শিক্ষামূলক গল্প

মিলাদের পূণ্য মাহফিল

সকাল ৮টা। মুহাম্মদ ধড়ফড় করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। বিছানা ত্যাগ মাত্র ছুটে গেল আলমিরার দিকে। প্রয়োজনীয় পোশাকটি বের করল আলমিরা থেকে। তারপর কিছুটা জিরিয়ে হলো। এরপর মুখ রাখল আয়নায়। নিজেকে একটু পরিপাটি করে নিয়ে ছুটল দরজা পানে।
হায় আল্লাহ! ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি অথচ মুখটুকুও ধোয়া হয়নি!

আজ মুহাম্মদের তাড়া আছে বৈ কি। সে আজ বড় ব্যস্ত। হাতে কাজ অনেক। আগেভাগেই সব সারতে হবে। অন্যথায় তাকে সন্ধ্যে অবধি কাজেই ডুবে থাকতে হবে। উপস্থিত হতে পারবে না মীলাদের পুণ্য মাহফিলে।

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে মুহাম্মদ আবার ঘরে এলো। মুখ-হাত ধুয়ে মুহূর্তেই আবার বেরিয়ে এলো। গাড়ি নিজে ড্রাইভ করেই ছুটলো অফিসের উদ্দেশে। অফিসে পৌঁছে কালবিলম্ব না করে ডুবে গেল কাজের মধ্যে। কিছুক্ষণ বাদে এন্তার কাজ আর ঝামেলার ফাঁক গলেই তার মুঠোফোনে একটি মেসেজ এলো। কাজ বন্ধ করে মুহাম্মদ নজর দিলো মোবাইলে। মোবাইলের মেসেজ বক্স অন করল। বার্তাটি খুলতেই দেখতে পেল : ‘প্রিয় ভাই, তুমি কি আল্লাহকে ভালোবাসো? ভালোবাসো কি তাঁর রাসূল কে?’ মনে মনে সে জবাব দিল, অবশ্যই।

তারপর? মুহাম্মদ পড়ে চলে : ‘নিশ্চয় আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ঈমানের সবচে মজবুত রশি।’ বাহ্, সুন্দর লিখেছে তো!

এবার সে পরবর্তী লাইনগুলোতে চোখ বুলায় : ‘যদি তাঁদের ভালোবাসার এই হয় মর্যাদা, তাহলে এও কি সম্ভব যে, মীলাদ নবীর ভালোবাসা  প্রকাশের মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও কি আমরা তা হেলায় কাটিয়ে দেবো?’ মুহাম্মদ মন্তব্য করতে লাগল : এ কী ? জানি না লোকটি কী বলে? আরে! এ দেখি সালেহ। ভাই সালেহ আল্লাহ তোমাকে হেদায়েত দিন। মেসেজে কী বলা হয়েছে তা ভুলে মুঠোফোনটি রেখে দিল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে। আর হঠাৎ তখনই মনে পড়ল, সে তো ফজর সালাত আদায় করেনি।
একটু ভাবল, আপনা থেকেই ভেবে অবাক হলো, কোন জিনিসটি তাকে এ মুহূর্তে সালাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো? প্রায়ই তো সে ফজর সালাত পড়ে না। হাতের কাজ ফেলে মুহাম্মদ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। ফজর সালাত আদায়ে সে অন্তরে এক অপূর্ব সাড়া ও আত্মিক তাড়না বোধ করল।

দিনান্তে মুহাম্মদ সব কাজ শেষ করল। মীলাদে যাবার প্রস্তুতি সেরে গাড়িতে চাপল। গাড়িতে বসে ভাবনার লাগাম ছেড়ে দিল। মনের আরশিতে একে একে ভেসে উঠতে লাগল সারাদিনের তাবৎ ঘটনা। মেসেজটির কথা, ফজরের সালাতের কথা, সকালের তাড়াহুড়োর কথা- এমনকি মুখ না ধুয়ে ভুলে বেরিয়ে আসার কথা।  নিজে নিজে একটু হাসল। হৃদয়ে অনুভব করলো শান্তি, তৃপ্তি ও প্রশান্তি। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো : আলহামদুলিল্লাহ। সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য।

সে নিজে নিজের কাছে ফিরে এলো। নিজের কাছেই কৈফিয়ত তলব করল বছরের পর বছর সালাত কাযা করা বিশেষত ফজর না পড়া সম্পর্কে।

আপনাকে সে প্রশ্ন করল, তুমি কি মনে করো, আমি নিয়মিত ফজর সালাত পড়লে এই তৃপ্তি ও প্রশান্তি ধরে রাখতে পারব? স্মরণ হল শায়েখ খালেদের কথা। যিনি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাগাদা দিয়েছিলেন তাকে আগেভাগেই মীলাদে হাযির হতে।
শায়েখ খালেদ ফি বছর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্মরণ করিয়ে দেন মিলাদুন্নবীর গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষের কথা। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

তবে হ্যা, তার মনই তাকে বলল, এই শায়েখ খালেদ তো তোমাকে একবারও ফজর সালাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেননি। কিংবা তিনি এসে তোমাকে ফজরের সালাতে নিয়ে যাননি। যেমন করেন তিনি ঈদে মিলাদুন্নবীতে! সারা বছর তিনি ব্যস্ত থাকেন। সালাতের প্রতি তোমাকে একটুকু তাগিদ দেন না। কেবল এই সময়টি যখন আসে, তোমাকে স্মরণ করেন তিনি!

