ছোটগল্প/উপন্যাস

পরিণতি

১.

শোভনের রিংটোন শুনে কান খাড়া হয়ে যায় শান্তার। মোবাইলের স্ক্রিনে শোভনের হাসিমাখা চেহারাটা দেখে মূহূর্তেই উবে যায় সমস্ত রাগ, অভিমান। মোবাইলটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে একটু ঝাঁঝ আর অনেক ভালোবাসা মিশিয়ে বলে, ‘কি? তুমি না বলেছিলে আজ ফোন করতে পারবেনা? তোমার এমন কাজ, তেমন ব্যাস্ততা! কই? পারলে আমাকে ছাড়া থাকতে?’

ওপাশে কেবল নীরবতা।

বিরক্ত হয় শান্তা, ‘কি ব্যাপার শোভন? সারাদিন পরে একবার মাত্র ফোন করলে, তাও কোন কথা বলছনা। ব্যাপার কি?’

ওপাশে ফোঁপানোর শব্দ।

সচকিত হয়ে ওঠে শান্তা, ‘কে? কে ওখানে?’

জবাবে দ্বিধা আর অশ্রুমেশানো নারীকন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে, ‘আমি শোভনের স্ত্রী। আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে …’

হঠাৎ হুটোপুটির শব্দ, ধুপধাপ আঘাতের আওয়াজ, আর্তনাদ … ফোনের লাইনটা কেটে গেল।

মাথা ঝিম ঝিম করে ওঠে শান্তার। এইমাত্র কি ঘটে গেল সে কিছুই বুঝতে পারেনা। হৃৎপিন্ড এত দ্রতলয়ে স্পন্দিত হচ্ছে , মনে হচ্ছে যেন এখনই ফেটে যাবে। সে দ্রুত কল দেয় শোভনের নাম্বারে – একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার … কেউ ফোন ধরেনা। এবার ওর মনে পড়ে শোভন বলেছিলো ওর পরিবার খুব রক্ষণশীল। ওর মা যদি জানতে পারেন ছেলে প্রেম করছে তাহলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন। তাই শোভনই সবসময় ওকে ফোন করে, এই প্রথম ওর শোভনের নাম্বারে ফোন করা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, কিন্তু সেই নারীকন্ঠের আওয়াজ ওকে তাড়া করে ফেরে, ‘আমি শোভনের স্ত্রী। আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে …’। মেয়েটা কে? কেনই বা ওকে ফোন করল? কেন ওকে এসব বানোয়াট কথা বলল? শোভন ওকে ভালবাসে, সে ওকে বিয়ে করবে। কিন্তু শোভনের মোবাইল মেয়েটা পেলো কোথায়? অনেক প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খায় ওর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি ছাড়া, ‘মেয়েটি যদি সত্য বলে থাকে?’ যতবারই এই প্রশ্ন মনের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় ততবারই শান্তা শোভনের সাথে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি, ওর সাথে ঘুরতে গিয়ে আনন্দময় মূহূর্তগুলো, ওর কথার মায়াজালে আবিষ্ট হবার অনুভূতির কথা মনে করে সেটিকে মাটিচাপা দেয়।

ঘুম ভাঙ্গে শোভনের রিংটোনে। সাথে সাথে ঝাঁ করে গত সন্ধ্যার দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। ফোন ধরব, ধরব না করেও না ধরে থাকতে পারেনা শান্তা। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে শোভনের চনমনে গলার আওয়াজ, ‘কি গো রাজকন্যা? ঘুম ভাঙ্গলো?’ মনের ভেতর মুখিয়ে থাকা একরাশ প্রশ্নের সাথে এই স্বতঃস্ফুর্ত কন্ঠের কোন সঙ্গতি খুঁজে পায়না শান্তা। শোভন আবার বলে, ‘ওঠ গো রাজকন্যা! দেখ তোমার দুয়ারে কে এসেছে!’ এক মূহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দরজার দিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগায় সে। দরজার বাইরে শোভনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সব ভুলে চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি! এখানে?’

সাথে সাথে ওদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রতিবেশীদের কয়েক জোড়া চোখ। ঢাকায় পড়াশোনা কিংবা চাকরী করতে আসা অনেক মেয়ের মতই শান্তা একা থাকে। মা নেই। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ফিরে গিয়েছেন তাঁর প্রথমা স্ত্রীর সংসারে। কালক্রমে বাবা মেয়ের সম্পর্ক শিথিল হয়ে এসেছে, যদিও তিনি প্রতি মাসের শুরুতে মনে করে বিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। শান্তা নিজেই ভাল আয় করে, এই টাকা ওর প্রয়োজন নেই, সব ব্যাঙ্কেই জমছে। এর চেয়ে সে অনেক খুশি হত যদি বাবা মাসে একবার এসে ওকে দেখে যেতেন। সৎ মায়ের সাথে শান্তার সম্পর্ক ভালো না। সৎ ভাইবোনরা ওর অনেক বড়, সবাই নিজের নিজের ব্যাবসা বাণিজ্য সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, কারো সময় নেই ওর খবর রাখার। প্রতিবেশীরা জানে এই ছেলেটি এই মেয়েটির একাকীত্বের সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু ঢাকার জীবন ব্যাস্ত জীবন। ওদের কারো সময় নেই শুভাকাঙ্খী হয়ে ওকে দু’টো উপদেশ দেয়ার। তবে ব্যাস্ততার মাঝেও এমন রসময় ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য অবশ্য কারো সময়ের অভাব হয়না।

