হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)

রাসূল (ছাঃ) -এর মাদানী জীবন

পূর্বের অংশ পড়ুন: রাসূল (ছাঃ) -কে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং মদীনায় হিজরত

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।

এক. ১লা হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক  ৬২২ খৃষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার হ’তে ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলক্বা‘দ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর। এই সময় কাফের ও মুনাফিকদের মাধ্যমে ভিতরে ও বাইরের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা সমূহ সংঘটিত হয়। ইসলামকে সমূলে উৎখাত করার জন্য এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৪৮টি বড় ও ছোটখাট অনেকগুলি যুদ্ধ সংঘটিত ও অভিযান পরিচালিত হয়।

দুই. মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে সন্ধি চলাকালীন সময়। যার মেয়াদকাল ৬ হিজরী থেকে ৮ হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রায় দু’বছর। এই সময়ে প্রধানতঃ ইহুদী ও তাদের মিত্রদের সাথে বড়-ছোট ২১টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

তিন. ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর থেকে ১১ হিজরীতে রাসূলের মৃত্যু পর্যন্ত তিন বছর। এই সময়ে দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। চারদিক থেকে গোত্রনেতারা প্রতিনিধি দল নিয়ে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদেশী রাজন্যবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত পত্র প্রেরণ করেন। এই সময়ে মানাত, উযযা, সুওয়া‘ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ মূর্তিগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সময় হোনায়েন যুদ্ধ এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তাবূক যুদ্ধে গমন সহ বড়-ছোট ১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়। এভাবে মাদানী জীবনের ১০ বছরে ছোট-বড় ৮২টি যুদ্ধ ও অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু সব বাধা  অতিক্রম করে ইসলাম রাষ্ট্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি সমূহকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার মত শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়।

এক্ষণে আমরা রাসূলের মদীনায় হিজরত কালীন সময়ে মদীনার সামাজিক অবস্থা ও সে প্রেক্ষিতে রাসূলের গৃহীত কার্যক্রম সমূহ একে একে আলোচনা করব।-

মদীনার সামাজিক অবস্থা :

মক্কা ও মদীনার সামাজিক অবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কার সমাজ ব্যবস্থাপনায় কুরায়েশদের একক প্রভুত্ব ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের অধিকাংশ মূর্তি পূজারী ছিল। যদিও সবাই আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। হজ্জ ও ওমরাহ করত। ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের উপরে তারা কায়েম আছে বলে নিজেদেরকে ‘হানীফ’ (حنيف) বা ‘একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ’তে বিশ্বাসী’ বলে দাবী করত। বিগত নেককার লোকদের মূর্তির অসীলায় তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাতো। এই অসীলাপূজার কারণেই তারা মুশরিক জাতিতে পরিণত হয়েছিল এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়েছিল। তারাও রাসূলের প্রচারিত নির্ভেজাল তাওহীদকে তাদের কপট ধর্ম বিশ্বাস ও দুনিয়াবী স্বার্থের বিরোধী সাব্যস্ত করে রাসূলের ও মুসলমানদের রক্তকে হালাল গণ্য করেছিল। মক্কায় তারা ছিলেন দুর্বল ও মযলূম এবং বিরোধী কুরায়েশ নেতারা ছিলেন প্রবল ও পরাক্রমশালী।

পক্ষান্তরে মদীনায় সমাজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারু একক কর্তৃত্ব ছিল না। ধর্মীয় দিক দিয়েও তারা এক ছিল না বা বংশধারার দিক দিয়েও এক ছিল না। ইহুদীদের চক্রান্তে আউস ও খাযরাজের মধ্যে বহুদিন ধরে যুদ্ধ চলে আসছিল। সর্বশেষ বু‘আছের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে ধ্বংসকারী। যার পরেই তাদের আমন্ত্রণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। এর দ্বারা মদীনাবাসীদের আন্তরিক কামনা ছিল যে, তাঁর আগমনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটবে। ১১ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহর নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরেবী যুবকের ইসলাম গ্রহণের সময় তারা এই আশাবাদই ব্যক্ত করেছিল।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়াছরিবে এই সময় মূলতঃ দু’দল লোক বসবাস করত। একদল ছিল ইয়াছরিবের আদি বাসিন্দা পৌত্তলিক মুশরিক সম্প্রদায়। যারা প্রধানতঃ আউস ও খাযরাজ দু’গোত্রে বিভক্ত ছিল। যাদের মধ্যে যুদ্ধ ও হানাহানি  লেগেই থাকত। আউসদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন মু‘আয ও খাযরাজদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন ওবাদাহ। মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিলেন খাযরাজ গোত্রভুক্ত। এরা ছিল বিশুদ্ধ আরবী ভাষী।

দ্বিতীয় ছিল ইহুদী সম্প্রদায়। খৃষ্টানরা যাদেরকে মেরে-কেটে ফিলিস্তীন ও সিরিয়া এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা শেষনবীর আগমনের অপেক্ষায় এবং তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় তাদের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়ার আকাংখায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল বহুদিন পূর্বে। এরা ছিল হিব্রুভাষী। কিন্তু পরে আরবী ভাষী হয়। এদের প্রসিদ্ধ  গোত্র ছিল তিনটি : (১) বনু ক্বায়নুক্বা‘ (২) বনু নাযীর ও (৩) বনু কুরায়যা। এরা মদীনার উপকণ্ঠে তৈরী স্ব স্ব দুর্ভেদ্য দুর্গসমূহে বসবাস করত। দক্ষ ব্যবসায়ী ও সূদী কারবারী হওয়ার কারণে এরা ছিল সর্বাধিক সচ্ছল। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও কূট কৌশলের মাধ্যমে এরা আউস ও খাযরাজের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখতো এবং ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে উভয় গোত্রের উপরে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতো। এই সূক্ষ্ম পলিসির কারণে তাদের বনু ক্বায়নুক্বা‘ গোষ্ঠী খাযরাজদের মিত্র ছিল এবং বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোষ্ঠী আউসদের মিত্র ছিল। আসলে তারা উভয়ের শত্রু ছিল। তাদেরকে তারা সূদী ঋণ ও অস্ত্র ব্যবসার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করত। তারা এভাবে আরবদের শোষণ করত এবং তাদের মূর্খতার প্রতি তাচ্ছিল্য  করে বলত, لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الأُمِّيِّيْنَ سَبِيْلٌ ‘মূর্খদের ব্যাপারে আমাদের কোন দায়িত্ব নেই’ (আলে ইমরান ৩/৭৫)। অর্থাৎ মূর্খদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার বিনষ্ট করায় আমাদের কোন পাপ নেই। বর্তমান বিশ্বের ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শ্লোগানের আড়ালে উন্নয়নশীল ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তাদের শোষণ-নির্যাতন, সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসা পূর্বের ন্যায় বজায় রেখে চলেছে। ভূগর্ভের তৈল লুট করার জন্য তারা ভূপৃষ্ঠের মানুষের রক্ত পান করছে গোগ্রাসে। কিন্তু এই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারদের রক্ত নেশা মিটছে না।

