সাহসী মানুষের গল্প

বৈরী বাতাসে সাঁতার

দু’জনেই বেড়ে উঠছেন একই সাথে।

দু’জনের বয়স প্রায় একই।

তবুও একজন চলেছেন আলোকিত সূর্যের পথে।

আর অপর জনের পথটি ভয়ানক পিচ্ছিল্ চারপাশ থকথক করছে এক দুর্বিসহ গাঢ় অন্ধকার।

দু’জন পরম আত্মীয়।

সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা।

কিন্তু তখনও দু’জনের পথ বয়ে গেছে দুই দিকে। একজন- প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)।

আর অপরজন- আব্বাস ইবনুল মুত্তালিব।

ইসলামের দাওয়াত তখন চলছে প্রকাশ্যভাবে।

রাসূল (সা) সবাইকে ডাকছেন- আল্লাহর পথে। ইসলামের পথে। সত্যের পথে।

তাঁর আহবানে একে একে ভারী হয়ে উঠছে মুসলমানদের সংখ্যা।

অন্ধকার থেকে ফিরে আসছে তারা আলোর পথে। বুকটা জুড়িয়ে নিচ্ছে ঈমানের শীতল পানিতে।

আহ্‌ কী আরাম!

বহুকালের তৃষিত হৃদয় তাদের মুহূর্তেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

চাচা আব্বাস।–

তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন ভাতিজা মুহাম্মদকে (সা)।

কিন্তু তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই বলে মক্কার অন্যান্য হিংস্রদের মত তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়েও আসেননি। কোনোদিন বার করেননি তার ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের নখর।

আশর্যের কথাই বটে!

নিজে ইসলাম গ্রহণ না করেও তিনি সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন রাসূলকে (সা)।

বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ইসলামের দাওয়াত চারপাশে ছড়িয়ে দেবার জন্য।

তার সাহায্য-সহযোগিতার সেই দৃষ্টান্তও ছিল বিস্ময়কর।

হজ্বের মৌসুম।

মদীনা থেকে বাহাত্তর জন আনসার মক্কায় এলেন। তারা একত্রিত হয়েছেন মিনার একটি গোপন শিবিরে।

সবাই রাসূলের (সা) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে আহ্বান জানালেন:

হে দয়ার নবীজী! মক্কাবাসীরা আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। চলুন, আপনি আমাদের সাথে মদীনায় চলুন। আমরা আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি।

আব্বাস তখনও মুসলমান হননি।

কিন্তু অবাক কাণ্ড!

তিনিও উপস্থিত ছিলেন এই গোপন শিবিরে।

আনসারদের আহ্বান খুব মন দিয়ে শুনরেন আব্বাস। তারপর তাদেরকে বললেন:

“হে খাযরাজ কওমের লোকেরা!

আপনাদের জানা আছে, মুহাম্মদ (সা) স্বীয় গোত্রের মধ্যে সম্মান ও মর্যাদার সাথেই আছেন। শত্রুর মুকাবেলায় সর্বক্ষণ নামরা তাঁকে হেফাজত করেছি। এখন তিনি আপনাদের কাছে যেতে চান। যদি আপনারা জীবনবাজি রেখে তাঁকে সহায়তা করতে পারেন তাহলে খুবই ভাল কথা অন্যধায় এখনই সাফ সাফ বলে দিন।”

থামলেন আব্বাস।

তার কথাটা গুরুত্বের সাথে ভাবলেন তারা। তারপর বললেন, হ্যাঁ! আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছি। রাসূল (সা) আমাদের কাছে পূর্ণ হিফাজতেই থাকবেন। আমরা তো আছিই তাঁর চারপাশে।

তাদের আশ্বাসের মধ্যে ছিল না কোনো খাঁদ। ছিল না কোনো ফঅঁকি বা  চালাকিও।

এর কিছুদিন পরই নবী (সা) হিজরতের অনুমতি পেলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে। দয়ার নবীজী মক্কা ছেড়ে চলে গেলেন মদীনায়।

নবীজী মদীনায় আছেন।

ইতোমধ্যে বদর যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।

আব্বাস তখন মক্কায়।

কী নির্মম পরিহাস!

মক্কার কুরাইশদের অবর্ণনীয় চাপের মুখে আব্বাসকেও রাসূলের (সা) প্রতিপক্ষ লড়াই করতে যেতে হলো বদর প্রান্তরে।

কী নিষ্ঠুর দৃশ্য!

প্রাণপ্রিয় ভাতিজার বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতে হচ্ছে চাচা আব্বাসকে!

কিছুতেই তিনি এটা মেনে নিতে পারছেন না।

পরিস্থিতি এমনই যে তিনি অন্য কিছু করতেও পারছেন না। সেই এক কঠিনতম অবস্থা!

