হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)

আয়েশা (রাঃ) -এর সাথে রাসূল (ছাঃ) -এর বিবাহ এং ছয় জন পবিত্রাত্মা যুবকের ইসলাম গ্রহণ

পূর্বের অংশ পড়ুন: নাজাশীর দরবারে কুরায়েশ প্রতিনিধি দল

মাসাধিক কাল ত্বায়েফ সফর শেষে দশম নববী সনের যুলক্বা‘দাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন। এ সময় একটানা তিনটি হারাম মাসের সুবর্ণ সুযোগকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগানোর মনস্থ করেন। তিনি হজ্জে আগত দূরদেশী কাফেলা সমূহের তাঁবুতে গিয়ে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। যদিও কেউ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়নি।

একাদশ নববী বর্ষ :

এই বছর বাইরের দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওমরা করার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন এবং নবী আগমনের সংবাদ শুনে রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারা এ সময় ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ইয়াছরিবের বিখ্যাত কবি ও উচ্চ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ও ‘কামিল’ লকবধারী সুওয়াইদ বিন ছামেত (سويد بن صامت) , ইয়াছরিবের আউস গোত্রের ইয়াস বিন মু‘আয (إياس بن معاذ) , ইয়াছরিবের বিখ্যাত ‘গেফার’ গোত্রের আবু যার গেফারী (أبو ذرغفارى) , দাওস গোত্রের নেতা ও কবি তুফায়েল বিন আমর দাওসী (طفيل بن عمروالدوسى) , ইয়ামনের যেমাদ আযদী (ضماد الأزدى) প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ। এই সকল ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের স্ব স্ব এলাকায় ইসলামের বাণী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে দলে দলে লোক ইসলাম কবুল করে। ইয়ামনের অধিবাসী যেমাদ আযদী ছিলেন ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে জিন ছাড়ানো চিকিৎসক। মক্কাবাসীদের কাছে সবকিছু শুনে তিনি রাসূলকে জিনে ধরা রোগী মনে করে তাঁর কাছে আসেন এবং বলেন, يا محمد إنى أرقى من هذا الريح فهل لك حاجة ‘হে মুহাম্মাদ! ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে আমি চিকিৎসা করে থাকি। আপনার কোন প্রয়োজন আছে কি?’ জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে শুনিয়ে দেন খুৎবাতুল হাজতের সেই অমৃত বাণী সমূহ- যা প্রতিটি খুৎবা ও বক্তৃতার সূচনায় আবৃত্তি করা পরবর্তীতে সুনণাতে পরিণত হয়ে যায়। খুৎবাটি নিম্নরূপ :

إن الحمد لله نحمده ونستعينه، من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادى له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد:

‘নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দান করেন, তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে হেদায়াতকারী কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’

যেমাদ কথাগুলি শুনে ভাবে গদগদ হয়ে রাসূলকে বারবার কথাগুলি বলতে অনুরোধ করেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কথাগুলি তিনবার বলেন। অতঃপর যেমাদ বলে উঠলেন, لقد سمعت قول الكهنة و قول السحرة وقول الشعراء فما سمعت مثل كلماتك هؤلاء، لقد بلغن قاموس البحر هات يدك أبايعك على الإسلام فبايعه-  ‘আমি জ্যোতিষীদের, জাদুকরদের ও কবিদের কথা শুনেছি। কিন্তু আপনার কথাগুলির মত কারুর কাছে শুনিনি। এগুলি সমুদ্রের গভীরে পৌঁছে গেছে। আপনি হাত বাড়িয়ে দিন আমি আপনার নিকটে ইসলামের উপরে বায়‘আত করব।’ অতঃপর তিনি বায়‘আত করেন।[1]

হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে বিবাহ :

একাদশ নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে অর্থাৎ হযরত সওদা বিনতে যাম‘আর সাথে বিয়ের ঠিক এক বছরের মাথায় নবীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ার মানসে হযরত আবুবকরের একান্ত ইচ্ছায় তাঁর নাবালিকা কন্যা আয়েশাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিবাহ করেন। বিয়ের তিন বছর পরে সাবালিকা হ’লে নয় বছর বয়সে মদীনায় ১ম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে তিনি নবীগৃহে গমন করেন।