তওবা! তওবা! এ কেমন হীন চিন্তা? শায়েখ খালেদ তো নেককার ব্যক্তি। অলী আল্লাহ মানুষ। এটা করেন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসায়। তাঁর উচ্চ মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখাতে। ভালোবাসায়…….। হ্যা, ভালোবাসা বৈ কিছুই নয়! মেসেজটিতে আজ যা পড়লাম। কত সুন্দর কথা সেগুলো। মুঠোফোনটা সে আবার বের করল। বন্ধু সালেহ প্রেরিত বার্তাটি বের করে তা পুনরায় পড়তে লাগল : ‘প্রিয় ভাই, তুমি কি আল্লাহকে ভালোবাসো? ভালোবাসো কি তাঁর রাসূল কে? নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা ঈমানের সবচে মজবুত ভিত।’
একদম খাঁটি কথা। মুহাম্মদ নিজেকে প্রশ্ন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেন নি : ঈমানের মজবুততম রশি হলো, আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা এবং তাঁর জন্যই ঘৃণা করা।’? 

মুহাম্মদ পড়ে চলে : ‘যদি তাঁদের ভালোবাসার এই হয় মর্যাদা, তাহলে এও কি সম্ভব যে, মীলাদ নবীর ভালোবাসা প্রকাশকের উপায় হওয়া সত্ত্বেও আমরা তা হেলায় কাটিয়ে দেবো?’

সালেহ, সে তো আমার পুরনো বন্ধু। বাল্যকাল থেকেই তাকে চিনি। তাকে সর্বদা সব বিষয়ে উদ্যমী ও অনুসন্ধিৎসু হিসেবে দেখে এসেছি। অন্যের মতের প্রতি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও নিজের বোধটাকে সে কখনো অন্যের করুণার ওপর ছেড়ে দেয় না। না বুঝে সে কোনো বক্তব্য মেনে নেয় না। মনে পড়ে একদিন ক্লাসে এক শিক্ষক বলেছিলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন অলীর সঙ্গে মুসাফাহা করতে কবর থেকে তাঁর দস্ত মুবারক বের করে দিয়েছিলেন’। সে সহজে এ কথা মেনে নিতে পারছিল না। ফলে সে শিক্ষকের কাছে এই তথ্যের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলো। তার যুক্তি, এমন যেহেতু কোনো সম্মানিত বা প্রবীণ সাহাবীর ক্ষেত্রে ঘটেনি তাহলে তা অলী-বুযুর্গদের ক্ষেত্রে ঘটে কি করে? আমরা তার শাণিত যুক্তি ও ব্যক্তিত্বের কারিশমা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। 

আচ্ছা, সালেহ যদি জ্ঞানী হয়ে থাকে, আমিও তো তবে জ্ঞানহীন নই। আমি না ভেবে তার সব কথাও তো মেনে নিতে পারি না। সালেহ তো কট্টরপন্থী আলেমদের সঙ্গে উঠাবসা করে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসেন না।

হায় আল্লাহ, কী আশ্চর্য ! আমি সালেহ ও তার সম মনাদের সম্পর্কে ভাবছি তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসেন না! অথচ তিনিই তো আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসায় উপচে পড়া এই বার্তাটি প্রেরণ করেছেন! আমার মনে আছে গত মাসে এ ধরনের একজন বুযুর্গের পেছনে জুমার সালাত আদায় করেছিলাম। তাকে তো নবী প্রেমের সুবাসই ছড়াতে দেখলাম। তিনি তাঁর খুতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানার্থে জোরালো বক্তব্য রাখছিলেন। মুসল্লীদের তিনি আহ্বান জানাচ্ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী সকল দেশের পণ্য বয়কটের মাধ্যমে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে। তখন শুধু তাঁর মুখেই এই দরকারী আহ্বান শোনা যাচ্ছিল। শায়েখ খালেদের সঙ্গে দেখা হলে তাকেও এ ব্যাপারে সোচ্চার বলে মনে হলো। তদুপরি সালেহ ও তার সঙ্গীদের দেখি তারা সীরাতে রাসূলের ওপরও বেশ গুরুত্ব দেন। একবার সালেহ আমাকে তার এক সতীর্থের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি সীরাতে রাসূলের ওপর সহীহ হাদিস নির্ভর একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বন্ধু সুলাইমানের কথাও উল্লেখ করা যায়। তিনি ছোটদের জন্য সহজ গদ্যে সীরাত গল্প সংকলন প্রকাশ করেছেন।

