সচেতনতা

শিশুদের সাথে আমরা যে ভুল কাজগুলো করি

শিশুরাও মানুষ। যেই শিশুটা এইমাত্র জন্মগ্রহণ করলো, তারও অন্য সব মানুষের মতই কিছু পাওনা আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান বাদেও আরও বেশি কিছু। সেটা হলো সম্মান আর ভালোবাসা। একটা শিশুকে একদম একদিন বয়স থেকেও মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হবে। তার লজ্জা ও মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। তাকে ভালোবাসতে হবে।

পরিবারের সাথে আছে, এমন বেশিরভাগ শিশুই প্রচণ্ড ভালোবাসা পায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বা রাস্তাঘাটে ফেলে দেওয়া শিশুদের মত তারা বঞ্চিত নয়। তবে বাবা-মায়ের অসতর্কতার কারণে প্রচণ্ড ভালোবাসা সত্ত্বেও আমরা সন্তানদের সাথে কিছু অনৈতিক, অসম্মানজনক, ভুল কাজ করে ফেলি–

এক. বাচ্চাকে কাপড় ছাড়া মানুষের সামনে আনা:

বাসায় অতিথি আসলে বাচ্চাকে সবসময় কাপড় পরিহিত অবস্থায় রাখা উচিত। খুব গরম হলেও অন্তত পাতলা পোশাক পরানো দরকার। শিশুরা জন্মের সময় থেকে লজ্জাশীল হয়। কারণ আল্লাহ মানুষকে এমন স্বভাব দিয়েই তৈরি করেছেন। আমরা শিশুদেরকে উদোম শরীরে রাখলে, বা বিশেষ কিছু অঙ্গের কাছে ছেঁড়া কাপড় পরালে ওরা লজ্জা পায়। তাই ওরা বুঝতে শেখার আগে থেকেই অভিভাবকদের এই ব্যাপারটার দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। অনেক বাবা-মা ফেসবুকে ছবি, ভিডিও ইত্যাদি দেওয়ার সময় বাচ্চার পোশাকের দিকে খুব একটা খেয়াল করেন না। কোনো একটা ছবি সুন্দর এসেছে বা দেখতে মজার লাগছে ভেবে শেয়ার করে ফেলেন। অথচ বাচ্চাটি বড়ো হয়ে নিজের উলঙ্গ ছবি দেখে খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। হয়তো সে বড়ো হয়ে আদৌ এটা পছন্দ করবে না যে তার গোপনাঙ্গ বের করা ছবি সবাই দেখেছে। আমাদের ছোটদেরকেও সম্মান করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বড়োদের ওপর ছোটদেরকে দেখাশোনার দায়-দায়িত্ব দিয়েছেন। ওদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেললে, বা মানুষের সামনে ওদের লজ্জা নষ্ট করলে সেটার জন্য আমরা দায়ী থাকবো।

দুই. যৌনতা বৃদ্ধিকারী পোশাক পরানো:

একবার ঈদে ঢাকার ভালো কিছু শপিং মলে ছোট্ট কাজিনের জন্য কাপড় কিনতে গিয়েছি। অবস্থা দেখে আমার কাপড় কেনার রুচি হলো না। দেখা গেলো, ঈদের সময় যেসব “নতুন কাপড়” বাজারে এসেছে, তার প্রত্যেকটি কাপড়ই খুবই কুরুচিকর। টাইট, বিশেষ বিশেষ অঙ্গে ডিজাইন করা। কাপড়গুলোর সাইজ বড়ো হলে কোনো বড়ো মানুষ অনায়াসে তার ডিজাইনের পোশাক হিসেবে পরে ফেলতে পারতেন। কাপড়গুলোর ডিজাইন কোনোক্রমেই ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুদের উপযুক্ত বলে মনে হয় নি। যারা বাংলাদেশেই থাকেন, তারা দর্জির কাছে গিয়ে আগে থেকেই সুন্দর কিছু কাপড় ঈদের জন্য বানিয়ে রাখতে পারেন। তারপর সেটা আলমারিতে তুলে রাখলেন, ঈদের সময় বা কোনো অনুষ্ঠানের আগে বের করে দিলেন। এতে করে ঈদের সময় যদি ভালো ডিজাইনের পোশাক মার্কেটে নাও আসে, তাহলেও ঝামেলায় পড়তে হবে না। যদি কোনো নতুন পোশাক না থাকে, তবুও উচিত এসব বাজে ডিজাইনের পোশাক না পরানো। কারণ আমাদের সমাজেই শিশুদেরকে যৌন হয়রানি করার অনেক পশু পরিচয় গোপন করে আছে। অনেক সময় আমাদের পরিচিত মানুষেরাও বিকৃত মানসিকতার হতে পারে। তাই শিশুকে বাজে বেমানান পোশাক পরিয়ে আমরা ছেড়ে দিবো না। এসব মানুষ তাদের খারাপ মানসিকতার জন্যই বাজে কাজ করে থাকে এবং তাদের জুলুমের জন্য তারাই আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবে–এটা সত্য কথা। তবে আমরা বাবা-মা হয়ে সন্তানের জন্য অবশ্যই ফুল-প্রটেকশন নেওয়ার চেষ্টা করবো।

