সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

বর্ষবরণ – ঈমান হরণ

উৎসব মানুষের প্রাণের চাহিদা। আনন্দের খোরাক।  ক্লেশ-ক্লান্তি ভুলার উপায়। আমেজে ডুব দিয়ে মনকে সজীব করার মাধ্যম। সে দৃষ্টিকোণ  থেকে ইসলাম মানুষের জন্য সার্বজনীন উৎসবের ব্যবস্থা করেছে দুই ঈদ প্রবর্তনের  মাধ্যমে। এ তো শুধু উৎসব নয়; বরং দুই ঈদকে যারা সুন্নাহ ভিত্তিক উদযাপন করতে  পেরেছেন, তারাই উপলব্ধি করেছেন এলাহী উৎসবের শীতলতা কত! কত প্রশান্তিদায়ক! অথচ  হালে দেখা যায়, উৎসব মানে বাদ্য-বাজনার আবশ্যিক ব্যবহার, প্রায় নগ্ন নারীর বাধাহীন  মিশ্রণ, তরুণ-তরুণীর বেসামাল কীর্তিকলাপ, উচ্চশব্দে ইবলীসের হাসি ও জম্পেশ আড্ডা  ইত্যাদি। এসব ব্যতীত যেন উৎসব অচল, নিরস, প্রাণহীন।

পহেলা বৈশাখ! লোকে বলে, এটা নাকি একমাত্র  অসাম্প্রদায়িক মহা উৎসব। যেখানে নেই কোন ধর্মের ভেদ, নেই জাতির। একুল বাংলা ওকুল  বাংলা দুই বাংলার মেলবন্ধন। সাম্যবাণী বৈকি! এরা অসাম্প্রদায়িক শব্দটি দিয়ে কী  বুঝাতে চায়? এরা চায় সকল ধর্মের সাথে মিলেমিশে খিচুড়ী মার্কা একটা উৎসবের। যে উৎসব  সকলের মধ্যকার ছেদ-পার্থক্য দূর করে একাকার করে দিবে। ভেঙ্গে দিবে ধর্মের প্রাচীর।  আসুন! ঘেটে দেখা যাক, বর্ষবরণের এমন উৎসবে মেতে উঠা সঙ্গত কি-না।

বাংলা সনের উৎপত্তি :

মোঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে বাংলা সনের পথচলা।  বাংলা সন প্রবর্তনের পিছনে প্রধানত দু’টি কারণ পরিলক্ষিত হয়। প্রথমতঃ আকবরের  শাসনকার্য হিজরী সন অনুযায়ী পরিচালিত হ’ত। এতে খাজনা আদায়ে অসুবিধার সৃষ্টি হ’ত।  কারণ চান্দ্রবর্ষ প্রতি বছর ১০/১১ দিন এগিয়ে যায়। এটি আল্লাহর বিশেষ করুণা যে,  তিনি ইবাদতকে চন্দ্রের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন। এতে করে যুগ পরিক্রমায় আরবী মাসগুলো  সব ঋতুতেই আসে। সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত হলে চিরকালই এক মওসুমে ছিয়াম অথবা অন্যান্য  ইবাদত পালন করতে হ’ত। কারণ সূর্যের সাথে সৌরবর্ষের হিসাব থাকায় দিন-মাস-ঋতুর গণনা  সব সময় একই থাকে। শস্য উৎপাদন ও খাজনা আদায়ের সমন্বয় সাধনের জন্য সম্রাট আকবর  সৌরবর্ষের হিসাবে বাংলা সালের প্রবর্তন করেন।[1]

ইতিহাসে দ্বিতীয় যে কারণটির উল্লেখ রয়েছে, তা  হল-  আকবরের ছিল পাঁচ শতাধীক স্ত্রী।[2] মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন নানা  ধর্মের স্ত্রীদের মধ্যে হিন্দুপ্রধান দেশ ভারতে আকবরের হিন্দু স্ত্রীদের সংখ্যা  ছিল বেশী। মুসলিম শাসক আকবরের হেরেমে সকল স্ত্রী নিজ নিজ ধর্ম পালন করত। পৃথক পৃথক  উপাসনালয় ছিল তাদের জন্য। তবে আকবরের জীবনে হিন্দুয়ানী ষ্টাইল আছড়ে পড়ে মূলতঃ  হিন্দু স্ত্রীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে। তৎকালীন হিন্দুরা আকবরের নিকট দাবী জানায়,  যীশুখৃষ্টের সাথে খৃষ্টাব্দ, মুহাম্মাদের সাথে হিজরী সাল জড়িত। আমাদের জন্য পৃথক  কিছু নেই। অথচ হিন্দু হিতৈষী বাদশাহ হিসাবে হিন্দুদের কল্যাণে আপনার পৃথক সালের  ব্যবস্থা করা উচিত। অতঃপর তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রবর্তন করা হল ‘তারিখ-ই-ইলাহী’  সনের।[3] এটিই পরবর্তীতে ‘ফসলী সন’, অতঃপর ‘বাংলা সন’ বা  বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলা সনের উক্ত  ক্যালেন্ডার প্রস্ত্তত করেন তৎকালীন পন্ডিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী।

আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ৫  নভেম্বর মোতাবেক হিজরী ৯৬৩ সালের মুহাররম মাসে। তখনো বঙ্গে শকাব্দ চালু ছিল যার  শুরুর মাস ছিল চৈত্র। শকাব্দ হল- মধ্য এশিয়ার প্রাচীন রাজা ‘শক’ কর্তৃক প্রবর্তিত  সাল। এটি বাংলা সাল থেকে ৫১৫ বছর বেশী ও খৃষ্টসাল থেকে ৭৮ বছর কম (অর্থাৎ  ১৪২১+৫১৫/২০১৪-৭৮=১৯৩৬, এখন শকাব্দ ১৯৩৬)।

আকবরের সিংহাসনারোহণের মাস মুহাররমের সাথে  শকাব্দের বৈশাখ মাস পড়ে যাওয়ায় তিনি ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ বা ফসলী সনের শুরু করেন বৈশাখ  মাস দিয়ে। সেই থেকে চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখ দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। আববরের আদেশে  ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ৯৯২ হিজরীতে ফসলী সন বা বাংলা সনের ফরমান জারী হয়। ৯৯২  হিজরীতে আদেশ জারী করলেও ৯৬৩ হিজরীতে আকবরের সিংহাসন আরোহণের সাল থেকে বাংলা সন  গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ সালে বাংলা ও হিজরী সাল একই ছিল। অতঃপর হিজরী সাল প্রতি বছর  ১০/১১ দিন এগিয়ে যাওয়ায় (২০১৪ইং/১৪২১ বঙ্গাব্দ-৯৬৩) ৪৫৯ বছরে হিজরীবর্ষ এগিয়ে গেছে  ১৫ বছর। ফলে এখন বাংলা ১৪২১ আর আরবী ১৪৩৬।

ইংরেজী সালের বর্তমান রূপ যেভাবে এল :

খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য আমেরিকার  মেক্সিকোতে এক উচ্চমান সভ্যতা ছিল। যার নাম ‘মায়া সভ্যতা’। মায়াদের সংখ্যা  তাত্ত্বিক জ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা, শিল্পকলার  উন্নতি ইত্যাদিতে ইতিহাস বিস্মিত। তারাই প্রথম আবিষ্কার করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে  আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন।

বলা হয়ে থাকে, নিজেদের গণনার সুবিধার্থে  সর্বপ্রথম রোমানরা ক্যালেন্ডার তৈরী করে। তাতে বছরের প্রথম মাস ছিল মারটিয়াস। যা  বর্তমানের মার্চ মাস। এটি তাদের যুদ্ধ দেবতার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। অতঃপর  খৃষ্টপূর্ব ১ম শতকে জুলিয়াস সিজার কয়েক দফা পরিবর্তন ঘটান ক্যালেন্ডারে। তৎকালীন  প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় তিনিই প্রথম ক্যালেন্ডারে (মায়াদের আবিষ্কৃত  সূর্যকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ কাল) ৩৬৫ দিন ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার  উদ্ভাবিত ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ বাজারে প্রচলিত থাকে। বহুকাল পরে এই ক্যালেন্ডার  সংশোধন করে নতুন একটি ক্যালেন্ডার চালু হয়। দু’জন জোতির্বিজ্ঞানীর সাহায্যে  খৃষ্টধর্মের ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরী ১৫৭৭ সালে জুলিয়াস প্রবর্তিত প্রচলিত  ক্যালেন্ডারটিতে পরিবর্তন আনেন। অবশেষে ১৫৮২ সালে আরেক দফা সংষ্কার করে বর্তমান  কাঠামোতে দাঁড় করান। পরিবর্তিত এ ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় জানুয়ারী দিয়ে,  যা গ্রীকদের আত্মরক্ষার দেবতা ‘জানুস’-এর নামে রাখা হয়। আমাদের ব্যবহৃত বর্তমান  ইংরেজী ক্যালেন্ডারটি ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। প্রায় সারাবিশ্বে প্রচলিত ইংরেজী  ক্যালেন্ডার এখন এটিই।

