে দোষ দিলেন আপনার দুরাবস্থার জন্য। বাকি জীবনটা আল্লাহর কোন নির্দেশ না মেনে, তার সাথে যুদ্ধ করে, তার নির্দেশগুলো অমান্য করে দোযখে চলে গেলেন।

আপনি যদি রকির পেছনে না ঘুরে রহিমের সাথে থাকতেন, আপনার একটা সুন্দর চরিত্র তৈরি হত, আপনি সুন্দর চিন্তা করতে শিখতেন, ঠিকমত পড়ালেখা করতেন, ভাল রেজাল্ট করে ভালো কলেজে পড়তে পারতেন। আপনার জীবনটা সফল হতো। তখন আপনি সারাজীবন আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে, তাঁর আদেশ মেনে জীবন পার করে বেহেশতে চলে যেতেন।

আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন। আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আপনি দায়ী।

আবার ধরুন আপনি রকির পেছনে লেগে ছিলেন এবং কোন মতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরেছেন আপনার বাবা-মার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত চেষ্টা করার পর। তারপর একদিন আপনার বন্ধু করিম আপনাকে এসে বলল, “দোস্ত, আমার এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম। ওদের এক দল আছে যারা সন্ধার পর ‘ইয়ে’ করতে যায়। সাংঘাতিক মজার ব্যপার নাকি। চল, আমরাও আজকে একবার ‘ইয়ে’ করে দেখি।” এখন এতদিনে আপনার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আজে বাজে বন্ধুর সাথে মিশলে জীবনে কত পস্তাতে হয়। কিন্তু তারপরেও আপনি লোভ সামলাতে পারলেন না, বন্ধুর সাথে চলে গেলেন। এর জন্য যদি আল্লাহ আপনাকে ধরে সোজা জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন, আপনি কি আল্লাহকে দোষ দিবেন?

কিন্তু ধরুন আপনি নিজে তো গেলেনই না, বরং আপনার বন্ধু করিমকেও আটকে রাখলেন। তাকে আপনার নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ভালো করে বোঝালেন। যার ফলে সে জীবনে একটা বড় ভুল করা থেকে বেঁচে গেল। নিজেকে সংশোধন করার জন্য এবং অন্য একজন মানুষের জীবনকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ খুশি হয়ে আপনাকে বেহেশত দিয়ে দিলেন।

এভাবে আল্লাহ আমাদেরকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাস্তার ব্যবস্থা করে দেন। আমাদেরকে সংশোধনের সুযোগ করে দেন। কিছু রাস্তা আপনাকে আরও খারাপ করে দিবে, আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের জীবনে আরও কষ্ট এনে দিবে। কিছু রাস্তা আপনাকে আপনার দুরবস্থা থেকে বের করে এনে জীবনটা সহজ করে দিবে। আপনি যদি আপনার গত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না পেয়ে, নিজের লোভ, ইগো, সন্মান, রাগ, অহংকারকে সংযত না করে আবারো ভুল রাস্তায় চলে যান, তাহলে এর জন্য আপনি দায়ী, আল্লাহ নয়।

আমি নিশ্চিত ভাবে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছি, সে কৃতজ্ঞ হোক আর অকৃতজ্ঞ হোক।  (৭৬:৩)

এ পর্যন্ত যা বললাম তা হল মানুষের মস্তিস্ক বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে তার পক্ষে ধারণা করা সম্ভব এমন কিছু উপলব্ধি। যেহেতু ‘কদর’ ব্যপারটিই মানুষের কল্পনাতীত একটি ব্যপার, তাই মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা যত উন্নত হবে, মানুষের এই সম্পর্কে ধারণায় তত পরিবর্তন হবে। এখন পর্যন্ত আমরা এইটুকুই আন্দাজ করতে পারি। আল্লাহ্‌ই জানেন তিনি কিভাবে কদর সৃষ্টি করেছেন। এধরনের ব্যপার মানুষের জন্য চিন্তা করাটা কঠিন কারণ মানুষ সময়ের মধ্যে বাস করে এবং সময়ের বাইরে কোন কিছু তারা চিন্তা করতে পারেনা। আমাদের ভাষায় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এর বাইরে আর কোন শব্দ নেই। যেহেতু আমাদের ভাষায় এর বাইরে কোন শব্দ নেই, সেহেতু আমরা সময়ের বাইরে কিছু কল্পনাও করতে পারিনা।

বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ

“আল্লাহ থাকতে এতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন? এতো ভুমিকম্প হয় কেন? বন্যা হয় কেন? এতো মানুষ মারা যায় কেন?”