একাদশ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুম :

ছয় জন পবিত্রাত্মা যুবকের ইসলাম গ্রহণ

দিনের বেলায় আবু লাহাব ও অন্যান্যদের পিছু লাগা ও পদে পদে অপদস্থ হবার ভয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির গভীরে দাওয়াতে বের হওয়ার মনস্থ করেন। সেমতে তিনি একরাতে আবুবকর ও আলীকে সাথে নিয়ে বহিরাগত বিভিন্ন হজ্জ কাফেলার লোকদের সঙ্গে তাদের তাঁবুতে বা বাইরে সাক্ষাত করে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। এমন সময় তাঁরা মিনার আক্বাবাহ গিরিসংকটের আলো-অাঁধারীর মধ্যে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলেন যে, তারা ইয়াছরিব থেকে হজ্জে এসেছেন এবং তারা ইহুদীদের মিত্র খাযরাজ গোত্রের লোক। তারা ছিলেন সংখ্যায় ছয়জন এবং ছয়জনই ছিলেন তরতাজা তরুণ যুবক। তারা ছিলেন ইয়াছরিবের জ্ঞানী ও নেতৃস্থানীয় যুবকদের শীর্ষস্থানীয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে বসে পড়লেন। অতঃপর তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনালেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল। তারা ইতিপূর্বে তাদের মিত্র ইহুদীদের নিকটে শুনেছিল যে, সত্বর আখেরী যামানার নবীর আবির্ভাব ঘটবে এবং তাঁকে সাথে নিয়ে তারা ইয়াছরিববাসী প্রতিপক্ষদের পিষে মারবে’। ইনিই যে সেই নবী, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে তখনই ইসলাম কবুল করল।

অতঃপর তারা বলল, সদ্য সমাপ্ত বু‘আছ যুদ্ধের ফলে ইয়াছরিববাসীগণ পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। পারস্পরিক হানাহানি ও শত্রুতার ফলে তাদের সমাজে এখন অশান্তির আগুন জ্বলছে। অতএব এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যদি ইয়াছরিবে হিজরত করেন, তবে তাঁর আহবানে সেখানে শান্তি স্থাপিত হ’তে পারে এবং আউস ও খাযরাজ উভয় দল তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে। ফলে তাঁর চাইতে অধিকতর সম্মানিত ব্যক্তি সেখানে আর কেউ হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দাওয়াত শুনলেন এবং তাদেরকে ফিরে গিয়ে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে বললেন (যাতে হিজরতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়)।
উপরোক্ত সৌভাগ্যবান ছয়জন খাযরাজী যুবনেতা ছিলেন- আস‘আদ বিন যুরারাহ (أسعد بن زرارة) ইনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। কিন্তু ইনিই ছিলেন তাদের নেতা।  (২) আওফ বিন হারেছ বিন রেফা‘আহ (عوف بن الحارث) (৩) রাফে‘ বিন মালেক বিন আজলান (رافع بن مالك بن العجلان) (৪) কুৎবা বিন আমের বিন হাদীদাহ (قطبة بن عامر بن حديدة) (৫) উকবা বিন আমের বিন নাবী (عقبة بن عامر بن نابي) (৬) জাবের বিন আবদুল্লাহ (جابر بن عبد الله) (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত দু’জন ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জার গোত্রের। ইয়াছরিববাসীগণের উক্ত দাওয়াতই মদীনায় হিজরতের বীজ বপন করে। যা মাত্র তিন বছরের মাথায় গিয়ে ফল দান করে।[2]

পরবর্তী অংশ পড়ুন: আক্বাবাহর বায়‘আত, ইসরা ও মিরাজ


[1] মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬০ ‘নবুঅতের নিদর্শন সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[2] সুলায়মান মনছূরপুরী আল-ইস্তী‘আবের বরাতে ৬ষ্ঠ ব্যক্তির নাম সা‘দ বিন রাবী‘ (سعد بن ربيع) বলেছেন- সেখানে জাবিরের নাম নেই। … রহমাতুল লিল আলামীন ১/৭৬ টীকা-৩।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button