ইংরেজী সালের সাথে বাংলা সালের সমন্বয় :

ইংরেজী সালের মত বাংলা সালেও ৩৬৫ দিন। মূলতঃ  পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড  অর্থাৎ প্রায় ৬ ঘণ্টা। চার বছর পর এই ৬ ঘণ্টা ১ দিনে পরিণত হয়ে ৩৬৬ দিন হয়ে যায়।  ইংরেজী ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাস ৩১ দিনে (৭´৩১=২১৭), ৪ মাস ৩০ দিনে (৪´৩০=১২০), ফেব্রুয়ারী মাস ২৮ দিনে মোট (২১৭+১২০+২৮)= ৩৬৫ দিন। চার বছর পর  ফেব্রুয়ারী মাস ২৯ দিনে হয়। যে বছর ফেব্রুয়ারী মাস ২৯ দিনে হয় সে বছরের দিন সংখ্যা  হয় ৩৬৬ এবং বছরটির নাম Leapyear।  ২৯ ফেব্রুয়ারীর দিনটির নাম Leap day। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে এই নিয়মটি প্রচলিত হয়ে আসছে।

বাংলা সালের সাথে খৃষ্টাব্দের মিল করতে ড.  মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করা হয়।  ঐ কমিটি ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সালে বাংলা সালের সংস্কার করেন এভাবে-

১. বছরের প্রথম  পাঁচ মাস (বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র) গণনা হবে ৩১ দিনে।

২. পরের সাত মাস  (আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র) গণনা হবে ৩০ দিনে।

৩. ইংরেজী লিপ  ইয়ারে বাংলা ফাল্গুনের সাথে ১ যোগ হয়ে ৩১ দিনে হবে।

এই সংস্কারের ফলে এখন প্রতি ইংরেজী বছরের ১৪  এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা এ সংস্কার গ্রহণ করেনি।  ফলে বাংলা সাল হ’লেও তাদের সাথে তারিখে আমাদের মিল নেই।

বৈশাখ উদযাপনের গোড়ার কথা :

সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন  শুরু হয়। চৈত্রের শেষ দিনে বঙ্গের জমিদারদের নিকট প্রজারা তাদের সকল খাজনা, মাশুল,  শুল্ক পরিশোধ  করত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা  বৈশাখ তারা উৎসবের আয়োজন করত। মূলতঃ তাদের এদিনের প্রধান কাজ ছিল একটি হালখাতা  তৈরী করা। হালখাতা মানে বর্তমান খাতা বা নতুন হিসাব বহি। অর্থাৎ নতুন বছরের যাবতীয়  হিসাব নতুন করে শুরু করার খাতা। এটা হল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রচলিত ইতিহাস।

গভীরে যে কথা রয়ে গেছে তা হল, হিন্দু হিতৈষী শাসক  সম্রাট আকবরের রূহে হিন্দুয়ানা গুলে ছিল। তার উদ্ভাবিত মিকশ্চার ধর্ম  ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’র মত সব ধর্মের অংশগ্রহণে একটি উৎসব হওয়া তার কাম্য ছিল। বৈশাখের  অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে তার আকাংখিত মিকশ্চার উৎসব। এতে তার হিন্দু স্ত্রী ও হিন্দু  প্রজারা বেশী উৎফুল্ল হয়। কারণ তাদের দাবীর প্রেক্ষিতেই এই সালের উৎপত্তি এবং এমন সার্বজনীন  উৎসব!

বর্ষবরণ হয় যেভাবে :

ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষবরণ হয় দুইবার। একবার তাবৎ  বিশ্বের সাথে ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন। নিজস্ব সংস্কৃতিতে আরেকবার বৈশাখ উদযাপন। অবশ্য  বৈশাখ উদযাপনটাই যেন বাঙ্গালির ‘অবশ্য পালনীয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশাখ মাতাল জনৈক  লেখক পহেলা বৈশাখের চিত্রাঙ্কনে লিখেছেন- ‘শিশুরা খেলছে, বড়রা বেড়াচ্ছে,  প্রেমিক-প্রেমিকারা কূজনে মগ্ন, খুশিতে, লাবণ্যে, মাধুর্যে সব পরিবেশ ঝলমল করে  উঠে। ওরা না থাকলে যেন মিথ্যে হত আকাশের তারা ফোটা, মিথ্যে হত জীবনের মানে’।[4]