এসবের পরও কীভাবে বলি তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসে না? যে ব্যক্তি সুন্নতের অনুসরণ করে এবং বিদ‘আত বর্জন করে আর রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ যার জীবনের ব্রত, যে যথার্থ মূল্যায়ন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত, সুন্নাহ ও শরীয়তকে, কী করে তার সম্পর্কে বলা যায় তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসেন না!  
হ্যা, আজকের ফজর সালাতের বরকতই যদি হয় এই হেদায়াত ও সৌভাগ্য, তাহলে যে ব্যক্তি দিন-রাত অষ্টপ্রহর রাসূলুল্লাহর আনীত দীনের ছকে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে, কত বরকতই না সে দেখতে পায়। যাহোক, ঈদে মিলাদুন্নবী পালন তো ভালো কাজই বটে। এ তো কেবল যিকর, নবীর ওপর দরূদ পাঠ ও কল্যাণ কাজে সমবেত হওয়ার নাম। একে বিদ‘আত বলা এক ‘অনুচিত কঠোরতা’ ও ‘অযাচিত গোঁড়ামী’ বৈ কি?

‘অনুচিত কঠোরতা’ ও ‘অযাচিত গোঁড়ামী’ ‘অনুচিত কঠোরতা’ ও ‘অযাচিত গোঁড়ামী’ – এভাবে সে বাক্যটি আওড়াতে থাকে।
কয়েক সেকেন্ড পর। আচ্ছা প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বর্জন করেছেন, সকল মুসলমানের শ্রেষ্ঠ জামাত যা করেন নি, তা করা অপ্রয়োজনীয় নাকি তারা যা বর্জন করছে তাই অপ্রয়োজনীয়? আহ্ আমি যে চিন্তা মাথায় না এনে পারছি না।  

মুহাম্মদ মুহূর্তকাল ভাবল, তারপর একটি পাবলিক উদ্যানে ঢুকে পড়ল। এখানে কিছুটা সময় কাটানো যাক। কোমল পানীয় পেটে চালান করে একটু ঠান্ডা হওয়া দরকার।
মুহম্মদ একপাশে গিয়ে বসল। ওয়েটারকে একগ্লাস পুদিনা ছিটানো লেবুর জুস দিতে বলল। একটু রিল্যাক্সড হল। মনোরম জায়গাটি তাকে মুগ্ধ করল। উদ্যানের সৌন্দর্য ও পরিপাট্য তাকে সজীব করে তুলল।
অকস্মাৎ তার এই সুন্দর সময়ে ছেদ টানল গুটিকয় দুষ্টু বালকের হল্লা। ওরা অশোভন আচরণ করছে। মুহাম্মদ খেয়াল করে দেখল, গালাগাল আর মন্দ বাক্যই ওদের পারস্পরিক অভিবাদনের ভাষা। কিছুক্ষণ  বাদেই ওরা বিবাদ শুরু করল। হট্টগোল শোনা গেল। আর দেখতে না দেখতেই ওরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। ওমা সে কি! প্রতিপক্ষের ওপর হামলার জন্য ওদের একজন ধারালো অস্ত্র এবং চাকু বের করল! আল্লাহর দয়া না হলে দু’একজন বোধ হয় খুনই হয়ে যেত। অদূরে পুলিশের একটি গাড়ি এসে থামল। একজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এই উদ্যানের দিকেই এগিয়ে আসছিল হালকা নাস্তা করতে। ছেলেগুলো তাকে দেখেই ছুটে পালাল। মনে মনে সে আল্লাহর শোকর আদায় করল। এই তো, তিনি দয়া না করলে এখানে আজ কেউ একজন খুনই হয়ে যেত।

আসলে এই সুন্দর জায়গাটিতে একজন নিরাপত্তারক্ষী থাকা দরকার। নয়তো যে কোনো মুহূর্তে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাবে। তেমন না হলে বরং এটি বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয়। অন্যথায় এটি হবে সেসব অপরাধীর অভয়ারণ্য যাদের কর্মকাণ্ড সমাজে শুধু অশান্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

হ্যা, যাতে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের দিকই বেশি, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করাই শ্রেয়। এই পয়েন্টে এসে মুহাম্মদ নিজেই নিজের সঙ্গে তর্ক জড়িয়ে গেল। এভাবে অনেক মীলাদেই তো মন্দ ও অকল্যাণ চর্চা হয় বেশি। আল্লাহর কসম, ওরা মিলাদুন্নবী উদযাপানের নামে মদ ও গঞ্জিকা সেবন করে। অনেক মীলাদেই সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করা হয়। নৃত্য-গান ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা হয়। এতো রাসূলের প্রকৃত ভালোবাসার নমুনা হতে পারে না। তবে আলহামদুলিল্লাহ আমি যে মীলাদে উপস্থিত হই। আমার পরিবার-পরিজন যে মীলাদ অনুষ্ঠান করে থাকে, সেগুলো এসব বিদ‘আত থেকে নিরাপদ। বিদ‘আত! আমি কী বললাম? বিদ‘আত! কী করে উচ্চারণ করলাম এই শব্দ?
হ্যা, শপথ আল্লাহর, এতো বিদ‘আত বৈ কিছুই নয়। মুহাম্মদ, তুমি ভাবছো তোমাদের মীলাদ এসব নিষিদ্ধ মন্দাচার থেকে মুক্ত। কিন্তু সেখানে অন্য নিষিদ্ধ বিষয় তো রয়েছে। তুমি সেসব পছন্দ কর এবং সেসবে তুমি অভ্যস্ত বলে তা টের পাও না। আর তোমাদের এই মীলাদ, তাদের যে মীলাদকে বিদ‘আত বললে সেই পর্যায়ে যে একদিন উন্নীত হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? 

