সাহসী মানুষের গল্প

পরম পাওয়া

তখনও সূর্য ওঠেনি ইসলামের।

তখনও অন্ধকারে তলিয়ে মক্কা, মদীনাসহ গোটা পৃথিবী।

কিন্তু এই অন্ধকার আর কতকাল চলবে? এর অবসান হওয়া চাই।

আল্লাহ বড়ই মেহেরবান।

তিনি মানুষের মুক্তির যুগে যুগে, কালে কালে পাঠান তার এই প্রিয় পৃথিবীতে শান্তির বারতা নিয়ে আলোর মানুষ।

হযরত ঈসার (আ) পর তো বহুকাল কেটে গেল।

মানুষ তখন ভুলে বসে আছে তার দেখানো পথের কথা। আর জড়িয়ে পড়েছে হাজারো পাপের সাথে।

পাপে আর পাপে গোটা পৃথিবী কলুষিত হয়ে উঠেছে।

এই পাপ আর অন্ধকার দূর করার জন্যই মহান আল্লাহ পাঠালেন তার প্রিয় নবী মুহাম্মদকে (সা)।

মক্কাকর একটি জীর্ণ কুটিরে সহসা বয়ে গেল আলোর বন্যা।

শুধুই কি মক্কায়?

না। গোটা পৃথিবীতেই পৌছে গেল এই খুশির বারতা।

হ্যাঁ। এসেছেন! এসেছেন আলোকের সেনাপতি সুন্দর ভুবনে।

এবার তো কেবল আলোর খেলা!

জোছনার ঝলকানি!

কেন নয়!

আল্লাহ পাকই তো প্রিয় রাসুলকে (সা) সেই আলোকজ্জ্বল এক আশ্চর্য প্রদীপ হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ পাক যে তার বান্দাকে বড় বেশি ভালোবাসেন। তিনিই তো বান্দার অতি আপন। একান্ত কাছের।

নবুওয়ত প্রাপ্তির পর রাসূল (সা) ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শতগুণে।

ঝর্ণধারার মত গড়িয়ে তার তার প্রহরগুলো। আর বাতাসের বেগে ছুটে বেড়ান তিনি এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে।

একটিই উদ্দেশ্য তাঁর।–

কিসে হবে মানুষের মুক্তি।

কিসে আসবে শান্তি ও শৃঙ্খলা।

কিসে বইবে প্রতিটি মানুরে মনে আলোকিত বন্যা। কিসে!

সেসব কেবল আল্লাহর দেয়া আল কুরআনেই মৌচাকের মধুর মত জমা হয়ে আছে।

আল কুরআন!

এই এক আশ্চর্য জাদুর মৌচাক।

সেখানে কেবল সমাধানের সুপেয় মধু আর মধু। যা কখনো নিঃশেষ হবার নয়।

মক্কায় তখন চলছে  কুরআনের চর্চা। সেখানে সর্বত্র চলছে এর প্রচার ও প্রসারের কাজ।

ইসলামের একদল জানাজ মুজাহিদ মৌমাছির মত মিশে আছেন রাসূলের (সা) সাথে।

যারাই আসেনসেদিকে, তারাই পথ পেয়ে যান।

কী সেই আলোকিত ঝলমল পথ!

কী সেই সুখ ও শান্তির পথ!

দুনিয়ার ধন-দৌলত আর রাজপ্রাসাদ অতি তুচ্ছ সেই সুখের কাছে।

সে যে আখিরাতের সওদা।

যেখানেকেবলই শান্তি আর শান্তি।

যারা সৌভাগ্যবান, তারা সমবেত হয়েছেন রাসূলের (সা) চারপাশে।

মক্কায় তখন চলছে আল কুরআনের চাষবাস।

জমিনটা খুব উর্বর নয়।

তবুও তো চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই রাসূলের (সা)। ক্লান্তি নেই তাঁর পরিশ্রমী মহান সাথীদেরও।