ইংরেজী নববর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে  পালিত হয়। আমেরিকাতে হয় সবচেয়ে বড় নিউইয়ার পার্টি- যাতে ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে।  অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ৮০ হাযারের মত আতশবাজি ফুটানো  হয়। মেক্সিকোতে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২-টা ঘণ্টা ধ্বনি বাজানো  হয়। প্রতি ঘণ্টা ধ্বনিতে ১টি করে আঙ্গুর খাওয়া হয়, আর মনে করা হয়, যে উদ্দেশ্যে  আঙ্গুর খাওয়া হবে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে। ডেনমার্কে আবার কেমন লঙ্কাকান্ড! ডেনিশরা  প্রতিবেশীর দরজায় কাঁচের জিনিসপত্র ছুড়তে থাকে। যার দরজায় যতবেশী কাঁচ জমা হবে,  নতুন বছর তার তত ভাল যাবে। আর কোরিয়ানরা যৌবন হারানোর ভয়ে রাতে ঘুম থেকে বিরত থাকে।  তাদের বিশ্বাস বছর শুরুর সময় ঘুমালে চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়। বাংলাদেশে রাত বারটা  বাজার সাথে সাথে আতশবাজি, নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, উন্মত্ততা শুরু হয়। নতুন পোশাক,  ভাল খাবার, বিভিন্ন স্পটে ঘুরতে যাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন  ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পালিত হয় ইংরেজী নববর্ষ।

অপরদিকে বাংলাদেশে বৈশাখ বরণের চিত্রও ভয়াবহ। পহেলা  বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় ৩১ চৈত্র; চৈত্র  সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তি মানে চৈত্রের শেষদিন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য  দিয়ে চৈত্রকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সূর্যাদয়ের সঙ্গে সঙ্গে  ছায়ানটের শিল্পিরা বিশ্বকবির বৈশাখী গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…’ গেয়ে সূর্যবরণের  মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।

জানা প্রয়োজন, রমনার বটমূল পহেলা বৈশাখের ধমনী।  যে গাছের ছায়ায় ছায়ানটের মঞ্চ তৈরী হয় সেটি বট গাছ নয়। অশ্বত্থ গাছ। সুতরাং বটমূল  নয় অশ্বত্থমূল। বটমূল হল প্রচলিত ভুল শব্দের ব্যবহার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে বৈশাখের  প্রধান আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বের হয়। দেশের সমৃদ্ধি কামনায় শোভাযাত্রা বের হয়  বলে এর নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। হাযার হাযার মানুষের অংশগ্রহণে মূর্তি-মুখোশ  মিছিলে ঢাক-ঢোল, কাঁসা-তবলার তালে তালে চলতে থাকে সঙ্গীত-নৃত্য, উল্লাস-উন্মত্ততা।  এ শোভাযাত্রায় এ বছরের শ্লোগান ছিল, ‘জাগ্রত কর, উদ্যত কর, নির্ভর কর হে’। লক্ষণীয়  যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গল কামনার প্রতীক হল চারুকলার ম্যাসব্যাপী পরিশ্রমে  বানানো ঘোড়া, হাতি, ময়ূর, পেঁচা, পুতুল, পাখি, মূর্তি, বিভিন্ন মুখোশ প্রভৃতি।

প্রিয় পাঠক! বৈশাখী অনুষ্ঠানের শুরুটাতেই হয়ত টের  পেয়েছেন এটি যে সূর্যপূজা। এছাড়া বিনোদনের নামে পালনীয় কার্যক্রমেও হয়তো লক্ষ্য  করেছেন হিন্দু কালচারের সফল বিচরণ। তারা বাঙ্গালী হ’তে গিয়ে হিন্দু রীতির লৌহ  নিগঢ়ে নিজেকে জড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক হ’তে চাইছেন। আসলে অসাম্প্রদায়িকতাটা কি? এটি কি  সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা? যদি তাই হয়, তবে বৈশাখের আহবান ধর্মনিরপেক্ষতার  আহবান নয় কি? দুর্ভাগ্য হতভাগা মুসলমানদের, যারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে  জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দু সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেজেছে।

পান্তা-ইলিশ যেভাবে :