বদর মানেই তো কঠিন পরীক্ষার ক্ষেত্র।

যুদ্ধ চলছে তুমুল গতিতে।

যুদ্ধ চলছে মুসলিম আর মুশরিকদের মধ্যে।

কিন্তু আল্লাহর রহমতে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে বিজয়ী হলেন- সত্যের সৈনিক মুসলিম বাহিনী।

বদরে মুশরিকের সাথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আব্বাস কেন যোগ দিয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণ জানতেন দয়ার নবীজী। এজন্য তিনি আগেই বলে রেখেছিলেণ তাঁর সাথীদেরকে- “যুদ্ধের সময় আব্বাস বা বনু হাশিমের কেউ সামনে পড়লে তাদেরকে হত্যা করবে না।’ কারণ, জোরপূর্বক তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনা হয়েছে।”

যুদ্ধ শেষ।

মুসলমানদের হাতে বন্দী হলেণ মুশরিকদের সাথে আব্বাস, আকীল ও নাওফিল ইবনে হারিস।

নিয়ম অনুযায়ী সকল বন্দীকেই বেঁধে রাখা হয়েছে। তার ভেতরে আছেন আব্বাসও।

কিন্তু অন্যদের চেয়ে আব্বাসের বাঁধনটি ছিল অনেক বেশি শক্ত। এত শক্তভাবে তাকে বাঁধা হয়েছিল যে তিনি বেদনায় কেবলই কঁকিয়ে উঠছিলেন।

রাতে ঘুমিয়ে আছেন নবী মুহাম্মদ (সা)!

হঠাৎ এক কাতর কণ্ঠের আর্তচিৎকারে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল।

সাহাবারা রাসূলের (সা) ঘুমের ব্যাঘাতের কথা ভেবে আব্বাসের বাঁধনটা ঢিলা করে দিলেন।

থেমে গেল তার যন্ত্রণাদায়ক কঁকানি।

রাসুল জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপর! আর কোনো কাতর কণ্ঠস্বর শুনছি না কেন?

তারা বললেন, বাঁধন ঢিলা করে দিয়েছি।

রাসূল (সা) সাথে সাথে নির্দেশ দিলেন: “সকল বন্দীর বাঁধনই ঢিলা করে দাও।”

ইনসাফ আর ইহসান কাকে চলে? রাসূলই (সা) তার উত্তম নিদর্শন।

বদর যুদ্ধে বন্দীদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত হলো।

আব্বাসের আম্বা ছিলেন মদীনার আনসার গোত্র খাযরাজের কন্যা। এই কারণে খাযরাজ গোত্রের সবাই রাসূলের (সা) কাছে অনুরোধ করলো:

“আব্বাস তো আমাদেরই ভাগ্নে। আমরা তার মুক্তিপণ মাফ করে দিচ্ছি।”

তাদের প্রস্তাব একবাক্যে নাকচ করে দিলেন রাসুল। বললেন, না! তা কখনই হতে পারে না। কারণ এটা সাম্যের খেলাফ। বরং তিনি আব্বাসে মুক্তিপণের পরিমাণটা একটু বেশিই করে দিলেন। কারণ তিনি জানতেন, সেই অর্থ পরিশোধ করার ক্ষমতা তার আছে।

এত অর্থ?

বিস্মিত হয়ে আব্বাস অনুনয়-বিনয়ের সাথে তার অক্ষমতা প্রকাশ করলেন, “আমি তো অন্তর থেকে আগেই মুসলমান হয়েছিলাম। মুশরিকরা আমাকে বাধ্য করেছে এই যুদ্ধে অংশ নিতে।”

আব্বাসের কথা শুনে রাসুল (সা) বলরেণ:

“অন্তরের অবস্থা আল্লাহপাকই ভাল জানেন। আপনার দাবি সত্য হলে আল্লাহই তার প্রতিদান দেবেন। তবে বাহ্যিক অবস্থার বিচারে আপনাকে কোনো প্রকার সুবিধা দেয়া যাবে না। আর মুক্তিপণ আদায়ে আপনার অক্ষমতাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আমি জানি মক্কার উম্মুল ফজলের কাছে আপনি মোটা অংকের অর্থ রেখে এসেছেন।”

রাসূলের একথা শুনে আব্বাস বিস্ময়ের সাথে বললেন, “আল্লহর কসম! আমি ও উম্মুল ফজল ছাড়া আর কেউ এই অর্থের কথা জানে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, আপনি আল্লাহর রাসূল।”

সত্যি সত্য্ তিনি নিজের, ভাতুষউত্র আকীল এবং নাওফিল ইবনে হারিসের পক্ষ থেকে মোটা অংকের মক্তিপণ আদায় করে বন্দিদগশা থেকে মুক্তি লাভ করলেন।

মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে হযরত আব্বাস সপরিবারে মদীনায় হিজরত করলেন।

রাসূলের (সা) খেদমতে হাজির হয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দিলেন। সেই সাথে তিনি মদীনায় স্থায়ীভাবে বসবাসও শুরু করলেন।

হযরত আব্বাস।–

সেই আব্বাস এখন বদলে গেছেন সম্পূর্ণ।

ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলামের খেদমতে।

মক্কা বিজয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।

হুনাইনের অভিযানে রাসূলের (সা) সাথে একই বাহনে আরোহী ছিলেন তিনি।

কী বৌভাগ্য তার!