সেই সময় ইয়াছরিবে পৌত্তলিক মুশরিক ও ইহুদীদের  বাইরে কিছু সংখ্যক খৃষ্টানও বসবাস করত। যারা ইহুদীদের ন্যায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল শেষনবীর আগমন প্রত্যাশায়। ইহুদীরা ভেবেছিল, শেষনবী হযরত ইসহাকের বংশে হবেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের বিগত অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবেন। তারা ইয়াছরিবের লোকদের হুমকি দিত এই বলে যে, سيخرج نبى آخر الزمان فنتبعه ونقتُلكم معه قتل عاد وإرم ‘শেষ যামানার নবী সত্বর আগমন করবেন, আমরা তাঁর অনুসারী হব এবং তোমাদের হত্যা করব (বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি) ‘আদ ও ইরমের ন্যায়’।[1] কিন্তু হযরত ইসমাঈলের বংশে শেষনবীর আগমন ঘটায় এবং তিনি হযরত মূসা ও ঈসা (আঃ) উভয়ের সত্যায়ন করায় ইহুদীরা তাঁর শত্রু হয়ে যায়। পক্ষান্তরে খৃষ্টানরা ভেবেছিল যে, শেষনবী এসে তাদের লালিত বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের কথিত ত্রিত্ববাদ, ঈসার পুত্রত্ববাদ, প্রায়শ্চিত্ববাদ, সন্যাসবাদ ও পোপের ঐশী নেতৃত্ববাদ সমর্থন করবেন। কিন্তু এসবের বিপরীত হওয়ায় তারাও রাসূলের বিরোধী হয়ে গেল। উল্লেখ্য যে, ইহুদী ও নাছারা কারু মধ্যে তাদের ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে কোনরূপ সংগ্রামী চেতনা ছিল না। ধর্মের প্রতিপাদ্য তাদের মধ্যে যা লক্ষ্য করা যেত, সেটা ছিল জাদু-টোনা, ঝাঁড়-ফুঁক, শুভ-অশুভ লক্ষণ নির্ধারণ ও অনুরূপ আরও কিছু ক্রিয়া-কর্ম। এ সকল কাজের জন্যই তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী-গুণী এবং আধ্যাত্মিক গুরু ও নেতা মনে করত।

চতুর্থ আরেকটি উপদল গড়ে উঠেছিল খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূলের নেতৃত্বে। বু‘আছ যুদ্ধের পরে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র মিলে তাকে নেতা নির্বাচিত করে। এজন্য তারা রাজমুকুট তৈরী করে এবং এই প্রথমবারের মত উভয় গোত্র একত্রিত হয়ে তাকে রাজ আসনে বসাতে যাচ্ছিল। এমনি সময়ে রাসূলের আগমন ঘটে এবং উভয় গোত্র তাকে ছেড়ে রাসূলকে নেতারূপে বরণ করে। এতে আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের সকল ক্ষোভ গিয়ে জমা হয় রাসূলের উপরে। কিন্তু অবস্থা অনুকূল না দেখে তারা চুপ থাকে এবং  বছর দেড়েক পরে বদর যুদ্ধের পর হতাশ হয়ে অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়। তবে আদি বাসিন্দা আউস ও খাযরাজদের অনেকে পূর্বেই ইসলাম কবুল করায় এবং তারাই রাসূলকে ও মুহাজিরগণকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্রয় দেওয়ায় অন্যেরা সবাই চুপ থাকে এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নেয়।

উপরোক্ত চারটি দল তথা (১) পৌত্তলিক মুশরিক আউস-খাযরাজ, (২) ইহুদী, (৩) নাছারা ও (৪) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের গ্রুপের গোপন বিরোধিতা ছাড়াও মুহাজির মুসলমানগণের নানাবিধ সমস্যা মুকাবিলা করা রাসূলের জন্য বলতে গেলে জ্বলন্ত সমস্যা ছিল। তবে মুহাজিরদের সমস্যা আনছাররাই মিটিয়ে দিত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে মক্কা থেকে কোন মুহাজির মুসলমান এলেই তাদেরকে সাদরে বরণ করে নিত মদীনার নবদীক্ষিত আনছার মুসলমানগণ। ফলে মুহাজিরগণের সমস্যা ছিল পজেটিভ। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের সমস্যা ছিল নেগেটিভ। যা সর্বদা রাসূলকে চিন্তাগ্রস্ত করে রাখতো।

নবতর বয়কট :

উপরোক্ত সমস্যাবলীর সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটি কঠিন সমস্যা। সেটা ছিল মক্কার মুশরিকদের অপতৎপরতা। তারা মুহাজিরদের ফেলে আসা বাড়ী-ঘর ও ধন-সম্পত্তি জবরদখল করে নিল। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বন্দী ও নির্যাতন করতে লাগল। অধিকন্তু তাদের ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক নেতৃত্বের প্রভাব খাটিয়ে আরব উপদ্বীপের অন্যান্য ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকদের উস্কানি দিতে লাগল, যাতে মদীনায় খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় বস্ত্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে মদীনায় জিনিষপত্র আমদানী হরাস পেতে থাকল। যা মক্কার মুশরিকদের সাথে মদীনার মুসলমানদের মধ্যে ক্রমে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে ফেলল।