স্বভাবতই তুমি বলবে, না। আমরা ও আমাদের শায়েখরা এবং আমাদের পূর্ব পুরুষরা দীর্ঘদিন ধরেই মিলাদুন্নবী পালন করে আসছি। আমাদের নিয়মে কোনো ব্যত্যয় হয় নি। আলহামদুলিল্লাহ ওসব বিদ‘আতও আমাদের স্পর্শ করে নি।

মুহাম্মদ, তুমি কি মনে করো না আব্দুল্লাহরা যে মিলাদুন্নবী পালন করতো তা এক সময় ভালোই ছিল। একদিন ঠিক তোমাদের মীলাদের মতোই নির্দোষ ছিল। খোঁজ নিয়ে দেখ আজ তারাই মিলাদুন্নবী উৎসব পালনে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। এমনকি আব্দুল্লাহর এক আত্মীয় আমাকে বলেছে, তারা মীলাদের অনুষ্ঠানাদিতে মাদককেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। হ্যা, আমার ঠিক মনে আছে। সন্দেহ নাই ওরা এসব ঠিক করছে না।

কিন্তু কেন ওরা ভুল করছে? আমাদেরও কি ভুল করা সম্ভব নয়? এটা  কি সম্ভব নয় যে, আমরাও একদিন তাদের মতো করতে লাগব? না, নাহ। ওরা ভুল করছে। আমি এটা গোঁড়ামীবশত বলছি না। বলছি কারণ, তারা আমাদের পূর্বসুরীরা যা করেছেন তা বিকৃত ও পরিবর্তিত করার মেহনত করেছে।

আচ্ছা, মীলাদ পুরোটাই কি আমাদের পূর্বসুরীদের পথে পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন নয়? এ কথা হৃদয়ে উদয় হওয়া মাত্র তর্ক মিইয়ে এলো। ভাবনার দিগন্ত রেখা ছোট হয়ে এলো। ঠিক বটে। তবে এটা তো ভালো কাজ।
এ চিন্তা মাথায় উদয় হওয়ার পর থেকেই মুহাম্মদ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আগেভাগেই মীলাদে উপস্থিত হবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। কামনা করতে লাগল, যদি সালেহের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তবে তার সঙ্গে পর্যালোচনা করা যেত।

কিন্তু সালেহ কোথায়? তার কাছে পৌঁছাই বা সম্ভব কিসে? মুহাম্মদ তার মোবাইলে মেসেজ অপশনের ইনবক্সে গিয়ে পুরনো মেসেজগুলো পড়তে লাগলো। এর মধ্যে সে কিছুদিন আগে পাঠানো সালেহের আরেকটি মেসেজ খুঁজে পেল। সালেহ তাতে লিখেছে : ‘আপনি কিন্তু নিজের জন্য গাড়ি কিনতে গিয়ে তা পছন্দের ভার অন্যের ওপর ছেড়ে দেন না। ভালো ফ্ল্যাট কিনে নিজের সুরুচি ও আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটাতে চান। পরিবারকে চমকে দিতে চান। বড় কিছু কিনতেই তো আপনি অন্যের মতামতকে পাত্তা দেন না। বরং নিজের রুচি ও পছন্দকেই অগ্রাধিকার দেন।’

মুহাম্মদ পড়ে চলে : ‘তাহলে আপনি নিজের দীনদারীর ব্যাপারে যে সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য আনতে চান আল্লাহকে খুশি করা জন্য, তা নির্বাচনের ভার কেন ছেড়ে দেন অন্যের ওপর?’

নাহ, আল্লাহর কসম, এ যুক্তি আমি মানতে পারি না। আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে আমি খেয়াল-খুশি মত যা তা করতে পারি না। আমি এমন কোনো কাজে ইবাদত মনে করে আমার জীবনের মূল্যবান সময়ের সামান্যও ব্যয় করতে রাযী নই, যা আখিরাতে আমার কল্যাণ বয়ে আনবে না। যে কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ভূমিকা রাখবে না। অনেক সুস্পষ্ট ও আপাত সুন্দর ইবাদতও কি কখনো বিদ‘আত হতে পারে না? পক্ষান্তরে অনেক তেতো কাজও তো সুন্নত হতে পারে।

