পরিবার ও দাম্পত্য

সফল পরিবার : এর সংজ্ঞা ও সাফল্যের মাপকাঠি

একটি সফল পরিবার ‘আদর্শ’ অবস্থাকে মানসনেত্রে ধারণ করে

সকলেরই আর্থসামাজিক পটভূমি এক নয়। একটি আদর্শ পরিবারের জন্য ঠিক যা যা দরকার – তার সবকিছুই সবার থাকবে না – এটাই আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত ক্বদর। কিন্তু তা হলেও আক্ষরিক অর্থেই ‘আদর্শ পরিবার’ এর ধারণা নিয়ে এগোতে হবে – যা দ্বীন, শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান, আখলাক, সমাজসেবা এমনকি জাগতিক অগ্রগতির নিরিখেও সকলের জন্য আদর্শ। এই আদর্শ পরিবার আমরা কেউ পুরোপুরি গঠন করতে না পারলেও এ নিয়ে আলোচনা হতে বাধা নেই। বরং এর আলোচনা হওয়া উচিৎ, একে লক্ষ্য বানানো উচিৎ যেন এর কাছাকাছি আমরা যেতে পারি। আমরা মুসলিমরা আজ লক্ষ্য নির্ধারণে কার্পণ্যের পরিচয় দিচ্ছি, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। লক্ষ্যকে বড় রাখতে কোন অর্থ বা শ্রম ব্যয় হয় না। বড় স্বপ্ন দেখতে পারাই বড় কিছু করতে পারার প্রথম ধাপ – তা দুনিয়াবি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা আল্লাহর জন্য বড় কিছু করার ক্ষেত্রেই হোক। তাই শতভাগ আদর্শ পরিবার নিয়ে কথা চলুক – যেন আমরা এর যতটা সম্ভব কাছাকাছি যেতে পারি।

উদাহরণস্বরূপ একটি আদর্শ পরিবারের করণীয় একটি কাজ হল বিভিন্ন ধরনের বই কেনার পেছনে বড় অংকের টাকা খরচ করা। সীমিত আয়ের কারও এই লাইনটি পড়ে ভাবা ঠিক নয় যে কথাটি শুধু সম্পদশালীদের জন্য। বরং তিনি বক্তব্যটিকে ‘স্কেল ডাউন’ করে নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবেন। সুতরাং তিনি সাধ্যমত খরচ করবেন বাচ্চাদের জন্য বই কেনার পেছনে। প্রয়োজনে তিনি ধূমপান ত্যাগ করে বেঁচে যাওয়া অর্থ অথবা টেলিভিশন ক্রয়ের জন্য সঞ্চিত অর্থ বরাদ্দ করবেন বই কেনায়। আর এরূপ ‘পজিটিভ’ দৃষ্টিভঙ্গী রাখলে আদর্শ পরিবারকে চিত্রায়িত করার গুরত্ব উপলব্ধি করা যাবে ।

ইসলাম একটি সফল পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু

পরিবার সফল যদি তা ইসলামের মাপকাঠিতে সফল হয় – কোন ‘মুসলিম’ ব্যক্তির এ ব্যাপারে দ্বিধা বা ভিন্নমত থাকা সমীচীন নয়। উদাহরণস্বরূপ পরিবারের সন্তানেরা সকলেই নিজ নিজ অঙ্গনে বিশ্বখ্যাত, অথচ তারা আল্লাহর দ্বীন অনুযায়ী জীবনযাপন করে না – এমন পরিবারকে সফল পরিবার বলা যাবে না।

আখিরাতের সাফল্য অগ্রগণ্য

সফলতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে: শিক্ষা, সমাজসেবা, ক্যারিয়ার … কিন্তু আখিরাতের সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য:

وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

আর নিশ্চয়ই আখিরাতের আবাস – সেটাই তো জীবন! যদি ওরা জানত!

সূরা আনকাবূত, ২৯ : ৬৪

সুতরাং দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে একটি পরিবার কতটা সফল হতে পেরেছে, সাফল্যের মাপকাঠিতে তা হবে অগ্রগণ্য।

পরিবারের সাফল্যই উম্মাতের সাফল্য

উম্মাত পরিবারের সমষ্টি। তাই মুসলিম পরিবারগুলোর সাফল্য দিয়েই উম্মাতের সাফল্য বিচার করা হবে।

সাফল্যের নির্ধারিত স্তরে পৌঁছানো যতই বিলম্বিত হোক, ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই বড় কথা

সাফল্যেরও বহু স্তর আছে। কোন পরিবার তার সন্তানদের প্রত্যেককে আল্লাহ প্রদত্ত বাধ্যতামূলক কাজগুলো করার পর্যায়ে উপনীত হওয়াকে লক্ষ্য বানাতে পারে, আবার কোন পরিবারের লক্ষ্য হতে পারে সন্তানদের প্রত্যেককে শুধু সাধারণ মুসলিম নয় বরং আলেম বানানো।