শান্তা চায়না প্রতিবেশীদের রসাত্মক আলোচনার খোরাক হতে। এদের সবাইকে সে ঘৃণা করে। এরা অন্যের মন্দ নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পায়, কিন্তু অন্যের ভাল দেখলে এরা সহ্য করতে পারেনা। গ্রামের মেয়ে শহরে এসে যতই আধুনিকা হোক, ছোটবেলা থেকে নিজের মাঝে গড়ে ওঠা মূল্যবোধের শেকড়টাকে নিমেষে উপড়ে ফেলতে পারেনা সে। গ্রামের ফজিলত দাদী বলতেন, ছেলেরা মেয়েদের কাছে যা চায় তা বিয়ের আগে পেয়ে গেলে আর বিয়ে করতে চায়না, বিয়ে অনেক বড় দায়িত্ব, কে চায় সেধে এই দায়িত্ব কাঁধে নিতে? তাই সে শোভনকে নিয়ে পাবলিক প্লেসে বেড়াতে গেলেও কোনদিন ঘরে প্রবেশ করতে দেয়নি। কিন্তু প্রতিবেশীদের উৎসুক দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার্থে সে শোভনকে ঘরে ঢুকতে বলে। অনেক প্রশ্ন ওর মনে। এই সম্পর্ক টিকতে হলে ওর প্রশ্নের জবাব চাই।

নাস্তার টেবিলে বসে শান্তা কোন ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, ‘মেয়েটা কে?’

শোভন আকাশ থেকে পড়ে, ‘কোন মেয়েটা?’

গত সন্ধ্যার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে শান্তা। সব শুনে শোভন খুব অবাক হয়, ‘তোমাকে তো বলেই ছিলাম গতকাল আমি খুব ব্যাস্ত থাকব। অফিসে এত কাজ ছিলো যে ফোন কোথায় ছিলো খবর ছিলোনা। সেই ফাঁকে হয়ত অফিসের কোন মেয়ের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপে। টেবিলের ওপর ফ্রি মোবাইল পেয়ে কল করে দেয়’।

‘সে আমার নাম্বার পেলো কোথায়?’

‘তুমি তো জানোই আমার মোবাইলে সবসময় লাস্ট কল তুমি। লাস্ট কল টিপে দিয়েছে আর কি!’

শান্তাকে চিন্তিত দেখে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে শোভন, ‘কি নিয়ে এত ভাবছ বল তো! তুমি কি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করনা?’

এবার শান্তা বিব্রত হয়ে পড়ে। নাহ, কে না কে ফোন করেছে সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি করার কোন অর্থ হয়না। তাছাড়া দু’জনেরই অফিসের সময় হয়ে এসেছে। শোভন বার বার তাড়া দিচ্ছে ওর অফিসে যেতে হবে। জরুরী কাজে নাইটকোচেই চলে আসতে হয়েছে ওকে। এত কষ্ট করার পর যদি কাজটা উদ্ধার না হয় তাহলে অফিসে কি বলবে? শান্তা দ্রুত প্লেটগুলো গুছিয়ে গিয়ে অফিসের জন্য রেডী হয়ে আসে। এবার শোভন বাথরুমে ঢোকে। ডাইনিং রুমে টেবিলের ওপর শোভনের মোবাইলটা পড়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনা শান্তা। একবার বাথরুমের দরজার দিকে চকিতে নজর দিয়ে মোবাইলটা তুলে নেয়, কল হিস্ট্রি চেক করে। একটু আগে শান্তাকে করা কল ছাড়া পুরো কল হিস্ট্রি ফাঁকা। কি মনে করে কন্ট্যাক্ট লিস্টও চেক করে সে, নাহ, কোথাও ওর নাম বা নাম্বার নেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শান্তা। কাজ থেকে ফিরে শোভনের সাথে কথা বলতে হবে।

সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে বসে শান্তাকে খাবার খুটতে দেখে শোভন খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার? খাচ্ছ না যে!’

শান্তা আবদারের সুরে বলে, ‘শোন, এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে আমার আর ভাল লাগছেনা। আমি আমাদের প্রেমের স্বীকৃতি চাই। চল, আমরা বিয়ে করি। এবার তুমি বাড়ী ফিরে যাবার সময় আমি তোমার সাথে যাব’।

শোভন খেতে খেতে বলে, ‘পাগল হয়েছ? মা তোমাকে আর আমাকে দু’জনকেই কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবেন’।

‘দেবেন না। আমি ওনার পা ধরে ওনার কাছে ওনার ছেলেকে ভিক্ষা চাইব। উনি রাজী না হয়ে পারবেনই না!’