মাক্কী ও মাদানী জীবনের প্রধান পার্থক্য সমূহ :

মাক্কী ও মাদানী জীবনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কায় জন্মস্থান হ’লেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানগণ সেখানে ছিলেন দুনিয়াবী শক্তির দিক দিয়ে পরাজিত ও নির্যাতিত। পক্ষান্তরে মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাগডোর ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের হাতে। এখানে বিরোধীরা ছিল নিষ্প্রভ। ফলে মদীনার অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলামকে পূর্ণতা দানের সুযোগ আসে। আর সেকারণেই ইসলামের যাবতীয় হারাম-হালাল ও আর্থ-সামাজিক বিধি-বিধান একে একে মাদানী জীবনে অবতীর্ণ হয় ও তা    বাস্তবায়িত হয়। অতঃপর বিদায় হজ্জের সময় আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ণতার সনদ হিসাবে আয়াত নাযিল হয়-الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيْنًا، ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপরে আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহাজ্জ তারিখ শুক্রবারে বিদায় হজ্জের সময় মক্কায় আরাফা ময়দানে অবস্থানকালে এ আয়াত নাযিল হয় এবং এর মাত্র ৮১ দিন পরে ১১ হিজরীর ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবারে মদীনায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু বরণ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, অত্র আয়াত নাযিলের পর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তবে উৎসাহ  প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন মূলক  মাত্র কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। এভাবে আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে সত্য দ্বীন নাযিল হওয়ার যে সিলসিলা জারি হয়েছিল, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় তার সমাপ্তি ঘটে এবং আল্লাহ প্রেরিত ইলাহী বিধানের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

ইহুদীদের কপট চরিত্র :

হিজরতের পূর্ব থেকেই ইহুদীরা মক্কায় রাসূলের আবির্ভাব সম্পর্কে জানত। এখন যখন তিনি মদীনায় হিজরত করে এলেন এবং মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন করলেন। যার ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও হিংসা-হানাহানিতে বিপর্যস্ত ইয়াছরিবের গোত্র সমূহের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ-মধুর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকল, তখন তা ইহুদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। তাদের আশংকা হ’ল যে, এইভাবে যদি সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও আপোষে ভাই ভাই হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের ‘বিভক্ত কর ও শাসন-শোষণ কর’ নীতি মাঠে মারা যাবে। এর ফলে তাদের সামাজিক নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। সাথে সাথে ইসলামে সূদ হারাম হওয়ার কারণে তাদের রক্তচোষা সূদী কারবার একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, যা তাদের পূঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় ধ্বস নামাবে। এমনকি চক্রবৃদ্ধি হারে ফেঁপে ওঠা সূদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অত্যাচারমূলক চুক্তির ফলে ইয়াছবির বাসীদের যে বিপুল ধন-সম্পদ তারা কুক্ষিগত করেছিল, তার সবই তাদেরকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হ’তে হবে। ফলে তারা রাসূলের বিরুদ্ধে গোপনে শত্রুতা  শুরু করে দেয়। পরে যা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তাদের কপট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ রাসূলের মদীনায় পদার্পণের প্রথম দিনেই ঘটে। নিম্নের দু’টি ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।-

দু’টি দৃষ্টান্ত :

(১) ইহুদী নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সম্পর্কে তার কন্যা ছাফিয়াহ যিনি পরবর্তীতে রাসূলের স্ত্রী হয়ে উম্মুল মুমেনীন রূপে  বরিত হন, তিনি বলেন, আমি আমার বাপ-চাচাদের নিকটে তাদের সকল সন্তানের মধ্যে অধিক প্রিয় ছিলাম এবং সকলের আগেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তারা আদর করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথম ইয়াছরিবে আগমন করেন ও ক্বোবায় বনু আমর বিন আওফের গোত্রে অবতরণ করেন, সেদিন অতি প্রত্যুষে আমার পিতা ও চাচা রাসূলের দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে তারা ক্লান্ত ও অবসন্নচিত্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আমি ছুটে তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম তারা এত চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এ সময় আমি আমার চাচাকে বলতে শুনলাম তিনি আমার আববাকে বলছেন, أهو هو؟ ‘ইনিই কি তিনি? আববা বললেন, نعم والله ‘আল্লাহর কসম, ইনিই তিনি’। চাচা বললেন, فما فى نفسك منه ‘এখন তাঁর সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী’? আববা বললেন, عداوتُه والله ما بقيتُ ‘স্রেফ শত্রুতা। আল্লাহর কসম যতদিন আমি বেঁচে থাকব’।

উল্লেখ্য যে, ইহুদী আলেম ও সমাজনেতাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, لَوْ آمَنَ بِىْ عَشْرَةٌ مِنَ الْيَهُوْدِ لَآمَنَ بِى الْيَهُوْدُ، رواه البخارى عن ابى هريرة- ‘যদি আমার উপরে দশজন ইহুদী নেতা ঈমান আনত, তাহ’লে গোটা ইহুদী সম্প্রদায় আমার উপরে ঈমান আনতো’।[2] ছোট ভাই আবু ইয়াসের ইবনে আখত্বাব লোকদের বলল, أطيعونى فان هذا هو النبى الذى كنا ننتظر- ‘তোমরা আমার অনুসরণ কর। কেননা ইনিই সেই নবী আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম’। কিন্তু বড় ভাই হুয়াই বিন আখত্বাব বিরোধিতা করায় সাধারণ ইহুদীরা ইসলাম কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।[3] এতে বুঝা যায় যে, সমাজনেতা ও আলেমগণের দায়িত্ব সর্বাধিক। অতএব তাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য।

