সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিং ও হয়রানি

আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। ভবিষ্যতে শুধু নিজের নয় উন্নতি করবে দেশেরও। এমনই ভাবনা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে মেয়েরা। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন। কথায় আছে- শেষ ভালো তার, যার শুরু ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার পর প্রথম দিনই যার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা, তা হচ্ছে র্যাগিং। হাইস্কুল ও কলেজে আমরা যে র্যাগের কথা শুনতাম, ইউনিভার্সিটিতে নাকি জুনিয়রদের সিনিয়ররা র্যাগ দিয়ে থাকে। সেই র্যাগিংই যখন সব সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষাজীবনের কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকে। সিনিয়রদের কাছ থেকে কী শিক্ষা নিয়ে জুনিয়ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী কয়েকটা বছর পার করবে। আর বংশপরম্পরায় তারাও কি ফেরত দেবে এই আচরণ তাদের জুনিয়রদের?

আমাদের সব সরকারি বেসরকারি কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে র্যাগিং বর্তমানে একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা দ্বারা র্যাগিং নামের বখাটেদের প্রহসনের শিকার হচ্ছে নতুন শিক্ষার্থীরা। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লুবনা (ছদ্মনাম) বলেন, ভর্তির পর যেহেতু এটাই প্রথম দিন ইউনিভার্সিটির, তাই কারোর সাথে কারোর তেমন চেনাজানা নেই। একজন আরেকজনকে হাই হ্যালো করে শুরু করলাম নিজেদের ভেতরকার পরিচিতি পর্ব। হঠাৎ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রছাত্রী আমাদের ছত্রভঙ্গ করে একেকজনকে আলাদা আলাদা রুমে নিয়ে গেল। তাদের সবার হাঁকডাক আর শারীরিক গঠনের কাছে আমরা নিতান্তই অসহায় হয়েছিলাম। তারপর শুরু হলো আমাদের ভয়াবহ র্যাগিং। ছেলেমেয়ে কেউই বাদ পড়ল না। এর মধ্যে দু’জন ক্লাসমেটের ভয়াবহ র্যাগের কথা উল্লেখ করতে চাই। আমার এক ক্লাসমেটকে (মেয়ে) একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে একটা জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে বলা হয় এতে টান দিতে, আর এরপর এটিকে দাঁত দিয়ে পিষে খেয়ে ফেলতে। ওতো অন্ধকার ঘরে এসে কান্না শুরু করে দেয়; কিন্তু এত কিছুর পরেও ক্ষান্ত হয়নি ওই সিনিয়ররূপী ইভটিজাররা। এ জুনিয়র ছাত্রীকে বাধ্য করে সিগারেট খেতে। আরেকজন ছাত্রীকে একজন সিনিয়র ছাত্র এসে বলে, তুমি তো ছোট তাই তোমার শাস্তির পরিমাণটা একটু কমানো হলো; তোমাকে বরং একটি সিনেমার গানের নায়িকার মতো নাচতে হবে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো অনেকেই দেখেছিল এই র্যাগের নামে ভয়াবহ ইভটিজিংয়ের দৃশ্যগুলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি।

রুবির বড় ভাই কলেজে পড়া অবস্থায় র্যাগের শিকার হয়, যার পরিণতি এতটাই দুঃখজনক, যা একটি পরিবারকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। র্যাগের নামে রুবির ভাইকে মাদক সেবন করানো হয়। এতে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তার শরীর-মন সব এত তিক্ত অভিজ্ঞতায় ন্যস্ত থাকে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন বলে জানালেন চিকিৎসকেরা। তার পরও শহরের নামকরা একটি রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। রুবির মা ছেলের এই পরিণতি সহ্য করতে না পেরে হার্ট অ্যাটক করে মৃত্যুবরণ করেন। অন্য ভাইয়েরা তার সাথে সম্পর্ক রাখে না। রুবি আর তার বাবা প্রতীক্ষায় থাকনে কবে তার ছেলে ভালো হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।

র্যাগিং এর প্রথম শুরুটা হয়েছিল গ্রিক কালচারে সপ্তম ও অষ্টম শতকে। খেলার মাঠে টিম স্পিরিট আনার জন্য। পরে ধীরে ধীরে পশ্চিমা ইউনিভার্সিটিতে এটা ঢুকে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এর প্রচলন শুরু হয় বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে। আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে এর প্রচলন শুরু হয় ১৮২৮ থেকে ১৮৪৫ সময়ে আমাদের উপমহাদেশে এ অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে ইউরোপিয়ানদের মধ্যমে। যে সব দেশ থেকে র্যাগিং এসেছিল সময়ের সাথে সাথে তারা এ খারাপ প্রথম ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে আমাদের উপমহাদেশে। বিশেষ করে আমাদের দেশে এখনো এ ভয়ঙ্কর প্রথা রয়ে গেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাগিং নিষিদ্ধ করেছে। তবুও চলছে এ প্রথা। এতে ছাত্রীরা প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধাক্কা খায়। তাই সময় এসেছে এই খারাপ প্রথাকে বন্ধ করার।

 

– বদরুন নেসা নিপা / ইনকিলাব

 

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button