মেকি যুক্তির পূজারী হতে গিয়ে কি বিজ্ঞ আলেমদের মত ছাড়াই এ বিষয়টির সমাধানে পৌঁছবো? মীলাদের পক্ষে যারা সাফাই গান তাদের বুযুর্গদর্শন চেহারা দেখে গলে যাবো? অন্য যেসব আলেম সত্যের বার্তা নিয়ে আসেন, যাদের কথা শুনে আমার মনের দুয়ার খুলে যায়, যাদের বক্তব্য শুনলে আমার চিত্তে সাড়া পড়ে, আমি তাদের কাছে গিয়েই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবো। যারা শুধু মৌসুমী ইশকে রাসূলের কথা বলেন তারা নয়; জীবনের প্রতিটি কর্মে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করেন তাদের কথাই আমি গ্রহণ করবো।
এই বিন্দুতে এসেই মুহাম্মদের সামনে দৃশ্যপট পরিষ্কার হতে লাগল। সে জীবনের নতুন নকশা আকঁতে লাগল। সহসা তার সামনে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত ভিড় করল। যেন সে পূর্ব থেকেই এসব স্থির করে রেখেছিল।

১. এমন কোনো সংশয়াচ্ছন্ন ইবাদতে আমি জড়াব না যে সম্পর্কে আমি জানি না তা আল্লাহ তা‘আলাকে খুশি করবে না অখুশি। দীনের বিধি-বিধান সুস্পষ্ট, দিবালোকের ন্যায় সর্বজন দৃষ্টিগ্রাহ্য। এতে কোনো সন্দেহপূর্ণ বা অস্পষ্ট কাজে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমি যদি এর হক ও দায়দায়িত্ব আদায়ে সচেষ্ট হই, তবে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেবার অবকাশই নেই।

২. আজ আমি মীলাদে উপস্থিত হবো না। এরপর আর কখনো নয়। এর বদলে আজ আমাকে আল্লাহ আমার নতুন জন্ম দান করেছেন। আজ থেকে আমি নতুন মানুষ। আজ থেকে আমি প্রতি মুহূর্তে নবীর জন্য উৎসব করবো। উৎসব করবো তাঁর সুন্নত বাস্তবায়নের মাধ্যমে। উদযাপন করব তাঁর আনুগত্যের মধ্য দিয়ে। এবং সময় মতো ফজর সালাত ও অন্য সালাত আদায়ের মাধ্যমে। উদযাপন করবো জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তাঁকে বিচারক মানার মাধ্যমে। আল্লাহর কসম, এখনই আমি এর স্বাদ অনুভব করছি। এ যেন এমন মিষ্টতা যার আস্বাদ ভোগ করছি আমার দেহ ও মনে। সেই জন্ম কত না সুন্দর যা আমি উপভোগ করছি। আমি তো কেবল আমার প্রেমাস্পদেরই অনুকরণ করব। আমি তাঁর সঙ্গে জীবিত থাকব প্রতিটি নীরবতায় ও সরবতায়।

৩. আমাদের দায়িত্ব আলেমদের উপদেশ শ্রবণ করা। তাদেরকে সম্মান ও মুহাব্বত করা। তাই বলে কারো কাছে আমাদের জ্ঞান বন্ধক রাখতে পারি না। কিয়ামতের দিন হিসাব তো নিজেকেই দিতে হবে। তাই আমাদের করণীয়, আমরা যে কাজে তাঁদের অনুসরণ করব সেটা সুন্নত না বিদ‘আত তা বুঝতে হবে। অনুধাবন করতে হবে এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন হবে কি-না। কারণ, আলেমরাও কখনো ভুল করেন। কখনো অভ্যাস বা প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। অতএব পৃথিবীর কোনো আলেমকে আমি সর্ব বিষয়ে অনুসরণের ক্ষেত্রে নবীর সমতুল্য বানাতে পারি না।

৪. আশা করি আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তাঁর রাসূলের বাণীর মাধ্যমে উপকৃত হবার তাওফীক দেবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্য মতে, জান্নাতের কাছে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে নিয়ে যায় এমন কোনো জিনিস নেই যা তিনি আমাদের  সুস্পষ্ট বলে দেন নি। সুতরাং এরপর আমি আর কোন জিনিসটির প্রত্যাশা করতে পারি? দীনের সঠিক বুঝ দানের জন্য মুহাম্মদ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করল।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে রেডিও অন করলো। আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল শায়খ সাউদ আশ-শুরাইম সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করছেন :
‘আর তোমার রবের বাণী সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীসমূহের কোন পরিবর্তনকারী নেই। আর তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। আর যদি তুমি যারা যমীনে আছে তাদের অধিকাংশের আনুগত্য কর, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা শুধু ধারণারই অনুসরণ করে এবং তারা শুধু অনুমানই করে। নিশ্চয় তোমার রব অধিক অবগত তার সম্পর্কে, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং তিনি অধিক অবগত হিদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১১৫-১১৭} 

আমার প্রিয় ভাই, এটি এক ব্যক্তির বাস্তব ঘটনা আল্লাহ তা‘আলা যার অন্তরে নিজের মতের ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতকে প্রধান্য দেবার নূর দান করেছেন। রাসূলুল্লাহকে আদর্শ ও ইমাম হিসেবে গ্রহণ করার তাওফীক দিয়েছেন। তাই তো তিনি সক্ষম হয়েছেন তাঁর পূর্ণ আনুগত্য ও প্রশ্নাতীত অনুসরণে। সফল হয়েছেন দীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে।