বাহনের পিঠে বসেই তিনি বললেন:

“এ যুদ্ধে কাফেরদের জয় হলো এবং মুসলিম মুজাহিদরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো।”

রাসূল (সা) বললেন: “আব্বাস! তীরন্দাজদের আওয়াজ দাও।”

আব্বাস আওয়াজ দিলেন জোর গলায়: ‘তীরন্দাজরা কোথায়?’…

কী আশ্চর্য!

আব্বাসের এই তীব্র আওয়াজের সাথে সাথেই ঘুরে গেল যুদ্ধের মোড়।

শুধু হুনাইন নয়।

তায়েফ অবরোধ, তাবুক অভিযান এবং বিদায় হজেও অংশ নিয়েছিলেন দুঃসাহসী আব্বাস।

দুঃসাহসী, কিন্তু তিনিই আবা সত্যের পক্ষে কোমল। কোমল এবং বিনয়ী। আব্বাস ছিলেন অত্যন্ত দানশীল, অতিথিপরায়ংণ ও দয়ালু এক অসামান্য সোনার মানুষ।

তার সম্পর্কে হযরত দা’দও বলেছৈন:

“আব্বাস হলেন আল্লাহর রাসূলের চাচা, কুরাইশদের মধ্যে সর্বাধিক দরাজ দিল এবং আত্ময়িস্বজনের প্রতি অধিক মনোযোগী। তিনি ছিলেন কোমল অন্তরবিশিষ্ট। দুআর জন্য হাত উঠালেই তার দুই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তো কেবল অশ্রুর বন্যা। এই কারণে তার দুআর একটি বিশেষ আছরও লক্ষ্য করা যেত।”

আর মর্যাদার দিকে দিয়ে?

মর্যাদার দিক দিয়ে আব্বাস ছিলেন অসাধারণ।

স্বয়ং রাসূলে কারীমও চাচা আব্বাসকে খুব সম্মান করতেন। তার সামান্য কষ্টকেও দুঃখ পেতেন দয়ার নবীজী (সা)।

একবার কুরাইশদের একটি রূঢ় আচরণ সম্পর্কে রাসূলের কাছে আব্বাস অভিযোগ করলে রাসূল ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন:

“সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন! যে ব্যীক্ত আল্লাহ ও রাসূলের জন্য আপনাদের ভালোবাসেন না, তার অন্তরে ঈমানের নূর থাকবে না।”

হযরত আব্বাসকে এমনই ভালোবাসতেন আর শ্রদ্ধা করতেন রাসল (সা)। কী অতুলনীয় রাসূলের সেই ভালোবাসা আর সম্মানের নিদর্শন!

একবার রাসুল (সা) একটি বৈঠকে কথা বলছেন হযরত আবু বকর এবং উমরের (রা) সাথে।

এমন সময় সেখান উপস্থিত হলেন হযরত আব্বাস।

চাচাকে দেখেই রাসূল (সা) তাকে নিজের ও আবু বকরের মাঝখানে বসালেন। আর তখনই রাসুল (সা) তাঁর কণ্ঠস্বর একটু নিচু করে কথা বলা শুরু করলেন।

আব্বাস চলে গেলেন।

আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, “হে রাসূল! এমনটি করলেন কেন?”

রাসূল (সা) বললেন:

জিব্রাঈল আমাকে বলেছেন, “আব্বাস উপস্থিত হলে আমি যেন আমার কণ্ঠস্বর নিচু করে, যেমন আমার সামনে তোমাদের কণ্ঠস্বর নিচু করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন।”

রাসূলে কারীমের (সা) পর, পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেধীন ও হযরত আব্বাসের মর্যাদা এবং সম্মানের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক।

হযরত উমর এবং হযরত উসমান (রা) ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার সম্মানার্থে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন। বলতেন, “ইনি হচ্ছেন রাসূলের (সা) চাচা।”

হযরত আবু বকর একমাত্র আব্বাসকেই নিজের আসন থেকে সরে গিয়ে স্থান করে দিতেন।

হযরত আব্বাস!-

সাগর সমান এই মর্যাদা আর সম্মান কি তার এমনিতেই এসেছে?

এই মর্যাদা অর্জন করতে গিয়ে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ঈমানের বিশাল দরিয়া। আর টপকাতে হয়েছে তার একের পর এক আগুন এবং ধৈর্যের উপত্যক।

বৈরী বাতাসে সাঁতার কেটেই তো এক সময় এভাবে পৌঁছানো যায় প্রশান্ত এবং আলোকিত এক নির্ভরতার উপকূলে!

 

– মোশাররফ হোসেন খান

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button