হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)

রাসূল (ছাঃ) -এর উপর বিভিন্নমুখী অত্যাচার

পূর্বের অংশ পড়ুন: রাসূল (ছাঃ) -এর প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া

সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর আবু লাহাবের নেতৃত্বে কুরায়েশ নেতাদের মধ্য থেকে ২৫ জনের একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে এখন থেকে কঠোরতম নির্যাতন চালাতে হবে। এ ব্যাপারে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ করা চলবে না।  তারা দেখল যে, অন্য মুসলমানদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। তারা অধিকাংশই সমাজের দুর্বল শ্রেণীর। আবু বকর, ওছমান প্রমুখ যারা উচ্চ শ্রেণীর আছেন, তারা ভদ্র মানুষ। দুষ্টদের অভদ্রতার সামনে তারা মুহাম্মাদকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। সমস্যা হ’ল খোদ মুহাম্মাদ ও তাঁর চাচা আবু তালেবকে নিয়ে। এ দু’জনই অত্যন্ত সম্মানিত ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাদের উপরে হস্তক্ষেপ করলে তাদের দু’টি গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদিও তারা মুশরিক। সবদিক ভেবেচিন্তে তারা দুর্বল মুসলমানদের উপরে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করার সাথে সাথে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে দৈহিকভাবে ও মানসিকভাবে অপদস্থ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যেমন-

১. রাসূলের উপর প্রতিবেশীদের অত্যাচার

আবু লাহাব ছিল রাসূলের চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। সে ও তার স্ত্রী ছাড়াও অন্যতম প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। এদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন। ইনিই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা। বস্ত্ততঃ মু‘আবিয়া ও ইয়াযীদ বাদে তাঁর বংশধরগণই উমাইয়া খেলাফতের ধারানুক্রমিক খলীফা ছিলেন। ইনি ব্যতীত বাকীরা রাসূলের উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। যেমন, তাদের বাড়ির যবেহ করা দুম্বা-ভেড়ার নাড়ি-ভুঁড়ি তারা রাসূলের বাড়ীর মধ্যে ছুঁড়ে মারত। তাদের বাড়ীর আবর্জনাসমূহ রাসূলের রান্না ঘরের মধ্যে নিক্ষেপ করত যাতে রান্না অবস্থায় সব তরকারি নষ্ট হয়ে যায়। রাসূল সেগুলি কুড়িয়ে এনে দরজায় খাড়া হয়ে তাদের ডাক দিয়ে বলতেন يابنى عبد مناف أى جوارهذا؟ ‘হে বনু আবদে মানাফ! এটা কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?’এরপর তিনি সেগুলি দূরে ফেলে আসতেন।

২. কা‘বা গৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (ছাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। আবু জাহ্ল ও তার সাথীরা অদূরে বসেছিল। কিছুক্ষণ পর তার নির্দেশে ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুড়ির চাপে ও দূর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই সময় কিভাবে এই দুঃসংবাদ ফাতেমার কানে পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,

 اللهم عليك بقريش (ثلاث مرات)، اللهم عليك بعمرو بن هشام اى بأبى جهل وعليك بعتبة بن ربيعة وشيبة بن ربيعة والوليد بن عتبة وامية بن خلف وعقبة بن ابى مُعَيط وعُمارة بن الوليد، متفق عليه-

‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধরো (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম আবু জাহলকে ধরো। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধরো’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূলের আবির্ভাব ও অহি-রসূচনা’ অনুচ্ছেদ। )

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হ’তে পারে কিংবা দেরীতে হয়ে থাকে অথবা পরকালে হয়। কিন্তু দেরীতে হওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহল গং রাসূলের বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় ও বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। অবশেষে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে রাসূলের উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সবগুলো একত্রে ধ্বংস হয়ে যায়।

৩. সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া : এ ব্যাপারে উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করত। তাছাড়া রাসূলকে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করত এবং তাঁকে অভিশাপ দিত। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়, وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘প্রত্যেক সম্মুখ নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য রয়েছে ধ্বংস’ (হুমাযাহ১০৪/১)

৪. রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করা :

(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূলের কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল।

(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি বলেই একটা হেঁচকা টানে রাসূলের গায়ের জামা ছিঁড়ে দিল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূলের জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূলের মেয়ে উম্মু কুলছূমকে তালাক দেয়। পরে উক্ত মেয়ের বিয়ে হযরত ওছমানের সাথে হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك ‘আল্লাহ তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’। কিছুদিন পরে ওতায়বা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠল, هو والله يأكلنى كما دعا محمد علىّ فقتلنى وهو بمكة وانا بالشام ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিল। সে আমাকে হত্যা করল। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। পরদিন সকালে বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল।