(২) আব্দুল্লাহ বিন সালাম-এর অনুসারীগণ : ক্বোবার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ইয়াছরিবে বনু নাজ্জার গোত্রে অবতরণ করেন, তখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন ইহুদীদের সবচেয়ে বড় আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি  রাসূলকে এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যা নবী ব্যতীত কারু পক্ষে বলা সম্ভব নয়। রাসূলের নিকট থেকে সঠিক জবাব পেয়ে তিনি সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। তিনি রাসূলকে সাবধান করে দিলেন এই মর্মে যে, إِنَّ الْيَهُوْدَ قَوْمٌ بُهُتٌ إِنْ عَلِمُوْا بِإِسْلاَمِىْ قَبْلَ أَنْ تَسْأَلَهُمْ بَهَتُوْنِىْ عِنْدَكَ، ‘ইহুদীরা হ’ল মিথ্যা অপবাদ দানকারী এক ঘৃণিত সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করার আগেই যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জেনে  ফেলে, তাহ’লে তারা আপনার নিকটে আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিবে’। তখন তিনি আব্দুল্লাহকে পাশেই আত্মগোপন করতে বলে ইহুদীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদের নিকটে আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল, سَيِّدُنَا وَابْنُ سَيِّدِنَا،  خَيْرُنَا وَابْنُ خَيْرِنَا- ‘আমাদের নেতা এবং নেতার পুত্র নেতা। আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَفَرَأَيْتُمْ إَنْ أَسْلَمَ عَبْدُ اللهِ، আচ্ছা যদি আব্দুল্লাহ মুসলমান হয়ে যায়? তারা দুবার বা তিনবার বলল, أَعَاذَهُ اللهُ مِنْ ذَلِكَ ‘আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন’! অতঃপর আব্দুললাহ বিন সালাম গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলেন। এটা শোনামাত্র ইহুদীরা বলে উঠলো, شَرُّنَا وَابْنُ شَرِّنَا ‘আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ও নিকৃষ্ট  ব্যক্তির পুত্র’।[4] আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেন, يَا مَعْشَرَ الْيَهُوْدَ اتَّقُوا اللهَ فَوَ اللهِ الَّذِىْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ، إِنَّكُمْ لَتَعْلَمُوْنَ أَنَهُ رَسُوْلُ اللهِ وَأَنَّهُ جَاءَ بِحَقٍّ- ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়!  আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, নিশ্চয়ই তোমরা  ভালভাবেই জানো যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি অবশ্যই সত্য সহ আগমন করেছেন’। জবাবে তারা বলল, كَذَبْتَ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’।[5] বলা বাহুল্য এটাই ছিল ইহুদীদের সম্পর্কে রাসূলের প্রথম অভিজ্ঞতা, যা তিনি মদীনায় অবতরণের প্রথম দিকেই হাছিল করেন।

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন :

পূর্বোক্ত সামগ্রিক অবস্থা সম্মুখে রেখে এক্ষণে আমরা মদীনায় নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সংশোধন এবং বাইরের অবস্থা সামাল দিয়ে চলতে হয়েছে। নতুন জাতি গঠনের প্রধান ভিত্তি হ’ল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র স্থাপন। সেজন্য তিনি ক্বোবায় প্রথম মসজিদ নির্মাণের পর এবার মদীনায় প্রধান মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

মসজিদে নববীর নির্মাণ :

মদীনায় প্রবেশ করে রাসূলের উটনী যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হ’ল মসজিদে নববীর কেন্দ্রস্থল। স্থানটির  মালিক ছিল দু’জন ইয়াতীম বালক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি খরীদ করলেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করলেন।[6] অতঃপর তার আশপাশের কবরগুলি এবং বাড়ী-ঘরের ভগ্নস্তূপ সহ স্থানটি সমতল করলেন। গারক্বাদের খেজুর গাছগুলি উঠিয়ে সেগুলিকে ক্বিবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে পুঁতে দেওয়া হয়।[7] ঐ সময় ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা ছিল মদীনা হ’তে উত্তর দিকে। তিনটি দরজার দু’বাহুর স্তম্ভগুলি পাথরের, মধ্যের খাম্বাগুলি খেজুর বৃক্ষের, দেওয়াল কাঁচা ইটের, ছাদ খেজুর ডালপাতার এবং বালু ও ছোট কাঁকর বিছানো মেঝে- এই নিয়ে তৈরী হ’ল মসজিদে নববী, যা তখন ছিল ৭০×৬০×৭ হাত আয়তন বিশিষ্ট। পরবর্তীতে বাড়িয়ে ১০০×১০০×৭ করা হয়। যেখানে বর্ষায় বৃষ্টি ঝরে পড়ত। ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হ’লে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। কেননা মক্কা হ’ল মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে। এ সময় উত্তর দেওয়ালের বাইরে একটা খেজুর পাতার ছাপড়া দেওয়া হয়।[8] আরবীতে বারান্দা বা চাতালকে ‘ছুফফাহ’ বলা হয়। উক্ত ছুফফাহ’তে নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় মুসলমানদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া হ’ত। পরবর্তীতে তাদের কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা চলে যেতেন। বারান্দায় বা চাতালে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আছহাবে ছুফফাহ’ (أصحاب الصفة) নামে খ্যাতি লাভ করেছেন।  বিখ্যাত হাদীছবেত্তা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এখানকার অন্যতম সদস্য ছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে ওমরের যুগে বাহরায়নের এবং উমাইয়া যুগে মদীনার গভর্ণর নিযুক্ত হন।[9] মসজিদ নির্মাণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজ হাতে ইট ও পাথর বহন করেন। এ সময় তিনি সাথীদের উৎসাহিত করে তাদেরকে সাথে নিয়ে বলতেন,

اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الْآخِرَه + فَاغْفِرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَةَ-

‘হে আল্লাহ! আখেরাতের আরাম ব্যতীত কোন আরাম নেই’। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,

اللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُ الْآخِرَهْ + فَانْصُرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَةَ

‘হে আল্লাহ! আখেরাতের কল্যাণ ব্যতীত কল্যাণ নেই। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের সাহায্য কর’। মসজিদ নির্মাণের বরকত মন্ডিত কাজের প্রতি উজ্জীবিত করার জন্য তিনি বলেন,