বস্তুত আল্লাহর প্রিয় ও পছন্দসই হক তথা সত্যের মানদণ্ড কিন্তু ভালো রুচি বোধ কিংবা বংশ পরম্পরার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় না। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাজের মাধ্যমে চেনা যায় না। এমন জ্ঞানের ফয়সালার মাধ্যমেও জানা যায় না, যা শরীয়তের আলোয় আলোকিত নয়। তেমনি এমন ব্যক্তির অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমেও নয়, যার বক্তব্যের পেছনে আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই।

তবে যে সত্যিকারার্থে হিদায়াত প্রত্যাশী হবে, তারপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথে নব উদ্ভাবন নয়; সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখাবে, সে কিন্তু তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছবেই। আবু যর গিফারী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
‘হে আমার বান্দা, তোমরা সবাই বিভ্রান্ত, কেবল আমি যাকে সঠিক পথে পরিচালিত করি। অতএব তোমরা আমার কাছেই সঠিক পথের জন্য প্রার্থনা করো। আমি তোমাদের হিদায়াত দেব।’ [মুসলিম : ৬৭৩৭] 

হিদায়াতের পথ ছাড়া অন্য পথ সম্পর্কে তিনি বলেন,
‘আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১৫৩}

নিজের ইচ্ছে মত চলা এক বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের নিন্দা করতে গিয়ে আল্লাহ তা‌‘আলা বলেন,
‘তারা তো কেবল অনুমান এবং নিজেরা যা চায়, তার অনুসরণ করে। অথচ তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াত এসেছে।’ {সূরা আন-নাজম, আয়াত : ২৩} 

মীলাদ সম্পর্কে যখন কেউ খোলা মনে, মানুষের প্রভাবমুক্ত হয়ে ভাববেন, পূর্ণ শরীয়তের প্রমাণাদি সামনে রাখবেন, তিনি নিশ্চিত উপলব্ধি করবেন, মীলাদের উদ্দেশ্য ভালো হতে পারে; কিন্তু মীলাদ কোনো ভালো কাজ হতে পারে না। কারণ, মীলাদ বা মিলাদুন্নবীর আবিষ্কার মানেই দীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করা। তারপর এতে বিভিন্ন মুসলিম দেশে নানা মন্দ বিষয় ও খারাপ অনুষঙ্গ যোগ করা হয়। মীলাদে সহজ যে বিষয়টি অহরহই হয় তা হলো, এতে অংশগ্রহণকারীরা  মীলাদের মধ্যে কিয়াম করেন। এর জন্য তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। কেউ এলে যেভাবে দাঁড়ানো হয় ঠিক সেভাবে দাঁড়ান। সেখানে সুগন্ধি ছিটিয়ে গভীর আবেগ আর পরম তৃপ্তি নিয়ে গীতের সুরে গাওয়া হয় :
‘স্বাগতম মোর চোখের আলো, স্বাগতম, স্বাগতম,
স্বাগতম ওহে হুসেনের নানা, স্বাগতম, স্বাগতম।’

আরও যেমন গাওয়া হয় :
‘তুমি যে নূরেরও ছবি, তুমি যে নিখিলের রবি।
তুমি না এলে দুনিয়ায়, হত না এ ধরার সবি।’
ইয়া নবী সালাই মুআলাইকা,
ইয়া হাবীব সালাই মুআলাইকা।’

অনেক মীলাদে গল্পে ইঙ্গিতকৃত অনেক নিষিদ্ধ বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়। কোনোটাতে সরাসরি কুফরি কাজ পর্যন্ত সংঘটিত হয়। যেমন বলেছেন শায়েখ আব্দুর রহমান আকীল, একসময় যার সম্পর্ক ছিল তথাকথিত এই তাসাউফপন্থীদের সঙ্গে। 

