জীবনের বাঁকে বাঁকে

আমার ভাগ্য কী আমার হাতে

The lamb thy riot dooms to bleed today,

Had he thy reason, would he skip and play?

Pleas’d to the last, he crops the flow’ry food,

And licks the hand just rais’d to shed his blood.

Oh blindness to the future! kindly giv’n,

That each may fill the circle mark’d by Heav’n:

কবি আলেকজান্ডার পোপের এই চিত্রকল্পটি যখন প্রথম পড়েছিলাম তখনও আমি ইসলাম বোঝা শুরু করিনি। কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই খুব মনে ধরেছিল। একটা ভেড়া যদি জানত আজ তার জীবনের শেষ দিন, সে কি লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করতে পারত? সেকি তার এতদিনের পালক কিন্তু ভবিষ্যত হন্তারকের হাত থেকে খাবার খেতে পারত? আসলে আল্লাহ অনেক দয়া করে ভাগ্যকে আমাদের সামনে অজানা রেখেছেন নয়ত আমরা একটি দিনও চলতে পারতামনা।

জ্ঞান প্রকাশ্যের আকাঙ্খা যাদের মধ্যে প্রবল তাদের বিতর্কের একটা প্রিয় বিষয় হচ্ছে ভাগ্য। অবশ্য শুধু পন্ডিত নয়, ভাগ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করে সাধারণ মুসলিমরাও বিপদে পড়ে যায় প্রায়ই। ভাগ্য অদৃশ্য জগতের ব্যাপার। অতীতকে আমরা দেখি কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে তা কেউ জানে না। হস্ত-বিশারদ নামের কিছু বদ্ধ উন্মাদ ভবিষ্যত জানার দাবী করে কিন্তু এদের একটা কথা মেলে তো দশটা মেলে না। আরে ভবিষ্যত জানলে তো লটারীর টিকিট বা সস্তা শেয়ার কিনে বড়লোক হওয়া উচিত, মানুষের হাত ধরে ধাপ্পাবাজী কেন করা? মানুষ আসলে ভবিষ্যত জানে না, ভবিষ্যতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে আছে, আর কারো কাছে নেই। ইসলামে ভাগ্য সম্পর্কে শিক্ষাটা খুব স্পষ্ট যা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অর্জন করা দরকারী, এতটাই জরুরী যে একে ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়েছে। প্রায়োগিক জীবনে এ শিক্ষার সুফল – এতে জীবন সহজ হয়, খুব কষ্টের মুহুর্তগুলোকেও ইসলামের পরশপাথর দিয়ে বদলে দেয়া যায়।

আরবিতে ভাগ্যকে ক্বদর বলা হয়। মুসলিম হিসেবে এর ভালো ও খারাপ ফলাফলে বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ। ক্বদরের চারটি স্তর আছে –

১. জ্ঞান: আল্লাহর জ্ঞান অসীম। তিনি সৃষ্টি করার আগে থেকেই সব কিছু জানেন। পৃথিবী শুরু থেকে ধ্বংস অবধি কি হবে আর কি হবে না, কিভাবে হবে, কেন হবে সব তিনি জানেন।

২. কিতাব: আল্লাহ কিয়ামাত পর্যন্ত যা ঘটবে তার সব কিছু ‘লাওহে মাহফুয’ নামের একটি কিতাবে লিখে রেখেছেন।

৩. ইচ্ছে: আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তাই হয়। কোন কিছুই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয় না। আবার তিনি যা ইচ্ছে করেন না তা হয় না।

৪. সৃষ্টি: আল্লাহ আমাদের যেমন সৃষ্টি করেছেন তেমন আমাদের সব কাজ, সব কথাও তিনিই সৃষ্টি করেছেন।১

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার পাশাপাশি সে জীবনে কী করবে, কত দিন বাঁচবে, কী খাবে, কোথায় জন্মাবে, কোথায় মারা যাবে ইত্যাদি সব কিছু ঠিক করে রেখেছেন। আল্লাহ যা ঠিক করে রেখেছেন তার বাইরে কিছুই হবে না। আল্লাহ যা চান সেটা হবেই, কেউ সেটা ঠেকাতে পারবে না। আর আল্লাহ যা চান না সেটা কোনভাবেই হবে না, সমস্ত পৃথিবীর মানুষ একসাথে চেষ্টা করলেও সেটা হবে না।২

