সচেতনতা

Edge (প্রান্ত)

চাকরি নেই? কাজ নেই? আসলেই?

কিছুটা দুঃখ নিয়েই লিখতে হচ্ছে — ব্যাপারটা মানতে পারি না। গড়ে প্রতি মাসে দুজন আমার কাছে কাজের জন্য লোক চান। গড়ে প্রতিমাসে দশজন আমার কাছে কাজ চান।

মনে হতে পারে, দশ জন কাজ করতে আগ্রহী, অথচ কাজ দিতে আগ্রহী দুজন–তাহলে তো আসলেই কাজের অভাব।

কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, অভাবটা আসলে কাজের না, সক্ষমতার। যেমন এক মাস আগে একভাই ইংরেজি থেকে কিছু টেকনিকাল পেপার অনুবাদের জন্য মানুষ চেয়েছিলেন। সাথে সম্পাদনার কিছু কাজ-ও যেন করতে পারে। যোগ্যতা অনুসারে বেতন–তবে হাজার দশেক দেবেন অন্তত।

আমার কাছে যে সিভিগুলো জমা আছে একটাও তাকে দেওয়ার মতো নয়। কাজ আছে, কিন্তু কাজের লোক নেই।

গতকাল একজনের সাথে দেখা হলো। তিনি শিক্ষক। আগে যে স্কুলে চাকরি করতেন সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বেকার। জিজ্ঞেস করলাম অ্যাকটিভিটি বেসড লারনিং নিয়ে কিছু জানেন? অথবা সেলফ অরগানাইজড লারনিং এনভারমেন্টের ব্যাপারে কিছু?

উনি বললেন, এসব নাকি উনার লাগত না।

আমরা একজন মানুষ খুঁজছি, যাকে দিয়ে আমরা একটা কারিকুলাম কীভাবে বাচ্চারা আগ্রহ নিয়ে পড়বে সেটা গবেষণা করব। বাচ্চারা কিছু জিনিস মুখস্থ করবে – যেমন কুরআন, আবার কিছু জিনিস কাজ করতে করতে শিখবে – যেমন অযুর নিয়ম। বাংলাদেশের অধিকাংশ মক্তবে নূরানী পদ্ধতিতে সুর করে অযুর নিয়ম মুখস্থ করানো হয়। এটা অপ্রয়োজনীয়। প্রতিদিন মক্তবে এসে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অযু করে দুই রাকাত সলাত আদায় করলে সে যেমন আমলটা শিখবে–তেমন নিয়ম-ও শিখবে। শুধুই সুর করে মাসআলা মুখস্থ করে না দুনিয়াতে লাভ হবে, না আখিরাতে।

জানেন আমরা কী খুঁজছি? বিএড? এমএড? না। ইন্টার পাশ হলেই চলবে। তবে, পড়াশোনাতে আগ্রহ থাকতে হবে। পড়তে এবং পড়াতে ব্যাপক উৎসাহ থাকতে হবে। সে আমাদের সাথে কাজ করবে, পাশাপাশি অবসর সময়ে ব্যাচেলরস ডিগ্রি নিতে পারে। নিলেও সমস্যা নেই, না নিলেও সমস্যা নেই। ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটিতে বিএড ডিগ্রি আছে। সেখানে বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কোর্স আছে। আমরা এমন মানুষ চাই যে নিজের ইচ্ছাতে এই কোর্সগুলো করবে।

যার নিজের শেখার আগ্রহ নেই, সে বাচ্চাদের মধ্যে শেখার আগ্রহ তৈরি করবে কীভাবে?

আমরা খুঁজছি একজন মুসলিম যে শিশু শিক্ষার ব্যাপারে প্যাশনেট। সে তার জীবনের অর্থ খুঁজে পায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে শেখানোতে। সে চাকরি করবে না, কাজ করবে। একেবারে বাক্সের বাইরের নিয়মে সে মাদ্রাসার বাচ্চাদের পড়াতে চাইবে। এমন শিক্ষা দিতে চাইবে যেটা ছাত্রের বুকের ভেতর থাকবে আজীবন।

এই বাংলাদেশে কত বেকার ছেলে — অথচ এমন কাউকে পাই না, যে এই বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জটা নেবে। নেট ঘেটে মন্টেসারি আর সোলের শেখানোর সিস্টেমগুলো জেনে নেবে। এরপর বাচ্চাদের উপর সেই শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করবে। তারপর বাচ্চাদের শেখার অবস্থা দেখে দরকারমাফিক ডেলিভারি মেথড বদলে নেবে।

পাই না মানুষ। সবাই ফেসবুকার। ফেসবুকিং করবেন না, তা বলছি না। বলছি, কাজ তো কিছু করুন!

