সাহসী মানুষের গল্প

বারুদের বৃষ্টি

মক্কায় আশ্রয় নিয়েছেন মিকদাদ ইবন আমর। আছেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে। কিন্তু তার হৃদয় এবং দৃষ্টিটা ছিল উন্মুক্ত।

মক্কা।

মক্কা তখন আলোর বিভায় আলোকিত হয়ে উঠছে ক্রমশ।

কারণ ততোদিনে রাসূল (সা) তাওহীদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন চারদিকে।

কিন্তু বেশ গোপনে। মাত্র গুটিকয়েক মানুষের মাঝে।

মিকদাদের চারপাশে তখনো অন্ধকার।

কিন্তু তার ভাল লাগে না সেই কুৎসিত পরিবেশ।

কেমন বেরহম সবাই। কেবলি হানাহানি আর রক্তারক্তি। অশান্তির সয়লাব। অনাচারের প্লাবন।

মুক্তির উপায় কি?

ভাবেন মিকদাদ।

ভাবতে ভাবতেই একদিন আকস্মিকভাবে জেনে গেলেন। জেনে গেলেন রাসূলের (সা) কথা।

তাঁর দীনের দাওয়াতের কথা।

জেনে গেলেন, যত সুখ আর নিরাপত্তা- সে কেবল আছে এইখানে, আল্লাহর দীনের ভেতর।

তবে আর দেরি কেন?

না। দেরি নয়।

মিকদাদ ছুটে গেলেন রাসূলের (সা) কাছে। তারপর গ্রহণ করলেন ইসলাম।

ইসলাম গ্রহণ করে তিনি মিথ্যার কুহক থেকে মুক্তি লাভ করলেন। ভাগ্যবান মনে করলেন নিজেকে।

যখনই কালেমা পাঠ করলেন মিকদাদ, তখনই তার বুকের ভেতর প্রবেশ করলো এক প্রশান্তির বাতাস। আর সেই সাথে তুমুল ঢেউ তুললো সাহসী তুফান।

ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছে মক্কায়। গোপনে।

কিন্তু না।

মিকদাদ এতে সন্তুষ্ট নন।

নিজের বিবেক এবং সাহসের সাথেই এ যেন লুকোচুরি খেলা।

এটা তার পছন্দ নয়।

তিনি সরাসরি, সবার সামনেই দিতেন চান ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা।

তিনি গ্রহণ করেছেন আল্লাহর বাণী, রাসূলের বাণী, সত্য ও সঠিক পথের দিশা। সুতরাং সেখানে আবার লুকোচুরির কী আছে? হোক না বৈরী পরিবেশ।

তবুও সাহসে বুক বাঁধতে হবে।

সত্যে পক্ষে দাঁড়াতে আবার কীসের ভয়?

অসামান্য সাহসী মিকদাদ।

ভয় নয়। শঙ্কা নয়। দ্বিধা বা সংকোচও নয়। তিনি সরাসরি মক্কায় ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু করে দিলেন।

কারুর ভয় তিনি ভীতু নন।

মক্কায় তখন চলছে দুশমনদের অকথ্য নির্যাতন।

যারাই সত্যপথের সাথী হচ্ছেন। তাদেরই চলছে নির্যাতনের স্টীম রোলার।

কেউই রেহাই পাচ্ছেন না কাফেরদের হিংস্র থাবা থেকে।

মিকদাদাও জানেন সে কথা।

তারপরও তিনি তার সিদ্ধান্ত অনড়। যেন সে এক হেরার পর্বত।

মিকদাদ প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন মক্কায়।

মানুষকে ডাকছেন এক আল্লাহর পথে। ইসলামের পথে।

রাসূলের (সা) পথে।

কাজটি খুবই কঠিন।

শত্রুরা ক্ষেপে গেল মুহূর্তেই।

কাল যারা ছিল কাছের মানুষ, আপনজন-তারাও দাঁড়িয়ে গেল মিকাদাদের বিরুদ্ধে।

যারা তাকে আগে ভালো বাসতো, প্রশংসা করতো, তাদের মুখেও এখন অশ্রাব্য গালি। তাদের হাতে ফুলে বদলে এখন উঠে এসেছে চকচকে তরবারি।

কী এক নির্মমক নিষ্ঠুর পরিবেশ!