মদীনা তখনো অন্ধকারে তলিয়ে আছে।

সেখানে তখনো পৌঁছেনি নবীর (সা) কোনো আলোক ধারা।

সেখানকার মানুষ আগের মতই রয়ে গেছে তুমুল অন্ধকারে।

ব্যক্তিগত-ব্যক্তিতে ঝগড়া-বিবাচ। গোত্রে-গোত্রে কেবল মারামারি আর অশান্তি।

সামান্য বিরোধ নিয়েও ঘটে যায় তুমুল কাণ্ড। রক্তারক্তি।

মদীনা তখনো অশান্তির সাগরে কেবলি হাবুডুবু খাচ্ছে।

তারা সেই দুঃসহ যাতনা থেকে মুক্তি চায়। মুক্তি চায় যাবতীয় অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা থেকে।

কিন্তু কিভাবে?

সেটা তখনো তারা জেনে-বুঝে উঠতে পারেনি।

ঠিক এমনি এক সময়।–

মদীনার আসয়াদ ইবনে যুরারা এবংজাকওয়ান ইবনে আরবদিল কায়স তাদের একটি ঝগড়া মীমাংসার জন্য এলেন মক্কায়।

তাদের বিবাধ মীমাংসা করবেন মক্কার কুরাইশ গোত্রের বিখ্যাত নেতা উতবা ইবন রাবী’য়া।

উতবার কাছে তারা তাদের সমস্যার কথা বিশদভাবে বললেন।

তাদের কথা শুন উতবা তাদের জন্য একটি মীমাংসার পথও বাতলে দিলেন।

কিন্তু বিষয় সেটা নয়।–

রহস্যটা লুকিয়ে আছে অন্যখানে।

কথায় কথায় উতবার কাছেই শুনলেন তারা মুহাম্মদের (সা) কথা। শুনলেন আল কুরআনের কথা।

শুনার পর থেকেই তাদের মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো বিষয়টি সম্পর্কে আরো জানার জন্য।

মক্কায় তখনো প্রকাশ্যে ইসলামের কাজ চালানো সম্ভব হয়নি।

চলছে গোপনে গোপনে।

আল কুরআনের বাণীও মানুষের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে সেইভাবে। সন্তর্পণে। রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে-সর্বত্রই চলছে দাওয়াতের এমনি গোপন মিশন।

আসয়াদ ও জাকওয়ান।

দু’জনই বুদ্ধিমান।

তারা গোপনে চলে গেলেন দয়ার নবীজী মুহাম্মাদের (সা) কাছে।

অতি গোপনে।

মক্কার দুষ্টু লোকদের সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল পূর্ব থেকেই।

তারা জানতেন এই সকল দুষ্ট লোকদের নির্মমতার খবর। এইজন্যই তারা গোপনীয়তার আশ্রয় নিলেন।

আসয়াদ এবং জাকওয়ানকে কাছে পেয়ে খুবই খুশি হলেন দয়ার নবীজী (সা)। একে তো তারা নতুন, যারা আসছেন আলোর পথে। আবার তারা ভিন্ন শহরের, মদীনার মানুষ।

সুতরাং খুশির কথাই বটে।

কারণ এখন থেকে মক্কার বাইরে- মদীনায়ও আল কুরআনের প্রচার-প্রসারের কাজ চলবে। আল্লাহর রহমত এবং বরকত তো এইভঅবেই আসে। অপ্রত্যাশিতাবে হয়তো বা পাওয়া যায় তাঁর সেই করুণার বৃষ্টি।

আসয়াদ এবং জাকওয়ান রাসূলের (সা) কাছ থেকে আল কুরআনের কিছু অংশ শুনলেন। তাদের ভীষণ ভালো লাগলো। বুছলেন, আরে! এই তো সেইপথ- যে পথের সন্ধানে আমরা ঘুরেছি সারাটি জীবন যাযাবরের মত। তবে আর দেরি কেন!