هَذَا الْحِمَالُ لاَ حِمَالَ خَيْبَرْ + هَذَا أَبَرُّ رَبَّنَا وَأَطْهَرْ-

‘এটা খায়বারের বোঝা নয়। একাজ আমাদের পালনকর্তার অতীব পুণ্যময় ও পবিত্র কাজ’। রাসূলের নিজ হাতে কাজ করায় উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীগণ গেয়ে ওঠেন-

لَئِنْ قَعَدْنَا وَالنّبِيُّ يَعْمَلُ + لَذَاكَ مِنَّا الْعَمَلُ الْمُضَلَّلُ-

‘যদি আমরা বসে থাকি, আর নবী কাজ করেন, তবে সেটা আমাদের পক্ষ থেকে হবে নিতান্তই ভ্রষ্ট আমল’।[10]

নবীগৃহ নির্মাণ :

এই সময় মসজিদের পাশে একই নিয়মে কতগুলি ঘর তৈরী করা হয়। এগুলি ছিল নবীপত্নীগণের জন্য আবাসিক কক্ষ। এগুলি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবু আইয়ূবের গৃহ ছেড়ে সপরিবারে এখানে চলে আসেন।

(২) আযানের প্রবর্তন : মসজিদ নির্মিত হওয়ার পর মুছল্লীদের পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে আহবানের জন্য পরামর্শ সভা বসে। বিভিন্ন জনে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। পরে একই রাতে ১১ জন ছাহাবী বর্তমান আযানের স্বপ্ন দেখেন। পরদিন আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন আবদে রবিবহী (রাঃ) প্রথমে এসে রাসূলকে স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনালে তিনি উচ্চকণ্ঠের অধিকারী বেলালকে আযান দেওয়ার নির্দেশ দেন। আযানের ধ্বনি শুনে কাপড় ঘেঁষতে ঘেঁষতে ওমর (রাঃ) দৌড়ে এসে বললেন ‘হে রাসূল! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ফালিল্লা-হিল হামদ’।[11] বলা বাহুল্য, এই আযান কেবল ধ্বনি মাত্র ছিল না। বরং এ ছিল শিরকের অমানিশা ভেদকারী আপোষহীন তাওহীদের এক দ্ব্যর্থহীন  আহবান। যা কেবল সে যুগে মদীনার মুশরিক ও ইহুদী-নাছারাদের হৃদয়কে ভীত-কম্পিত করেনি বরং যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত শিরকী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ বিপ্লবের উদাত্ত ঘোষণা। এ আযান যুগে যুগে প্রত্যেক আল্লাহ প্রেমিকের হৃদয়ে এনে দেয় এক অনন্য প্রেমের মূর্ছনা। যার আহবানে সাড়া দিয়ে পাগলপরা হয়ে ছুটে চলে মুমিন মসজিদের পানে। লুটিয়ে পড়ে সিজদায় স্বীয় প্রভুর সকাশে। তনুমন ঢেলে দিয়ে নিবেদন করে আল্লাহর দরবারে। বাংলার কবি কত সুন্দরই না গেয়েছেন-

কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী
কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি’ (কায়কোবাদ)।

ইহুদীদের বাঁশি, নাছারাদের ঘণ্টাধ্বনি ও পৌত্তলিকদের বাদ্য-বাজনার বিপরীতে মুসলমানদের আযান ধ্বনির মধ্যেকার পার্থক্য আসমান ও যমীনের পার্থক্যের ন্যায়। আযানের মধ্যে রয়েছে ধ্বনির  সাথে বাণী, রয়েছে  হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, রয়েছে আপোষহীন আক্বীদার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা এবং রয়েছে আত্মনিবেদন ও আত্মকল্যাণের এক হৃদয়ভেদী আহবান। এমন বহুবিধ অর্থবহ মর্মস্পর্শী ও সুউচ্চ আহবানধ্বনি পৃথিবীর কোন ধর্মে বা কোন জাতির মধ্যে নেই। ১ম হিজরী সনে আযান চালু হওয়ার পর থেকে অধ্যাবধি তা প্রতি মুহূর্তে ধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে অবিরামভাবে অপ্রতিহত গতিতে। কারণ আহ্নিক গতিতে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর প্রতি স্থানে সর্বদা ছালাতের সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে আযানের সময়ের। ঢাকায় যখন যোহরের ওয়াক্ত হচ্ছে, তার এক মিনিট আগে হচ্ছে পূর্বদিকের যেলায় আবার এক মিনিট পরে হচ্ছে পশ্চিম দিকের যেলায়। এভাবে পৃথিবীর সর্বত্র দিবসে ও রাত্রে প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিটে আযান হচ্ছে। আর সেই সাথে ধ্বনিত হচ্ছে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যবাণী এবং উচ্চকিত হচ্ছে আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্বের অনন্য ধ্বনি। মানুষ যদি কখনো এ আহবানের মর্ম বুঝে এগিয়ে আসে, তবে পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাবে শিরকী জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকার। দূর হবে মানুষের প্রতি মানুষের দাসত্ব। প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর গোলামীর অধীনে মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। শৃংখলমুক্ত হবে সত্য, ন্যায় ও মানবাধিকার।

(৩) আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন :

মসজিদে নববীর নির্মাণ কার্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, তাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে আনছার ও মুহাজির উভয় দলের নেতৃস্থানীয় ৯০ জন ব্যক্তির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠক আহবান করেন, যেখানে উভয় দলের অর্ধেক অর্ধেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের (المؤاخاة الإسلامية) বন্ধন স্থাপন করেন এই শর্তে যে, ‘তারা পরস্পরের দুঃখ-বেদনার সাথী হবেন এবং মৃত্যুর পরে পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন’। তবে উত্তরাধিকার লাভের শর্তটি ২য় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে যায়। যেখানে বলা হয়,وَأُوْلُوا الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِيْ كِتَابِ اللهِ إِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ- ‘বংশ সম্পর্কীয় আত্মীয়গণ পরস্পরের অধিক হকদার আল্লাহর কিতাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে অধিক জ্ঞাত’ (আনফাল ৮/৭৫)। তবে উত্তরাধিকার লাভের বিষয়টি রহিত হ’লেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল অটুট এবং অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে এইরূপ নিঃস্বার্থ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের কোন তুলনা নেই। দু’একটি দৃষ্টন্ত প্রদত্ত হ’ল-