এ জন্যই এসব বিদ‘আত, যাকে অনেকে নগন্য মনে করেন; সমালোচনার যোগ্যও মনে করেন না, তা-ই কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে অনেকগুলো বিদ‘আতের মোহনায় পরিণত হয়। তখন আর এসব ছাড়া মীলাদই হয় না। মীলাদ তখন রূপ নেয় বিশাল আকাশের, যার মাঝে এসব আবর্তিত হতে থাকে। রূপান্তরিত হয় একটি মৌসুমের যা থেকে এসবের বিস্তার ঘটে। এটাকেই অনেক আলেম বলেন, ‘আল-বিদ‘আতুল মুরাক্কাবা’ বা বিদ‘আত সমষ্টি। 
মীলাদগুলোতে কী হয় তা জানার জন্য মিশরে অভিবাসী এক বৃটিশ সৈন্য ম্যাকফার্সন প্রণীত ‘মিশরে মীলাদ’ বইটি পড়ে দেখা যেতে পারে। মীলাদ নিয়ে তিনি জোর অনুসন্ধান চালান। অনেক জায়গায় মীলাদ পর্যবেক্ষণ করেন। বইটিতে তিনি যা দেখেছেন তা-ই লিখেছেন। এসব বিবরণের ক্ষেত্রে কোথাও তাকে অতিরঞ্জনের দোষে অভিযুক্ত করা যায় না। তিনি কেবল একজন বিস্মিত দর্শকের ভূমিকায় সরল বিবরণ দিয়ে গেছেন। প্রাচ্যের সমাজগুলোর আচার-অনুষ্ঠানের ওপর বিস্তর গবেষণা রয়েছে তার। মীলাদের পক্ষে-বিপক্ষে কিন্তু তার কিছু বলার নেই। তার ভূমিকা কেবল বিবৃতি ও বিবরণ পর্যন্ত সীমিত। তিনি অনেকগুলো মীলাদ অনুষ্ঠানের বর্ণনা তুলে ধরেছেন, যার সবগুলো জানতে তিনি প্রায় বছরখানেক সময় ব্যয় করেছেন। যুগ যুগ ধরে এমন আচার-অনুষ্ঠান চলে আসছে। সত্যি বলতে কী এসব দেখে শুধু শয়তানই খুশি হয়। এসব আচার দীনের মর্ম মূলে আঘাত হানে। তাওহীদের সুদীপ্ত চেতনা ধ্বংস করে। আল্লাহ আমাদের মীলাদ থেকে হিফাযত করুন। 

হে জ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা, এটি ফিরে আসার এবং নিজেকে শোধরাবার আহ্বান। আপনি অতীতে যা বুঝেছেন, যে সীদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তার বিপরীতে যদি সত্য বা হক দীপ্ত ও উদ্ভাসিত হয়, তবে সে সত্যে ফিরে আসতে আর বিলম্ব করবেন না। মনে রাখবেন, সত্য সনাতন। সত্য চিরন্তন। এবং সত্যই কেবল অনুসরণীয়।

ভালোবাসা একটি হৃদয়গত আমল। বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আচার-আচরণ এর নিদর্শন। অমুক দল অন্যদের থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বেশি ভালোবাসে, এটা কোনো দাবীর বিষয় নয়। এমন দাবীও অবান্তর, আমরা যা করি যারা এসব করে না, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেমিক নয় তারা। কারণ, সাহাবীদের সম্পর্কে যা বলা হবে পরীক্ষা না করে তা-ই সত্য মনে করার দিন গত হয়েছে। তাঁদের সম্পর্কে যা ইচ্ছে তাই বলবে কীভাবে। তাঁরা তো কঠিন ও সহজ- সবই পূর্ণ করে গিয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে দীন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আল্লাহর দীন ও তাঁর হাবীবের ভালোবাসায় তাঁরা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন। এতে আর সংস্কারের কিছু নেই। আছে শুধু অনুসরণ আর অনুকরণ করার। প্রয়োজন শুধু একে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা। ব্যক্তিগতভাবে আহত করা এ লেখার অভিপ্রায় নয়। উদ্দেশ্য কেবল প্রচল উপায়ে এবং দরদ মেশানো কথায় মানুষকে সত্য বুঝানো। 

ইসলামে গোষ্ঠীপ্রীতি বা গোষ্ঠীবিদ্বেষ এবং ‘ভালো চেহারায় মন্দ ছড়ানোর চেয়ে ক্ষতিকর কিছু নেই’। এর চেয়ে আর কোনো খেলায় শয়তান এত বেশি খুশি হয় না। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ে মানুষকে নিয়ে শয়তান এতোটা সফল খেলা খেলে না।

প্রকৃতপক্ষে যে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করে, তেতো হলেও সে সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করে। সবচে’ অপ্রিয় ব্যক্তি বললেও সত্যকে সে মেনে নেয়। তেমনি সে মিথ্যা পরিত্যাগ করে, যদিও তাতে তার স্বার্থ বা মনের টান থাকে। একইভাবে সে মিথ্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করে না, যদিও তার বাপ-ভাই বা কাছের কেউ এর পক্ষ নেয়।