এক বিংশ শতাব্দীতে গত দশ বছরের গড় হিসাব করলে প্রতি বছর গড়ে ৭০,০০০ মানুষ মারা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। কিন্তু মানুষের দোষের কারণে কত মানুষ মারা যায় জানেন?

  • শুধু এইডসে গড়ে বছরে ১৮ লক্ষ মারা যায় এবং ২০১০ সালে সাড়া পৃথিবীতে ৩.৪ কোটি এইডস আক্রান্ত মানুষ পাওয়া গেছে।
  • ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক কঙ্গো যুদ্ধে ৩৩ লক্ষ মানুষ মারা গেছে।
  • রাস্তায় দুর্ঘটনায় বছরে ১২ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

এরকম শত শত পরিসংখ্যান রয়েছে যা প্রমাণ করে পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ মারা যায় মানুষেরই ভুলের কারণে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে খুব কমই মারা যায়।

এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই হয় মানুষের কারণে। যেমন নদীতে অপরিকল্পিত বাধ দেবার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে খরা সৃষ্টি হয়। তারপর খরা থেকে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, মহামারি। নিয়ন্ত্রণহীন গাছ উজার করার ফলে  হয় অনাবৃষ্টি এবং মাটির পানি শোষণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে হয় বন্যা, নদী ভাঙ্গন। তারপর বন্যা থেকে মহামারি, দুরভিক্ষ। ফ্যাক্টরির বর্জ্য নদীতে ফেলে নদী দূষণের কারণে হয় মহামারি, খাবারের অভাব, দুর্ভিক্ষ, এবং ব্যাপক পরিবেশ দূষণ, যার কারণে মানুষের নানা ধরণের জটিল অসুখ হয়। কোটি কোটি টন মানুষের বর্জ্য নদী থেকে সমুদ্রে ফেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট, মহামারি, ক্যানসার সৃষ্টি ইত্যাদি।

আল্লাহ কখনও কোন জাতির উপরে দেয়া তাঁর অনুগ্রহকে বদলান না, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেদেরকে বদলিয়ে না ফেলে। (৮:৫৩)

আমরা কত ভাবে প্রকৃতির ক্ষতি করি এবং প্রকৃতি কত ভাবে সেই ক্ষতি গুলোকে সংশোধন করার চেষ্টা করে তা দেখতে হলে এই অসাধারণ ডকুমেন্টারিটি দেখুন। আপনার পৃথিবী সম্পর্কে শ্রদ্ধা হাজার গুণে বেড়ে যাবে যখন আপনি দেখবেন পৃথিবীতে কত হাজার ধরণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান দিয়ে তৈরি করে রেখেছেন মানুষের অবাধ দূষণ পরিস্কার করার জন্য। কিন্তু তারপরেও মানুষ সীমালঙ্ঘন করে এবং তার ফলাফল ভোগ করে।

মানুষের কোনই হাত নেই এমন কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল – সুনামি, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরি এবং উল্কাপাত। এখন সুনামি, আগ্নেয়গিরি এবং ভুমিকম্প প্রবণ এলাকা গুলো মানুষ ভালো করেই জানে। তারা সেখান থেকে সরে গেলেই পারে। কিন্তু তারা সেটা করে না। বাপ-দাদার ভিটামাটি আকরে ধরে থাকার এক অন্ধ মোহ আছে তাদের মধ্যে। তারা ভূমিকম্পে, সুনামিতে, যুদ্ধে মারা যাবে, কিন্তু তারপরেও সেখান থেকে তারা সরে যাবে না। তারা অমুসলিম, অত্যাচারী শাসকের অত্যাচারে জীবন পার করবে, কিন্তু আল্লাহর দেওয়া এত বড় পৃথিবীতে অন্য কোথাও গিয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে না। এদের জন্য আল্লাহ বলেছেনঃ

