বিভ্রান্তির সমাধান

ধর্ম = ভয়?

আমরা অনেকে মনে করি ধর্ম মানেই হচ্ছে সবসময় আল্লাহ্‌র ﷻ ভয়ে ভয়ে থাকা, দোযখের ভয়াবহ শাস্তির কথা সবসময় মনে রেখে মুখ গোমড়া করে ভালো কাজ করে চলা। কোনো কারণে আমাদের অনেকের ভিতরে “ধর্ম মানেই ভয়”, এই ধারণাটি ঢুকে গেছে। আমাদের অনেকে তাদের ছেলে মেয়েদেরকে ছোট বেলা থেকেই ‘আল্লাহ’ নামের এক ভয়ংকর কোনো কিছুর ভয় দেখিয়ে বড় করি। বাচ্চারা আমাদের কথা না শুনলে, দুষ্টামি করলে, আল্লাহ্‌র ﷻ কথা বলে ভয় দেখাই। কোনো খারাপ কাজ করলে, আল্লাহর ﷻ শাস্তির ভয় দেখাই। একারণে তারা ছোটবেলা থেকে বড় হয় আল্লাহ্‌র ﷻ সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ধারণা নিয়ে। তারা মনে করে আল্লাহ্‌ ﷻ মানেই হচ্ছে হেডমাস্টারদের মতো বদরাগী, কথায় কথায় শাস্তি দেয় এমন এক ভয়ংকর সত্ত্বা, যাকে আমাদের সারাজীবন ভয় করে চলতে হবে। একারনে তারা যখন বড় হয়ে ইসলাম মানার চেষ্টা করে, তখন সেই চেষ্টার মধ্যে না থাকে কোনো আন্তরিকতা, না থাকে কোনো ভালবাসা, থাকে শুধুই কিছু আনুষ্ঠানিকতা।

ছোটবেলায় বাবা-মাকে খুশি করার জন্য, তাদেরকে গর্ব করার মতো কিছু দেবার জন্য ছেলে মেয়েরা নিজেদের জান দিয়ে দেয়। কিন্তু আল্লাহ্‌কে ﷻ খুশি করার জন্য কিছু করার মধ্যে তাদের কোনো আন্তরিক আগ্রহ থাকে না। বরং কোনোভাবে আল্লাহ্‌র ﷻ কাছ থেকে বাঁচার জন্য কমপক্ষে যেটুকু করে পার পাওয়া যায়, সেটুকুই করার চেষ্টা করে।

সুরা ফাতিহা পড়ে দেখুন। কোথাও বলা আছে আল্লাহ্‌কে ﷻ ভয় পেতে? বরং প্রথম আয়াতটিই হচ্ছে – “সমস্ত প্রশংসা-ধন্যবাদ আল্লাহ্‌র, যিনি পরম দয়ালু, নিরন্তর দয়ালু।” সেখানে কিন্তু বলা নেই, “সমস্ত ভয়ভীতি আল্লাহ্‌র প্রতি, যিনি কঠিন, বদরাগী।” সুরা ইখলাস পড়ে দেখুন – কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। সুরা ফালাক, নাস এরকম যত কমন সুরা আমরা সবাই ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি, কোথাও আপনি পাবেন না যে, আল্লাহ্‌ ﷻ একজন কঠিন, রাগী সত্ত্বা। বরং তাঁর অসীম করুণা, নিরন্তর দয়া, মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম ধৈর্য, চরম সহনশীলতা, অসীম ক্ষমা – এই দিয়ে কু’রআন ভরে আছে। আমরা কোনো কারণে সেই পজিটিভ বাণী গুলোর উপর ফোকাস না করে খালি ‘নেগেটিভ’ বাণীগুলোর উপর ফোকাস করি। কু’রআনে কতগুলো জাহান্নামের আয়াত আছে, কত জায়গায় আল্লাহ্‌ ﷻ শাস্তির কথা বলেছেন, শুধু সেগুলোকে নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগি। যার ফলে আমাদের অনেকেরই আল্লাহ্‌র ﷻ সাথে সম্পর্ক হয়ে যায় খুব ফর্মাল একটা সম্পর্ক। আমরা তাঁকে মনে প্রাণে ভালবাসতে পারি না। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে একধরণের তিক্ততা মিশ্রিত। তাঁর ইবাদত করি অনেকটা ঠেকায় পড়ে।