ইমাম কুরতুবী স্বীয় তাফসীরে অত্র ঘটনাটি সূরা আবাসা-এর ১৭ আয়াত (قُتِلَ الْإِنسَانُ مَا أَكْفَرَهُ) -এর শানে নুযূল হিসাবে বর্ণনা করেছেন যাহহাকের সূত্রে ইবনু আববাস হতে। সেখানে নাম বলা হয়েছে উৎবা এবং স্থানের নাম বলা হয়েছে الغاضرة । তবে বর্ণনাটি صحيح নয়। কেননা ইবনু আববাসের সাথে যাহহাকের সাক্ষাৎ ঘটেনি।(কুরতুবীপৃঃ১৮৯।)

৫. রাসূলের মুখে পচা হাড্ডি চূর্ণ ছুঁড়ে মারা :

উবাই বিন খালাফ নিজে একবার মরা-পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূলের কাছে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মুখ ভর্তি হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধে বমি হবার উপক্রম হয়।

৬. তার সামনে এসে মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা :

রাসূলকে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা বদমাশ ছিল আখনাস বিন শুরাইক্ব ছাক্বাফী। তবে মুফতী শফী  এ ব্যক্তির নাম ওলীদ বিন মুগীরা বলেছেন। তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তি আসলেই জারজ ছিল। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূলের সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। আল্লাহ পাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ-

‘আপনি কথা শুনবেন না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিকহারে বাধাদানকারী, সীমা লংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং সে জারজ সন্তান’ (ক্বলম৬৮/১০-১৩)
তার এই বাড়াবাড়ির কারণ ছিল তার অতুল বিত্ত-বৈভবের অহংকার। যেমন আল্লাহ বলেন,

 أَنْ كَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِيْنَ- إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- سَنَسِمُهُ عَلَى الْخُرْطُوْمِ، (القلم ১৪-১৬)-

‘আর এটা এ কারণে যে, সে ছিল মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মালিক’। ‘যখন তার সম্মুখে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, এসব পুরাকালের উপকথা’। ‘সত্বর আমরা তার নাসিকা দাগিয়ে দেব’ (ক্বলম৬৮/১৪-১৬)। হাতী বা শূকরের শুঁড়কে আরবীতে ‘খুরতূম’ বলা হয়। অথচ এখানে ঐ ব্যক্তির নাম সম্পর্কে এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তার হীনতা ও নিকৃষ্টতা প্রকাশ করার জন্য। ক্বিয়ামতের দিন তার নাসিকা দাগিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে এজন্য যে, অন্যের সামনে তার লাঞ্ছনা যেন পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। দুনিয়াতে সে রাসূলের দাওয়াত থেকে নাক সিটকিয়েছিল, তাই ক্বিয়ামতের দিন তার বদলা হিসাবে তার নাসিকা দাগানো হবে। একাজ অন্যেরা করলেও তার পাপ ছিল বেশী এবং সে ছিল নেতা। তাই তাকে সেদিন চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। نعوذ بالله من غضبه وقهره

৭. রাসূলের সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া :

এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহ্ল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তাঁর কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে? এ যুগের বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ পন্ডিত ও জ্ঞানপাপী মুসলমানদের অবস্থাও ঠিক অনুরূপ। যারা দিনরাত কুরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে মূলতঃ অন্যকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য। লোকেরা ভাবে, তারা বড় জ্ঞানী। অথচ তারা এ ব্যাপারে একেবারেই গোমূর্খ। আবু জাহলের এই কপট ও গর্বিত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে- فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى- ‘সে বিশ্বাস করেনি এবং ছালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ৭৫/৩১-৩৩)

এক বর্ণনায় এসেছে যে, তার অশ্লীল গালিগালাজ শুনে এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) আবু জাহলের জামার কলার ধরে জোরে হেচকা টান মেরে নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন, أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ثُمَّ أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ‘তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’। ‘অতঃপর তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’ (ক্বিয়ামাহ৭৫/৩৪-৩৫)

৮. কা‘বা গৃহে ছালাত আদায়ে নানারূপ বাধা সৃষ্টি :

(ক) প্রথম দিকে সকালে ও সন্ধ্যায় দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম ছিল। প্রথম তিন বছর সকলে সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বা গৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল, ألم أنهك عن هذا يا محمد! ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব করতে নিষেধ করিনি’?

তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে, بأى شيء تهددنى يا محمد أما والله إنى لأكثر هذا الوادى ناديًا. ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ। আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে বড়। তখন আল্লাহ সূরা আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াত গুলি নাযিল করেন।(তিরমিযীহা/৩৩৪৯, সিলসিলাছাহীহাহহা/২৭৫। )

كَلَّا إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- َرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى- كَلَّا لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ-

‘কখনোই না। সত্য-সত্যই মানুষ সীমা লংঘন করে’। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’। ‘নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর দিকেই সবার প্রত্যাবর্তন হবে’। ‘আপনি কি তাকে (আবু জাহলকে) দেখেছেন যে নিষেধ করে’? ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে) যখন সে ছালাত আদায় করে’। ‘আপনি কি দেখেছেন যদি সে সৎপথে থাকে’। ‘অথবা আল্লাহ ভীতির নির্দেশ দেয়’। ‘আপনি কি দেখেছেন যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’। ‘সে কি জানেনা যে, (তার ভাল মানুষী ও মিথ্যাচার সবই) আল্লাহ দেখেন’। ‘কখনোই না’, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে কষে টান দেব’। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’। ‘আমরাও ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’। ‘কখনোই না। আপনি তার কথা শুনবেন না। আপনি সিজদা করুন ও (আপনার প্রভুর) নৈকট্য তালাশ করুন’ (আলাক্ব৯৬/৬-১৯)

আবু জাহল ও রাসূলের মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।(মুসলিম, মিশকাতহা/১০২৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ২১অনুচ্ছেদ)

শিক্ষণীয় বিষয় (৭):

এতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এই যে, (ক) দূরদর্শী কাফের ও মুশরিক নেতারা মুসলমানদের ব্যক্তিগত ইবাদতকেই সবচেয়ে বেশী ভয় করে। যদিও তারা মুখে বলে যে, এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কেননা তাদের মতে ধর্ম হ’ল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। ধর্মের ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ নেই। কিন্তু নেতারা জানে যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু তার বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আবু জাহ্ল ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। তাই সে মূল জায়গাতে বাধা সৃষ্টি করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে, কা‘বাতে একবার আল্লাহর জন্য সিজদা চালু হ’লে পাশেই রক্ষিত দেব-দেবীর সম্মুখে কেউ আর মাথা নীচু করবে না। তাদের অসীলায় কেউ আর মুক্তি চাইবে না এবং সেখানে কেউ আর নযর-নেয়ায দেবে না। অথচ অসীলা পূজার এই শিরকের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাদের অর্থবল, জনবল, সামাজিক সম্মান সবকিছু। বর্তমান যুগের কবরপূজারী ও ওরস ব্যবসায়ী মুসলমানদের অবস্থা সেযুগের আবু জাহ্লদের চাইতে ভিন্ন কিছুই নয়। একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী নেতারা চাকুরী, ব্যবসা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুকৌশলে মুসলমান নর-নারীকে তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।

(খ) উপরোক্ত আয়াত সমূহ নাযিল হওয়ার পর আবু জাহ্ল মনে মনে ভীত হ’লেও বাইরে ঠাট বজায় রেখেই চলল। একদিন সে কুরায়েশ নেতাদের সামনে বলে বসল যে, লাত ও উয্যার কসম! যদি মুহাম্মাদকে পুনরায় সেখানে ছালাতরত দেখি, তাহ’লে নিশ্চিতভাবেই আমি তার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে তার নাকমুখ মাটিতে আচ্ছামত থেৎলে দেব’ (মুসলিম)। পরে একদিন সে রাসূলকে সেখানে ছালাতরত দেখল। তখন নেতারা তাকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উস্কে দিল। ফলে সে খুব আস্ফালন করে রাসূলের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু না। হঠাৎ দেখা গেল যে, সে ভয়ে পিছিয়ে আসছে। আর দুই হাত শূন্যে উঁচু করে কি যেন এড়াতে চেষ্টা করছে’। পিছিয়ে এসে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমার ও তার মধ্যে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড দেখলাম, যা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لو دنا منى لاختطفته الملائكة عضوا عضوا ‘সে যদি আমার কাছে পৌঁছত, তাহ’লে ফেরেশতারা তার এক একটা অঙ্গ ছিন্ন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত’।[1]