যখন ফেরেস্তারা ঐসব লোকদের আত্মাকে নিয়ে যাবে যারা নিজেদের উপরে অত্যাচার করছিল এবং জিজ্ঞেস করবে, “তোমরা কি অবস্থায় ছিলে?” তারা উত্তর দিবে, “আমরা দুর্বল/অত্যাচারিত/অসহায় অবস্থায় ছিলাম।” ফেরেস্তারা বলবে, “আল্লাহর পৃথিবী কি যথেষ্ট বড় ছিল না, তোমাদের অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য?” ঐসব লোকদের আশ্রয় হবে জাহান্নাম, এক জঘন্য গন্তব্য।  কিন্তু সেসব সত্যিকারের অসহায় পুরুষ, মহিলা এবং বাচ্চারা ছাড়া ,যাদের নিজেদের কোন সামর্থ্য ছিল না এবং যাদের অন্য কোন পথও ছিল না। (৪:৯৭-৯৮)

তবে শুধু অসহায় মানুষদেরই যে সবসময় দোষ তা নয়। মানুষ তার স্বার্থপর রাজনৈতিক নিয়ম দিয়ে আল্লাহর দেওয়া পৃথিবীকে ‘দেশ’ নামের ১৯৬টা ভাগে ভাগ করে এবং ‘ভিসা’ নামের একটি ব্যবস্থা করে এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে গরিব অসহায় মানুষগুলোকে ভুমিকম্প, সুনামি প্রবণ এলাকাগুলোতে অসহায় ভাবে বন্দি থাকতে হবেই। আল্লাহর দেওয়া এই বিশাল পৃথিবীতে এতো খালি জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে তারা শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারবে না। এর জন্য আল্লাহকে দোষ দিয়ে তো কোন লাভ নেই। মানুষ কত স্বার্থপর হতে পারে তা কিছুদিন আগে বার্মাতেই দেখা গেছে। হাজার হাজার গরীব মুসলমান গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য, দিনের পর দিন না খেয়ে সমুদ্রে ভেসে বাংলাদেশে আসলো একটু আশ্রয় পাবার জন্য, আর বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে ভিসা না থাকার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দিল। এধরণের চরম অমানুষিকতার পরেও বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ যে পরের দিনই ভুমিকম্পে ধসে মারা যায়নি তার কারণ আল্লাহ নিরন্তর করুণাময়, চরম ধৈর্যশীল।

অনেকে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ কেন পৃথিবীকে এমনভাবে তৈরি করলো না যাতে করে পৃথিবীতে কখনও বন্যা, খরা, মহামারি, ভুমিকম্প না হয়? আল্লাহর তো সব ক্ষমতাই আছে। তিনি কি ইচ্ছা করলেই এমন একটা পৃথিবী তৈরি করতে পারতেন না যেখানে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না?

সহজ উত্তর – হ্যা, তিনি পারেন এবং তিনি বেহেশত তৈরি করেছেন যেখানে কোন বন্যা, খরা, মহামারি, ভুমিকম্প হয় না। পৃথিবী তৈরির উদ্দেশ্য ছিল না পৃথিবীকে আরেকটা বেহেশত বানানোর।

আর যারা আরও বিস্তারিত জানতে চান কেন পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির জন্য ভুমিকম্প প্রয়োজন, কেন খরা না থাকলে প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে যেত – তারা এই আর্টিকেলটি পড়ে দেখুন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে পৃথিবীর নিজেকে দূষণ মুক্ত করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার একটি সহজাত প্রক্রিয়া। মানুষ ব্যাপক দূষণ করার পরেও পৃথিবীকে বসবাস যোগ্য রাখার জন্য আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান দিয়ে হাজার হাজার স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার মধ্যে একটি।

আল্লাহর বিরুদ্ধে আরেকটি সাধারণ অভিযোগ হল আল্লাহ কেন পৃথিবীতে এত মানুষ পাঠাল, কিন্তু তাদের জন্য যথেষ্ট খাবার, প্রাকৃতিক সম্পদ, জায়গা দিয়ে পাঠাল না। এটি একটি বিরাট ভুল ধারণা যে পৃথিবীতে এত যে গরিব মানুষ তার মূল কারণ পৃথিবীতে সম্পদের অভাব। পৃথিবীত মাত্র ১% মানুষ পুরো পৃথিবীর ৪৮% সম্পদ দখল করে রেখেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১০% মানুষ পুরো পৃথিবীর ৮৫% সম্পদের অধিকারী! মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, যা কিনা প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ, আজকে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১% এর উপর বেঁচে আছে!

