দাওয়াত ও জিহাদ

দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের ভূমিকা

মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে সাধারণভাবে তিনটি স্তরে শ্রেণী বিন্যাস করা যায়। শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। এই তিন কালের মধ্যে সকল বিবেচনায় যৌবনকাল শ্রেষ্ঠ। সৌন্দর্যের কাল যৌবন, শক্তির কাল যৌবন, জীবনের পূর্ণতার কাল যৌবন। তাই কবি বলেছেন ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। যৌবন যেমন সৃষ্টির স্বরূপ, পূর্ণতার স্বরূপ, তেমনি পরিপূর্ণ জীবনও প্রাণের স্বরূপ। যে কারণে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই যৌবনের জয়গান গেয়েছেন। জীবন ও সমাজের পরিবর্তনে এবং তার সৌন্দর্য বর্ধনে তারুণ্য শ্রেষ্ঠ সহায়ক শক্তি। প্রসিদ্ধ কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে এই যৌবনের স্তব-গান। নবী করীম (ছাঃ)ও নানাভাবে যুবকদের স্বাগত জানিয়েছেন, ছাহাবাদেরকে জানাতে বলেছেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘তিনি কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী তোমাদেরকে মারহাবা জানাচ্ছি। রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝিয়ে দেওয়ার নিদের্শ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী আহলুল হাদীছ।’

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তারুণ্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তরুণ ও যুব সমাজের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘জবাকুসুম সঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়াছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি, তাহার স্তব-গান গাহিয়াছি। তরুণ অরুণের মতই যে তারুণ্য তিমিরবিদারী সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলিতে খেলিতে তাহার উদয়, রঙ ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অস্ত। যৌবন-সূর্য যথায় অস্তমিত দুঃখের তিমিরকুন্তলা নিশীথিনীর সেই ত লীলাভূমি’।

তারুণ্য বা বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। কারণ তরুণ ও তারুণ্য এক জিনিষ নয়। নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বহু যুবককে দেখিয়াছি-যাহাদের যৌবনের উর্দির নীচে বার্ধক্যের কঙ্কাল-মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি- যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘ-লুপ্ত সূর্যের মত প্রদীপ্ত যৌবন’। এজন্য যারা ‘পুরাতনকে মিথ্যাকে মৃতকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থকে’, ‘মায়াচ্ছন্ন নব-যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচ-কাওয়াজ করিতে জানে না’, যারা ‘অটল-সংস্কার-পাষাণ স্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে’, যারা ‘নব অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে, আলোকপিয়াসী প্রাণ-চঞ্চল শিশুদের কল-কোলাহলে যাহারা বিরক্ত হইয়া অভিসম্পাত’ করে; বয়স তার যাই হোক না কেন সে কখনো তরুণ নয়। তরুণ তারাই ‘যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তন্ড প্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে’।

তরুণ বা যুব সমাজই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। যুগে যুগে এই তরুণরাই পৃথিবীর বুকে বহু অসাধ্য সাধন করেছে। দ্বীন প্রচারেও যুব সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। ইসলামের আদি যুগ থেকেই শত বাঁধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা হৃদয়ে ধারণ করে দ্বীনের পথে বহু যুবক হাসি মুখে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে ইনশাল্লাহ।

কুরআন ও হাদীছ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি নবী-রাসূলের যুগে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। এক্ষেত্রে শারয়ী বিধানেও যুব সমাজের উপর গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। যৌবনকাল মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তারুণ্য কারো বাঁধা মানতে চায় না। সে তার আপন গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। যৌবন যেমন গড়তে পারে, তেমনি ভাঙতেও জানে। নদীর দু’পাড়ে উঁচু বাঁধ না দিলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যেমন নদীর পানি দু’কূল প্লাবিত করে ফসলের ক্ষেতসহ বসতবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়; যৌবন কালকে সুপথে নিয়ন্ত্রণ না করলে তেমনি যে কোন মুহূর্তে বিপথগামী হতে বাধ্য। সে কারণেই প্রত্যেক যুবককে সতর্ক করে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, কিয়ামতের কঠিনতম সময়ে সাত শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে; যেদিন আল্লার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না। তার দ্বিতীয় নম্বরে বলা হচে ‘ঐ যুবক যে আল্লাহর ইবাদতে যৌবনকে অতিবাহিত করেছে’ (বুখারী, মুসলিম)। অপর এক হাদীছে নবী (ছাঃ) বলেন, কিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত কোন আদম সন্তান এক পাও অগ্রসর হতে পারবে না। প্রথম হল- ‘তার বয়স, সে তা কোন কাজে ব্যয় করেছে। দ্বিতীয় হল- ‘তার যৌবনকাল, সে তা কোন পথে ব্যয় করেছে’ (তিরমিযী)।