হেসে ফেলে শোভন, ‘মাকে রাজী করতে তোমার যতদিন সময় লাগবে তত লম্বা ছুটি তোমাকে অফিস থেকে দেবেনা’।

‘দেবে, আমি অফিসে কথা বলে এসেছি’।

এবার শোভন খাওয়া বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ‘তুমি তো দেখছি সিরিয়াস!’

শান্তা এবার উদগ্রীব হয়ে বলে, ‘তুমি কি ভেবেছ মিথামিথ্যি বলছি? দেখ শোভন, আমরা দু’বছর যাবত বিয়ে করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আছি। আর কত অপেক্ষা করব বল? মাকে তো কোন না কোন একদিন কথাটা বলতেই হবে, তবে আজ কেন নয়?’

শোভন কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘হুট করে তোমাকে নিয়ে গেলে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে। এবার আমি একা যাই। গিয়ে মাকে তোমার কথা বলব। আগামীবার আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাব’।

আনন্দে ক্ষিদে পেয়ে যায় শান্তার। সে সাগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবারের ওপর।

 

২.

আনন্দে উচ্ছ্বাসে দিন কাটে শান্তার। শোভন কোনদিন ফোন করে বলে, ‘আজ মাকে তোমার কথা একটু করে বললাম’; কোনদিন বলে, ‘আজ মা তোমার নাম জিজ্ঞেস করলেন’; আরেকদিন বলে, ‘মা তোমার ছবি দেখতে চেয়েছেন’।

একদিন ছুটির দিনে বিকেলে শুয়েবসে মনের ক্যানভাসে কল্পনার রংতুলিতে নানান ছবি আঁকছিলো শান্তা। কোন বেরসিক ফোন করল এ’সময়? অপরিচিত নাম্বার। অলসভাবে ‘হ্যালো’ বলে শান্তা। ওপাশ থেকে ভেসে আসে, ‘হ্যালো, আমি ঝর্ণা’।

শান্তা ঝর্ণা নামের কাউকে চেনেনা, কিন্তু ওপাশের গলাটা শুনে পরিচিত মনে হয়। ‘শান্তা, আমি তোমার পায়ে পড়ি, আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে, তুমি আমার সংসারটা ভেঙ্গে দিয়োনা’, কান্নার গমকে কথা বন্ধ হয়ে যায় মেয়েটার।

হঠাৎ বিবিধ নারীকন্ঠে চিৎকার শোনা যায়, ‘অ্যাই, ওকে ছেড়ে দে’, ‘খবরদার বললাম ওর গায়ে হাত তুলবি না’, ‘মাগো!’, ধুপধাপ কিলঘুষি, নারীদের সম্মিলিত চিৎকার আর কান্না … লাইনটা কেটে যায়।

শান্তার মন থেকে সমস্ত সুখকল্পনা হাওয়ায় উড়ে যায়। সে নিশ্চিত এই মেয়েটাই ওকে শোভনের নাম্বার থেকে ফোন করে বলেছিল, ‘আমি শোভনের স্ত্রী। আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে …’, সেই গলা ওর ভুল হতেই পারেনা। আজ আবার বলল, ‘শান্তা, আমি তোমার পায়ে পড়ি, আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে, তুমি আমার সংসারটা ভেঙ্গে দিয়োনা’। কে এই মেয়ে? কেন সে বার বার ওকে বিরক্ত করছে?

সন্ধ্যায় শোভন ফোন করল, মা রাজী হয়েছেন, আগামী মাসের এক তারিখে বিয়ে, ঢাকায়। বাঁধভাঙ্গা আনন্দের মাঝেও প্রশ্নটা ওর মনের ভেতর খচ খচ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে বলেই ফেলে, ‘শোভন, তুমি কি ঝর্ণা নামে কাউকে চেন?’

‘না তো! কেন?’

‘এই নামে একটা মেয়ে আজ আমাকে ফোন করে বলল আমি ওর সংসার ভেঙ্গে দিচ্ছি। আমি নিশ্চিত এই মেয়েটাই আমাকে বলেছিল সে তোমার স্ত্রী’।

‘শোন, তোমার হবু স্বামী যে মেয়েদের কাছে পাত্র হিসেবে কত পপুলার তারই প্রমাণ এটা। হবে কোন মেয়ে, আমার অজান্তে আমার প্রতি আকৃষ্ট। এখন তোমার সাথে বিয়ের কথা শুনে হিংসায় এমন করছে। মাথা থেকে এসব বাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেল তো! আমাদের এই আনন্দের মূহূর্তটা আমি কোনভাবেই নষ্ট করতে চাইনা’।