আল্লাহ মানুষ ও জ্বীনকে এমন কিছু দিয়েছেন যা অন্য কাউকে দেননি, সেটা হল ইচ্ছেশক্তি।

অতএব যার ইচ্ছা, সে এটা থেকে উপদেশ গ্রহণ করুক।৩

আল্লাহ ইচ্ছেশক্তি দেয়ার সাথে সাথে দু’ধরণের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন – সৎ ও মন্দ। আল্লাহ মানুষকে আদেশ করেছেন সে যেন ভাল পথে চলে আর খারাপ পথে না চলে। কিন্তু মানুষ কোন পথে চলবে সেটা আল্লাহ মানুষের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি মানুষকে দুই পথেই চলার ক্ষমতা দিয়েছেন, ভালো কাজ করার শক্তি দিয়েছেন তেমনি খারাপ কাজ করারও শক্তি দিয়েছেন। কিন্ত তিনি মানুষকে তার পছন্দ-অপছন্দের কথা জানিয়ে দিয়েছেন – যে ভালো পথ বেছে নেবে, ভালো কাজ করবে তাকে আল্লাহ পুরষ্কার দেবেন। আর যে খারাপ কাজ করবে, খারাপ পথে চলবে তাকে তিনি সেজন্য শাস্তি দেবেন। আল্লাহ যদিও পছন্দ করেন না যে মানুষ খারাপ কাজ করুক, তবুও যেহেতু তিনি মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছেশক্তি দিয়েছেন তাই তিনি সেই অপছন্দনীয় কাজটি করার সামর্থ্য এবং প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছেন। আল্লাহ জানেন মানুষ কী করবে, কিন্তু মানুষ নিজের ইচ্ছেতেই সেটা করবে।

একটা ছাত্র একেবারেই পড়াশোনা করে না। তার শিক্ষক তার পড়াশোনার অবস্থা দেখে বললেন যে, এই ছেলে পরীক্ষায় খারাপ করবে। ফল বের হবার পর দেখা গেল সত্যি সত্যি সে পরীক্ষায় ফেল করেছে। তাহলে পরীক্ষায় খারাপ করার জন্য কি সেই শিক্ষক দায়ী না সেই ছাত্র দায়ী? অবশ্যই সে ছাত্র দায়ী। ঠিক সেরকম আল্লাহ জানেন যে কে ভাল কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে। কিন্তু যেহেতু তার জ্ঞান কাউকে বাধ্য করেননি তাই যে যার নিজের কাজের জন্য দায়ী থাকবে।

একজন মানুষ কামারের কাছ থেকে একটা বটি কিনে আনল। এই বটি দিয়ে সে একদিন রাগের বশে তার স্ত্রীকে আঘাত করে মেরে ফেলল। এই ঘটনায় বটি তৈরীর কারণে কি কামারকে অভিযুক্ত করা যাবে? ছুরি-বটি ছাড়া রান্নাঘর চলেনা – তার বেশীরভাগ ব্যবহারই উপকারী। কিন্তু এটা দিয়ে যদি কেউ মানুষ মারে তাহলে বুঝতে হবে দোষটা উপকরণের নয়, ব্যবহারকারীর। ঠিক তেমন আল্লাহ আমাদের বুদ্ধি-বিবেক, অঙ্গ-প্র্ত্যঙ্গ তৈরী করে দিলেন, খাবারের মাধ্যমে শক্তি দিলেন এবং কোন একটা প্রেক্ষাপটে এনে উপস্থিত করলেন। তিনি আমাদের কাজের স্রষ্টা হলেও আমরা কি করব সেটা আমরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