(গ) ইবনু ইসহাকের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, একদিন চরমপন্থী কুরায়েশ নেতাদের সামনে আবু জাহ্ল শপথ করে বলল, মুহাম্মাদকে পুনরায় ছালাত আদায় করতে দেখলে আমি তাকে এমনভাবে পাথর ছুঁড়ে মারব যে, তার মাথা চূর্ণ হয়ে যাবে’। আবু জাহ্ল পাথর নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে রইল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যথারীতি এসে ছালাতে মগ্ন হলেন। কুরায়েশ নেতারাও জমা হ’ল আবু জাহ্লের ক্রিয়াকান্ড দেখার জন্য। রাসূল (ছাঃ) সিজদায় গেলে আবু জাহ্ল পাথর উঠিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই দ্রুত ভয়ে পিছিয়ে এল। এ সময় তার হাতের সাথে পাথরখন্ডটা এমনভাবে চিমটি লেগে ছিল, সে তা ছাড়াতে পারছিল না। লোকেরা তার অবস্থা কি জিজ্ঞেস করলে সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, একটা ভয়ংকর উট আমাকে খেতে আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জিব্রীল স্বয়ং উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে তাকে ভয় দেখিয়েছিল। কাছে এলে তাকে ধরে নিত’।

(ঘ) আরেক দিনের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা চতবরে ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় দূরাচার ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে সিজদারত অবস্থায় রাসূলের ঘাড়ের উপর পা দিয়ে এমন জোরে পিষ্ট করে দেয় যে, তাঁর চোখ দু’টো ঠিকরে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। অনুরূপ আরেকদিন ছালাতরত অবস্থায় উক্ত ওক্ববা এসে তাঁর গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে তিনি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবু বকর (রাঃ) ছুটে এসে কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশ গুলিকে সরিয়ে দিলেন ও ধিক্কার দিয়ে বললেন, أتقتلون رجلا أن يقول ربى الله وقد جاء كم بالبنيات ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি স্পষ্ট প্রমাণ সমূহ নিয়ে তোমাদের কাছে আগমন করেছেন? এ সময় তারা রাসূলকে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’।[2]

রাসূলের জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিল, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ-

‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন লোককে হত্যা করবে, যে বলে যে, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণাদি সহকারে আগমন করেছেন’ (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)

(ঙ) শিস দেওয়া ও তালি বাজানো : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বা গৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূলের ছালাত ও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো যায়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءً وَّتَصْدِيَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ ‘আর কা‘বার নিকটে তাদের ইবাদত বলতে শিস দেওয়া ও তালি বাজানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতএব (ক্বিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে) তোমরা নিজেদের কুফরীর আযাবের স্বাদ আস্বাদন কর’ (আনফাল ৮/৩৫)

(চ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহ্ল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিল যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ-

‘আর কাফেররা বলে যে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন আযাব আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কাজের হীনতম বদলা নেব’ (হামীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)

আজকাল মসজিদে ছালাতের সময় বা রামাযানে সাহারীর পূর্বে যারা জোরে জোরে রেডিও ও ক্যাসেট বাজায়, কিংবা মাইকবাজি করে ও হট্টগোল করে, তারা সবাই সেদিনের মক্কার কাফেরদের অনুসরণ করে এবং তাদের শাস্তিও অনুরূপ হবার সম্ভাবনা রয়েছে, যেরূপ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। একইভাবে হোটেলে ও বাজারে ব্যস্ততার সময় মাইকে কুরআন তেলাওয়াতের ক্যাসেট চালানোও ঠিক নয়। কেননা কুরআন শোনার জন্য মনোযোগ দেওয়া শর্ত। অথচ ঐ সময় মনোযোগ দেওয়া যায় না।

১০. সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করায় গযব নাযিল হয় না কেন বলে যুক্তি প্রদর্শন করা : নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্য নবী হ’তেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হয়ে থাকে, তাহ’লে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম গ্রহণ করা হ’তে মানুষ পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- وَإِذْ قَالُوْا اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ-

‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা (তাচ্ছিল্যের সাথে) বলে, আমরা শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’। ‘এতদ্ব্যতীত যখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, হে আল্লাহ! যদি এটাই তোমার নিকট থেকে আগত সত্য দ্বীন হয়ে থাকে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপরে আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদের উপরে বেদনাদায়ক আযাব নাযিল কর’। ‘অথচ আল্লাহ কখনোই তাদের উপরে আযাব নাযিল করবেন না, যতক্ষণ আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন। তাছাড়া তারা (দুর্বল মুসলমানেরা) যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, আল্লাহ কখনো তাদের উপরে আযাব দিবেন না’ (আনফাল ৮/৩১-৩৩)