এক তারিখে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করে শোভন আর শান্তার বিয়ে হয়ে যায়। শান্তার পক্ষ থেকে আসে কেবল ওর বাবা আর সবার বড় সৎভাইটি। শোভনের পক্ষ থেকে শুধু ওর মা। শান্তা কিছু বন্ধুবান্ধবকে দাওয়াত দেয়। শোভনকেও বলে ওর সহকর্মী, বন্ধুদের বলতে। কিন্তু শোভন ওর খরচ বাড়াতে চায়না বলে কাউকে বলেনি। শোভনের মাকে দেখে বেশ অবাক হয় শান্তা। ছোটখাটো, চুপচাপ এই মানুষটাকে দেখে সে কিছুতেই শোভনের বর্ণনার সাথে মেলাতে পারেনা। শোভন ওনাকে ভয় পাবে কি, ওনাকেই দেখে মনে হয় ছেলের ভয়ে তটস্থ! হাঁটতে চলতে ওনার প্রচন্ড কষ্ট হয়। বিয়ের পরদিনই উনি গোঁ ধরলেন বাড়ী চলে যাবেন। ছেলে বৌয়ের বাসায় উঠেছে সেটা তার ব্যাপার, তিনি কোনভাবেই পরের মেয়ের ঘাড়ের ওপর উঠে বসতে পারবেন না। অনেক অনুনয় বিনয় করে তাঁকে বোঝানো হোল। কিন্তু তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ অস্পষ্ট উচ্চারণে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে রইলেন। শোভন বলল, ‘আমি যাই, মাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি’।

শান্তা কিছুতেই রাজী না। সে বলল, ‘চল, আমরা দু’জন গিয়ে তাঁকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। এই সুযোগে তোমাদের বাড়ীটাও আমার দেখা হয়ে যাবে’।

শোভন আপত্তি জানায়, ‘কি বল? নতুন বৌ কি এভাবে শ্বশুরবাড়ী যেতে পারে নাকি? তোমাকে স্বাগত জানাবে কে? অনুষ্ঠান করবে কে? মা তো এখানে!’

শান্তা কিছুটা দমে গিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে, তাহলে তুমি গিয়ে মাকে বাড়ীতে দিয়ে এসো’।

এর দু’বছর পর। শান্তার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। শোভন বাচ্চা নিতে কিছুতেই রাজী ছিলোনা। কিন্তু শান্তা জানে বয়স তো আর বসে থাকবেনা, তাই সে একাই সিদ্ধান্ত নেয়। এখন সে মেয়ে মায়াকে নিয়ে প্রচন্ড খুশি। কিন্তু শোভনের যে কি হোল কে জানে! সে বলল, ঘরখরচ সে একা কাজ করে চালাতে পারবেনা। তাই তিনমাস পর ছোট্ট পুতুলটাকে পাড়ার এক মহিলার হাতে তুলে দিয়ে আবার কাজে যাওয়া শুরু করে শান্তা। ঘরের সব খরচ সে একাই চালায়। শোভনের টাকা মাকে পাঠিয়ে দিতে বলে। শোভন প্রথমে আমতা আমতা করলেও পরে রাজী হয়ে যায়।

একদিন শোভন বাথরুমে ঢুকেছে। ওর ফোনে একটা কল আসতে দেখে ফোন ধরে শান্তা। ওপাশ থেকে এক মহিলা খুব ব্যাস্তভাবে বলে, ‘মো … শোভন কই? সে নাই?’

শান্তা বলে, ‘ও তো বাথরুমে। আপনি কে বলছেন? আপনার মেসেজটা বলে দিন, ও বেরোলে আমি কলব্যাক করতে বলব’।

‘আমি মুক্তা, শোভনের বড়বোন। ওকে বল মা খুব অসুস্থ। এখানে আর চিকিৎসা হবেনা, ঢাকা নিতে হবে। খরচ আমি দেব। সে যেন শীঘ্র ব্যাবস্থা করে’।

থ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে শান্তা। শোভনের বড়বোন? সে তো বাবামার একমাত্র ছেলে! ইনি তবে কে?

 

৩.

শোভন বাথরুম থেকে বেরোলে শান্তা ওকে খবরটা দেয়। শোভন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ওর প্রশ্নেরও কোন জবাব দেয়না। কিন্তু শান্তা মনে শান্তি পায়না। ফোন যেই করে থাকুক, মা অসুস্থ এটাই এখন প্রায়োরিটি। পরদিন সে অফিস থেকে ফেরার পথে দু’টো টিকেট করে এনে শোভনকে বলে, ‘অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি। কাল আমরা মাকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি’।

প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় শোভন। ওর এত রেগে যাবার কারণ বুঝতে পারেনা শান্তা। আজকাল প্রায়ই সে কারণে অকারণে রাগারাগি করে। নিশ্চয়ই মায়ের জন্য মন খারাপ, এই ভেবে পাত্তা দেয়না শান্তা। কোন জবাব না দিয়ে ধীরেসুস্থে স্যুটকেস গুছাতে থাকে। পরদিন ভোরে শোভনের খিটিমিটির মধ্যে ট্যাক্সি ডাকিয়ে বাস স্টেশনে রওয়ানা দেয় ওরা। বাসে উঠেও শোভনের মুডের কোন উন্নতি হয়না। সাত ঘন্টা পর বাস থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়ীর উঠোনে থামে ওরা। সাধারন গ্রামীন চাষীদের বাড়ী যেমন। দেখে মনে হয় যেন কতদিন এখানে কেউ থাকেনা। অনেকক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ার পর পাশের বাড়ীর এক মহিলা বেরিয়ে এসে বলে, ‘তুই এসেছিস, …র বাচ্চা! বুড়া মা’টাকে উঠানের মধ্যে ফেলে দিয়ে যে চলে গেলি, দুই বছরে একবারও কি মনে হোলনা দেখে আসি বুড়ি মরল না বেঁচে আছে?’