শুধু তাই না, মাত্র ২% ধনী মানুষগুলো পুরো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি বাড়ি এবং জমির মালিক। বাকি অর্ধেক জমি এবং বাড়ির মধ্যে বাকি ৯৮% জনসংখ্যা বসবাস করছে। মানুষের মধ্যে আজকে যে এই চরম বৈষম্য তার কারণ ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতি, লোভ এবং দুর্নীতি। সুদ আরেকটি বড় কারণ যা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে করে বড় লোকরা বসে বসে আরও বড় লোক হয়, আর মধ্যবিত্ত এবং গরিবরা অমানুষিক খাটার পরেও দিনে দিনে আরও গরিব হতে থাকে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পুরো পৃথিবীর সব মানুষকে, পুরো ৬ বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেকে একটি বাসা এবং সামনে একটি ছোট বাগান দিলেও পৃথিবীর সব মানুষকে যুক্তরাজ্যের এক টেক্সাস অঙ্গরাজ্যেই জায়গা দেওয়া যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে এক বিরাট পৃথিবী দিয়েছেন, কিন্তু মাত্র ২% লোভী মানুষের কারণে আজকে ১.৬ বিলিয়ন মানুষ দিনে একবেলাও খেতে পারে না।

আল্লাহ কখনই মানব জাতির কোন ক্ষতি করেন না, বরং মানুষরাই মানুষের ক্ষতি করে। (১০:৪৪)

আল্লাহ মানুষকে যথেষ্ট সময় দেন নিজেদেরকে শোধরানোর জন্য। তারপরেও যখন মানুষ শোধরায় না, তখন বিরাট কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, বিপুল পরিমাণের সম্পত্তির ক্ষতি হয় যা ধনীদের কুক্ষিগত থাকে, প্রচুর অসহায় মানুষ মারা যায়, যাদের জীবনটা ইতিমধ্যেই পশুর চেয়েও অধম ছিল। তারপর যে মানুষগুলো বেঁচে থাকে, তারা আবার নতুন করে সভ্যতার শুরু করে। এরকম আগে অনেকবার হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা আছে, হয়তো এই বছরই সেটা হতে পারে।

“মুসলমানরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি?”

এটা নির্ভর করে আপনাকে কে শিখিয়েছে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতির সংজ্ঞা? আমেরিকা? ব্রিটেন? যে দেশে প্রতি ঘন্টায় ৭৮ টা ধর্ষণ হয়, সেই দেশের চেয়ে পশ্চাদপদ দেশ কোনটা আছে পৃথিবীতে? যে দেশে ৬০% দম্পতি তালাক দেয়, তাদের চেয়ে দুর্বল জাতি কোনটা? যে জাতি বছরে ৬.৪ বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট করে এলকোহল জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতিতে, ৭.৩ বিলিয়ন পাউন্ড এলকোহল জনিত অপরাধ দমনে, ২.৭ বিলিয়ন পাউন্ড এলকোহল আসক্ত মানুষদের চিকিৎসায়, এবং বছরে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় এলকোহল জনিত অসুস্থতা ও অপরাধের কারণে – তাদের চেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি কোনটা?

চিন্তা করতে পারেন কত বড় সময় এবং সম্পদের অপচয় এগুলো? এক ব্রিটেনের ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে সাড়া পৃথিবীর ১.৬ বিলিয়ন গরিব মানুষের অভাব দূর করে ফেলা যেত। প্রতি বছর আমরা পৃথিবী থেকে সমস্ত অভাব দূর করে ফেলতে পারতাম এই এলকোহলের কারণে নষ্ট করা সময় এবং সম্পদ দিয়ে। একটা মানুষকেও আর না খেয়ে মারা যেতে হত না। কিন্তু সেটা না করে একদিকে আমরা বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট করছি মদ খাওয়ার ফলে যত ঝামেলা হয় সেগুলো ঠিক করতে গিয়ে, অন্যদিকে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার বাচ্চা মারা যাচ্ছে ময়লা পানি খেয়ে, আঠারো হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে খেতে না পেরে।