উল্লেখিত দু’টি হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কিয়ামতের ময়দানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিশেষ করে তার যৌবন কালের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবে দিতে হবে। আর শেষ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে গেলে সময় থাকতেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিশেষ করে যুব সমাজকে দায়িত্ব সচেতন হতে হবে। অন্যথায় সেদিন কঠিনভাবে অপমানিত হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা থাককে না। যার নিশ্চিত পরিণতি হল জাহান্নাম। এই চেতনাবোধ থেকেই বিগত দিনে জাহান্নামের ভয়ে ভীতু এবং জান্নাতের পাগল যুবসমাজ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মোহ ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বিলিয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি। কেননা তাদের হৃদয়ে সদা জাগ্রত ছিল মহান আল্লাহর অমীয় বাণী-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন’ (তওবা ১১১)।

দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের ভূমিকার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে হযরত ওমর (রাঃ)-এর কথা। তিনি মুসলমান হওয়ার আগ পর্যন্ত নবী (ছাঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা অত্যন্ত সংগোপণে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। অন্যদের সাথে স্বয়ং ওমরও ছিলেন ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোর শত্রু। নাঙ্গা তরবারী নিয়ে যে ওমর মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শিরোচ্ছেদ করতে পাগলের মত ছুটে চলেছেন, সেই ওমরই আল্লাহর অশেষ রহমতে যখন মুসলমান হয়ে গেলেন তখন থেকেই প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হয়ে গেল। ওমর (রাঃ)সহ মোট চল্লিশ জনের ছোট্ট একটি মুসলিম কাফেলা মক্কার অলিতে-গলিতে মিছিল বের করল। উলঙ্গ তরবারী হাতে মিছিলের প্রথম কাতারে মহাবীর ওমর (রাঃ)। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তাকবীর ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বণীতে মক্কার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। কাবা প্রাঙ্গণে গিয়ে মিছিল শেষ হল। সকলে একসাথে ছালাত আদায় করলেন। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ওমরকে দেখে কুরায়েশ যারপরনাই বিস্মিত-হতভম্ব হল। তাদের ক্রোধান্বিত অবস্থা দেখে ওমর (রাঃ) বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘সাবধান! কোন মুসলমানের কেশাগ্র স্পর্শ করলে ওমরের তরবারী আজ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে’। তাৎক্ষণিক তারা কিছু না করতে পারলেও কোন দিনই মক্কার কাফের-মুশরিকরা মুসলমানদেরকে সহজ ভাবে গ্রহণ করেনি। যার ফলে সংঘটিত হয় বদর, ওহুদ, খন্দকসহ অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এসব সমর ক্ষেত্রেও মুসলিম যুবসমাজই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে একথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, যুবসমাজের আত্মত্যাগ ছাড়া পৃথিবীতে কোন সত্য উদ্ঘাটন বা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বনী ইসরাঈলের গো-কুরবানীর কাহিনী সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বনী ইসরাঈলের এক যুবক তার চাচার সম্পত্তির লোভে এবং চাচাতো বোনকে বিয়ে করার আশায় রাতের অন্ধকারে চাচাকে হত্যা করে মৃতদেহ অন্যের বাড়ির সামনে রেখে আসে। পরদিন সকলে যে বাড়ির সামনে লাশ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে চাচাকে হত্যার অভিযোগ উত্থাপন করে। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায় তারা উভয় পক্ষ বিষয়টি মিমাংসার জন্য হযরত মুসা (আঃ) এর স্মরণাপন্ন হয়। তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানান যে, তোমরা একটা গাভী কুরবানী করে তার এক টুকরো গোশত ঐ মৃত লাশের গায়ে স্পর্শ কর, তাহলে সে জীবিত হয়ে তার মৃত্যু-কাহিনী বর্ণনা করবে। তারা তখন মুসা (আঃ)-এর সাথে বহু বাদানুবাদ করল যেমন, গাভীটি কেমন হবে, তার রং কি, তার সয়স কেমন ইত্যাদি। আল্লাহর পক্ষ থেকে তখন গাভীর যতগুলো গুণাগুন বর্ণনা করা হল তার প্রথমটি হল- ‘গাভীটি বয়সে বৃদ্ধও হবে না আবার বাছুরও হবে না। এর মধ্যবর্তী যৌবন বয়সের হতে হবে’ (বাকারা ৬৮)। অবশেষে তারা তাই করল। মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে তার হত্যার রহস্য প্রকাশ করে দিল। দু’টি গোত্র সাক্ষাত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা পেল। এখানে লক্ষণীয় যে, একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে কিছু মানুষকে নিষ্কৃতি প্রদানের অসীলা হিসাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি মধ্যম বয়সী প্রাণীকে নির্বাচন করা হল।

দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজের আত্মত্যাগের গুরুত্ব আরো বেশী পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে ‘আসহাবুল উখদূদ’-এর কাহিনীতে। ঘটনাটি সংক্ষেপে এরূপ- পূর্ব জামানায় এক রাজা একটি ছেলেকে যাদুবিদ্যা শেখানোর জন্য তার বৃদ্ধ যাদুকরের কাছে পাঠায়। ছেলেটি যাদুবিদ্যা শিক্ষার পাশাপাশি এক খৃষ্টান পাদ্রীর নিকটে ছবক নিত। একদিন তার যাতায়াতের পথে বিরাট এক বন্য জন্তু এসে মানুষের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে রাখল। ছেলেটি তখন ভাবল আজ আমি পরখ করে দেখব, পাদ্রী শ্রেষ্ঠ না যাদুকর শ্রেষ্ঠ? সে তখন একটি পাথর হাতে নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ! পাদ্রীর কর্ম যাদুকরের কর্ম হতে আপনার কাছে যদি অধিক পছন্দনীয় হয়, তবে এ জন্তুটিকে মেরে ফেলুন’। এই বলে সে পাথরটি নিক্ষেপ করল এবং ঐ পাথরের আঘাতে জন্তুটি মরে গেল। বিষয়টি সর্বত্র জানাজানি হয়ে গেল। তখন অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীসহ বিভিন্ন রোগীরা ছেলেটির কাছে আসতো। তারা আল্লাহর উপর ঈমান আনলে সে তাদের রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করত তাদের রোগ ভাল হয়ে যেত। এক পর্যায় রাজার পরিষদের এক সদস্য অন্ধ ছেলেটির নিকটে গিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল, আল্লাহর রহমতে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। পরের দিন সে রাজ দরবারে গেলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করল, কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে উত্তর দিল, আমার রব। রাজা বলল, আমি ছাড়া তোমার রব কে? সে বলল, আল্লাহ তোমার ও আমার রব। তখন রাজা তাকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করতে লাগল। অবশেষে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলেটির কথা বলে দেয়। রাজা তখন ছেলেটিকে গ্রেফতার করে তাকেও নির্মমভাবে নির্যাতন শুরু করে। এক পর্যায় ছেলেটি বাধ্য হয়ে পাদ্রীর কথা রাজাকে বলে। রাজা তখন পাদ্রীকে গ্রেফতার করে আনে তার দ্বীন ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু সে প্রস্তাবে পাদ্রী অস্বীকৃতি জানালে তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত করা হয়। এরপর তার পরিষদের লোকটিকে বলা হয়, তুমি তোমার দ্বীন ত্যাগ কর। সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে হত্যা করা হয়। অতঃপর একই ভাবে ছেলেটিও দ্বীন পরিত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তাকে কিছু সৈন্যের সাথে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় তুলে সেখান থেকে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে পাহাড় কেঁপে উঠে, এতে তার সঙ্গীরা পাহাড়ের চূড়া হতে নিচে পড়ে মারা যায় এবং ছেলেটি প্রাণে রক্ষা পায়। অতঃপর তাকে নৌকায় করে সাগরের মাঝখানে নিয়ে পানিতে ফেলে দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও যারা তাকে নিয়ে গেল ঝড়ের কারণে তাদের সলীল সমাধি হল, কিন্তু আল্লাহর রহমতে ছেলেটির কিছুই হল না। রাজার হতবিহবল অবস্থা দেখে ছেলেটি রাজাকে বলল, তুমি আমার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না করলে আমাকে হত্যা করতে পারবে না। সে তখন রাজাকে বলল, একটি ময়দানে রাজ্যের সকল জনগণকে সমবেত কর। তাই করা হল। অতঃপর ছেলেটি বলল, এবার আমাকে শূলের উপর উঠাও এবং আমার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মাঝখানে রেখে ‘ছেলেটির রবের নামে তীর মারছি’ বলে তীর নিক্ষেপ কর। তাই করা হল এবং ছেলেটি মারা গেল। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকল জনতা বলে উঠল, ‘আমরা ছেলেটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম’। যে আশঙ্কায় ভীত হয়ে রাজা পাদ্রীকে, পরিষদ সদস্যকে এবং এই ছেলেকে হত্যা করল; শেষ পর্যন্ত তাই বাস্তবায়িত হল। রাজা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী এই মানুষগুলোকে ধরে ধরে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারল। সংক্ষেপে বর্ণিত এ ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ছেলেটি একমাত্র দ্বীন প্রচারের খাতিরে স্বেচ্ছায় নিজের হত্যার কৌশল শত্রুর নিকটে ব্যক্ত করল। ফলে মাত্র একজন যুবকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে হাযার হাযার মানুষ পরকালীন মুক্তির দিশা খুঁজে পেল। এমনিভাবে যুগে যুগে যুবসমাজের আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্যায় ও অসত্যের দম্ভ চূর্ণ হয়ে তদস্থলে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্ব পরিমন্ডলে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে সর্বত্র নব্য ফেরাউন ও নমরুদ মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করতে অক্টোপাসের মত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা তোহমত দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য জাতির কাছে তাদেরকে হেয় বা ঘৃণ্য জাতি হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। ইরাক, আফগান, কাশ্মীর, সোমালিয়াসহ বিশ্বের যেখানেই মুসলমানরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং শোষণ, বঞ্চণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে, সেখানেই তাদেরকে ইহুদী-খৃষ্টানদের মদদপুষ্ট প্রচার মাধ্যমগুলো জঙ্গী হিসেবে চিত্রিত করছে। অথচ তাদের মুখে কখনও ইসরাঈলকে জঙ্গী বলতে শোনা যায় না, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহী, ভারতের উলফাসহ অন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপগুলোকে, নেপালের মাওবাদী বিদ্রোহী বাহিনীসহ অন্য ধর্মাবলম্বী চরমপন্থী কোন গ্রুপকে জঙ্গী বলতে শোনা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব মোড়লদের বিরুদ্ধে ঐ সকল চরমপন্থী দলগুলোকে অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহযোগিতা করারও অভিযোগ ওঠে, যা বহুলাংশে সত্য। ইহুদী-খৃষ্টানদের এহেন ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মুসলিম যুবকদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। যাতে কোন অবস্থাতেই কোন মুসলিম যুবক তাদের হাতের পুতুলে পরিণত না হয়।

