অর্থনীতি/ব্যবসা-বাণিজ্য

ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও সাহি’ত্যে সূদ

সূদ ও ইসলাম

সূদ প্রসঙ্গে ইসলামের অবস্থান সবচেয়ে কঠোর ও অনমনীয়। এ ব্যাপারে ইতিপূর্বেই সূরা বাক্বারাতে মহান আল্লাহর ঘোষণা বর্ণনা করা হয়েছে। এ সূরাতেই আরও বলা হয়েছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللّهَ وَذَرُوْا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ- فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوْا فَأْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللّهِ وَرَسُوْلِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوْسُ أَمْوَالِكُمْ لاَ تَظْلِمُوْنَ وَلاَ تُظْلَمُوْنَ-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সূদের যে অংশ বাকী আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও। যদি তোমরা তা না করো তাহ’লে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে রাখ। আর যদি তোমরা তওবা কর তবে তোমাদের মূলধন ফিরিয়ে নিতে পারবে। না তোমরা যুলুম করবে, না তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে’ (বাক্বারাহ ২/২৭৮-৭৯)

ক্বিয়ামতের দিন সূদখোরদের অবস্থা কেমন হবে সে সম্পর্কে ঐ সূরাতেই বলা হয়েছে,

اَلَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لاَ يَقُوْمُوْنَ إِلاَّ كَمَا يَقُوْمُ الَّذِيْ يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوْا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا-

‘যারা সূদ খায় তারা ক্বিয়ামতে দন্ডায়মান হবে যেভাবে দন্ডায়মান হবে ঐ ব্যক্তি যার উপর শয়তান আছর করে। তাদের এ অবস্থার কারণ, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয়ও তো সূদ নেওয়ারই মতো’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)

সূদের লেনদেন ও সূদের সাথে সংশ্রব রাখা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ: هُمْ سَوَاءٌ- ‘যারা সূদ খায়, সূদ দেয়, সূদের হিসাব লিখে এবং সূদের সাক্ষ্য দেয়, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের উপর লা‘নত করেছেন এবং এরা অপরাধের ক্ষেত্রে সকলেই সমান’।[1]

পবিত্র কুরআনে বহু ধরনের গুনাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সেসবের জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সূদের ক্ষেত্রে যত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোন গুনাহের ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি। এজন্যই সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সূদ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রাসূলে করীম (ছাঃ) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ নাজরানের খৃষ্টানদের সাথে তিনি যে সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখে পাঠান- ‘যদি তোমরা সূদী কারবার করো তাহ’লে তোমাদের সাথে চুক্তি ভেঙ্গে যাবে এবং আমাদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে’। বনু মুগীরার সূদী লেনদেন সমগ্র আরবে প্রসিদ্ধ ছিল। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের প্রাপ্য সমুদয় সূদ বাতিল করে দেন এবং মক্কায় তাঁর নিযুক্ত তহসীলদারদেরকে লিখে পাঠান, যদি তারা (বনু মুগীরা) সূদ গ্রহণ করা বন্ধ না করে তাহ’লে তাদের সাথে যুদ্ধ করো।

রিবার অবৈধতা আল-কুরআনের সাতটি আয়াত (বাক্বারাহ ২৭৫-২৭৬, ২৭৮-২৮০; আলে ইমরান ১৩০ এবং রুম ৩৯) এবং চল্লিশটিরও বেশী হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ তুলে ধরা হ’ল-

(১) আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلرِّبَا سَبْعُوْنَ جُزْءًا، أَيْسَرُهَا أَنْ يَّنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ- ‘সূদের (পাপের) সত্তুরটি স্তর রয়েছে। যার নিম্নতম স্তর হ’ল মায়ের সাথে যেনা করার পাপ’।[2]

(২) আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, دِرْهَمُ رِبًا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ، أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَّثَلاَثِيْنَ زِنِيَّةً، ‘কোন ব্যক্তি যদি এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) রিবা বা সূদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে তার পাপ ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক বেশী হয়’।[3]

(৩) কূফার ক্বাযী খ্যাতনামা তাবেঈ আবু বুরদা বিন আবু মূসা বলেন, আমি মদীনায় এলাম এবং ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করলাম। তখন তিনি বললেন, তুমি এমন এক এলাকায় বাস কর, যেখানে সূদ ব্যাপকহারে প্রচলিত। অতএব  যদি কারু নিকট তোমার কোন পাওনা থাকে, আর সে যদি তোমার নিকট এক থলে ভূষি বা যব কিংবা এক অাঁটি ঘাসও উপঢৌকন দেয়, তবুও তুমি তা গ্রহণ করো না। কেননা ওটা হবে ‘রিবা’ বা সূদ’।[4]