আপনি একটা জাতিকে শুধুই তার অর্থনীতি আর প্রযুক্তি দিয়ে বিচার করলে তো হবে না। তাদের নৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দিকগুলো তো দেখতে হবে। একদিকে তারা চাঁদে মানুষ পাঠাচ্ছে অন্যদিকে তারা তেল, সোনা এবং হীরার লোভে আফ্রিকাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন করছে, ঘণ্টায় ৭৮টা ধর্ষণ করছে, ৯৭% ধর্ষণকারীকে একদিনও জেল খাটতে হয়না; যেই দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ Obese এবং তাদের চিকিৎসায় বছরে ১২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়- সেই দেশকে আপনি যদি ‘উন্নত জাতি’ বলেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার বিচার বুদ্ধিতে সমস্যা আছে।

ধরুন আপনি আপনার মেয়েকে আমেরিকাতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন পড়ার জন্য। কয়েক দিন পর সে ক্যাম্পাসে ধর্ষিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফেরত আসলো। আপনি কি তারপরেও বলবেন পশ্চিমা দেশগুলো উন্নত জাতি? আপনি জানেন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রতি চারটা মেয়ের মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার হয়? তাও আবার প্রথম বছরেই? তার মধ্যে ৮৪% মেয়ে কোনদিন কাউকে জানতে দেয় না সেই ঘটনা?

গরীব মুসলিম দেশগুলো সেই তুলনায় কত ভালো আছে, চিন্তা করে দেখুন।

দ্বিতীয়ত, মুসলিম দেশের সংজ্ঞা কি? বাংলাদেশ কি মুসলিম দেশ? আপনি যদি বলেন হ্যা, তাহলে আপনার ইসলামিক রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক ধারনা নেই। বিশ্বের যে দেশগুলোতে ইসলামিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি কার্যকর, যাদেরকে ‘ইসলামিক দেশ’ বলা যেতে পারে, সেগুলো হল সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরান, লিবিয়া ইত্যাদি। সেগুলোর একটাও দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি নয়।

“কেন ধর্মের নামে সবচেয়ে বেশি খুনাখুনি, যুদ্ধ? আল্লাহ থাকলে তা হয় কিভাবে?”

বিংশ শতাব্দীর আগে যত হত্যা হয়েছে, তার মধ্যে ৩% হত্যা ধর্মীয় ঘটনার সাথে জড়িত। বাকি ৯৭% হত্যা যুদ্ধ, রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক কারণে।

সুত্রঃ STATISTICS OF DEMOCIDE

নাস্তিকরা এই বিংশ শতাব্দীতে ১৫ কোটির বেশি মানুষ খুন করেছে। পুরো বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমান মানুষ তারা এই বিংশ শতাব্দীতেই মেরে শেষ করেছে।

সুত্রঃ The Irrational Atheist

১৯১৭ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত মোট ১৪.৮ কোটি মানুষ মারা গেছে ৫২ জন নাস্তিকের কারণে, যা পুরো বিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধ, গৃহ যুদ্ধ এবং সকল অন্যয়ের কারণে মারা যাওয়া মোট জনসংখ্যার চেয়ে ৩ গুণ বেশি! নোবেল পুরস্কার জয়ী Aleksandr Solzhenitsyn পঞ্চাশ বছর ধরে গবেষণা করে বের করেছেন যে রাশিয়াতে যে ৬ কোটি মানুষ মারা গেছে কমিউনিজমের কারণে, তার আসল কারণ নাস্তিকতা

সুতরাং ধর্মীয় কারণে যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়, সবচেয়ে বেশি খুনাখুনি হয়, সবচেয়ে বড় যুদ্ধগুলো হয় – এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আপনি মিডিয়ার মগজ ধোলাইয়ের শিকার, আর কিছু না। টিভিতে যা দেখেন এবং পত্রিকায় যা পড়েন, সেটাই বিশ্বাস না করে যথাযথ সরকারী পরিসংখ্যানগুলো পড়ে দেখুন। যেহেতু মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নাস্তিকদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, তাই তারা কৌশলে এইসব তথ্য ধামাচাপা দিয়ে রাখে এবং ধর্মের নামে কিছু ঘটলে সেটাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে।

“শুধু মুসলমানরাই এতো সন্ত্রাসী, টেররিস্ট হয় কেন?”