মানুষ যেহেতু ভবিষ্যত জানে না, তাই তার কর্তব্য যখন আল্লাহ তাকে কোন পরিস্থিতিতে ফেলেন তখন কুর’আন এবং সুন্নাহের মোতাবেক আল্লাহর পছন্দ অনুযায়ী কাজ করা, আপন প্রবৃত্তিকে তোষণ না করা। যেমন, একটা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আমি দেখলাম সুন্দরী বাছাই প্রতিযোগীতা চলছে। আবার ঘরের কোণে কুরআনুল কারীমের একটা অনুবাদও পেলাম। আল্লাহ মানুষকে দিয়ে টেলিভিশন তৈরি করিয়েছেন, এর অনুষ্ঠানগুলো তৈরি করিয়েছেন এবং এর চলার জন্য দরকারী শক্তি বিদ্যুতের উৎসও সৃষ্টি করেছেন। আবার কুর’আনের বাণী আল্লাহর নিজের, তিনি আলিমদের দিয়ে এর অনুবাদ করিয়ে নিয়েছেন, বিজ্ঞানীদের দিয়ে ছাপাখানা তৈরী করিয়ে নিয়েছেন। এখন আমি কী করব সেটাই আল্লাহ পরীক্ষা করে পুরষ্কার অথবা শাস্তি দেবেন। আমি যদি টিভিতে মেয়েদের নিলামে তোলার আয়োজন দেখি তাহলে শাস্তি পেতে হবে। যদি আমি ঐ সময় কুরআন পড়ে সময়টা পার করি তাহলে আল্লাহ আমাকে সেজন্য পুরষ্কার দেবেন।

কিছু প্রশ্ন ও ভুল ধারণা:

১. যদি আল্লাহ সবই জানেন তাহলে তিনি সবকিছু সৃষ্টি করতে গেলেন কেন?

জান্নাতে যাওয়া যাদের নিশ্চিত তাদের জান্নাতে দিলে তারা যে কিছু ভাল কাজ করে, কিছু ত্যাগের বিনিময়ে, প্রচেষ্টার বিনিময়ে জান্নাত পেয়েছে সেটা থাকত না। কিন্তু দুনিয়ার জীবন পার হয়ে যখন মানুষকে জান্নাতে দেয়া হবে, তার বুঝতে পারবে তারা কতটুকু কষ্ট করেছে আর তার বদলে কত বড় পুরষ্কার পেয়েছে। আর জাহান্নামীদের সরাসরি জাহান্নামে দিলে তারা আপত্তি তুলত, আল্লাহ অন্যায় বিচার করেছেন। দুনিয়াতে সময় কাটানোর ফলে তারা নিজেদের অন্যায়টা তারা বুঝতে পারবে। কেন সত্যের খোঁজ করেনি, সত্যটা পেয়েও মানেনি – এমর্মে আফসোস করতে থাকবে। আমরা জাহান্নামের শারীরিক শাস্তির বর্ণনা পড়ে ভয় পাই, কিন্তু সেখানে কি পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা আছে তা কী ভেবে দেখেছি? ‘কেন ঐ খারাপ কাজটা করেছিলাম’ ‘কেন ঐ ভাল কাজটা করিনি’ – এই পরিতাপের মানসিক যন্ত্রণা এত ভয়াবহ যে মানুষ সারা জীবনে করা একটা ভুলের হিসেব না মেটাতে পারে আত্মহত্যা করে। কিন্তু সারাটা জীবন যখন মিথ্যা হয়ে যায়, সারাটা জীবন যখন পরিতাপের কারণ হয়ে যায় তখন অনুভূতিটা কি ভীষণ ভয়াবহ ভাবা যায়?

২. আল্লাহ খারাপ কাজ/কথা সৃষ্টি করলেন কেন? ভাল একজন সত্ত্বা কি খারাপ কিছু সৃষ্টি করতে পারে?

আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তা হয় – ‘পুরোপুরি ভালো’ অথবা ‘অল্প খারাপ বেশি ভালো’; এর মানে আল্লাহ খারাপ কোন কিছু সৃষ্টি করেননি। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার কিছুর কোন খারাপ দিক থাকতে পারে কিন্তু সেটারও ভালো দিক অনেক বেশি। একটা হাদিসে আমরা এই প্রমাণ পাই।

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেখানে তার সাহাবাদের নিয়ে বসতেন সেখানে একটা ছোট ছেলে খেলা করত। ছেলেটার বাবা রসুলের সাহাবাদের সাথে বসে রসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কথা শুনতেন। বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি দেখলেন যে সেই লোক আর সেই বাচ্চা কেউই আসে না। তিনি সাহাবাদের জিজ্ঞেস করে জানলেন যে ঐ বাচ্চাটা মারা গেছে আর সেজন্য ঐ লোকটা এত কষ্ট পেয়েছে যে সে আসছে না। রসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন ঐ লোকটার সাথে কথা বললেন। তিনি লোকটাকে জানালেন যে যদি রসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ করেন তবে ঐ বাচ্চাটাকে আল্লাহ আবার জীবন ফিরিয়ে দেবেন। তবে লোকটি যদি ধৈর্য ধরে তবে ঐ বাচ্চাটি তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।৪

