শিক্ষামূলক গল্প

আগুনে সুন্দরী

মানুষের মন এক অদ্ভুত চিজ। চোখের সামনে এমন অভাবনীয় দৃশ্য ঘটমান, আর আমার মন কি’না আমাকে নিয়ে চলে গেল বেড়াতে, তিন বছর আগে, যখন প্রথম এই ছেলেটিকে দেখেছিলাম।

সেদিন ছিলো আমাদের ছাত্রজীবনের সমাপ্তি দিবস। রায়হান বলল, ‘চল, আজ সেলেব্রেট করি। কি করা যায়? কি করা যায়? পেয়েছি! চল, তোকে কাবাব খাওয়াব, পোড়া মাংসের গন্ধে খাবার এসে পৌঁছবার আগেই তোর ঠোঁটের কোণ বেয়ে লোল পড়বে, দেখে দেখে আমি হাসব। সিরিয়াস মজা হবে’।

রায়হান আর আমার বন্ধুত্ব হোল যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ, পরস্পরনির্ভরশীলতাই যার ভিত্তি। সে বিশাল বড়লোকের ছেলে, ওর দাদার দেয়া হাসপাতাল ওদের পারিবারিক সম্পদের একটি অংশ। সুতরাং, মেধা থাক বা না থাক, ওকে ডাক্তার হতেই হবে। আর আমি হলাম গরীবের মেধাবী ছেলে। মেধার জোরে ভর্তি পেয়েছি বটে, কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। রায়হানের সুবিধা আমি ওকে পড়াশোনায় সাহায্য করি, আমার সুবিধা সে আমার পকেটের অবস্থা বুঝে আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমার সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখে। সব দিক মিলিয়ে এই বন্ধুত্বে উভয়ের লাভ। আমরা উভয়ই জানি আমরা পাশ করব। কিন্তু রায়হান পাশ করা মাত্র গিয়ে বসবে ওর দাদার হাসপাতালে, কয়েক বছরের ভেতর সে পৌঁছে যাবে এম ডির চেয়ারে; আর আমার চিন্তা আমাকে কোন পাহাড়ে বা কোন অজ পাড়াগাঁয়ে পাঠানো হবে। যাক, এই সুযোগে একবার কাবাব খাওয়া হয়ে যাবে, এটাই লাভ।

দোকানে গিয়ে পোড়া মাংসের গন্ধে আসলেই আমার জিভে জল আসতে লাগল। অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হয়না। এমন সময় আজকের এই ছেলেটা একটা মেয়ে নিয়ে প্রবেশ করল। গিয়ে বসল রায়হানের পেছনের টেবিলটায়। ওদের অন্তরঙ্গতা দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওরা স্বামী স্ত্রী। কিন্তু স্বামী স্ত্রী পাবলিক প্লেসে এতটা অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করেনা, কারণ ওদের অন্তরঙ্গ হবার জন্য বাড়ীঘর রয়েছে। মেয়েটা হোল যাকে বলে আগুনে সুন্দরী, হাসিতে মুক্তো ঝরে টাইপের। এত সুন্দর মেয়েটা কেন কারো ঘর আলো না করে এমন একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে তার মানসম্মানের কোন পরোয়াই করেনা, সেটা বুঝতে পারলাম না। যাক, বড় বড় লোকের বড় বড় কারবার আমার মত গরীবের ছেলেরা বুঝবে তাই বা আশা করি কি করে? নিজের অজান্তেই বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল মেয়েটার দিকে। মন বলল, ‘হে ফাইয়াজ, তোমার প্রভু তোমাকে যে চোখ দিয়েছেন তার হিসেব কিন্তু তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে, ভুলে যেয়োনা’। মনের ওপর জোর খাটিয়ে রায়হানকে বললাম, ‘নাহ, আজ কাবাব খাবনা। চল, চাইনিজে যাই’। ওর আপত্তি উপেক্ষা করে, অর্ডার ক্যান্সেল করে, দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মহাখাপ্পা হয়েছিলো রায়হান সেদিন, কিন্তু আমি ওকে আজও বলিনি কেন সেদিন এমন অদ্ভুত আচরণ করেছিলাম।