১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে অ্যামেরিকাতে মাত্র ৬% আক্রমণ হয়েছে মুসলমান চরমপন্থিদের দ্বারা, বাকি ৯৪% আক্রমণ হয়েছে ল্যাটীনো, বামপন্থি চরম পন্থি, ইহুদি চরমপন্থি, কম্যুনিস্ট, এবং অন্যান্য সংগঠন দিয়ে।

একই ভাবে ইউরোপে ৯৯.৬% আক্রমনের পেছনে কোন মুসলিম দলের হাত নেই।

যেমন ২০০৬ সালের ইউরোপের পরিসংখ্যান দেখুন। একটি মাত্র আক্রমণ ইসলাম চরমপন্থীদের দ্বারা আর বাকি ৪৯৭ আক্রমণ বিভিন্ন দলের দ্বারা।

এই পরিসংখ্যানগুলো আমেরিকা এবং ইউরোপের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে নেওয়া। বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন।

সুতরাং যারা বলে মুসলমানরাই খালি টেররিস্ট হয়, তারাই শুধু মারামারি, খুনা খুনি করে, কাশ্মীরের উদাহরণ দেয় – তারা আসলে মিডিয়ার মগজ ধোলাইয়ের শিকার, আর কিছু না। টিভিতে যা দেখেন এবং পত্রিকায় যা পড়েন সেটাই বিশ্বাস না করে যথাযথ সরকারী পরিসংখ্যানগুলো পড়ে দেখুন। যেহেতু ইসলাম প্রচার হলে এবং ইসলামিক আইন ব্যবস্থা আসলে পৃথিবীর বেশিরভাগ ধনী এবং খমতাবান মানুষকে তাদের বিশাল সম্পত্তি, অন্যায় ব্যবসা, মদ, জুয়া, নারী সঙ্গ সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে, সেহেতু তারা আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে হাত করে রেখে যেভাবে সম্ভব ইসলামের নামে অপপ্রচার করে ইসলামকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য।

“আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন? এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো অন্যায়”

হিটলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ মেরে গেছে। তাকে যদি ছয় লাখ বার আগুনে ঝলসানো হয় তাহলে কি তাকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে? যতদিন পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত হিটলারের এই গণহত্যার কারণে যেই ক্ষতিটা হয়ে গেছে, তাকে তার জন্য ছয় লাখ বার আগুনে ঝলসালেও কিছুই হবে না। তাকে ছয় কোটি বার ফুটন্ত পানিতে চুবালেও সেই ছয় লক্ষ মানুষের পরিবারের কষ্টের সমান কষ্ট দেওয়া হবে না। সেই ছয় লক্ষ মানুষ যে কয়েক কোটি মানুষকে জন্ম দিতে পারতো, তার উসুল হবে না।

“আমরা তো হিটলার না। আমরা তো মানুষ খুন করছি না, বা তেলের লোভে যুদ্ধ করছিনা, অথবা গরীব মানুষের টাকা মেরে দিচ্ছিনা। আমাদেরকে কেন আল্লাহ ফুটন্ত পানিতে ঝলসাবে, আগুনে চামড়া পুড়িয়ে আবার নতুন চামড়া দিবে বার বার কষ্ট দেবার জন্য? আমরা এমন কি দোষ করলাম যার জন্য এত ভয়াবহ শাস্তি পাবো?”

আমাদের প্রতিটা দোষের ফলাফল এবং প্রভাব যে কত ব্যাপক, সেটা আমরা কখনও ঠিকভাবে চিন্তা করে দেখিনা। আমরা অনেকেই মনে করি – আমরা যেসব পাপ করি সেগুলো ছোটখাট ব্যপার। এর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে এত বড় শাস্তি দিবেন না। কয়েকটা দিন হয়তো দোযখে একটু কষ্ট করবো, ব্যাস, তারপরেই মুক্তি। এধরণের মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেনঃ

তারা বলে, “আগুন আমাদের মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে”। তাদেরকে বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার নিয়েছ – কারণ আল্লাহ কখনো অঙ্গীকার ভাঙেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে এমন কিছু বল যা নিয়ে তোমাদের কোনই জ্ঞান নেই?” (২:৮০)