শোভন কোন জবাব দেয়না। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘বড়বুবু ফোন করে বলল মা অসুস্থ, সেজন্যই তো এলাম। তো মা কই?’

‘সে তো তখনই মুক্তা এসে তোর মাকে নিয়ে গেল। এমন কঠিন রোগী এখানে একা একা বাঁচত কি করে?’

আবার রিক্সায় চেপে বসে ওরা। শোভনের মুখের অবস্থা দেখে শান্তা কোন প্রশ্ন করেনা। শোভনের মা এত অসুস্থ, অথচ মহিলার কোন কমন সেন্স নেই, কিভাবে এত কড়া কড়া কতগুলি কথা বলল বেচারাকে! অথচ সে নিজের স্ত্রী সন্তানের পেছনে ব্যায় না করে প্রতিটি পয়সা মাকে পাঠিয়ে দেয়!

কিছুদূর গিয়ে একটি মোটামুটি অবস্থাপন্ন গৃহস্থবাড়ী দেখা গেল। গৃহস্থ বাড়ীর আঙ্গিনায় আরামকেদারায় বসে পড়ন্ত বিকেলের রোদ পোহাচ্ছিল। ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। বাড়ীর ভেতর হাঁক শোনা গেল, ‘বৌ, তোমার কুলাঙ্গার ভাই এসেছে’। একজন বিশালকায় মহিলা ব্যাস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। কোন অভিবাদন নয়, অভ্যর্থনা নয়, নীরবে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন বাড়ীর ভেতর। একটা বড় কামরার ঠিক মধ্যখানে বিশাল একটা খাটের ওপর শুয়ে আছেন শীর্ণকায়া মা, হাড়ের সাথে চামড়া যেন লেগে গিয়েছে। সেই হাড্ডিচর্মসার দেহের সেবায় ব্যাস্ত তিন চারজন মেয়ে। একজনকে দেখে বুঝা গেল নিশ্চয়ই সেই বিশালকায়া মহিলার মেয়ে, বিবাহিতা, কোলে বাচ্চা, সযত্নে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যে পায়ে হাত বুলাচ্ছে সে সম্ভবত ওনার ছোটমেয়ে, হয়ত ক্লাস নাইন টেনে পড়ে। আরেকটা মেয়ে ঔষধপত্র গুছিয়ে, বাসী খাবার পানি নিয়ে যাচ্ছে, এর খুব কমই খাওয়া হয়েছে। শোভনকে দেখে কেউ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না সামান্য নাক কুঁচকানো ছাড়া। শোভন পাত্তা দিলোনা। মায়ের পাশে গিয়ে ‘মা’ বলে ডাক দিতেই তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। ওকে চিনতে পারার সাথে সাথে এক অপার্থিব চিৎকার বেরিয়ে এলো ওনার গলার ভেতর থেকে। চোখ দিয়ে ফোয়ারার মত পানি বইতে লাগল, ‘কি এক হতভাগা জন্ম দিলাম আমি! তুই আমার দুনিয়া আখিরাত সব খেলি। এখন আমি আল্লাহর সামনে গিয়ে কি জবাব দেব?’ তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হোল, বুকের ভেতর ঘড় ঘড় শব্দ হতে লাগল। সেই বিশালকায়া মহিলা শোভনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে মাকে জাপ্টে ধরল। কিন্তু মাকে রাখতে পারল না। আর দশ পনেরো মিনিট প্রচন্ড কষ্ট ভোগ করে তিনি পার্থিব শরীরটাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন।

যে মূহূর্তে স্পষ্ট হয়ে গেল মা নেই, সেই বিশালকায়া মহিলা তার পাহাড়ের মত শরীর নিয়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে শোভনের দিকে ফিরে হিংস্র বাঘিনীর মত গর্জন করে উঠল, ‘তুই খুনী, তুই খুনী। তুই আমার মাকে খুন করেছিস। বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। নইলে আমি তোকে খুন করব’। তাঁর দুই মেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তাঁকে আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল। শোভন কোন কথা না বলে বের হয়ে গেল। এই গলা শান্তার পরিচিত। ইনিই তবে মুক্তাবুবু। সে এগিয়ে গিয়ে মায়ের চোখ দু’টো আলতো করে বন্ধ করে দিলো, ঐ দৃষ্টিতে যে ভয় ছিলো তা সে সহ্য করতে পারছিলোনা। জীবনের সমাপ্তি চোখে দেখতে পেলে নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে বুঝি এমনই ভয় ছেয়ে যায় মৃত্যুপথযাত্রীর দুই চোখে। মুক্তা এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শান্তা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলে, ‘বুবু, শান্ত হোন। তিনি তো শোভনেরও মা ছিলেন!’