এক্ষেত্রে তারা সাফল্যের ভিন্ন ভিন্ন স্তরকে লক্ষ্য বানিয়েছে। তবে নির্ধারিত স্তরে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি ধীর হতে পারে, কখনও বা পৌঁছানো নাও যেতে পারে – এটাই মানবজীবনের বৈশিষ্ট্য। এজন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালালে প্রতিদান পাওয়াই যাবে, লক্ষ্য উপনীত হওয়া সম্ভব হোক বা না হোক।

فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا

সুতরাং মধ্যপন্থা অবলম্বন কর ও [আদর্শ অবস্থার] নিকটবর্তী হও।

বুখারী(৩৯)

যা হওয়া কাম্য, আর যা হচ্ছে – এ দুয়ের পার্থক্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা

কাঙ্ক্ষিত মানের সাথে বিদ্যমান মানের পার্থক্য নিরূপণ করা এবং এই পার্থক্য সাধ্যমত ক্রমান্বয়ে কমানো – এটাই যে কোন বিষয়ের গুণগত মান রক্ষার মূল তত্ত্ব। পরিবারের সাফল্যও এর ব্যতিক্রম নয়। এজন্য পরিবারে নিয়মিত মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু থাকা জরুরী।

ধরা যাক পরিবারের লক্ষ্য সন্তানদেরকে কুরআনে হাফিয বানানো। এক্ষেত্রে তাদেরকে কোন মাদ্রাসায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা যথেষ্ট নয়, বরং হাফিয হওয়ার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হচ্ছে কি না, তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু থাকলে তবেই সমস্যা ধরা পড়বে, আর সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে মাদ্রাসা পরিবর্তন কিংবা অনুরূপ পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে।

সাফল্য পরিমাপের জন্য অন্যান্য পরিবারের সাথে তুলনা কাম্য, তবে নেতিবাচক পন্থায় নয়

নিজের তুলনায় শ্রেয় কারও পাশে নিজেকে দাঁড় করিয়ে তবেই মানুষ তার অবস্থান বুঝতে পারে। পরীক্ষায় ১০০ পাওয়া খুব বড় সাফল্য নয় যদি দেখা যায় ক্লাসের শতকরা ৯০ ভাগ পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। এজন্য সফল পরিবারগুলোর সাথে নিজেদের তুলনা কাম্য, কিন্তু তা যেন নেতিবাচক পন্থায় না হয়।

“অমুকের সন্তানরা লেখাপড়ায় এত ভাল অথচ তোমাদের পেছনে এত খরচ করেও তোমাদের রেজাল্ট ভাল হচ্ছে না” – এ ধরনের তুলনা সন্তানদের মনোবলকে চূর্ণ করবে ও তাদের মধ্যে হীনমন্যতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরী করবে। সেই সাথে যার সাথে তুলনায় তাকে তিরস্কার করা হচ্ছে, তার প্রতি বিদ্বেষ তৈরী হবে যা তার অনুসরণের পথে বাধা হবে।

বরং বলা যেতে পারে: “অমুকের সন্তান গণিতে বেশি পেলেও তোমরা মাশাআল্লাহ কুরআন তেলাওয়াতে অনেক অগ্রসর। চেষ্টা করলেও গণিতেও ওর মত ভাল হতে পারবে ইনশাআল্লাহ।”

সাফল্য স্থান, কাল, পরিবেশের সাথে আপেক্ষিক একটি বিষয়

এক সময় পরীক্ষায় ‘ফার্স্ট ডিভিশন’ ছিল এক মহাসাফল্য, কিন্তু বর্তমানে ‘ফার্স্ট ডিভিশন’ পাওয়া শতসহস্র ছাত্র রয়েছে। সুতরাং নিজ সময় ও স্থানে সাফল্যের প্রকৃত ধারণা থাকতে হবে।

সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য চাই সুন্দর বর্তমান

“সাফল্য ভবিষ্যতের বিষয়” – এ ধারণা যেন কাউকে প্রতারিত না করে। যেমনিভাবে রেসের প্রথম কয়েক সেকেণ্ডে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তি শেষে গিয়ে ঠিকই প্রথম হবে  – এমন ধারণা অমূলক, তেমনি বলা যায় পরিবারের বর্তমান অবস্থাই এর ভবিষ্যতের নির্দেশক। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক মা-বাবাই ছোট ক্লাসগুলোতে অবহেলা করেন এই আশায় যে বড় হলে সে তার ‘জন্মগত মেধা’র বদৌলতে সকলকে ছাড়িয়ে যাবে! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। অনেক মা-বাবাই ছোট বেলায় সন্তানকে অবাধ ভোগ-বিলাসে ডুবিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকেন যে বড় হলে সে নিজ থেকেই কর্মঠ হয়ে উঠবে এবং ভোগ-বিলাসের মায়া কাটিয়ে কঠোর পরিশ্রম করবে! ছোটবেলায় বেশি কুরআন-হাদীস না পড়লেও চলবে; বড় হলে, ‘পরিপক্ব’ হলে তখন দেখা যাবে! এগুলো সাফল্যের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ভুল দৃষ্টিভঙ্গী।

[এই নিবন্ধটি ড. আব্দুল কারীম বাক্কার রচিত ‘আত-তারবিয়াহ আর রাশীদাহ’ সিরিজের প্রথম বইতে বিদ্যমান আলোচনার আলোকে রচিত]

 

– মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button