ভ্রাতৃত্বের নমুনা :

(১) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাজির আব্দুর রহমান বিন আওফকে আনছার সা‘দ বিন রাবী‘-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দেন। অতঃপর সা‘দ তার মুহাজির ভাইকে বললেন, ‘আনছারদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা ধনী। আপনি আমার সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করুন এবং আমার দু’জন স্ত্রীর মধ্যে যাকে আপনি পসন্দ করেন বলুন, তাকে আমি তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে আপনি তাকে বিবাহ করবেন’। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দো‘আ করলেন, بارك الله فى اهلك ومالك، ‘আল্লাহ আপনার পরিবারে ও ধন-সম্পদে বরকত দান করুন’! আপনি আমাকে আপনাদের বাজার দেখিয়ে দিন। অতঃপর তাঁকে বনু ক্বায়নুক্বা-র বাজার দেখিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি সেখানে গিয়ে পনীর ও ঘি-এর ব্যবসা শুরু করলেন এবং কিছু দিনের মধ্যে সচ্ছলতা লাভ করলেন। এক সময় তিনি বিয়ে-শাদীও করলেন।[12]

(২) খেজুর বাগান ভাগ করে দেবার প্রস্তাব : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)  বলেন, আনছারগণ একদিন রাসূলের কাছে এসে নিবেদন করল যে, আপনি আমাদের খেজুর বাগানগুলি আমাদের ও মুহাজির ভাইগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তখন তারা বলল যে, তবে এমন করুন যে, মুহাজির ভাইগণ আমাদের কাজ করে দেবেন এবং আমরা ফলের অংশ দিব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে সম্মত হ’লেন।[13]

(৩) জমি বণ্টনের প্রস্তাব : বাহরায়েন এলাকা বিজিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এখানকার পতিত জমিগুলি আনছারদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে চাইলে তারা আপত্তি করে বলল, আমাদের মুহাজির ভাইদের উক্ত পরিমাণ জমি  বরাদ্দ দেওয়ার পরে আমাদের দিবেন। তার পূর্বে নয়।[14]

নবতর জাতীয়তা :

এতে বুঝা যায় যে, মুহাজির ভাইদের জন্য আনছারগণের সহমর্মিতা কত গভীর ছিল। মূলতঃ এই ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত। যার মাধ্যমে বংশ, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা প্রভৃতি আরবের চিরাচরিত বন্ধন সমূহের উপরে তাওহীদ ও আখেরাত ভিত্তিক নবতর এক অটুট জাতীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়। যা পরবর্তীতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দেয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লাহর গোলামীর অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ভিত্তিক ইসলামী খেলাফতের দৃঢ় ভিত্তি।

উপ্ত হয় এক অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক ইসলামী সমাজের বীজ। ‘আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান’- এই মহান সাম্যের বাণী ও তার বাস্তব প্রতিফলন দেখে আজীবন দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মযলূম জনতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরমভাবে নিগৃহীত ও শোষিত মানবতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তমরূপে বিকশিত মানবতা মদীনার আদি বাসিন্দাদের চমকিত করল। যা তাদের স্বার্থান্ধ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। নোংরা দুনিয়া পূজা হ’তে মুখ ফিরিয়ে আখেরাত মুখী মানুষের বিজয় মিছিল এগিয়ে চলল। কাফির-মুশরিক, ইহুদী-নাছারা ও মুনাফিকদের যাবতীয় চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করল বিশ্বজয়ী ইসলামী খেলাফত। যা কয়েক বছরের মধ্যেই তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তিকে দমিত করে অপরাজেয় বিশ্বশক্তিরূপে আবির্ভূত হ’ল। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

বস্ত্ততঃ আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে যদি এইরূপ নিখাদ ঐক্য সৃষ্টি না হ’ত এবং স্থানীয় ও বহিরাগত দ্বন্দ্বের ফাটল দেখা দিত, তাহ’লে মদীনায় মুসলমানদের উঠতি শক্তি অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। পরিণামে তাদেরকে চিরকাল ইহুদীদের শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হ’তে হ’ত। যেভাবে ইতিপূর্বে মক্কায় কুরায়েশ নেতাদের হাতে তারা পর্যুদস্ত হয়েছিল।

মদীনার সনদ :

মসজিদ প্রতিষ্ঠা এবং আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। বাস্তবে একাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। কেননা তারা প্রত্যেকে ছিল ধর্মান্ধতা, স্বার্থান্ধতা ও নানাবিধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা ও একটি সুশৃংখল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। তবুও বিশাল অন্তর নিয়ে আল্লাহর উপরে ভরসা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই অসাধ্য সাধনে মনোনিবেশ করলেন। এ সময় মদীনায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও সম্পদশালী এবং নেতৃত্ব দানকারী সম্প্রদায় ছিল ইহুদী সম্প্রদায়। তারা মুসলমানদের নবতর জীবনধারার প্রতি আকৃষ্ট থাকলেও তাদের সমাজ নেতাদের অধিকাংশ ছিল রাসূলের প্রতি ঈর্ষাণ্বিত। কিন্তু অতি ধূর্ত হওয়ার কারণে তারা প্রকাশ্য বিরোধিতায় লিপ্ত হয়নি। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিলেন।