অথচ উলটোটা হওয়ার কথা ছিল। আপনার চার পাশে তাকিয়ে দেখুন। আল্লাহ্‌ ﷻ কোন জিনিসটা আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য দিয়েছেন? আপনি কি সকালে ঘুম থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভয়ে লাফ দিয়ে উঠেন? আপনি শ্বাস নেওয়ার সময় আপনার ভিতরে কি ঢুকে গেল এই নিয়ে ভয়ে থাকেন? খাবার খাওয়ার সময় ভয়ে ভয়ে খান (বাংলাদেশ বাদে)? একটা কলার খোসা ছিলে আতংকে চিৎকার দিয়ে উঠেন? চারপাশে সবুজ গাছপালা, হাজারো রঙের ফুল, আকাশে শত শত পাখি, মাঠে সবুজ ঘাস, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সূর্য, চাঁদ, তারা – কোনটা দিয়ে আল্লাহ্‌ ﷻ আপনাকে প্রতি মুহূর্তে ভয় দেখাচ্ছেন? কোনটা দেখে আপনার মনে হয় আল্লাহ্‌ ﷻ একজন ভয়ংকর রাগী কেউ?

আপনি শুধু এক আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করুন—”তারা কি তাদের উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না? আমি কিভাবে সেটাকে বানিয়েছি এবং কিভাবে সেটাকে সুন্দর করেছি, যাতে কোনো ফাটল নেই? [সূরা ক্বাফঃ৬]।” দেখুন, আল্লাহ্‌ ﷻ আকাশে সবচেয়ে প্রশান্তিকর দুটো রঙ – সাদা এবং হালকা নীল ব্যবহার করেছেন এবং আকাশে মেঘগুলো কতো শান্তভাবে ধীরে ধীরে চলে। কোটি কোটি টন পানি প্রতিদিন আমাদের মাথার উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে শৃঙ্খলভাবে, কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, কোনো শব্দ হচ্ছে না, কোনো মেঘ পড়ে যাচ্ছে না, আমরা কেউ টেরও পাচ্ছি না। তিনি যদি আকাশটিকে মঙ্গল গ্রহের আকাশের মতো লাল এবং ভয়ংকর অশান্ত করতেন, তাহলে আমরা সারা দিনরাত আতংকে থাকতাম এবং আমাদের বাসাগুলোকে হয় অত্যন্ত মজবুত এবং বড় জোর এক-দুই তলার মধ্যে রাখতে হতো, না হয় মাটির নিচে বাসা বানাতে হতো। কিন্তু না, আমরা খোলা নীল আকাশের নীচে, সবুজ মাঠে, হলুদ সরিষা ক্ষেতে কতো আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি!

আপনি যখন জন্ম হয়েছিলেন, বাথরুম করে গা মাখামাখি করে ফেলতেন, তখন আল্লাহ্‌ ﷻ আপনাকে দুজন মানুষ আপনার সেবায় ২৪ ঘণ্টা নিবেদিত করে দিয়েছিলেন, যাতে আপনার মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে আপনাকে কিছুই করতে না হয়। তারা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদের খাওয়া, ঘুম, আরাম সব ত্যাগ করে, চরম মানসিক এবং শারীরিক কষ্ট সহ্য করে, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, আপনার জন্য যখন যা করা দরকার তাই করেছিলেন। তারপর আপনি একটু বড় হলেন, আপনার খাবার, জামাকাপড়, পড়ালেখা সব কিছুই আপনার হয়ে কেউ না কেউ ব্যবস্থা করে দিল। আপনার সঙ্গী দরকার, আল্লাহ্‌ ﷻ আপনাকে বন্ধু বান্ধব থেকে শুরু করে একদিন আপনার জীবন সঙ্গী দিয়ে দিলেন। আপনি পৃথিবীতে আপনার নাম রেখে যেতে চান, আল্লাহ্‌ ﷻ আপনাকে বংশধরের ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধুমাত্র মানুষের তৈরি সমাজ, দেশ, সরকার ছাড়া কোন্‌ প্রাকৃতিক জিনিসটা দিয়ে আল্লাহ্‌ ﷻ আপনাকে সবসময় ভয়ের মধ্যে রাখছেন?