না, দেরি নয়। মুহূর্তেই তারা দু’জনই রাসূলের (সা) কাছে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এবং তারপর-

তারপর তারা উতবার কাছে আর না গিয়ে ফিরে গেলেন আপন জন্মভূমি মদীনায়।

তাদের মনটা তখন ঢেউ টলোমল পদ্মদীঘি।

বৃষ্টি ধোয়া বলুর উঠোন।

পুকুর পাড়ের সবুজ চাতাল।

কী যে প্রশান্তি!

কী যে আরাম!

এ অপার্থিব ফুরফুরে বেহেশতি হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তাদের হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

তারা তখন ভীষণভাবে উজ্জীবিত এবং উদ্বেলিত।

মদীনায় ফিরে দু’জনই লেগে গেলেন ইসলামের খেদমতে।

আল কুরআনের প্রচার প্রসারই তাদের তখন প্রধান কাজ।

রাসূলের বাণী অন্যের কাছে তুলে ধরাই তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেম্য।

সুতরাং আর নয় মারামারি। আর নয় হানাহানি। এবার চির শান্তি ও কল্যাণের পথে কেবলই হাঁটার পালা।

হাঁটছেন আসয়াদ। হাঁটছেন জাকওয়ান।

হাঁটছেন আল্লাহ পথে।

আল কুরআনের পথে।

রাসূলের (সা) নির্দেশিত পথে।

ফলে তাদের আর শঙ্কা কিসের?

কিসের আর ভয়?

মদীনা!

চমৎকার একটি শহর।

ইসলামের জন্যও একটি প্রশস্ত উর্বর ক্ষেত্র। কী সৌভাগ্যবান এই দু’জন। তারাই প্রথম মদীনায় ইসলাম প্রচারের সৌভাগ্য অর্জন করলেন!

এই দু’জনের মধ্যে আসয়াদের (রা) সৌভাগ্যের বিষয়টি আর একটু ভিন্ন।

হযরত আসয়াদ মদীনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সেই সাথে তিনি নামাযের ইমামতিও করে যাচ্ছেন প্রতিটি দিন।

যতদিন না রাসূল (সা) মুসায়বকে (রা) মদীনায় দীন প্রচারের জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে পাঠালেন, ততোদিনই মদীনার প্রতিটি নামাযের ইমামতি করেছেন আসয়াদ।

কী সৌভাগ্যবান তিনি!

মুসয়াবকে কাছে পেয়ে আনন্দে বাগবাগ হয়ে উঠলেন আসয়াদ।

এবার মুসয়াবের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে দু’জনের দীনের দাওয়াতের কাজ আরো বেগবান করে তুললেন।

তার মনের স্পৃহা এবং শক্তিও বেড়ে গেল বহুগুণে।

আসয়াদ এবং মুসয়াবের সম্মিলিত দাওয়াতের ফলে মাত্র এক বছর পর নবুওয়াতের দ্বাদশ বছরে হজের মৌসুমে তিয়াত্তার, মতান্তরে পঁচাত্তর জন্য নারী-পুরুষ মদীনা থেকে এলেন।

ইসলামের এই বিশাল বাহিনীটি মিনার আকাবায়ে গোপনে মিলিত হন দয়ার নবীজীর (সা) সাথে।

তৃতীয় এবং সর্বশেষ এই আকাবায় শামিল হয়েছিলেন আসয়াদও।

এই আকাবায় রাসূলের (সা) হাতে হাত রেখে সর্বপ্রথম যিনি বাইয়াত বা শপথ গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন, তিনিই হযরত আসয়াদ।

বাইয়াতের পর রাসুল (সা) মদীনায় দীনি দাওয়াতের জন্য নকীব বা দায়িত্বশীল নির্বাচন করলেন।