মুক্তা উদ্ভ্রান্তের মত ফিরে তাকায় শান্তার দিকে। সেই পাহাড়ের মত শরীর আর লাল লাল চোখ দেখে ভয় পেয়ে যায় শান্তা। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘শোভন? ওর নাম তো মোক্তার! ওকে শোভন নামে শুধু তুমিই চেন’।

শান্তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। না! ওর নামটা! নামটাও সে ওকে মিথ্যা বলেছে?

‘মোক্তার বিয়ে করেছিল ঝর্ণাকে। বড়লোকের মেয়েকে সুন্দর সুন্দর কথায় ভুলিয়ে বিয়ে করল ঠিক, কিন্তু কাজ নেই কর্ম নেই, নিজেই চলতে পারেনা, বৌ চালাবে কি করে? ঝর্ণার বাবা মাসে পাঁচ হাজার টাকা ধরে দিলো ওদের কাপড়ের দোকান থেকে। ঐ টাকা আনতে সে মাসে একবার ঢাকায় যেত। ঐ দোকানে গিয়ে দেখা পেলো তোমার। ঝর্ণার তখন বাচ্চা হবে। তখন আর ওকে ভাল লাগেনা মোক্তারের। সে তখন তোমার প্রেমে মজেছে। আমরা অনেক বুঝালাম, পরে ভাবলাম একবার বাচ্চা হয়ে গেলে সন্তানের মায়ায় সে ফিরে আসবে। মা, আমি ঝর্ণার টুকটাক বদনাম করতাম। এটা না করলে ঘরের বৌয়ের উপর পাওয়ার দেখানো যায়না। কিন্তু আমরা কখনোই চাইনি ওর ঘর ভাঙ্গুক। একবার সে তোমাকে ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করে। কি মারটা মেরেছিল ওকে পাষন্ডটা, দুই সপ্তাহ চোখ খুলতে পারেনি মেয়েটা। অথচ পরের দিন সে আবার ওদের দোকান থেকে টাকা আনতে গেল! মেয়েটার যে এত সহ্যশক্তি ছিলো! এগুলো কিছুই সে তার বাবামা ভাইদের বলতনা। পালিয়ে বিয়ে করে একবার ওদের সমাজের কাছে অপদস্থ করেছে, আবার যাতে কিছু না হয় সেজন্য কি সহ্য করেনি সে! কিন্তু পারলনা তো সংসারটা টিকাতে। তোমার মোটা মাথায় কিছুই ঢুকলোনা। তোমার কাছে শেষ একবার আর্জি জানানোর জন্য আমিই ওকে ফোনটা করে দেই। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। মোক্তার টের পেয়ে ওকে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দিলো। মানুষ কোন পশুকেও ঐভাবে মারেনা। অবুঝ বাচ্চাটা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে। মেয়েটা সেই সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে বন্ধ দুয়ারের বাইরে বসে কাঁদল। কিন্তু মোক্তার আমাদের দরজার কাছেও যেতে দিলোনা। ঝর্ণাকে মারতে দেখে মা ‘অ্যাই, ওকে ছেড়ে দে’ বলে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখন বুঝিনি মায়ের স্ট্রোক হয়ে যায়। আমি মাকে নিয়ে বসে আছি, ডাক্তার আনার জন্য চিৎকার করে কাঁদছি, এর মধ্যে সেই পশুটা দরজা পাহাড়া দিতে দিতে তোমাকে বিয়ের খোশখবর শোনায়, বাইরে তখনও বৌটা বসে কাঁদছে। আমার অসুস্থ মা’টাকে চিকিৎসার কথা বলে ঢাকায় তোমার বিয়ে খেতে নিয়ে যায়। আবার দুইদিন পর বাড়ীর উঠানে ফেলে রেখে চলে যায়। এই দুই বছরে না একটা টেলিফোন, না একটা টাকা, না কিছু …’

‘কিন্তু ও তো ওর বেতনের সম্পূর্ন টাকা মায়ের জন্য পাঠাত!’

‘ও কিছু করলে তো বেতন! ঝর্ণাদের দোকানের টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তো একটা টাকাও আয় করে নাই, তাহলে টাকা পাঠাবে কোত্থেকে?’

পৃথিবীটা দুলে ওঠে শান্তার চোখের সামনে। তারপর ওর আর কিছু মনে নেই।

 

৪.