মৃত্যু একটা কষ্টকর ব্যাপার তা ঠিক কিন্তু জান্নাতে যাওয়ার আনন্দের তুলনায় মৃত্যু কিছুই নয়। তাই আমাদের কাছে কোন জিনিস খারাপ মনে হলেও আসলে সেটা খারাপ না, তার ভালো কোন দিক আছে। কিন্তু আমরা মানুষেরা সময়ের খুব ছোট একটা অংশ দেখতে পাই বলে আমরা কখনই আল্লাহর সব কাজের কারণ বুঝতে পারবো না। শয়তানকে যদি সৃষ্টি না করা হত, তাহলে মানুষ দুনিয়াতে পরীক্ষাও দিতে পারত না, জান্নাতের মত অকল্পনীয় একটা পুরষ্কারও পেত না। তাই শয়তান আপাত দৃষ্টিতে ‘খারাপ’ হলেও আদতে সে আমাদের জান্নাতে যাওয়ার একটা পরীক্ষা মাত্র।

৩. আল্লাহ অবিশ্বাসীদের অন্তর তালাবদ্ধ করে রেখেছেন বলে তারা সত্যটা বুঝতে পারছে না।

বরং ব্যাপারটা উলটো; কুর’আনের যত জায়গায় অন্তর তালাবাদ্ধ করার কথা এসেছে সবখানেই কোন অপরাধে আল্লাহ মোহর মেরেছেন তা বলে দিয়েছেন। যেমন সুরা বাকারার শুরুতে আল্লাহ ‘আল্লাযিনা কাফারু’ অর্থাৎ যারা অবিশ্বাস করেছে – একথা বলে তাদের অপরাধ স্পষ্ট করে নিয়েছেন। তারপর তিনি আপন রসুলকে এই বলে সান্তনা দিচ্ছেন যে, এমন মানুষদের সাবধান করা আর না করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, কারণ তারা তাদের অবিশ্বাসের উপর এতটাই দৃঢ়প্রত্তিজ্ঞ যে আল্লাহ তাদের অন্তরে তালা মেরে দিয়েছেন; শ্রবণ-দৃষ্টিশক্তিতে পর্দা দিয়ে রেখেছেন। সুতরাং এ ধরণের মানুষের সাথে সময় নষ্ট করার দরকার নেই, তাদের প্রত্যাখ্যানে ব্যাথিত হবারও কিছু নেই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে একজন অবিশ্বাসী যখন দাবী করে তার অন্তরে মোহর আছে সুতরাং তার কোন দোষ নেই তখন আসলে সে নিজেই নিজের অন্তরে মোহর মেরে নিল। মোহর তো আর ভারতীয় গরুর গায়ের সিল না যে সেটা বাইরে থেকে দেখা যাবে। আর অবিশ্বাসীদের কাছে আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে কোন তালিকাও পাঠিয়ে দেননি যেখানে সে তার নামটা খুজে পেয়েছে। আল্লাহ যাকে খুশী বিভ্রান্ত করেন এই আয়াতের মাধ্যমে যারা বিভ্রান্ত হতে চায় তারা বিভ্রান্তদের দলে যোগ দেয়। অথচ একই আয়াতে যে আল্লাহ যাকে খুশী হিদায়াত করেন বলে উল্লেখ করেছেন সেটা অবিশ্বাসীদের চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাসীরা যখন এই আয়াত পড়ে তখন তারা আশায় বুক বাঁধে – এই পৃথিবীর নানা মতবাদের ডামাডোলে আল্লাহ আমাকে সত্য পথটা নিশ্চয়ই দেখাবেন।

৪. আল্লাহর ইচ্ছেতেই যদি সবকিছু হয় তাহলে মানুষের ইচ্ছের দাম কী?