বলা বাহুল্য এই চুক্তিটি ছিল একটি আন্তধর্মীয় ও আন্তসাম্প্রদায়িক চুক্তি, যার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ স্বার্থে ও একক লক্ষ্যে একটি উম্মাহ বা জাতি গঠিত হয়। আধুনিক পরিভাষায় যাকে ‘রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই চুক্তিনামার ধারা সমূহ লক্ষ্য করলে তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গভীর দূরদৃষ্টি ফুটে ওঠে। উল্লেখ্য যে, চুক্তির বিষয়বস্ত্তগুলিকে জীবনীকারগণ পৃথক পৃথক ধারায় বিন্যস্ত করেছেন। যা কারু কারু গণনায় ৪৭টি ধারায় বিধৃত  হয়েছে। বলা বলে যে, এই সনদ ছিল রাষ্ট্র গঠন ও তার সংবিধান রচনায় পথিকৃৎ এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সর্বপ্রথম ভিত্তি স্বরূপ। নিম্নে আমরা উক্ত সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারা সমূহ উল্লেখ করলাম।-

মদীনার সনদের মধ্যে কিছু অংশ ছিল মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে, যাতে ১৫টি ধারা ছিল। কিছু ছিল ইহুদীদের সাথে, যাতে ১২টি ধারা ছিল। এতদ্ব্যতীত মদীনার আশপাশের ছোট ছোট গোত্রগুলির সাথে পৃথক পৃথক চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। যাতে মক্কার কুরায়েশরা এসে তাদের সঙ্গে অাঁতাত করতে না পারে। সব চুক্তিগুলোর ধারা একত্রিত করলে ৪৭টি ধারা হয় বলে বিশেষজ্ঞগণ হিসাব করেছেন। আমরা এখানে চুক্তিনামার প্রধান কয়েকটি ধারা উল্লেখ করলাম।-

هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، بَيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ مِنْ قُرَيْشٍ وَيَثْرِبَ وَمَنْ تَبِعَهُمْ فَلَحِقَ بِهِمْ وَجَاهَدَ مَعَهُمْ-

১. ‘এটি লিখিত হচ্ছে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে মুমিন ও মুসলমানদের মধ্যে যারা কুরায়শী ও ইয়াছরেবী এবং তাদের অনুগামী, যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করে থাকে’।

২. إنَّهُمْ أُمَّةٌ وَاحِدَةٌ مِنْ دُوْنِ النَّّاسِ ‘এরা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসাবে গণ্য হবে’।

৩. وَإِنَّ يَهُوْدَ بَنِيْ عَوْفٍ أُمَّةٌ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَ، لِلْيَهُوْدِ دِيْنُهُمْ وَلِلْمُسْلِمَيْنِ دِينُهُمْ، مَوَالِيْهِمْ وَأَنْفُسُهُمْ، كَذَلِكَ لِغَيْرِ بَنِىْ عَوْفٍ مِنَ الْيَهُوْدِ- ‘বনু আওফের ইহুদীগণ মুসলমানদের সাথে একই জাতিরূপে গণ্য হবে। ইহুদীদের জন্য তাদের দ্বীন এবং মুসলমানদের জন্য তাদের দ্বীন। এটা তাদের দাস-দাসী ও সংশ্লিষ্টদের জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য সমভাবে গণ্য হবে। বনু আওফ ব্যতীত অন্য ইহুদীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে’।

৪. وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ عَلَى مَنْ حَارَبَ أَهْلَ هَذِهِ الصَّحِيْفَةِ، ‘এই চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষের সঙ্গে কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হ’লে তার বিরুদ্ধে সকলে মিলিতভাবে যুদ্ধ করবে’।

৫. وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ وَالنَّصِيْحَةَ وَالْبِرَّ دُوْنَ الْإِثْمِ ‘চুক্তিভুক্ত লোকেরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে কাজ করবে, পাপাচারের ভিত্তিতে নয়’।

৬.  وَإِنَّ الْيَهُوْدَ يُنْفِقُوْنَ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَ مَا دَامُوْا مُحَارَبِيْنَ ‘যুদ্ধ চলাকালে ইহুদীগণ মুসলমানদের সাথে ব্যয়ভার বহন করবে’।

৭.  وَإِنَّ بِطَانَةَ يَهُوْدَ كَأَنْفُسِهِمْ ‘ইহুদীদের মিত্রগণ হুদীদের মতই গণ্য হবে’।

৮. وَإِنَّهُ لَمْ يَأْثَمْ امْرُؤٌ بِحَلِيْفِهِ ‘মিত্রের অন্যায়ের কারণে ব্যক্তি দায়ী হবে না’।

৯. وَإِنَّ يَثْرِبَ حَرَامٌ جَوْفُهَا لِأَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيْفَةِ  ‘চুক্তিভুক্ত সকলের জন্য মদীনার অভ্যন্তরভাগ হারাম অর্থাৎ নিরাপদ এলাকা হিসাবে গণ্য হবে’।

১০. وَإِنَّ النَّصْرَ لِلْمَظْلُوْمِ ‘মযলূমকে সাহায্য করা হবে’।

১১. وَإِنَّ الْجَارَ كَالنَّفْسِ غَيْرَ مُضَارٍّ وَلاَ آثِمٌ ‘প্রতিবেশীগণ চুক্তিবদ্ধ পক্ষের ন্যায় গণ্য হবে। তাদের প্রতি কোনরূপ ক্ষতি ও অন্যায় করা হবে না’।

১২. وَإِنَّهُ مَا كَانَ بَيْنَ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيْفَةِ مِنْ حَدَثٍ أَوْ اشْتِجَارٍ يُخَافُ فَسَادُهُ فَإِنَّ مَرَدَّهُ إلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَإِلَى مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর মধ্যে কোন সমস্যা ও ঝগড়ার সৃষ্টি হ’লে এবং তাতে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকটে নীত হবে’।

১৩. وَإِنَّهُ لاَ تُجَارُ قُرَيْشٌ وَلاَ مَنْ نَصَرَهَا ‘কুরায়েশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেওয়া চলবে না’।

১৪. وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ عَلَى مَنْ دَهَمَ يَثْرِبَ، ‘ইয়াছরিবের উপরে কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।

১৫. وَإِنَّهُ لاَ يَحُوْلُ هَذَا الْكِتَابُ دُوْنَ ظَالِمٍ وَآثِمٍ ‘কোন অত্যাচারী ও পাপীর জন্য এ চুক্তিনামা কোনরূপ সহায়ক হবে না’ (সূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিশাম)