পরদিন একটা অপরিচিত খাটে নিজেকে আবিষ্কার করে শান্তা। মুক্তাবুবুর বড় মেয়েটা নিজের বাচ্চা আর মায়াকে মাদুর পেতে একসাথে রোদে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। এই অনিন্দ্য সুন্দর ভালোবাসার দৃশ্যটা দেখে শান্তার মনে হয় যেন গতরাতে যা ঘটেছে তা ছিলো এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু প্রত্যক্ষ সবকিছু সাক্ষ্য দেয়, ওর দুঃসহ স্মৃতিটা আসলেই বাস্তবতা।

সে মাথা তুলে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কি?’

‘নাবিলা’।

‘তুমি কি একটু মায়াকে দেখবে? আমি একটু বাইরে যাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে’।

‘ও মা, আমি তো রাত থেকেই ওকে দেখছি! আপনি যান’।

মাথা ঝিমঝিম করে শান্তার। পুকুরপাড়ে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে ঝির ঝির বাতাসে মাথার ভেতরের সব জঞ্জাল উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সে। একটু পর একটা শিশুর খিল খিল হাসির শব্দ, সাথে কোন নারী, সম্ভবত শিশুটির মায়ের, প্রশ্রয়দায়িনী নির্মল হসির আওয়াজ শুনে চোখ তুলে তাকায় শান্তা। পুকুরের ঐ পাড়ে একটা অসম্ভব সুন্দর শিশু এক অসম্ভব রূপবতী মায়ের কোলে বসে স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরোটা পুকুরপাড় জুড়ে। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় শান্তার। সেই টানা টানা চোখ কি যেন বলতে চায়। দু’জনই দু’জনের দিকে এগিয়ে যায় অমোঘ আকর্ষনে।

মেয়েটা অপ্সরীর মত রিনরিনে কন্ঠে বলে, ‘শান্তা, তাই না?’

গলাটা কেমন পরিচিত মনে হয়। কিন্তু একটা অপরিচিত মেয়ে ওকে নাম ধরে ডাকছে, ব্যাপারটাতে প্রচন্ড অবাক হয় শান্তা। মেয়েটা আবারও বলে, ‘তুমিই তবে শান্তা, মোক্তারের … শোভনের বৌ’।

‘তুমি?’

‘আমি ঝর্ণা। মোক্তারের … শোভনের বৌ ছিলাম’।

শান্তার বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে আসে, সে ঝর্ণার দু’হাত মুঠো করে ধরে বলে, ‘বিশ্বাস কর, আমি জানতাম না’।

ঝর্ণা বলে, ‘না, তুমি জানতে চাওনি’।

কোন অভিযোগ না, অভিমান না, নিখাদ সত্যের উপস্থাপনা। আসলেই তো, সত্য বার বার শান্তার সামনে এসে কড়া নেড়েছে কিন্তু সে নিজের সুখের পেছনে ছুটতে গিয়ে কিছুতেই তার আহ্বানে সাড়া দিতে পারেনি।

‘তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো’।

‘সে তো কবেই দিয়েছি! মোক্তারের বৌ হওয়াটাই তো একটা শাস্তি! আমি আর তোমার ওপর রাগ রেখে কি করব? আমি পাপ করেছিলাম। ওকে বিশ্বাস করে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলাম। তার শাস্তি তো আমি, আমার বাবামা, আমার পুরো পরিবার মিলে পেলাম। ও আমাকে বের করে দিয়ে আসলে আমাকে মুক্তি দিয়েছে, আমার গুনাহ শেষপর্যন্ত মাফ হয়েছে’।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চায়, ‘পুকুরের ঐ পাড়ে আলিশান বাগানবাড়ীটা নিশ্চয়ই তোমার বাপের বাড়ী!’

‘কে বলল? ওটা আমার বাড়ী। আমার স্বামীর বাড়ী। তিন বছর আগে ওর বৌ মরল বাচ্চা হতে গিয়ে। সে সিদ্ধান্ত নিলো আর বিয়ে করবেনা। কিন্তু যখন মোক্তার আমাকে বের করে দিলো তখন মুক্তা বুবু ওর সাথে কথা বলে, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করল। কেমন হালে আছি তা তো দেখছই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা মানুষটা খুব ভাল। আমাকে, আমার বাচ্চাকে নিজের মত করে যত্ন করে’।

‘বিশ্বাস কর, তুমি ভাল আছ দেখে ভাল লাগছে। আমাকে মাফ করে দিয়ো ঝর্ণা’।

ঝর্ণা কিছু বললনা। মুক্তাকে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বুবু, লোকজন কবর দিয়ে ফিরেছে?’

‘আমার ছেলে ছোটটা এসে বলল মোনাজাত শেষ, যেকোন সময় ফিরবে। রায়হানকে বলেছি আমাদের এখানে এসে নাস্তা খেতে, তুমিও চলে আস’।

তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে শিশুটিকে কোলে আহ্বান করে, শিশুটিও খিল খিল করে হাসতে হাসতে মুক্তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শান্তার দিকে তাকিয়ে মুক্তা বলে, ‘ওর নাম মুসলিম’। তারপর আর কিছু না বলে বাড়ীর দিকে এগোতে থাকে। শান্তা আর ঝর্ণা নিঃশব্দে অনুসরন করে।

নাস্তার পর্ব শেষে শোভন আর শান্তা ফিরে আসে ঢাকায়। ঝর্ণার স্বামী রায়হানকে এক নজর দেখে ওর মনে হয় এই বাড়ীর সবাই যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনই মনের দিক থেকেও পবিত্র। ওদের সাথে নিজের ভাগ্যের তুলনা করে কেমন একটা হাহাকার জন্মায় ওর মনের ভেতর।

 

৫.