আল্লাহর চাওয়া বা ইচ্ছেগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় – শারঈ বা বিধানগত, কাওনি বা সৃষ্টিগত।

শারঈ বা বিধানগত ইচ্ছে হল যা আল্লাহ ভালবাসেন কিন্তু এই ইচ্ছেটা আল্লাহ মানুষের ইচ্ছের জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন, তিনি মানুষকে এটা মানতে বাধ্য করেননি। একজন মুসলিম তার নিজের ইচ্ছেকে আল্লাহর শারঈ ইচ্ছের অধীন করে দেয়। আল্লাহর কাওনি বা সৃষ্টিগত ইচ্ছের মধ্যে যা আল্লাহ ভালবাসেন এবং যা আল্লাহ ভালবাসেন না, দুটোই পড়ে। আল্লাহর কাওনি ইচ্ছে জীব-জড়, পশু-পাখি, মুসলিম-অমুসলিম, সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, এবং কেউই এক অগ্রাহ্য করতে পারবে না। যখন আল্লাহ আল কুর’আনে বলেন যে তিনি ইচ্ছে করলে সবাইকে হিদায়াত করতে পারতেন তখন তিনি তার ‘কাওনি’ ইচ্ছের কথা বোঝান। কিন্তু তার সাথে সাথেই তিনি জানিয়ে দিলেন তিনি সবাইকে জোর করে হিদায়াত করবেন না, কারণ সত্য তো এই যে যারা স্বেচ্ছায় তার অবাধ্য হবে তাদের দ্বারা তিনি জাহান্নাম পূর্ণ করবেন, সেটা মানুষ হোক আর জ্বীন।৫ এখানে অন্য কোন সৃষ্টির কথা আসেনি কারণ কেবলমাত্র এ দু’টো সৃষ্টিরই স্বাধীন ইচ্ছেশক্তি দেয়া হয়েছে। আল-কুরানে আল্লাহ বলেন, মানুষ ইচ্ছে করতে পারবে না যতক্ষণ না তিনি ইচ্ছে করেন৬ – এখানেও আল্লাহর ‘সৃষ্টিগত’ ইচ্ছে বুঝিয়েছে কারণ তিনি মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছেশক্তি এবং বিবেচনাবোধ দিয়েছেন বলেই সে আল্লাহর পথ বেছে নিতে পারে।

মহান আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছে কিন্তু নেহায়েত খামখেয়ালি নয় বরং তার ভিত্তি আল্লাহর অসীম জ্ঞান এবং অসীম প্রজ্ঞা। কুর’আনে সৃষ্টিগত ইচ্ছের কথা বার বার উল্লেখিত হওয়ার কিছু কারণ আছে –

প্রথমত, যাতে বিশ্বাসী মুসলিমরা আত্মশ্লাঘাতে না ভোগে, তাদের যেন সবসময় মাথার মধ্যে থাকে যে তারা যে সুপথ পেয়েছে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। মুমিনের মনে অহংকার এসে বাসা বাঁধার সুযোগ যেন তৈরী না হয়।

দ্বিতীয়ত, যাতে ইসলামের পথে আহবানকারীরা এটুকু মনে রাখেন যে, তাদের দায়িত্ব শুধু আহবান জানান। কে মানবে, কে মানবেনা – এটা ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছে যেখানে আল্লাহ হস্তক্ষেপ করেন না। সেখানে কাউকে জোর করে মুসলিম বানানোর যেমন সুযোগ নেই তেমনি ইসলামের দাওয়াত গৃহীত না হলে হতাশ হবারও কিছু নেই। মানুষ তার সাধ্যমত দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা করবে এবং আল্লাহ সেই চেষ্টার বিচার করবেন, ফলাফলের নয়।

তৃতীয়ত, যে মানুষটা একবার বুঝে গেছে যে আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া তার কোন ক্ষতি হবে না এবং হলেও ততটুকুই হবে যতটুকু আল্লাহ চেয়েছেন, তাকে পৃথিবীর কোন শক্তির ভয় দেখিয়ে সত্য প্রচারে থামান যাবে না। যে মানুষটা বুঝে গেছে যে আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া তার কোন উপকার কেউ করতে পারবে না এবং পারলেও ততটুকুই পারবে যতটুকু আল্লাহ চেয়েছেন, তাকে পৃথিবীর কোন কিছুর লোভ দেখিয়ে অন্যায় কাজে লিপ্ত করা যাবে না। এটা ঈমানের সর্বোচ্চ শিখর, যেখানে উঠতে পেরেছিলেন বলে সাহাবারা অর্ধশতাব্দীর কম সময়েই অর্ধ পৃথিবীতে ইসলামের বাণী পৌছে দিতে পেরেছিলেন।

চতুর্থত, পার্থিব জীবনে সুখী থাকা। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন –

আদম সন্তানের সুখ নির্ভর করে তার প্রাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার উপরে। আদম সন্তানের দুঃখ ইস্তিখারা না করাতে, প্রাপ্তি নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকাতে।৭