তিন. টিভি দেখা:

অনেক বাবা-মা খুব সহজভাবে শিশুদের সামনে টিভি দেখেন। অনেক সময় খেয়ালও করেন না যে টিভিতে কী দেখাচ্ছে! হয়তো হিন্দি সিরিয়াল বা বাংলা নাটক দেখতে বসে আমরা ভাবছি, এখানে তো কোনো খারাপ সীন নাই। এগুলো বাচ্চাদের সামনে দেখতে ক্ষতি নাই। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, এখনকার পাঁচ-ছয় বছর বয়সের বাচ্চারাও অনেক পাকা! তারা অনেক কিছুই বোঝে। নাটক বা অনুষ্ঠানে সরাসরি অশ্লীল কিছু দেখানো না হলেও, তারা ইঙ্গিত ধরতে পারে। হাত ধরা, জড়িয়ে ধরা, চুমু দেওয়া– এইসব দৃশ্য শিশুমনে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। একটা ছেলে একটা মেয়ের জন্য গান গাইছে, বা একটা মেয়ে একটা ছেলের কথা ভেবে নাচছে, ফোনে কথা বলছে–এই ধরনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো পর্যন্ত বাচ্চাদের নজর এড়ায় না। তারা বোঝে সামথিং ইজ রং, সামথিং ইজ ফিশি হিয়ার। এভাবে তারা এই বিষয়গুলোর প্রতি কৌতূহলী হয়ে ওঠে আর একসময় এগুলো ওদের কাছেও নরমাল হয়ে যায়। সন্তানকে যারা সস্তা রিলেশনশিপ, শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি থেকে দূরে রেখে একজন বড়ো মানুষ হিসেবে তৈরি করতে চান, তাদের জন্য টিভিতে অন্তত এসব ফালতু অনুষ্ঠান দেখা বাদ দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

চার. মেয়েদেরকে ছেলেদের পোশাক পরানো বা ছেলেদেরকে মেয়ে সাজানো:

বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরালে বাচ্চাদের মধ্যে নিজের লিঙ্গ নিয়ে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। এমনিতেই আমাদের সমাজে গে এবং লেসবিয়ান জিনিসটা জোর করে ঢুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের উচিত হবে না, বাচ্চাকে এই দিকে পা বাড়ানোর কোনো সুযোগ করে দেওয়া। বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চাদেরকে টপস-প্যান্ট না পরিয়ে, ফ্রক ও পায়জামা পরানোই উত্তম। সাবালেগ হলে তাদেরকে ওড়না ব্যবহার করা শেখালে তারা স্বস্তি বোধ করে।

পাঁচ. বাচ্চাদেরকে ইঙ্গিতপূর্ণ খারাপ কথা শিক্ষা দেওয়া:

অনেক সময় দুষ্টুমি করেই আমরা বাচ্চাদেরকে খারাপ জিনিস শিখিয়ে ফেলি। এক মা তার তিন-চার বছর বয়সী ছেলের সামনে আরেক আত্মীয়কে বলছেন, “জানো, ওর না একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। স্কুলে গেলে ওই মেয়ের সাথে খুব ভাব!” ছোট শিশুরা অনেক সময় অন্য শিশুর প্রতি আগ্রহী হয়। এটাকে খারাপ দিকে টেনে নেওয়া উচিত নয়। এভাবে করে বললে বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই একটা বাজে কালচার শিখতে থাকে। “বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, রিলেশনশিপ” ব্যাপারগুলো এক সময় নরমাল হয়ে যায়। যদি ছোট্ট নাবালেগ বাচ্চার বিপরীত লিঙ্গের কোনো বন্ধু থেকেও থাকে, তাকে ভুলেও “বউ”, “জামাই”, “বয়ফ্রেন্ড”, বা “গার্লফ্রেন্ড” বলে উল্লেখ করবেন না। শুধু বলুন বন্ধু। আর নাবালেগ অবস্থা থেকেই তাকে একই লিঙ্গের বন্ধু বানানোর দিকে আগ্রহী করে তুলুন বা তাদের সাথেই মেশার ব্যবস্থা করে দিন। অনেক বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্র জীবনে বড়ো কিছু করার আশাতেই রিলেশনশিপ ও ভিন্ন লিঙ্গের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকে, যেহেতু এগুলো মানুষের মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। নবীজির (সা) সুন্নাহ অনুযায়ী নিশ্চিত ভাবেই বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ইত্যাদি বাজে কালচার হারাম। তাই ছোটবেলায় থেকে বাচ্চাদেরকে এসব শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যেসব বাবা-মা এ ধরনের কথা বাচ্চাদের সামনে বলছেন বা অন্যদেরকে বলতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাদের কাজটা