কিছু উদাহরণ দেই।

উদাহরণ – ১

আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে বসে একদিন একটা অশ্লীল হিন্দি গান দেখলেন। আপনার কাছে ব্যাপারটা কিছুই না, কারণ আপনার বয়স চল্লিস, আপানার চোখ এসব দেখতে দেখতে ইতিমধ্যে ঝলসে গেছে। আপনার কাছে এগুলো আর গায়ে লাগে না। কিন্তু আপনার ১১ বছরের যৌন আকাঙ্ক্ষায় টগবগে কিশোরের গানের একটা শট দেখে মাথা ঘুরে গেল। সে দিনে রাতে যখনি চোখ বন্ধ করে তখনি সেই শটটা বার বার দেখতে পায়। তারপর থেকে তার বাথরুমে গোসল করতে আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগা শুরু হল, সে তার ঘরের দরজা লক করে থাকা শুরু করলো, বন্ধুর বাসায় গিয়ে রাতে দেরি করে ফেরা শুরু হল, নানা কারণে দিনে রাতে যখন তখন বাসার বাইরে যাওয়া আসা আরম্ভ হল। এখান থেকে শুরু হল তার পতন। একসময় সে বিয়ে করলো এবং তার দীর্ঘ দিনের বদভ্যাসের ফলে শারীরিক সমস্যার কারণে বিকলাঙ্গ, না হয় অসুস্থ সন্তানের জন্ম দিল। তার পরিবারে চরম অশান্তি নেমে আসলো। সারাটা জীবন তাকে চরম কষ্ট করে, তার পোড়া কপালের জন্য আল্লাহকে দোষ দিয়ে, এক দুর্বিষহ জীবন পার করতে হল।

আপনি এটা পুরোটাই প্রতিরোধ করতে পারতেন হিন্দি গানটা শুরু হবার সাথে সাথে চ্যানেল পালটিয়ে দিয়ে এবং জোরে জোরে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে যে হিন্দি গান দেখাটা একটা খুবই খারাপ জিনিস। আপনার ছেলে আপনার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝত, এটা খুবই খারাপ কাজ এবং তারপর সে তার বাকি জীবনটা সংযত রাখত। সে আগামী বিশ বছর প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে বাথরুমে সময় নষ্ট না করে বিশ বছরে প্রায় ৩,৬৫০ ঘণ্টা কোন ভালো কাজ করে ব্যাপক পুণ্য অর্জন করতে পারত।

একটি ছেলের জীবন নষ্ট করে, সে যত ভালো কাজ করতে পারত এবং সেই ভালো কাজগুলোর জন্য যত মানুষের যত উপকার হত সেটা না হতে পারার জন্য; তার স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ির সারাজীবন দুখের জন্য এবং একটি বিকলাঙ্গ বা অসুস্থ প্রজন্মের শুরু করার জন্য আপনাকে যদি আল্লাহ কয়েক হাজার বার চামড়া আগুনে পুড়িয়ে আবার নতুন চামড়া দেন, আপনি কি বলবেন শাস্তিটা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছে? আপনি কি তখন চিল্লাচিল্লি করবেন – “আমিতো একটা হিন্দি গানই দেখেছিলাম!”

(জাহান্নামে তাদেরকে বলা হবে) “তোমাদেরকে কি আমার বাণী বার বার শোনানো হয় নি? তারপরেও কি তোমরা অমান্য করনি?” তারা বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা/অবাধ্যতায় ডুবে ছিলাম, আমরা একটা বিভ্রান্ত জাতি ছিলাম। ও আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। আমরা যদি এরপরেও একই কাজ করি, তাহলে আমরা সত্যিই অন্যায়কারী।” (২৩:১০৫-১০৭)

উদাহরণ – ২

একদিন সকালে আপনি আপনার ড্রাইভারকে একটা চড় মেরে তেল আনতে পাঠালেন। ড্রাইভার রাগে গজ গজ করতে করতে উল্টাপাল্টা গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় আরও দশ জন মানুষের মেজাজ খারাপ করে পেট্রোল পাম্পে গেল। সেই দশ জন মানুষ তাদের মেজাজ খারাপটা ছাড়ল রাস্তার আরও বিশ জন মানুষের উপর। সেই ত্রিশ জন লোক বাসায় ফিরে ত্রিশটা পরিবারের একশ জন সদস্যর উপর মেজাজ ছাড়ল। সেই একশ পরিবারের সদস্য তাদের মনের ঝাল মেটাল তাদের হাজার খানেক বন্ধু, আত্মীয়ের উপর।

আপনি সেদিন ড্রাইভারকে চড় মেরে একটা চেইন রিয়েকশন শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই চেইন রিয়েকশনের ভুক্তভুগি হাজার হাজার মানুষের কষ্টের জন্য আপনি দায়ী। আপনাকে যদি একটা চড় মারার জন্য জাহান্নামে এক লক্ষ বার লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, আপনি কি বলবেন, “দোযখের শাস্তি এতো কঠিন কেন?”

