হারাম-হালাল

একটু খারাপ কাজ করলে কি হয়? আমি তো কারও ক্ষতি করছি না!

একটু গাঁজা টানলে ক্ষতি কি? আমি তো কারও ক্ষতি করছি না। একটু মদ খেলে ক্ষতি কি? আমি তো মাতাল হয়ে যাচ্ছি না। একবার দুইবার সিগারেট টানলে ক্ষতি কি? আমার তো ক্যানসার হয়ে যাচ্ছে না।আমি একা সুদ না খেলে কি হবে, অন্যেরা তো সুদ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে না। আমি একা ঘুষ না দিলে কি হবে, অন্যেরা তো ঘুষ দেওয়া বন্ধ করছে না। আমি নিজে হিন্দি সিরিয়াল না দেখলে কি হবে, অন্যেরা তো হিন্দি সিরিয়াল দেখা বন্ধ করছে না।

আমাদের অনেকের মনেই এই ধরণের প্রশ্ন আসে যে, আমি একা ভালো হলে কি হবে, অন্যেরা তো ভালো হচ্ছে না, দেশের তো কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, সমাজ তো ভালো হয়ে যাচ্ছে না, দেশে তো দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না?

কখনও কি ভেবে দেখেছেন, সবাই যদি এরকম চিন্তা করতো, তাহলে কোনোদিন কি পৃথিবীতে কোনো অন্যায় বন্ধ হতো? কোনো দিন কি ভালো কিছু ঘটতো যার জন্য মানুষকে কোনো স্বার্থত্যাগ করতে হয়? পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ যদি এই চিন্তা করতো, তাহলে কি পৃথিবীতে কোনো মানুষ বাকি থাকতো যে সুদখোর, ঘুষখোর, সিরিয়াল-খোর, ধূমপায়ী না? এরকম একটা সমাজে, দেশে আপনি কি বেশিদিন টিকে থাকতে পারতেন?

আরেকটি ব্যাপার হল আপনি সবসময় নিজেকে তুলনা করছেন সমাজের ওই সব সুদখোর, ঘুষখোর, সিরিয়াল-খোরদের সাথে। আপনি কিন্তু নিজেকে সমাজের ভালো মানুষদের সাথে তুলনা করছেন না। আপনার আশে পাশে হয়তো পঞ্চাশ জন সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ মানুষ আছে। আপনি তাদেরকে আপনার মডেল হিসেবে নিয়ে, কেন আপনি তাদের মতো হতে পারবেন না, তা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছেন। অথচ সমাজে যে আরও বিশ জন সৎ মানুষ আছেন – যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন, রোযা রাখেন, সৎ চাকরি করেন, কখনও ঘুষ নেন না, সুদ খান না, দুর্নীতি করেন না, হিন্দি সিরিয়াল দেখেন না, তাদের সাথে কিন্তু আপনি নিজেকে তুলনা করছেন না।

এখন আপনি বলতে পারেন, সুদ না দিলে বাংলাদেশে কোনো কাজ হয় না। ঘুষ না দিলে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। একটু দুর্নীতি না করলে উপরে ওঠা যায় না। বাংলাদেশে যদি একটা বাড়ি, গাড়ি, জমি করতে চাই, আমাকে কিছু সুদ নিতে বা দিতে হবেই, কিছু ঘুষ দিতে হবেই, কিছু দুই নাম্বারি করতে হবেই। বাংলাদেশ তো মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ইংল্যান্ড, আমেরিকা না, যে এখানে সৎ ভাবে চলে জীবনে বড় কিছু হওয়া যায়।