আয়াত তিনটির মর্মকথা

উপরোক্ত তিনটি আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের ইতিকথা এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ ঐ নেতারা নিজেরাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূলের সুমধুর তেলাওয়াত শুনত। আর ফিরে যাওয়ার সময় মন্তব্য করত ليس هذا كلام البشر ‘এটা কখনোই মানুষের কালাম নয়’। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শুরায়েক্ব, এমনকি আবু জাহলের মত নেতারাও একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত। কিন্তু যখন তারা তাদের জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত। কারণ তখন দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে সত্য ভাষণ থেকে ফিরিয়ে রাখত। একই অবস্থা আজকালকের মুসলিম-অমুসলিম নেতাদের। যারা সবাই একবাক্যে রাসূল ও কুরআনের সত্যতাকে স্বীকার করেছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানতে রাযী হয় না স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে।

দ্বিতীয় আয়াতে কাফের নেতাদের আরেকটি কৌশল বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করার কারণে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? অথচ তারা ভালভাবেই জানত যে, আল্লাহ তার বান্দাকে বুঝবার ও তওবা করার অবকাশ দিয়ে থাকেন। প্রতিটি অপরাধের কারণে যখন-তখন গযব নাযিল করে তাকে ধ্বংস করেন না। যেমন আল্লাহ ফেরাঊনের মত দুরাচারকেও অন্যূন বিশ বছরের মত সময় দিয়েছিলেন এবং ৮/৯ প্রকার গযব নাযিল করেও যখন সে তওবা করেনি, তখন তাকে সদলবলে ডুবিয়ে মারেন। মক্কার কাফিররাও ভেবেছিল যেহেতু গযব নাযিল হচ্ছে না, অতএব আমরা ঠিক পথে আছি। মুহাম্মাদ বেদ্বীন হয়ে গেছে। সে আমাদের জামা‘আতের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। বস্ত্ততঃ যুগে যুগে কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা নিজেদেরকে সঠিক এবং সংস্কারপন্থী নেতাদের পথভ্রষ্ট বলে দাবী করেছে। মূসার বিরুদ্ধে ফেরাঊন তার লোকদের একই কথা বলে বুঝিয়েছিল যে, وَمَا أَهْدِيْكُمْ إِلاَّ سَبِيْلَ الرَّشَادِ ‘আমি তোমাদেরকে সর্বদা মঙ্গলের পথ দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৯)। আর মূসা (আঃ) সম্পর্কে সে বলল, وَإِنِّيْ لَأَظُنُّهُ كَاذِباً ‘আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি’ (মুমিন/গাফের ৪০/৩৭)। সে ধর্ম রক্ষা ও দেশে শান্তি রক্ষার দোহাই দিয়ে তাকে হত্যা করার অজুহাত দেখিয়ে বলল, ذَرُوْنِيْ أَقْتُلْ مُوْسَى وَلْيَدْعُ رَبَّهُ إِنِّيْ أَخَافُ أَنْ يُّبَدِّلَ دِيْنَكُمْ أَوْ أَنْ يُّظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ ‘তোমরা আমাকে ছাড়, আমি মূসাকে হত্যা করব। ডাকুক, সে তার রবকে। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনকে পরিবর্তন করে দেবে এবং সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৬)

মক্কার নেতারা একই কথা বলেছিল। তারা রাসূলকে ‘ছাবেঈ’ (صابئ) অর্থাৎ বিধর্মী, ও ‘কাযযাব’ (كذّاب) অর্থাৎ  ‘মহা মিথ্যাবাদী’ এবং ‘সমাজে বিভক্তি সৃষ্টিকারী’ বলেছিল।[3] আর সেকারণ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমান যুগে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের সত্যিকারের সেবকদের বিরুদ্ধে একই অপবাদ ও একই কৌশল অবলম্বন করেছে। তারাও আল্লাহর গযব সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হওয়াকে তাদের সত্যতার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং সমাজ সংস্কারক দ্বীনদার ব্যক্তির অত্যাচারিত হওয়াকে তার অসত্য হওয়ার প্রমাণ হিসাবে যুক্তি পেশ করে থাকে।

তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন অথবা আপনার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ কখনোই তাদের উপর গযব নাযিল করবেন না। কারণ একজন নবী ও ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সারা পৃথিবীর সমান নয়। এ কারণেই হাদীছে এসেছে, لاتقوم الساعة حتى لايقال فى الأرض: الله الله ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।[4] বস্ত্ততঃ ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের উপরে সে আযাবই নাযিল হয়েছিল। কেননা যে দুনিয়ার লোভে তারা ইসলামকে সত্য জেনেও তার বিরোধিতায় জীবনপাত করেছিল, সেই দুনিয়াবী নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সবই তাদের ধূলিসাৎ হয়ে যায় মক্কা বিজয়ের দিন এবং যেদিন তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়। নিজেদের জীবদ্দশায় এরূপ মর্মান্তিক ছন্দপতন প্রত্যক্ষ করা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী গযব নয় কি? বরং আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণে নিহত হওয়ার চাইতে এটিই ছিল কুরায়েশ নেতাদের জন্য আরও বড় গযব। যুগে যুগে সত্য এভাবেই বিজয়ী হয়েছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

১১. রাস্তায় ছেলে-ছোকরাদের লেলিয়ে দেওয়া :

উপরে বর্ণিত অত্যাচার সমূহের সাথে যোগ হ’ল একটি নিষ্ঠুরতম অত্যাচার। সেটি হ’ল নেতাদের কারসাজিতে ছেলে-ছোকরাদের অত্যাচার। যেহেতু ছোট ছেলেদের সাত খুন মাফ। তাই নেতারা তাদের কাজে লাগালো। আধুনিক পরিভাষায় নেতারা হ’ল গডফাদার এবং ছোকরারা হ’ল টিন এজার সন্ত্রাসী।
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যখন রাস্তায় বেরোতেন, তখনই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছোকরার দল ছুটে আসত। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওদের সালাম দিতেন। ওরা পাল্টা গালি দিত। তিনি ওদের উপদেশ দিতেন। ওরা তখন হি হি করে অট্টহাস্য করত। এভাবে কোন এক পর্যায়ে যখন ওরা রাসূলের দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারা শুরু করত, তখন রাসূল (ছাঃ) আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিতেন। তখন ছোকরারা চলে যেত। আবু সুফিয়ান বাহ্যিক সৌজন্য বজায় রাখতেন। সম্ভবতঃ এরই প্রতিদান স্বরূপ  মক্কা বিজয়ের রাতে সুফিয়ান গোপন অভিযানে এসে ধরা পড়লে রাসূল (ছাঃ) তাকে মাফ করে দেন এবং ঘোষণা দেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিবে, সে ব্যক্তি নিরাপদ থাকবে’।[5]

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ (৯)-

১. সত্য প্রতিষ্ঠায় মূল নেতাকেই আদর্শ হিসাবে সম্মুখে এগিয়ে আসতে হয়।

২. সংস্কারক ব্যক্তি উচ্চ বংশের ও সৎকর্মশীল নেককার পিতা-মাতার সন্তান হয়ে থাকেন।

৩. সংস্কারক নিজ ব্যক্তি জীবনে তর্কাতীতভাবে সৎ হন।

৪. সংস্কারক ব্যক্তি কখনোই বিলাসী হন না।

৫. সংস্কারের প্রধান বিষয় হ’ল মানুষের ব্যক্তিগত আক্বীদা ও আমল।

৬. জাহেলিয়াতের সঙ্গে আপোষ করে কখনোই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

৭. সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হ’লেই তার বিরোধিতা অপরিহার্য হবে।

৮. ইসলামী সংস্কারের বিরুদ্ধে সমাজে প্রধান বিরোধী হবে স্বার্থান্ধ ধর্মনেতা ও সমাজ নেতারা।

৯. যাবতীয় গীবত-তোহমত ও অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করার জন্য সংস্কারককে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকতে হবে।

১০. সংস্কারককে পুরোপুরি মানবহিতৈষী হতে হবে।

১১. স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে ময়দানে নামতে হবে।

১২. আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধান সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল মানবতার প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব- দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে।

১৩. নেতাকে অবশ্যই নৈশ ইবাদতে অভ্যস্ত হ’তে হবে এবং ফরয ও সুন্নাত সমূহ পালনে আন্তরিক হ’তে হবে।

১৪. নেতাকে যাবতীয় দুনিয়াবী লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।

১৫. সকল কাজে সর্বদা স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করতে হবে।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: ছাহাবীগণের উপর অত্যাচার


 

[1] মুসলিম হা/৬৯৯৬

[2] বুখারী, হা/৬৩৭৮; ৪৮১৫

[3] আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮২, ৯৭

[4] মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫১৬

[5] আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪০১

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button