ঢাকায় ফিরে আগের মতই সংসার চলতে থাকে ওদের। গ্রামে যাবার ঘটনা নিয়ে কেউ কথা তোলেনা। শান্তা থাকে ওর নিজের জগত নিয়ে, আর শোভন পড়ে থাকে ওর মোবাইল নিয়ে। একদিন শান্তার মাথায় আসে, শোভনের তো কোন বন্ধু নেই, আত্মীয়স্বজন ওকে ঘৃণা করে, তাহলে সে সারাদিন মোবাইলে কি করে? একদিন কৌতুহলী হয়ে শোভন বাথরুমে থাকার সুযোগে কল হিস্ট্রি চেক করে শান্তা। শুধু একটা কল দেখাচ্ছে, আর পুরোটা ফাঁকা। অথচ শোভন সকাল থেকে অন্তত দশটা কল করেছে। ঐ নাম্বারে কল দিয়ে শুনতে পায় একটা অপরিচিত নারীকন্ঠ, মনের মাধুরী মিশিয়ে বলছে, ‘কি? আমাকে ছাড়া থাকা যায়না, না?’ হুঙ্কার শুনে পেছন ফিরে দেখে শোভনের উদ্যত হাত, ওর আর কিছু মনে নেই।

যখন জ্ঞান ফেরে তখন রাত। শান্তা নিজেকে আবিষ্কার করে ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে, যেখানে সে পড়েছিলো সেখানেই। মায়া এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে ড্রয়িং রুমের সোফায়, চেহারাই বলছে ক্ষুধায় কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেডরুমে শোভন পুরো বিছানা জুড়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে, নাক ডাকছে অল্প অল্প। শান্তার আজ রাতে ইউনিভার্সিটির বান্ধবীদের সাথে একটা ছোটখাটো পুণর্মিলনী হবার কথা ছিলো, স্লিপ ওভারের মত। সে কিছুক্ষণ সোফায় বসে ভাবে। তারপর বারান্দায় গিয়ে সেলফোন থেকে বান্ধবী আলিয়াকে কল দেয়, ‘আলিয়া, নাতাশা আনিকা ওরা এসে পৌঁছেছে? আমি পথে দোস্ত, জ্যামে আটকে আছি। ট্রাফিকের শব্দ শুনতে পাচ্ছিস না? কতক্ষণে পৌঁছাতে পারব জানিনা। কিন্তু পথে যেহেতু, কোন না কোন এক সময় তো পৌছবই। আজ সারারাত একটুও ঘুমাবো না, শুধু গল্প করব, এই আমি কথা দিলাম। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তুই টেবিলে খাবার দে’।

বারান্দা থেকে রান্নাঘর হয়ে বেডরুমে যায় শান্তা। কিছুক্ষণ পর মুখহাত ধুয়ে, জামাকাপড় বদলে, ব্যাগ আর ঘুমন্ত মায়াকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দরজাটা খোলা রেখে।

সারারাত গল্পগুজবে কাটিয়ে দুপুর বারোটার দিকে বাড়ী ফিরে শান্তা দেখে ঘরভর্তি পুলিশ। ‘কি ব্যাপার? আপনারা আমার ঘরে কি করছেন?’ পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করেন সে কোথায় ছিলো, কোথা থেকে আসছে। শান্তা আলিয়ার নাম্বার দেয়। পুলিশ অফিসার আলিয়াকে ফোন করে নিশ্চিত হোন। তারপর বলেন, ‘সরি ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। আমরা আপনাকে সন্দেহ করছিনা, কিন্তু এটা রুটিন চেক ছিলো। আই অ্যাম অ্যাফ্রেড আই হ্যাভ স্যাড নিউজ ফর ইউ। আমরা অনুমান করছি আপনারা যাবার পর আপনার হাজব্যান্ড দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। বাসায় সম্ভবত ডাকাত পড়েছিল। হয়ত আপনার হাজব্যান্ড ঘুম থেকে জেগে যান, ওরা ওনাকে খুন করে সম্ভবত ভয়ে পালিয়ে যায়। ঘরের জিনিসপত্র তেমন কিছুই নিতে পারেনি। আই অ্যাম সরি ফর ইয়োর লস’।

শান্তা কোন কথা বলতে পারেনা। মায়াকে শক্ত করে চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ে। একজন মহিলা পুলিশ অফিসার এসে ওকে বাতাস করতে থাকে। দুই চোখে অশ্রুর বান ডাকে শান্তার। সে মনে মনে বলে, ‘আই অ্যাম নট’।

 

– রেহনুমা বিনতে আনিস

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button