মানুষকে মেনে নিতে হবে যে তার ভাগ্যে যা আছে তা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তাকে তাই যেকোন অবস্থাতেই আল্লাহর উপর খুশি থাকতে হবে। তার মানে এই না যে আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব। আমাদের দায়িত্ব পার্থিব এবং পরকালীন সফলতার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা। সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও যদি পার্থিব কোন ব্যাপারে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা রেখেছেন সেটাই মঙ্গলকর এ বিশ্বাস করতে হবে। তা খুশি মনে মেনে নিতে হবে। আর যেহেতু আল্লাহ আমাদের পরকালে কি হবে জানিয়ে দেননি সেহেতু আমৃত্যু ভাল কাজ করে যেতে হবে; আল্লাহর কাছে দু’আ করতে হবে যেন তিনি আমাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, জান্নাতে স্থান দেন।

কোন বিপদে মন খারাপ না করে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তার প্রশংসা করতে হয় কারণ এর চেয়ে বড় বিপদ তিনি দিতে পারতেন। আল্লাহ যখন কোন মানুষের জীবনে কোন বিপদ বা দুঃখ-কষ্ট দেন তখন তার তিনটি ভাল দিক থাকে –

১. যদি সেই মানুষটি খারাপ কাজ করতে থাকে তবে সে যেন বিরত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে।

২. সেই মানুষটি যেসব অন্যায় কাজ করেছে, পাপ করেছে তার প্রতিফল হিসেবে বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পৃথিবীতেই তার অপরাধের শাস্তি দিয়ে দেয়া।

৩. বিপদে মানুষটি ধৈর্য ধরে কিনা তা পরীক্ষা করা এবং সে ধৈর্য ধরলে তার অনেক বড় পুরষ্কার দেয়া।

তাই বিপদে পড়লে আমাদের উচিত পাপ স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আল্লাহ যেন আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন সে জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করা কারণ একমাত্র দু’আতে আল্লাহ ভাগ্য পরিবর্তন করেন।৮ অতঃপর কর্তব্য ঐ পরিস্থিতিতে আল্লাহর অনুমোদিত পথে যা করলে বিপদ কাটবে তা করা।

বিশাল এ পৃথিবীতে সময় কিংবা স্থানের বিচারে আমরা আসলে অতি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব। আমরা অনেক বড় বড় কথা বলতে পারি, অনেকের সমালোচনা করতে পারি কিন্তু দিন শেষে আমাদের প্রভাব বলয় অতি সীমিত। অহেতুক কথা না বলে, অনর্থক কাজ না করে আমাদের উচিত যে পরিস্থিতিতে আল্লাহ আমাদের রেখেছেন সে পরিস্থিতিতে সাধ্যমত সর্বোৎকৃষ্ট কাজটা করা। শেষ বিচারের দিনে আসলে বিচার হবে এটারই – আমার বেছে নেয়া ইচ্ছেগুলো কী ছিল। অন্যদের ইচ্ছেগুলো আমার জীবন প্রভাবিত করে সত্যি, কিন্তু আসলে তো আমি সেগুলো চাইলেই বদলে ফেলতে পারব না। তাই আমি যেখানে আমার ইচ্ছেশক্তি খাটাতে পারব – আমার আপন ব্যক্তিসত্ত্বার উপরে, সেখান থেকেই শুরু হোক পথ চলা, পরকালের অসীম মুক্তির পথে। আল্লাহ যেন তার যাবতীয় ইচ্ছে মেনে, আমাদের ইচ্ছেটাকে তার ইচ্ছেমত পরিচালিত করার ক্ষমতা দেন। আমিন।

 

– শরীফ আবু হায়াত অপু | ২১শে যুল-ক্বদা ১৪৩৩ হিজরি

—————————————————-

১ সুরা আস-সফফাত (৩৭), আয়াত ৯৬

২ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিরমিযি

৩ সুরা মুদদাস্সির (৭৪), আয়াত ৫৫

৪ সুনানে নাসাঈ

৫ সুরা আস-সাজদা (৩২), আয়াত ১৩

৬ সুরা আল-ইনসান (৭৬), আয়াত ৩০

৭ হাকিমের মতে সহীহ, ইবনে হাজার ফাতহুল বারীতে হাসান হিসেবে রায় দিয়েছেন

৮ তিরমিযি, ইবনে মাযাহ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button