সাবধান, তারা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন না। আর তারা আপনার সমালোচনা করবে এ শঙ্কায় আপনি তাদের প্রতি দুর্বল হবেন না। এটা তাদের মতো আপনাকেও ভুল পথে নিয়ে যাবে। এরা আপনাকে বাতিলের পক্ষে নিয়ে যাবে। সত্য উদ্ভাসিত হবার পর আর বাতিলের পক্ষ নেবার সুযোগ নেই। অন্যথায় আপনিও তাদের একজন হয়ে যাবেন। আত্মম্ভরী তার গরিমার অন্ধতারের ডুবে থাকে। একেরপর এক সে তার অপরাধ শুধু বাড়িয়েই চলে। বাপ-দাদা থেকে চলে আসছে বলেই তা করতে হবে এমন ভাবার অবকাশ নেই। দেখুন আল্লাহ তা‘আলা কী বলেন,
‘আমি কি তাদেরকে কুরআনের পূর্বে কোন কিতাব দিয়েছি, অতঃপর তারা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে? বরং তারা বলে, ‘আমরা নিশ্চয় আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি, আর নিশ্চয় আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে হিদায়াতপ্রাপ্ত হব’। আর এভাবেই তোমাদের পূর্বে যখনই আমি কোন জনপদে সতর্ককারী পাঠিয়েছি, তখনই সেখানকার বিলাসপ্রিয়রা বলেছে, ‘নিশ্চয় আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি এবং নিশ্চয় আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব’। তখন সে (সতর্ককারী) বলেছে, ‘তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষদের যে মতাদর্শে পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের কাছে তার চেয়ে উৎকৃষ্ট পথে নিয়ে আসি তবুও কি’? (তোমরা তাদের অনুসরণ করবে?) তারা বলেছে, ‘নিশ্চয় তোমাদেরকে যা দিয়ে পাঠানো হয়েছে আমরা তার অস্বীকারকারী।’ {সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত : ২১-২৪}  

আমাদের কাছে অনুসরণীয় কারা তা যেমন আগেই বলে দেওয়া হয়েছে। তেমনি দীনের নামে যে নানা বদদীন চালু হবে তারও ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে চৌদ্দশ বছর আগে। ইরবায বিন সারিয়া রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর ভয় এবং আনুগত্যের অসিয়ত করছি। যদিও কোনো দাস তোমাদের নেতৃত্ব দেয়। আমার পরবর্তীকালে যারা বেঁচে থাকবে, তারা অনেক বিভক্তি দেখতে পাবে। তোমরা তখন আমার ও আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশিদার আদর্শ অনুসরণ করবে। একে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। আর তোমরা (দীনের ব্যাপারে) নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে সাবধান থাকবে। কারণ প্রতিটি নব উদ্ভাবিত বিষয়ই (বিদ‘আত) পথভ্রষ্টতা।’ [মুসনাদ আহমদ : ১৭১৮৪; আবূ দাউদ : ৪৬০৯; তিরমিযী : ২৬৭৬; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৭১১০।]

হুযাইফাতুল ইয়ামান রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে কোনো ইবাদত যেটা রাসূলুল্লাহর সাহাবীরা করেন নি, তোমরা তা করবে না। কেননা অগ্রবর্তীরা (সাহাবীরা) পূর্ববর্তীদের জন্য কোনো কথাই বাদ রাখেন নি।’ [শাতিবী, ই‘তেসাম : ১/৬৮৩]

ইবন মাজশূন বলেন, ‘আমি মালেককে বলতে শুনেছি : যে ব্যক্তি পুন্য মনে করে ইসলামে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, সে যেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেসালাতের দায়িত্ব অপূর্ণ রেখেছেন বলে দাবী করল। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,   ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম’।[2] সুতরাং সেদিন যা দীনের অংশ ছিল না আজ তা দীনের অংশ হতে পারে না।’ [শাতিবী, ই‘তেসাম : ১/২৩]  

আয় আল্লাহ, জিবরাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের রব, দৃশ্য-অদৃশ্যের জ্ঞাতা এবং আসমান-যমীনের স্রষ্টা, তোমার বান্দারা যা নিয়ে বিরোধ করত সে বিষয়ে তুমিই ফয়সালা দেবে। বিরোধপূর্ণ বিষয়ে তুমি আমাদের সঠিক পথ দেখাও। যাকে তুমি চাও তাকেই কেবল তুমি সরল পথ দেখাও।

– আলী হাসান তৈয়ব

—————-
1 . মূল হাদীসটি হলো : বারা’ বিন আযেব রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : أَتَدْرُونَ أَيُّ عُرَى الإِيمَانِ أَوْثَقُ ؟ قُلْنَا : الصَّلاَةُ قَالَ : الصَّلاَةُ حَسَنَةٌ وَلَيْسَ بِذَاكَ قُلْنَا : الصِّيَامُ فَقَالَ مِثْلَ ذَلِكَ حَتَّى ذَكَرْنَا الْجِهَادَ ، فَقَالَ مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : « أَوْثَقُ عُرَى الإِيمَانِ الْحَبُّ فِي اللهِ وَالْبُغْضُ فِي اللَّهِ».
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমরা উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি বললেন, তোমরা কি জানো ঈমানের কোন রশিটি বেশি মজবুত? আমরা বললাম, সালাত। তিনি বললেন, সালাত তো একটি নেকীর কাজ, এটা তা নয়। আমরা বললাম, সিয়াম। এবারো তিনি আগের মতই বললেন। এভাবে আমরা জিহাদ পর্যন্ত (ইসলামের সব বড় ইবাদতগুলোর) কথা উল্লেখ করলাম। তিনি একই উত্তর দিলেন। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ঈমানের মজবুততম রশি হলো, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করা।’ [ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ : ৩১০৬০; মুসনাদ তিয়ালিসী : ১/১০১;  সহী  জামে : ৯৩৫২]

2 . সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ০৩।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button