তিনি যদি সত্যি একজন রাগী সত্ত্বা হতেন এবং তিনি চাইতেন আমরা সবসময় তাঁর ভয়ে থাকি, তাহলে আমাদের চারপাশের জগতটা প্রাকৃতিক ভাবেই হতো নিষ্ঠুর। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের দুশ্চিন্তায় হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে যেত যে, রাত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবো কি না। কিন্তু তা হয়নি। কারণ আল্লাহ্‌ ﷻ পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। তিনি অল্প করুণাময়, মাঝে মাঝে করুণাময় নন। আমরা সারাদিন নামাযে ফাঁকি দিয়ে ঘুমাতে যাই, কিন্তু পরদিন ঠিকই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে পারি। আমরা কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করি, গরীবের হক মেরে দেই, কিন্তু তারপরেও শ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাসের অভাব হয় না, তৃষ্ণা মেটাবার জন্য পানির অভাব হয় না। আমরা বনজঙ্গল উজার করে দেই, প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, কিন্তু তারপরেও বনের সব পশু পাখি, পোকামাকড় একসাথে সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করে শেষ করে দেয় না। কারণ আল্লাহ্‌ ﷻ প্রচণ্ড ক্ষমাশীল।

আপনি, আমি তাঁর মহা পরিকল্পনার কিছুই নাও বুঝতে পারি। আমাদের জীবনে কেন সমস্যাগুলো হল, সেগুলোর আসল কারণ কি, সেটা চিন্তা করে নাও বের করতে পারি। কিন্তু তাই বলে আল্লাহ্‌কে ﷻ ছোট করে, তাকে না বুঝে, ঠিকমতো চিন্তাভাবনা না করে, তাকে একটা ভয়ংকর কিছুতে পরিণত করার মতো অন্যায় করতে পারি না।

আসুন আমরা আল্লাহ্‌র ﷻ দয়াকে উপলব্ধি করার মানসিকতা তৈরি করি। আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে শেখাই যে, এই যে আমাদের কম্পিউটারটা, এটা বানানোর জন্য সবকিছু আল্লাহ্‌ ﷻ আমাদেরকে প্রকৃতিতে দিয়ে রেখেছেন। আজকে আমরা যে মজার ভাত, মাছ, ডাল খাচ্ছি, এগুলো সবই আল্লাহ্‌র ﷻ তৈরি করা; আল্লাহই ﷻ এগুলোকে এতো সুস্বাদু করে বানিয়েছেন। কালকে যে নতুন জামাটা কিনে দিলাম, সেটাও আল্লাহ্‌র ﷻ দেওয়া, কারণ আল্লাহ্‌ই ﷻ আমাকে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যা না থাকলে এই জামাটা কিনতে পারতাম না। অসুখ হলে সেটা ভালো করার জন্য ওষুধ বানানোর সব উপাদান আল্লাহই প্রকৃতিতে দিয়ে রেখেছেন। এভাবে প্রতিদিনের সব ভালো ব্যাপারগুলো যে আল্লাহ্‌র ﷻ কৃতিত্ব, সেগুলো আমরা নিজেরা এবং আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে বোঝাই। তাহলে তারা বড় হবে আল্লাহ্‌র ﷻ সম্পর্কে একটা সুন্দর ধারণা নিয়ে। তাদের জীবনে আল্লাহ্‌র ﷻ এতো চমৎকার সব অনুগ্রহের বিনিময়ে তাঁকে খুশি করার জন্য তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করবে। নামাযে দাঁড়াবে কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা নিয়ে। সিজদায় মাথা নত করবে বুক ভরা শ্রদ্ধা নিয়ে। এভাবেই আমরা নিজেদেরকে এবং তাদেরকে আল্লাহ্‌র ﷻ আরও কাছে নিয়ে যেতে পারবো, তাঁর সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে পারবো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠবো হাঁসি মুখে, “আজকে আল্লাহ্‌ ﷻ আমাকে নতুন কি দিবেন?” – এই আগ্রহ নিয়ে, এবং রাতের বেলা চোখ বন্ধ করবো বুক ভরা শান্তি নিয়ে, আল্লাহ্‌কে ﷻ অনেক ধন্যবাদ দিয়ে।

[বিঃদ্রঃ এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য নয় যে, আপনি আল্লাহ্‌কে ভয় করা বন্ধ করে যা খুশি তাই করা শুরু করেন এবং নিজের পাপগুলোকে ভুলে যান। মনে রাখবেন, আল্লাহ্‌ ﷻ হচ্ছেন পরম বিচারক, তিনি আপনার প্রতিটি কাজের বিচার করবেনই। একই সাথে তিনি প্রচণ্ড ক্ষমাশীল এবং অসীম দয়ালু − এটাও সবসময় মনে রাখবেন।]

– ওমর আল জাবির

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button