রাসূলের (সা) সেই নির্বাচিত প্রথম নকীব হলেন হযরত আসয়াদ।

মাঝখানে কালের পিঠে গড়িয়ে গেল বেশ কিছুটা কাল।

নবী (সা) যাচ্ছেন মদীনায়।

মদীনার আকাশে-বাতাসে ভেসে যাচ্ছে খুশির কলধ্বনি।

ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ।

সবাই অপেক্ষায় আছেন রাসূলের (সা) আগমনের দিকে। সবাই পিপাসিত দয়ার নবীজীকে (সা) স্বাগত জানানোর জন্য।

রাসূল (সা) এলেন মদীনায়।

মুহূর্তেই মুখরিত হয়ে উঠলো গোটা মদীনা।

কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্যখানে।

সেটা হলো, কে হবেন সেই সৌভাগ্যবান! যিনি নবীজীকে (সা) নিতে পারবেনতার বাসগৃহে?

এ নিয়ে দেখা দিল তাদের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা।

অবশেষে মীমাংসা হলো একটি শর্তে। রাসূলেল (সা) বাহন যার বাড়িতে এসে থামবে, তিনিই হবেন রাসূলকে (সা) বাড়িতে নেবার জন্য উপযুক্ত। সুতরাং এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি নয়। থেমে গেল প্রতিযোগিতার পালা।

কিন্তু থামে না উৎকণ্ঠার মরুঝড়।

সেটা বয়ে চলেছে মদীনার প্রতিটি নবীপ্রিয় মুমিনের হৃদয়েই।

অবশেষে থেমে গেল রাসূলেল (সা) বাহন। আবু আইউব আল আনসারীর বাড়ির সামনে।

ফলে আবু আইউবই হয়ে গেলেন রাসূলকে (সা) বাড়িতে নেবার সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি!

কিন্তু আসয়াদ!

তিনি তো কম সৌভাগ্যবান নন।

রাসূলকে (সা) তার বাড়িতে নেবার সৌভাগ্য হলো না ঠিকই, কিন্তু সেই বেদনার কুয়া কিছুটা পূর্ণ হলো খুশির বৃষ্টিতে। কারণ রাসূল (সা) আছেন আবু আইউবের বাড়িতে। আর রাসূলেল (সা) প্রিয় বাহন- উটনীটির দায়ত্বভার রয়ে গেল আসয়াদের ওপর।

হোক না উটনী!

তবু তো রাসূলের (সা) বাহন! সুতরাং এই মেহমানও তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান। মর্যাদার দিক থেকেও তো যথেষ্ট। আসয়াদ তার এই সৌভাগ্যে খুশি হলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায়করলেন।

হযরত আসয়াদ!

মক্কায় এসেছিলেন একটা ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসার জন্য।

আর মক্কা থেকে ফিরে গেলেন জীবনের মীমাংসা বুকে চেপে।

এবং কী আশ্চর্য!

বাকি সারাটি জীবনই তিনি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য খেদমত করে গেছেন ইসলামের। সেই সাথে রসূলের (সা)।

এটাই ছিল আসয়াদের (রা) জীবনে পরম পাওয়া।

হযরত আসয়াদ!

তিনি আল্লাহকে পেয়েছেন।

আলোকিত জীবনের জন্য দীনকে পেয়েছেন। পেয়েছেন প্রাণপ্রিয় রাসূলের (সা) সান্নিধ্য, ভালোবাসা এবং অশেষ দোয়া।

তার মত সৌভাগ্যের পরশে ধন্য হতে কার না ইচ্ছা জাগে?

নিজের জীবনকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিলে, আর রাসূলকে (সা) চরম ও পরমপ্রিয় করে নিতে পারলেই আমরাও অর্জন করতে পার ঝলমলে সোনালি সৌভাগ্য।

সেটাই তো হওয়া উচিত আমাদের চাওয়া-পাওয়া একমাত্র মূল উৎসধারা।

 

– মোশাররফ হোসেন খান

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button