হিজরতের প্রথম বছরেই মদীনাবাসী এবং শক্তিশালী ইহুদীদের সাথে অত্র চুক্তি সম্পাদনের ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামী খেলাফতের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং মদীনা তার রাজধানীতে পরিণত হয়। শান্তির এলাকা সম্প্রসারণের জন্য নবী করীম (ছাঃ) পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের এলাকা সমূহে গমন করেন ও তাদেরকে এ চুক্তিতে শামিল করেন। যেমন-

(১) ২য় হিজরীর ছফর মাসে মদীনা হ’তে ২৯ মাইল দূরবর্তী ওয়াদ্দান (ودَّان) এলাকায় এক অভিযানে গেলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেখানকার বনু যামরাহ গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে মানছূরপুরী উক্ত গোত্রের নাম বনু হামযা বিন বকর বিন আবদে মানাফ লিখেছেন।

(২) ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে বুওয়াত্ব পাহাড় (جبل بواط) এলাকায় এক অভিযানে গিয়ে তাদেরকেও চুক্তিনামায় শরীক করেন।

(৩) একই বছরের জুমাদাল আখেরাহ মাসে ইয়াম্বু ও মদীনার মধ্যবর্তী যুল উশায়রা (ذو العشيرة) এলাকায় গিয়ে বনু মুদলিজ (بنو مدلج) গোত্রের  সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এভাবে তিনি চেয়েছিলেন, যেন সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধাশংকা দূরীভূত হয়। তিনি চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দাওয়াত ও নছীহতের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে। কিন্তু কাফের ও মুনাফিকদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা তাঁকে অবশেষে তরবারি ধারণে বাধ্য করে। যে কারণে পরে বদর-ওহোদ প্রভৃতি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ (২০):

(১) সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কর্মীদল সৃষ্টি হ’লেও তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করা এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত কর্মীদের পাঠিয়ে বাস্তবতা যাচাই শেষে নেতাকে সবশেষে পদক্ষেপ রাখাই সংস্কারবাদী ও দূরদর্শী নেতার কর্তব্য। হিজরতের জন্য দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষা করার মধ্যে রাসূলের সেই কর্মনীতি আমরা দেখতে পাই।

(২) নেতৃবৃন্দের অকপট আশ্বাস ও সাধারণ জনমত পক্ষে থাকলেও নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সর্বদা কিছু শত্রু ও দ্বিমুখী চরিত্রের লোক অবশ্যই থাকবে, সংস্কারবাদী নেতাকে সর্বদা সে চিন্তা রাখতে হবে এবং সে হিসাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই কিছু ইহুদী নেতার বিরুদ্ধাচরণ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দ্বি-মুখী ও কপটাচরণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

(৩) শুধু প্রধান দল নয় বরং অন্যান্য ছোট দল ও সম্প্রদায়কে মূল্যায়ন করা ও তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল একটি বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্রগঠন করা সম্ভব। হিজরতের পরপরই রাসূলের এ ধরনের দূরদর্শী কর্মনীতি এবং মদীনার সনদ প্রণয়ন ও তাতে সকল দলের স্বাক্ষর গ্রহণ একথার প্রমাণ বহন করে।

(৪) বংশীয়, গোত্রীয় ও ধর্মীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখেও বৃহত্তর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, রাসূলের মাদানী জীবনের কর্মনীতি তার বাস্তব সাক্ষী।

(৫) একমাত্র ইসলামী বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। মদীনার সনদ তার বাস্তব দলীল।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ (২১):

* নতুন স্থানে গিয়ে নতুন সমাজ গড়তে গেলে সবার আগে প্রয়োজন, পরস্পরের মধ্যে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা স্থাপন। প্রথমে মসজিদ প্রতিষ্ঠা, অতঃপর মুহাজির ও আনছারের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন স্থাপনের পর ইহুদী সম্প্রদায় ও অন্যান্যদের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক মদীনার সনদ স্বাক্ষরের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত দূরদর্শী পদক্ষেপ প্রতিভাত হয়েছে।

* মানবহিতৈষী ও সমাজদরদী নেতা সাধ্যমত শান্তিপূর্ণ  পরিবেশ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সচেষ্ট থাকবেন। সাথে সাথে শত্রুপক্ষের চক্রান্ত সম্পর্কেও হুঁশিয়ার থাকবেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিবেন।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: বদর যুদ্ধ, ক্বিবলা পরিবর্তন ও ঈদ-উল-ফিতরের উৎসব


[1] আর রাহীক্ব ১৩৫।

[2] বুখারী হা/৩৯৪১, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৫২ অনুচ্ছেদ।

[3] ফাৎহুল বারী হা/… ৭/২৭৫।

[4] বুখারী, মিশকাত হা/৫৮৭০, ‘রাসূল (সাঃ)-এর মর্যাদা অধ্যায়, ‘মু‘জিযা’ অনুচ্ছেদ।

[5] বুখারী হা/৩৯১১ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৪৫ অনুচ্ছেদ।

[6] কুতুবুদ্দীন, তারীখুল মদীনা আল-মুনাওয়ারাহ, পৃঃ ৯২।

[7] তারীখুল মদীনা আল-মুনাওয়ারাহ, পৃঃ ৯২-৯৩।

[8] তারীখুল মদীনা আল-মুনাওয়ারাহ, পৃঃ ৯৩।

[9] তাহযীবুত তাহযীব ১২/২৪০ পৃঃ; মিশকাত হা/৮৩৯।

[10] আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৮৪।

[11] ছহীহ আবুদাঊদ হা/৪৬৯; ঐ, আওন সহ হা/৪৯৫।

[12] বুখারী, হা/৩৭৮০-৮১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৩৩ অনুচ্ছেদ ও হা/২৬৩০ ‘হেবা’ অধ্যায়, ৩৫ অনুচ্ছেদ।

[13] ঐ, হা/৩৭৮২।

[14] বুখারী হা/২৩৭৬ ‘জমি সেচ করা’ অধ্যায়, ১৪ অনুচ্ছেদ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button