ভাইয়েরা, যারা চাকরি চান কিন্তু পাচ্ছেন না, তারা নিজেরা নিজেদের জিজ্ঞেস করুন, আপনার edge কী? একটা ঘরে বিশজন চাকরিপ্রার্থী আছে, আপনি তাদের চেয়ে কীসে আলাদা? কী পারেন আপনি যেটা তারা পারে না?

ধরুন, আপনার পড়াশোনা মার্কেটিং –এ। আপনি ভিডিও এডিটিং করতে পারেন যেটা আদতে মার্কেটিং এর বিষয় নয়। কিন্তু মার্কেটিং এর একটা বড় টুল হচ্ছে ভিডিও। টিভি, ইউটিউব বা ফেসবুক—সবখানে চলচ্চিত্রের বেশ দাম আছে।

এখন আপনি মার্কেটিং এর মানুষ হয়ে, মার্কেটিং বিষয়-আশয় জানার সাথে সাথে অতিরিক্ত জানেন ভিডিও এডিটিং। বোঝেন ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের ব্যাপারটা। আপনার মামা-চাচা নেই—কিন্তু এই জ্ঞানটা আছে—এটাই আপনার edge। এই edge আপনাকে সবার চেয়ে আলাদা করে দেবে। আপনি ইন্টারভিউ বোর্ডে খালি আপনার বানানো একটা ভিডিও দেখাবেন—বইয়ের তত্ত্ব মুখস্থ আছে কিনা, এমন প্রশ্ন করবেই না আপনাকে। বিশ্বাস করেন—চাকরি তো আপনি পাবেন-ই, কাজও পাবেন। মানুষ আপনাকে ডেকে নিয়ে কাজ দেবে। আমরা দিয়েছি।

কেন দিয়েছি?

কারণ আমরা যখন একজন মানুষকে একটা কাজের জন্য নিই, তখন মাথায় হিসেব ঘোরে—আর কী কী কাজ সে করতে পারে। যে যত বেশি রকম কাজ পারে সে তত প্লাস প্লাস। তাকে দিয়ে আমাদের এমন কিছু ছোট কিন্তু জরুরী কাজ হয়ে যাবে যেটা বাইরে থেকে করাতে গেলে অনেক খরচ পড়ত, অনেক সময় লাগত—তারপরেও মনমতো হতো না।

যারা চাকরি দেয় তারা যখন নিতান্ত গোল আলু খোঁজে তখনও দেখে, কোন গোল আলুটা অন্যগুলো থেকে আলাদা। আমি যদি আর দশটা গোল আলুর মতো নিরামিষ হই তাহলে আমাকে কেন বেছে নেবে তারা? কেন? কী লাভে?

এই প্রশ্নটা আপনাকে নিজের কাছে নিজেকে করতে হবে।

অনেকে আক্ষেপ করেন—দাড়ি রাখার কারণে চাকরি হচ্ছে না। ভুল কথা। দাড়িটাও edge হতে পারে। ইসলাম মেনে চলাটাও edge হতে পারে। যারা দাড়ি-রাখা, টাখনুর ওপর প্যান্ট পড়া মুসলিম তারা আপাতদৃষ্টিতে প্র্যাকটিসিং মুসলিম। তাদেরকে বিশ্বাসভাজন, আমানতদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন কাজ, যেখানে আমানতদারীতা গুরুত্বপূর্ণ—সেখানে দাড়ি থাকাটাই edge।