সাম্প্রতিক কালে ধর্মের নামে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত কিছু যুবক সস্তায় জান্নাত লাভের আশায় ইহূদী-নাছারাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করছে। বিশেষ করে কোমলমতি যুবসমাজকে জিহাদের নামে সরাসরি জঙ্গী কার্যক্রমের মত ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কুরআন-হাদীছের খন্ড খন্ড আয়াত ও হাদীছ পড়িয়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে সরলমনা এসব ছেলেদের শরীরে বোমা বেঁধে ইসলামের দুশমন খতমের নামে যত্রতত্র হামলা চালানো হচ্ছে। আর তাতে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত নিরীহ নিরপরাধ প্রাণ। পরিণামে ছেলেটি ইহকাল-পরকাল দুটিই হারাচ্ছে; সাথে সাথে বিশ্বের দরবারে চির সত্য ধর্ম ইসলাম সন্ত্রাসীদের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি হত্যার বিনিময়ে হত্যা অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কোন নিরপরাধ ব্যক্তি হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল’ (মায়েদা ৩২)। অতএব সাবধান হে যুবসমাজ! কোন চক্রান্তকারীর চক্রান্তের শিকার হয়ে আমরা যেন বিপথগামী না হয়ে পড়ি। সাথে সাথে মহান আল্লাহ আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা যেন যথাযথভাবে পালন করে যেতে পারি সেদিকে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে। হে যুবক! সর্বদা স্মরণ রেখ রাসূলের বাণী। জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে গনীমত মনে কর। যার প্রথম নম্বরটি হল ‘তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে তোমার যৌবনকালকে’ (তিরমিযী)।

পরিশেষে যুব সমাজের প্রতি একান্ত নিবেদন, মহান আল্লাহ আমাদেরকে যৌবন নামক যে অমূল্য সম্পদ দান করেছেন, আমরা যেন তার যথাযথ সদ্ব্যবহার করে পরকালে সগৌরবে জান্নাতী যুবকদের কাতারে শামিল হতে পারি সে চেষ্টা করে যেতে হবে। মহান আল্লাহ যেন আমাদের এ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। আমীন!!

– ড. এ.এস.এম আযীযুল্লাহ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button