পোড়া মাংসের তীব্র গন্ধ অতীত থেকে টেনে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। মেয়েটা দু’দিন হোল হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্টের শব্দ। কিন্তু এই কষ্ট তার নিজের হাতে সৃষ্ট। চার বছর প্রেম করার পর বয়ফ্রেন্ড বিয়ে করবেনা জানিয়ে দেয়াতে সে নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে। পরিবারের সবাই মিলে আগুন নিভাতে নিভাতে ততক্ষণে শরীরের অধিকাংশ পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। মাথার চুল জ্বলে গিয়ে দগদগে লাল পোড়া চামড়া বেরিয়ে পড়েছে, মুখের রঙ কালো আর লালের সংমিশ্রনে ভয়াবহ হয়ে রয়েছে, ঠোঁট গলে গিয়ে কথা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছেনা। তবু যতবার কাছে যাচ্ছি ওর পাপড়িবিহীন চোখে দু’টো করুণ দৃষ্টিতে বলার চেষ্টা করছে, ‘আউয়ি আর ওয়াচতে চাইয়াঁ, আওয়াকে ওয়েরে হ্যালেন’।

আমি বুঝতে পারছি এটা ওর অভিমানের কথা নয়। ওর বাবা সেদিন থেকে এক মূহূর্তের জন্য ওকে ফেলে নড়েননি। মা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছেন না বলে রুমের বাইরে চেয়ার নিয়ে বসে অবিরাম কেঁদে চলেছেন, আর সাথে সাথে চলছে বিড়বিড় করে দু’আ পড়া। বড় বোনটা মনে হয় ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা বনে গিয়েছে। বোনের বিছানার পাশে খুব সুন্দর ফ্রুট বোলে সাজানো নানারকম ফলফলাদি, ছুরি, কাঁটা চামচ, বাটি সাজিয়ে রেখেছে। অথচ সে তো কিছুই খেতে পারবেনা! ভাইটা আজই এসেছে ঢাকা থেকে। এসে সব শুনে কিচ্ছুটি না বলে বেরিয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটির বর্ণনাতীত কষ্টের সামনে এই স্নেহমায়ার বন্ধন যে বড় ঠুনকো!

ভাইটা এইমাত্র ফিরে এলো তিন বছর আগে দেখা ছেলেটিকে নিয়ে। ওর কলার চেপে ঘাড় ধরে ঠেলতে লাগল মেয়েটির দিকে, ‘তুই আজ এখনই ওকে বিয়ে করবি’। ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে শিউড়ে উঠে পিছিয়ে আসতে চাইল। ভাইটি ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিলো, ‘কেন, ওর সাথে চার বছর ঘুরার সময় এত ভালো লেগেছে। এখন আর আমার বোনকে তোর ভালো লাগছেনা, তাইনা? আব্বা, ওকে চোখে চোখে রাখবেন, ও যেন কোনদিকে পালাতে না পারে। আমি এখনই বিয়ে পড়াবার ব্যাবস্থা করছি’।

বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। আমি হতবাক। চোখের সামনে যা ঘটছে তার চেয়েও হতবাক এই ভেবে যে এই সেই আগুনে সুন্দরী! এই মূহূর্তে ওর চেহারা, ওর গন্ধ, ওর কষ্টের শব্দ ডাক্তার হয়েও আমি সহ্য করতে পারছিনা, এই ছেলে তাকে সহ্য করবে কি করে?