(৪) আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَمَانِعَ الصَّدَقَةِ، وَكَانَ يَنْهَى عَنِ النَّوْحِ، ‘তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে অভিশাপ করতে শুনেছেন সূদখোরের প্রতি, সূদ দাতার প্রতি, সূদের প্রমাণপত্র লেখকের প্রতি ও ছাদাক্বা প্রদানে বাধাদানকারীর প্রতি। আর তিনি নিষেধ করতেন মৃতের  জন্য বিলাপ করা হ’তে’।[5]

(৫) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, إِنَّ الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيْرُ إِلَى قُلٍّ، ‘সূদের দ্বারা সম্পদ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন তার শেষ পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা।[6]

উপরোল্লিখিত হাদীছসমূহ থেকে সূদ সম্পর্কে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে। এসবের মধ্যে রয়েছে সূদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মহাপাপী বলে গণ্য হবে। সামান্য বিষয় এমনকি ঋণদাতাকে উপহার প্রদানও সূদ হিসাবে বিবেচিত হবে। সূদের শেষ পরিণতি হবে নিঃস্বতা। সূদ বহু প্রকারের হ’তে পারে। এক সময়ে সূদ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করবে এবং তা থেকে কারো রেহাই থাকবে না। সূদের গুনাহ (যা কবীরা গুণাহ) অতীব নিকৃষ্ট ধরনের ইত্যাদি। তাই সূদ প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা যেমন প্রয়োজন তেমনি সমাজদেহ হ’তে সূদ উচ্ছেদ ও রহিত করার জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণও সমান প্রয়োজন।

বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর জীবনের  সর্বশেষ ভাষণেও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে ভুলেননি। তিনি যে প্রকৃতই রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণেও তার পরিচয় রেখে গেছেন। অবিস্মরণীয় সেই ভাষণে তিনি একটিমাত্র ঘোষণার মাধ্যমে শোষণের বিষদাঁত চিরতরে ভেঙ্গে দিলেন। অবিচল কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘জাহেলী যুগের সমস্ত সূদ বাতিল করা হ’ল। সবার আগে আমাদের গোত্রের আববাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিবের সব সূদ আমিই রহিত করে দিলাম’।[7]

সেই ঘোষণার ফল হয়েছিল সূদূরপ্রসারী। উমাইয়া ও আববাসীয় খিলাফত পরবর্তী যুগেও বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশী বিশাল ভূখন্ডে দীর্ঘ নয়শত বছর ইসলামী হুকুমত বহাল থাকাকালীন কোথাও সূদ বিদ্যমান ছিল না। সূদের মাধ্যমে কোন লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য হয়নি। পরবর্তীতে মুসলমানদের  ভোগবিলাস ও আত্মবিস্মৃতির সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিসমূহ তাদের পরাভূত করে ধ্বংস করে দেয় তাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনের উপায়-উপকরণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ। বিপরীতে মুসলিম দেশ ও সমাজ কোন প্রতিরোধ তো গড়তে পারেইনি বরং ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে যোজন যোজন পথ। এই সময়েই ইউরোপে সংঘটিত শিল্প বিপ্লবের পথ ধরে নতুন আঙ্গিকে সূদ পুনরায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিশ্বের সকল দেশে, সমাজের সর্বস্তরে। ব্যাংকিং পদ্ধতির বিকাশ ঘটে শিল্প বিপ্লবের হাত ধরেই। ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমেই সমাজে সূদের সর্বনাশা শোষণ ও ধ্বংস আরও গভীর ব্যাপ্তি লাভ করে। একদিকে পুঁজি আবর্তিত হ’তে থাকে শুধু ধনীদের মধ্যেই, যা পবিত্র কুরআনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে সূদের কারণে আরও নতুন নতুন অর্থনৈতিক নির্যাতন ও শোষণ বিস্তৃতি লাভ করে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে, যার হাত থেকে পরিত্রাণ লাভ আজ আর সহজসাধ্য নয়।

অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও সাহি’ত্যে সূদ

কুরআন নাযিলের পূর্বে অন্যান্য যেসব আসমানী গ্রন্থ নাযিল হয়েছিল, সেসবেও সূদ নিষিদ্ধ ছিল। ঐসব গ্রন্থ আজ আর অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় না। একমাত্র আল-কুরআনই রয়েছে অবিকৃত অবস্থায়, থাকবেও ক্বিয়ামত পর্যন্ত। কারণ আল্লাহ রাববুল আলামীন স্বয়ং এর হেফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দাঊদ (আঃ)-এর উপর নাযিলকৃত গ্রন্থ ‘যাবূর’-এর কোন সন্ধান মেলে না। মূসা (আঃ)-এর উপর নাযিল হওয়া ‘তাওরাত’ ও ঈসা (আঃ)-এর উপর নাযিল হওয়া ‘ইনজীল’-এর যে বহু বিকৃতি ঘটানো হয়েছে যুগে যুগে, একথা তো সর্বজনবিদিত। তারপরও ইনজীল বা বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বা আদিপুস্তক তাওরাতেরই অংশবিশেষ বলে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ দাবী করেন। সেই আদিপুস্তকেই সূদ সম্বন্ধে যে ঘোষণা ও নির্দেশনা রয়েছে তা এ যুগের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। উদাহরণত-

(১) ‘তুমি যদি আমার প্রজাদের মধ্যে তোমার স্বজাতীয় কোন দীন-দুঃখীকে টাকা ধার দাও তবে তাহার কাছে সূদগ্রাহীর ন্যায় হইও না; তোমরা তাহার উপর সূদ চাপাইবে না’ [(Exodus) যাত্রাপুস্তক;  ২২: ২৬]

(২) ‘তুমি তাহা হইতে সূদ কিংবা বৃদ্ধি লইবে না, কিন্তু আপন ঈশ্বরকে ভয় করিবে… তুমি সূদের জন্য তাহাকে টাকা দিবে না’ [(Leviticus) লেবীয় পুস্তক, ২৫: ৩৬-৩৭]

(৩) ‘তুমি সূদের জন্য, রৌপ্যের সূদ, খাদ্য সামগ্রীর সূদ, কোন দ্রব্যের সূদ পাইবার জন্য আপন ভ্রাতাকে ঋণ দিবে না’ [(Deuteronomy) দ্বিতীয় বিবরণ, ২৩: ১৯]

(৪) ‘যে সূদ ও বৃদ্ধি লইয়া আপন ধন বাড়ায়… তাহার প্রার্থনাও ঘৃণাস্পদ’ [(Ecclesiastes) হি’তোপদেশ, ২৮: ৮-৯]

(৫) ‘যে সূদের জন্য টাকা ধার দেয় না… সে কখনও বিচলিত হইবে না’ [(The Psalm) গীতসংহিতা, ১৫: ৬]

(৬) ‘পরন্তু কোন ব্যক্তি যদি ধার্মিক হয়… সূদের লোভে ঋণ দেয় নাই, কিছু বৃদ্ধি লয় নাই… তবে সেই ব্যক্তি ধার্মিক, সে অবশ্য বাঁচিবে’ [(Ezekiel) যিহিস্কেল, ১৮: ৮-৯]

(৭) ‘যদি সূদের লোভে ঋণ দিয়া থাকে ও বৃদ্ধি লইয়া থাকে তবে সে কি বাঁচিবে? সে বাঁচিবে না; সে এই সকল ঘৃণার্হ কার্য করিয়াছে’ [(Ezekiel) যিহিস্কেল, ১৮: ৯৩]