কী এক দুঃসহ কঠিন পরীক্ষার কাল!

এই দুঃসহ রক্তনদী আর আগুনের পর্বত টপকে ক্রমাগত সামন এগিয়ে চলছেন দঃসাহসী কতিপয় সিংহদিল, সত্যপ্রাণ মুজাহিদ।

রাসূল (সা) আছেন তাঁদের সাথে।

শুধু সাথেই নন। রাসূলই (সা) তাদের মহান সেনাপতি। পথপ্রদর্শক।

মক্কার সেই ঘোরতর কঠিন সময়ে মাত্র সাতজন সাহসী পুরুষ প্রকাশ্যে ঈমান গ্রহণের কথা ঘোষণা দিলেন। কাজ করে যাচ্ছেন জীবনকেতুচ্ছ জ্ঞান করে সত্যর পক্ষে।

এই সাতজনের প্রথমজনই হলেন মহান সেনাপতি স্বয়ং রাসূলে মকবুল (সা)।

আর তাঁর বাকি ছয়জন হলেন হযরত আবু বকর, হযরত আম্মার,  তার মা সুমাইয়া, হযরত সুহাইব, হযরত বিলাল ও হযরত মিকদাদ।

তারা কেউই পরওয়া করলেন না কাফেরদের অত্যাচার, নির্যাতচন, হমকি কিংবা প্রাণনাশের।

মক্কার সেই কঠিন সময়ে প্রকাশ্যে ঈমান আনার ঘোষণা দেয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না।

এ ছিল এক অসীম সাহসের কাজ।

একমাত্র আল্লাহকেই যারা পরম নির্ভরযোগ্য অভিভাবক, প্রভু বলে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেন, কেবল তারাই এমনি সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেন।

ইসলাম গ্রহণের পর মিকদাদ সম্পূর্ণ বদলে গেলেন।

এ যেন রাতের পর সূর্যের উদয়। ঝলমলে দিনের শুভাগমন।

কিন্তু কাফেরদের বুজের জ্বালা এতে করে বেড়ে গেল অনেক গুণে।

তারা এবার আরও কঠিন ও হিংস্র হয়ে উঠলো।

প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেয়ার কারণে মিকদাদের ওপরও নেমে এলো কাফেরদের নির্যাতনের অগ্নিবৃষ্টি। মুষলধারায়।

রাসূল (সা)!

এক দয়ার সাগর।

তিনি তাঁর প্রিয় সাহাবীর এই নির্যাতন দেখছেন।

নবীজীর (সা) বুকটা বেদনায় ভারী হয়ে উঠলো। তিনি মিকদাদকে হিজরতের নির্দেশ দিলেন।

রাসূলের (সা) নির্দেশেই হিজরতে বাধ্য হলেন মিকদাদ।

হিজরী দ্বিতীয় সন।

এই সময়ই শিরক ও তাওহীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ‍শুরু হলো।

কুরাইশ বাহিনী পৌঁছে গেল বদর প্রান্তর।

রাসূল (সা) বুঝলেন, সামনেই কঠিন সময়।

তিনিও বদর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন তাঁর প্রিয় সাথীদের।

এটা ছিল সাহাবীদের জন্য প্রথম পরীক্ষার ক্ষেত্র।

সেনাপতি স্বয়ং রাসূল (সা)। তিনি তাঁর প্রিয় সাথীদের ঈমানের পরীক্ষা নিতে চাইলেন যুদ্ধে যাবার আগেই।

রাসূল (সা) পরামর্শ চাইলেন সাহাবীদের কাছ থেকে। যুদ্ধের ব্যাপারে।

উপস্থিত সাহাবীরা তাদের নিজ নিজ অভিমত ও রণকৌশল অপকটে ব্যক্ত করলেন রাসূলের (সা) সামনে।