খবর পেয়ে রায়হান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। ওহ, বলা হয়নি, আমাকে আর শেষ পর্যন্ত পাহাড়ে জঙ্গলে যেতে হয়নি, রায়হানের বুন্ধুত্ব আমাকে ওর দাদার হাসপাতালেই একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলো। এখন দু’জনে মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলাম পুলিশ ডাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। রায়হান রুমের বাইরে গিয়ে মোবাইলে কল দিলো পুলিশে। ততক্ষণে প্যাসেজে মেয়ের ভাইয়ের হুংকার শুনে বোঝা যাচ্ছে সে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। হঠাৎ ছেলেটা লাফিয়ে উঠল। ফ্রুট বোল থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে বাতাসে পোঁচ দিতে দিতে বলল, ‘আমি ওকে বিয়ে করতে পারবনা, আমাকে বাধ্য করার চেষ্টা করলে ভালো হবেনা’। মেয়ের বড়বোনের ওপর মেজাজটা খুব খারাপ হোল। ফ্রুট কাটার জন্য এত বড় সাইজের ছুরি লাগে নাকি? এটা দিয়ে গরু জবাই করা যাবে! ছোট ছুরি হলে চেষ্টা চালিয়ে দেখতাম ওকে নিরস্ত্র করা যায় কি’না। মেয়ের ভাই ঘরে ঢুকে ওর কান্ড দেখে রাগে ঠোঁট কুঁচকে ফেলল, আক্রমনোদ্যত কুকুরের মত ক্যানাইন দাঁত বেরিয়ে পড়ল তার। তারপরের ঘটনাগুলো অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে ঘটতে লাগল। স্লো মোশানে দেখা গেলে দর্শক দেখতেন, রায়হান আমার মনোভাব বুঝতে পেরে আমাকে শক্ত করে ধরে ফেলল যেন আমি ছুরি হাতে প্রলাপরত ছেলেটির দিকে এগোতে না পারি। মেয়েটির ভাই ছেলেটির দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, বুড়ো বাপ বাঁধা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। ভেতরে হুটোপুটির শব্দ শুনে বড়বোন কি ঘটছে দেখার জন্য এসে বেহুঁশ হয়ে দরজার পাশেই এলিয়ে পড়েছে। মেয়েকে ধরতে এসে মা ঘরের ভেতর দৃশ্য দেখে দিলেন এক গগনবিদারী চিৎকার। ছুরি হাতে ছেলেটা ওদিকে তাকাতেই মেয়েটির ভাই ওর কাছ থেকে ছুরি ছিনিয়ে নিতে পা বাড়াল। সাথে সাথে ছেলেটা সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে মেয়েটার হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরিটা বসিয়ে দিলো। সাথে সাথে সব স্তব্ধ, মেয়েটার সামান্য একটা দীর্ঘশ্বাস, তারপর ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। রায়হান এবার আমাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে ধরে ফেলল। ছেলেটা নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেনা সে এইমাত্র কি করেছে। সে বার বার বলছে, ‘আমি ওকে বিয়ে করতে পারবনা, আমি ওকে বিয়ে করতে পারবনা …’। আমি ততক্ষণে ছুটে গিয়েছি মেয়েটার পাশে। না, মনে হচ্ছেনা ওকে বাঁচানো যাবে। ওর শরীর এমনিতেই গত দু’দিন ধরে যুদ্ধ করে ক্লান্ত। ছুরিটা বিঁধেছে ঠিক ওর হৃৎপিন্ড বরাবর, ওর নিঃশ্বাসের শব্দ বলছে ও এবার এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়। মেয়েটার বাবা ঘটনার আকস্মিকতায় পাথরবৎ দাঁড়িয়ে রয়েছেন, চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন যেন। মেয়েটার ভাই দুই হাতে মাথার সমস্ত চুল আঁকড়ে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে, যেন সে পারলে পুরো ঘটনা আবার রিওয়াইন্ড করে এবার ঠিকভাবে করত। দরজার কাছে নার্স মা মেয়ের নিথর দেহগুলোতে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এর মাঝে মেয়েটার আত্মা ওর দেহ থেকে মুক্ত হয়ে উড়ে গেল।

মনে মনে ভাবলাম, যাক সে অন্তত এই নরকযন্ত্রনা থেকে তো মুক্তি পেল! পরক্ষণেই মনের আয়নায় ভেসে উঠল, ‘যে ভয় করে সে উপদেশ গ্রহন করবে, আর যে হতভাগা সে তা উপেক্ষা করবে, সে মহা অগ্নিতে প্রবেশ করবে, অতঃপর সেখানে সে মরবেও না জীবিতও থাকবেনা’ (সুরা আলাঃ আয়াত ১০-১৩)। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই জীবনে আমাদের কৃতকর্মের শাস্তি যতই কঠিন হোক, মৃত্যু এক সময় তার সমাপ্তি টেনে আনে, শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। কিন্তু এর পরবর্তী অধ্যায়ে মৃত্যুর অনুপস্থিতি এক বিরাট পার্থক্যসূচনাকারী ফ্যাক্টর। সেখানে কোন মৃত্যু, চেতনাহীনতা বা দুর্বলতা আমাদের আগুনের তেজ থেকে সাময়িক নিরাপত্তাও প্রদান করতে পারবেনা। তবে কিসের আশায় আমরা এই জীবনটা হেলাফেলায় কাটিয়ে দেই যেখানে এটিই একমাত্র ফলাফলনির্ধারনী পরীক্ষা? হঠাৎ মেয়েটির জন্য করুণা এবং বিষাদে ছেয়ে গেল মন। বেচারী! ওর প্রভু ওকে উজার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিবেচনার অভাবে সে এদিকেও কিছু পেলোনা, ওদিকেও কিছু পাবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। নিজের জন্য আশংকায় কেঁপে উঠলাম, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনে প্রবৃত্ত কোরোনা, আমাদের তোমার অনুগ্রহ দান কর, তুমিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা’!

——-
– রেহনুমা বিনতে আনিস

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

  1. খুব ভালো লিখেছেন। কিন্তু মেয়েটা দু’দিন হোল হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এধরনের বাক্য এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। মৃত্যু আল্লাহর হুকুম, তার সাথে পাঞ্জা লড়ার কথা ভাবাই যায় না। তাই না !!!! আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button