ছয়. ভয় দেখানো:

ভুতের ভয়, দৈত্যের ভয়, অন্ধকারে ভাউ দেওয়া–ইত্যাদি কাজ বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়। আমার বোনকে ছোট থাকতে অন্ধকারে ভয় দেখানোর কারণে ও বড়ো হয়েও অন্ধকারে বেশ ভয় পায়। যদিও বাচ্চারা বড়ো হয়ে টের পায় যে ভুত, দৈত্য এসব বলে কিছু নেই, তবু মন থেকে শৈশবের অব্যক্ত ভয়টা মুছে ফেলা শক্ত। তাই শিশুদেরকে ভয় দেখানো ঠিক নয়। এমনকি বাচ্চাদের জন্য আগডুম-বাগডুম আত্মা ও ভুতের কাহিনিঅলা সিনেমাও পরিহার করা উচিত। এসব কল্পকাহিনি শিশু মনে অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলে, তাদেরকে ভীতু মানুষ হিসেবে তৈরি করে।

সাত. বাচ্চাদের নাচ:

সচেতন বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবিক বিকাশের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও করার চেষ্টা করে থাকেন। বাচ্চাদের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি হিসেবে অনেক বাবা মা “নাচ”এর স্কুলে ভর্তি করান। এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া জরুরি। আমার মনে পড়ে, অনেকদিন আগে বাচ্চাদের নাচের অনুষ্ঠান দেখছিলাম। সেখানে একটা বাচ্চা এসে পুরো বড়োদের গানের সাথে বড়োদের মতো করে নাচ দেখালো। এমনকি বিচারকেরা পর্যন্ত বলাবলি করতে লাগলো যে, বাচ্চার নাচটা ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট ছিল। কারণ নাচটা আসলে যৌনতাপূর্ণ ছিল। বাচ্চাদেরকে ছোট বেলা থেকে নাচের দিকে আগ্রহী করে তুললে, সে আসলে কোন নাচের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে বলুন তো? ক্লাসিকাল ড্যান্সে সাধারণত আজকালকার বাচ্চাদের মন ভরে না। তারা হিন্দি ও ইংরেজি গানের সাথে যেসব জম্পেশ নাচ আছে, ওগুলোর দিকেই ঝুঁকে পড়ে। আর ফলাফল, যৌনতাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, নাচ। সবকিছু তারা বাবা-মায়ের সামনে করবে এমন নয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে করবে। স্কুলে গিয়ে ফাঁকা ক্লাসরুমে, টয়লেটে বা খেলার মাঠে তারা এসব বাজে নাচ শিখবে। নাচের দিকে আগ্রহী অনেকেই বড়ো হয়ে “মডেল” হতে চায় বা সিনেমায় কাজ করতে চায়। একসময় তারা তাদের লজ্জা পুরোপুরিই বিসর্জন দেয়। এক মেয়েকে চিনতাম, তার বাবা-মা তাকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। দেশে থাকলে সে মডেলিংয়ে যোগ দিতো এই ভয়ে। অবশ্য মা-বাবার চোখের আড়ালে এসেও সে বিভিন্ন পার্টি, ক্লাব ইত্যাদি নিয়েই মেতে ওঠে। আমাদেরকে লক্ষ রাখতে হবে সন্তানদেরকে যেন খারাপ দিকে ঠেলে না দিই। তাদেরকে ভালো দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রথম থেকেই বিচক্ষণতার সাথে এগোতে হবে। একদম অল্পবয়সী শিশুদেরকেও নাচতে বলা ঠিক না। এক্সট্রা অ্যাক্টিভিটি, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য কারাতে, সাঁতার, ফুটবল, বই পড়া, ছবি আঁকা, লেখালেখি ইত্যাদি অভ্যাস তৈরি করা যায়।

এছাড়া আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো শিশুদের সাথে করা ঠিক নয়। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।

 

– আনিকা তুবা

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button