খৃষ্টধর্মের শুরু হ’তে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা এবং রোমে পোপের নিয়ন্ত্রিত চার্চ হ’তে অন্যান্য চার্চের বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত সূদ নিষিদ্ধ ছিল। সকল চার্চই তখন এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করত। মধ্যযুগে ইউরোপের চার্চ অপরিসীম লোভ ও কৃপণতার জন্য সূদখোরদেরকে দেহপসারিণীদের সমতুল্য গণ্য করেছিল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রখ্যাত দার্শনিক ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তিগণও সূদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা সূদের অশুভ পরিণতি তুলে ধরেছেন এবং সূদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন। এ্যারিস্টটল তাঁর Politics গ্রন্থে সূদকে কৃত্রিম  মুনাফা আখ্যায়িত করে বলেছেন যে, অন্যান্য পণ্যের ন্যায় অর্থ ক্রয়-বিক্রয় করা এক ধরনের জালিয়াতি। সুতরাং, সূদের কোন বৈধতা থাকতে পারে না। প্লেটো তাঁর Laws নামক গ্রন্থে সূদের নিন্দা করেছেন।  থমাস একুইনাস সূদের বিরুদ্ধে যুক্তি  দিয়ে বলেছেন, অর্থ থেকে অর্থের  ব্যবহারকে পৃথক করা যায় না। অর্থের ব্যবহার করা মানে অর্থ খরচ করে ফেলা। এক্ষেত্রে একবার অর্থের ব্যবহারের মূল্য নেয়ার পর অর্থাৎ মুনাফা গ্রহণের পর পুনরায় অর্থের মূল্য নেওয়া হলে একই দ্রব্য দু’বার বিক্রি করার অপরাধ হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অবিচার’। সূদকে সময়ের মূল্য বলে যারা দাবী করেন তাদের যুক্তি খন্ডন করে তিনি বলেন, সময় এমন এক সাধারণ সম্পদ যার উপর ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা ও অন্যান্য সকলেরই সমান মালিকানা বা অধিকার রয়েছে। এ অবস্থায় শুধু ঋণদাতার সময়ের মূল্য দাবী করাকে তিনি অসাধু ব্যবসা বলে অভিহিত করেছেন। হিন্দু ধর্মেও সূদ গ্রহণকে সমর্থন করা হয়নি (মনুসংহিতা, ৮ম অধ্যায়, শ্লোক নং ১০২)। বৃহদ্ধর্ম পুরানৈত্ত সূদকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে (উত্তর খন্ড, শ্লোক নং ৬৩)

পুঁজিবাদের কঠোর সমালোচক এবং সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক প্রবক্তা কার্ল মার্কসও সূদ ও সূদখোরদের তীব্র ও তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন (দ্রঃ Capital. Vol. 2)। তিনি অর্থনীতি হ’তে সূদ উচ্ছেদ, সূদখোরদের কঠোর শাস্তি প্রদান ও তাদের সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। অর্থ বা মুদ্রাকে তিনি সমাজ শোষণের হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করেছেন। এজন্য সোভিয়েত রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে যুদ্ধ সাম্যবাদ চলাকালীন সময়ে (১৯১৮-২২) পুঁজিবাদী অর্থনীতি উৎখাতের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল পর্যন্ত অর্থনৈতিক লেনদেন হ’তে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।[8]

পল মিলস ও জন প্রিসলে বলেন, ইতিহাসের কালপরিক্রমায় দেখা যায় অন্যের দুর্ভাগ্য হ’তে ‘মুনাফা’ অর্জনের জন্য ইহুদী সূদখোরদের নিন্দা করা হয়েছে। প্লুটার্ক বিশ্বাস করতেন বিদেশী আক্রমণকারীদের চাইতে অর্থ ঋণদানকারীরা অধিক নির্যাতনকারী। সূদখোররা তাদের প্রবাদতুল্য অর্থগৃধণ ুতা, নিষ্ঠুরতা ও অর্থলোলুপতার জন্য বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনায় বিদ্রূপের খোরাক হয়ে রয়েছে। ইতালীর অমর কবি দান্তে সূদখোরদের নরকের অগ্নিবৃষ্টিময় সপ্তম বৃত্তে নিক্ষেপের কথা বলেছেন।  ইংরেজী সাহি’ত্যের অবিসংবাদিত সম্রাট সেক্সপীয়রের দি মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকের শাইলক ও মলিয়েরর দি মাইজার নাটকের হারপাগণের নাম কে না শুনেছে? বাংলা সাহি’ত্যেও গল্প-উপন্যাসে সূদখোরদের শোষণ-পীড়নের কাহিনীর উল্লেখ একেবারে অপ্রতুল নয়। রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা, শওকত ওসমানের ইতা প্রভৃতি গল্প এবং কাজী ইমদাদুল হকের আব্দুল্লা, অদ্বৈত মল্ল বর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম প্রভৃতি উপন্যাস তার প্রমাণ।

লেখক: শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান


[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৮০৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৬/১৯ পৃঃ হা/২৬৮৩।

[2]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৭৪, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/২৮২৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭০২

[3]. মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত হা/২৮২৫, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭০১

[4]. বুখারী, মিশকাত হা/২৮৩৩।

[5]. নাসাঈ, মিশকাত হা/২৮২৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭০৫, শাওয়াহেদ-এর কারণে হাদীছ ছহীহ

[6]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৭, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭০৩, ৬/২৭ পৃঃ।

[7]. তারীখে ত্ববারী; সীরাতে ইবনে হিশাম

[8]. বিস্তারিত দ্রষ্টব্য E.H. Carr- The Bolshevik Revolution, Vol. 2, Ch. 17; Macmillan, 1952.

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button