প্রথমত, আপনার কাছে বড় হবার সংজ্ঞা হচ্ছে – আমি যেভাবেই হোক বাড়ি, গাড়ি, জমি করবো, তার জন্য আমাকে যত খারাপ কাজই করতে হোক না কেন। আপনি সুদের লোণ নিয়ে যে বাড়িটা করলেন, সেটা আপনার বাড়ি না। সেটা ওই সব গরিব লোকদের বাড়ি, যাদের রক্ত চুষে ব্যাংক গুলো আপনাকে লোণ দিয়েছে এবং আপনার লোণের টাকা উঠাতে তাদের উপর সুদের বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনার বাড়িটা ওই সব লক্ষ লক্ষ মানুষের, যারা আজকে আরও বেশি ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ দিতে বাধ্য হয়েছে কারণ ব্যাংক আপনার লোণের টাকাটা বের করার জন্য গ্রাহকদের উপর সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনি মানুষকে বলে বেড়াচ্ছেন – “ভাই, আমার বাড়িটা সস্তাই পড়েছে, মাত্র তিন কোটি টাকা।” ওই বাড়িটার লোণের টাকা তো এসেছে লক্ষ গরিবের কাছ থেকে, লক্ষ ব্যাংকের গ্রাহকের কাছ থেকে! আপনি কিভাবে ওই বাড়ির মালিক হলেন? একইভাবে ঘুষের টাকায় কেনা জমিটা নিয়ে আপনার গর্ব করার কোনো কারণ নেই, কারণ আপনি বহু কষ্ট করে ঘুষ নিয়ে এবং দিয়ে যে জমিটা কিনেছেন সেটা জাহান্নামের জমির একটা অংশ। জাহান্নামের একটা অংশ কিনে যদি আপনি শান্তি অনুভব করেন, গর্ব অনুভব করেন এবং মানুষকে বলে বেড়ান – “ভাই, জাহান্নামে পাঁচ কাঠার একটা জমি কিনলাম। ওখানে বাড়ি করবো না এপার্টমেন্ট করবো চিন্তা করছি।” – তাহলে আপনার মতো বোকা আর কেউ হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, আপনি যদি মনে করেন বাংলাদেশে সব বড় লোকরাই বড় লোক হয়েছে দুই নাম্বারি করে, বাড়ি, গাড়ি, জমি করেছে ঘুষ দিয়ে, তাহলে আপনি সেলফ ডিলিউসনে ভুগছেন। আমি কোনোদিন একটা টাকাও ঘুষ দেইনি, সুদ দেইনি কিন্তু আল্লাহ ঠিকই আমাকে বাড়ি, গাড়ি, জমি করতে দিয়েছেন। অবশ্যই এজন্য আমাকে অন্যদের থেকে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে প্রত্যেকটা কাজ করার জন্য, কিন্তু তাতে কি? নিয়ম মেনে যেখানে যেই টাকা দেওয়া দরকার সেটা দিয়েছি, ঘুষ দিয়ে বিল ফাঁকি দেবার চেষ্টা করিনি যাতে করে সারা জীবন নিজের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ ধরে রাখতে হয়। আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিবেন আপনি কোনো ভাবেই আল্লাহ্‌র নির্দেশ অমান্য করবেন না দুনিয়ায় কিছু লাভ করার জন্য, তখন আল্লাহ্‌ যে আপনাকে কতভাবে পথ দেখিয়ে দিবেন, কত ভাবে সাহায্য করবেন দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার জন্য, সেটা আপনি শুধু অবাক হয়ে দেখতে থাকবেন।

যারা এটা বিশ্বাস করে না যে তাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অন্যায়ের জন্য উচ্চতর কোনো ক্ষমতার কাছে জবাব দিতে হবে, তারাই এধরণের প্রশ্ন করে – “একটু, আধটু খারাপ কাজ করলে কি হয়? আমি তো কারও ক্ষতি করছি না?” তারা এখনও এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি যে, তাদের থেকে বড় কোনো ক্ষমতার অধীনে তারা আছে, যিনি তাদের প্রত্যেকটা কথা, কাজ এবং চিন্তার হিসাব রাখছেন। এধরণের মানুষের কাছে ‘লোকে কি বলবে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘লোকে কি বলবে’ এই ভয়ে তারা সুদের লোণ নিয়ে বাড়ি-গাড়ি কিনবে যেন মানুষকে মুখ দেখাতে পারে, ঘুষ দিয়ে প্রমোশন নিবে, চুরি করে পরীক্ষায় পাস করবে। এমনকি তারা সোয়া নগ্ন হয়ে মাথা, চুল, গলা, ঘাড়, হাত, বুক ও পিঠের উপরের অংশ বের করে সমাজে চলাফেরাও করবে। তারা ‘লোকে কি বলবে’-কে এতই ভয় পায় যে, তারা কখনও চিন্তা করে দেখে না, তারা কি ঘোষণা দিয়েছিল, যখন তারা বলেছিলঃ

 লা ইলাহা ইল্লা ল্লাহ্‌ – আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোনোই প্রভু নেই।

বরং তাদের চিন্তা-ভাবনা, কথা, কাজের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন তারা ঘোষণা দিচ্ছেঃ

লা ইলাহা ইল্লা ‘লোকে কি বলবে’

কালেমা পড়ে কাকে তারা সবচেয়ে বড় প্রভু হিসেবে মেনে নিয়েছে – সেটা এখনও তারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি। এধরণের মানুষের কাছে আল্লাহ্‌ সবচেয়ে বড় প্রভু নয়, বরং তাদের কাছে ‘লোকে কি বলবে’ আল্লাহ্‌র থেকেও বড় প্রভু। যখনি তাদের জীবনে কোনো পরিস্থিতি আসে যেখানে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় – “আমি এটা করলে তো আল্লাহ্‌ রাগ করবে, কিন্তু না করলে লোকে কি বলবে?”, তখন তারা আল্লাহ্‌র থেকে ‘লোকে কি বলবে’ কে বেশি ভয় পায় এবং আল্লাহ্‌কে উপেক্ষা করে ‘লোকে কি বলবে’ ঠেকানোর জন্য যা করা দরকার সেটাই করে।

এরপরেও কিছু লোক আছে যারা অন্যকে আল্লাহর সমান মনে করে। তাকে তারা এমন ভাবে ভালবাসে, যেভাবে আল্লাহকে ভালবাসার কথা। কিন্তু যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। হায়রে যদি অন্যায়কারীরা দেখতে পেত [যেটা তারা পাবে, যখন তারা শাস্তির দিকে তাকিয়ে থাকবে] যে সকল ক্ষমতা আল্লাহর এবং আল্লাহ কঠিন শাস্তি দেন। [বাকারাহ ২ঃ১৬৫]

– ওমর আল জাবির

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button