দুনিয়াটা খুব কমপিটিটিভ। যারা ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে আছেন তাদের জন্য এই সময়টা কাজে লাগানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু শিখুন ভাইয়েরা, প্রডাকটিভ কিছু শিখুন। আপনার যা ভালো লাগে তাই শিখুন। আপনার বাংলা পড়তে ভালো লাগলে জোর করে ডাক্তারী পড়ার দরকার নেই। আপনি বাংলা ভালো করে পড়ুন—ব্যাকরণ পড়ুন। মানুষকে পড়ান—গবেষণা করুন—কীভাবে সহজে বাংলা পড়ানো যায়। দেখবেন আপনি অনেক ছাত্র পাচ্ছেন। দেখবেন হারামের সাথে আপোস না করেও আপনি বেশ স্বচ্ছল একটা জীবন যাপন করতে পারছেন। আপনি বাংলা পড়ানোতেই জীবনের অর্থ খুঁজে পাবেন। কত নষ্ট শিক্ষক ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়ানোর সময় ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় লিবিডো ঢুকিয়ে দেয়।

আপনি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়ানোর সময় হালাল-হারামটা সুস্পষ্ট করে দেন। আপনি পড়ানোর সাথে সাথে আপনার সব ছাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া শুরু করে দেবে, মেয়েদের দিকে তাকানো বন্ধ করে দেবে এমনটা নয়। আপনার সব ছাত্রী বোরখা পড়া শুরু করবে, ভ্রু-প্লাক বন্ধ করে দেবে এমনটা নয়। হয়ত কেউ করবে, আলহামদুলিল্লাহ; হয়ত কেউই করবে না। কিন্তু জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আপনার কথাটা তাদের মনে হবে। সেকুলার জীবনের অন্ধকার ছেড়ে সে ইসলামের আলোর দিকে আসা শুরু করবে। আর এই পরিবর্তন শুরু করবে তার বুকের মাঝে আপনার বুনে দেওয়া ইসলামের সেই বীজটা। অথচ আপনি ইমাম-খতিব-দাঈ কিছুই নন, আপনি একজন বাংলা শিক্ষক। আপনার কথা এমন কিছু মানুষ শুনবে যারা কোনোদিন কোনো খতিব, কোনো বক্তার সামনেই পড়েনি, পড়তে চায়-ও না।

ভালো বাংলা পারাটা আপনাকে দশজন বাংলা শিক্ষক, একশজন ইসলাম প্রচারক থেকে আলাদা করে দেবে। এটা আপনার edge। এই edge এর জোরে আপনি দুনিয়াতে ভালো থাকবেন।

ইসলামের বিশুদ্ধ জ্ঞানটা আপনাকে আর একশজন বাংলা শিক্ষক, দশজন ইসলাম প্রচারক থেকে আলাদা করে দেবে। এটা আপনার edge। এই edge এর জোরে আপনি আখিরাতে ভালো থাকবেন।

বিশ্বাস করেন ভাইয়েরা, আল্লাহ আল-আদল। তিনি চুড়ান্ত ন্যায় বিচারকারী। তিনি প্রতিটি মানুষকেই হায়াত, জীবনে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়েছেন। এর সাথে তিনি মানুষকে কোনো না কোনো কিছুতে বিশেষ সক্ষমতা দিয়েছেন। এখন আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে আপনি কোন কাজটা ভালোবাসেন, ভালো পারেন। খুঁজে বের করার পর আপনি নিজেকে ঘষা-মাজা করতে থাকুন, ঝালাই করতে থাকুন। এগুলো একটু কষ্টকর—কিন্তু আপনি যদি কাজটা ভালোবাসেন—তাহলে বেশি কষ্ট লাগবে না। ঘষা-মাজা-ঝালাই শেষে যখন আপনার edge টা বেরিয়ে যাবে, তখন আপনি দুনিয়াতে সম্মানজনক জীবিকার পাশাপাশি সমাজটাকেও বদলে দিতে পারবেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যেন আমাদের বাক্সের বাইরে ভাবার, আসার তাওফিক দেন। আল্লাহ যেন আমাদের সময়টাকে সদ্ব্যবহার করার তাওফিক দেন। আমীন।

 

-শরীফ আবু হায়াত অপু

১৭ই রজব, ১৪৩৭ হিজরি।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button