হযরত আবু বকর ও হযরত উমর ফারুক (রা) সহ সকলেই তাদের আত্মত্যাগ ও কুরবানীর বিরল দৃষ্টন্ত স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করলো।

মিকদাদও উপস্থিত আছে ন। এবার তার পালা।

তিনি এবার এক আবেগময় ভাষণে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সাথে আছি। আল্লাহর কসম! বনী ইসরাইলরা তাদের নবী মূসাকে (আ) বলেছিল: ‘তুমি ও তোমার রব দু’জন যাও এবং যুদ্ধ কর। আর আমরা এখানে বসে থাকি।’।– আমরা আপনাকে তেমন কথা বলবো না। বরং আমরা আপনাকে বলবো: আপনি ও আপনার রব দু’জন যান ও তাদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরাও আপনাদের সাথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। যিনি সত্যসহ আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই সত্তার কসম! আপনি যদি আমাদের ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত নিয়ে যান, আমরা আপনার সাথে যাব এবং আপনার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। আমরা আপনার ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে সকল দিক থেকে যুদ্ধ করবো। যতক্ষণ না আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করেন।”

মিকদাদের এই দুঃসাহসী উচ্চারণে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো রাসূলেল (সা) চেহারা মুবারক।

শুরু হলো বদর যুদ্ধ।

সত্যিই মিকদাদ তার সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন যুদ্ধের ময়দানে।

শত্রুর মুকাবেলায় সেদিন বদরপ্রান্তে মিকদাদ ছিলেন দুর্দান্ত এক সাহসের ফুলকি। বিদ্যুতের ফলা।

বদর যুদ্ধেই মিকদাদই ছিলেন অশ্বারোহী মুজাহিদ। এ কারণে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে:

“একমতা মিকদাদই সর্বপ্রথম আল্লাহর রাস্তায় তার ঘোড়া ছুটিয়েছেন।”

এটা তার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। বলা যায় এক বিরল সম্মাননাও।

বদর ছাড়াও, খন্দকসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে মিকদাদ অংশগ্রহণ করেছেন। আর প্রতিটি যুদ্ধে রেখে গেছেন তার সাহস, ত্যাগ ও  কুরবানীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

হযরত খুবাইবকে মক্কার কুরাইশরা শূলে চরিয় হত্যা করলো নৃশংসভাবে। খুবাইবের (রা) লাশ রাতের আঁধারে শূল থেকে নামিয়ে আনার জন্য রাসূল (সা) পাঠালেন যুবাইর ও মিকদাদকে।

তারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রাসূলেল (সা) নির্দেশ পালনে ছুটে গেলেন এবং সত্যি সত্যিই রাতের আঁধারে খুবাইবের লাশ শূল থেকে নামিয়ে ঘোড়ার পিঠে রওয়ানা দিলেন।

এ ধরনের দুঃসাহস ও ত্যাগের নজির মিকদাদের জীবনে রয়ে গেছে অজস্র।

ইসলাম গ্রহণের কারণে মুখোমুখি হয়েছেন অভাব ও দারিদ্রের। সহ্য করেছেন সীমাহীন নির্যাতন।

জীবনে নেমে এসেছে কত ধরনের অগ্নি-পরীক্ষা!

তবুও।–

তবুও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এতটুকু টলেনি তার ঈমানের পর্বত। কেন টলবে?

তিনি তো তার জীবনের জন্য একমাত্র আল্লাহ ও রাসূলকেই গ্রহণ করেছিলেন।

সুতরাং তার আর কীসের ভয়? কীসের পরওয়া?

হযরত মিকদাদ!-

মূলত তিনি ছিলেন রাসূলের আদর্শে উজ্জীবিত, ইসলামের এক মহান সাহসী সৈনিক।

আর আমাদের কাছে তো তিনি রয়ে গেছেন প্রেরণার এক জ্বলন্ত উপমা। সাহসের সেনালি সৈকত। বারুদের তুমুল বৃষ্টি।

 

– মোশাররফ হোসেন খান

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button