তুমি যদি দেখতে  পেতে, যখন অপরাধীরা মাথা নত করে বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা দেখলাম এবং শুনলাম। আমাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিন। এবার আমরা ভালো কাজ করবো। আমরা এবার  নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি। ” (৩২:১২)

উদাহরণ – ৩

ধরুন আপনার স্বামী (বা স্ত্রীর) সাথে তুমুল ঝগড়া হল। যার ফলে আপনি মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে গেলেন এবং শয়তান এই সুযোগ নিয়ে আপনাকে টিভিতে হিন্দি গান দেখার, ফেইসবুকে ফ্লার্ট করার অথবা মোবাইলে পরকীয়া করার সুযোগ করে দিল। যেহেতু ঝগড়া করে আপনি এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল, আপনি নোংরামি থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না, বরং এক ধরণের প্রতিশোধ নেবার মনোভাব থেকে – “আমার সাথে ঝগড়া করেছ? দাঁড়াও, আমি এখন বেশি করে পর্ণ দেখে, ফেইসবুকে আমার বয়ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ফ্লার্ট করে তোমাকে মজা দেখাচ্ছি” – এই মনে করে আপনি পাপে ডুবে গেলেন।

এখন আপনি দাবি করবেন, “ঝগড়া করে মেজাজ খারাপ ছিল, এজন্য এসব করেছি। এটা কোন মহা পাপ না, একটা মামুলি ঘটনা।”

এই মামুলি ঘটনা থেকে যদি আপনার অন্যায়ের তালিকা তৈরি করি, তাহলে কমপক্ষে এই কয়েকটা কারণে আপনাকে আল্লাহর আদালতে অভিযুক্ত করা যাবেঃ

  • পরিবারের সদস্যের সাথে অসাদাচারন।
  • পরিবারের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি।
  • পরিবারের সদস্যের সাথে বেইমানি করা।
  • শয়তানের সাথে সহযোগিতা করা।
  • নিজের ঈমান দুর্বল করা।
  • ঈমান দুর্বল হবার কারণে ভবিষ্যতে করা সকল পাপ কাজ।
  • অন্যের অন্যায় সমর্থন করা।
  • অন্যের কাছে অন্যায় প্রচার করা।
  • অশ্লীলতা গ্রহন এবং প্রচার করা, অশ্লীল সাইটের ট্রাফিক বৃদ্ধি করে তাদের উপার্জন বৃদ্ধি করা।
  • অশ্লীল কাজে একাধিক মানুষের সময়ের অপচয়।
  • অশ্লীল কাজে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়।
  • অশ্লীল কাজে পারিবারিক সম্পদের অপচয়, যা আপনার পরিবারের সদস্যদের হক।

এত সব অন্যায়ে অভিযুক্ত করে আপনাকে যদি লক্ষ বার অতি উত্তপ্ত পানিতে চুবিয়ে ঝলসানো হয়, তাহলে কি বেশি শাস্তি দেওয়া হবে?

আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা চিন্তা করিনা আমাদের প্রতিটি কথা এবং কাজের ফলাফল কত ব্যাপক। আমরা মনে করি আমরা যখন একজনকে কিছু বলি, বা একজনের সাথে কিছু করি, তার প্রভাব শুধুই তার উপর এবং তার কাছের মানুষের উপর পড়বে। কিন্তু তা নয়। আমাদের প্রতিটা কথা এবং কাজ সমাজে একটা চেইন রিয়েকশন শুরু করে দেয়। এমনকি ইন্টারনেটের বদলে আজকাল তার প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকটা খারাপ কথা বা কাজের জন্য আমাদেরকে দুই এক বার শাস্তি দিলে সেটা নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার হবে না? বরং আমাদের কোন খারাপ কথা বা কাজের জন্য পৃথিবীতে যত মানুষের যত ক্ষতি হবে, তার সমান শাস্তি আমাদেরকে দিতে হবেই, যদি সত্যিই ন্যায়বিচার করতে হয়।

– ওমর আল জাবির

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

  1. আসলে এতো লম্বা আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছায়ই ঘটে এবং কী ঘটবে তা আল্লাহ লওহে মাহফুজে পূর্বেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। লেখক স্পষ্টতঃই লওহে মাওফুজের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। নাউযুবিল্লাহ।

মন্তব্য করুন

Back to top button