সব কিছু ছাপিয়ে পানতা-ইলিশ হয়ে ওঠেছে বৈশাখের এক  অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইট-বালিতে সিমেন্টের ন্যায়। পান্তা-ইলিশ বিহীন বৈশাখের গাথুঁনী  যেন বালুময়, খড়খড়ে, ক্ষীয়মান। বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সংযোজনকারীদের অন্যতম  সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নিজেই উল্লেখ করেছেন কিভাবে তারা এর সূচনা করেন। তার  জবানীতে ঘটনাটি এরূপ- ৫ সেগুনবাগিচা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছিল দৈনিক দেশ এবং  সাপ্তাহিক বিপ্লবের কার্যালয়। সেকারণেই সেখানে বসত লেখক আড্ডা। আমি ছিলাম একজন  নিয়মিত আড্ডারু। ১৯৮৩ সাল। চৈত্রের শেষ। চারদিকে বৈশাখের আয়োজন চলছে। আমরা আড্ডা  দিতে দিতে পান্তা-পিয়াজ-কাঁচা মরিচের কথা তুলি। দৈনিক দেশের (প্রয়াত) বোরহান ভাই  রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দিলেন। আমি সমর্থন দিলাম। প্রথমে আমাকে  দায়িত্ব নিতে বললেন। কারণ সেই আড্ডায় আমিই একমাত্র বহিরাগত। ফলে কাজটা সম্পাদন  করতে সুবিধা হবে। আমি একা রাজি না হওয়ায় কবি ফারুক মাহমূদ আমাকে নিয়ে পুরো আয়োজনের  ব্যবস্থা করলেন। নিজেদের মধ্যে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তোলা হল। বাজার করা আর  রান্না-বান্নার দায়িত্ব দিলেন বিল্পব পত্রিকার পিয়নকে।

প্রথমে আমরা পান্তা আর ডিম ভাজা দিতে চাইলাম।  কিন্তু ডিমের স্থলে স্থান পেল জাতীয় মাছ ইলিশ। রাতে ভাত রেঁধে পান্তা তৈরী করে,  কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, ইলিশ ভাজা নিয়ে ‘এসো হে বৈশাখের আগেই ভোরে আমরা  হাজির হ’লাম বটমূলের রমনা রেষ্টেুরেন্টের সামনে। সঙ্গে মাটির সানকি। মুহূর্তের  মধ্যে শেষ হলো পান্তা-ইলিশ। এভাবে যাত্রা শুরু হলো পান্তা-ইলিশের (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ এপ্রিল ২০১৪, পৃষ্ঠা- ১)

বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ইসলামী মূল্যায়ণ :

বিশেষ সময়কে উদযাপন ও সূর্যকে আহবান : ইংরেজী নববর্ষের শুরু হয় ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা  ০১ মিনিটে। আর তখন থেকেই শুরু হয় আতশবাজি, বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, যুবক-যুবতীর ফ্রি  স্টাইল ফূর্তি। উল্লাস আর বেলেল্লাপনায় কেটে যায় সারাটি রাত।

রাতের গুরুত্বপূর্ণ যে সময়টিকে তারা টগবগে যৌবনের  লাগামছাড়া নেশা মেটানোর সময় হিসাবে বেছে নিয়েছে সে সময়টিতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার  আকাশে নেমে এসে আহবানকারীকে, অসুস্থকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে যা ইচ্ছা তা ডেকে ডেকে  দিয়ে যান।[5] মহান স্রষ্টার আহবানকে উপেক্ষা করে যারা শয়তানের  আহবানে রাত জাগে, তাদের পরিণাম আল্লাহর কাছে কি-ই বা হবে?

বাংলাদেশে ইংরেজী নববর্ষের চেয়ে বাংলা নববর্ষ  অনেক বেশী সাড়ম্বরে পালিত হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ এর শিল্পীরা রমনা বটমূলে  রবীন্দ্রনাথের গান এবং ধানমন্ডী রবীন্দ্র সরোবরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়ে  নববর্ষের সূচনা করে। নববর্ষের শুভ কামনায় বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলা  নববর্ষে সূর্যোদয়ের সময়টিকে কল্যাণের জননী হিসাবে বেছে নিয়ে সূর্যকে আহবান করা হয়।  এরূপ শুভাশুভ নির্ণয় ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেন الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ‘কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শিরক’।[6]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ، أَوْ تُطِيَّرَ  لَهُ أَوْ تَكَهَّنَ، أَوْ تُكِهِّنَ لَهُ أَوْ سَحَرَ، أَوْ سُحِرَ لَهُ ‘যে কুলক্ষণে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে বিশ্বাস করায়, যে ভাগ্য গণনা করে এবং যাকে  সে ভাগ্য গণনা করে দেয়, যে জাদু করে এবং যাকে সে জাদু করে দেয়- তারা আমাদের  (উম্মাতে মুহাম্মাদীর) অন্তর্ভুক্ত নয়।[7]

কোন সময়কে অশুভ বা শুভ মনে করা হিন্দু  সংস্কৃতিধারী মুসলিমের কাজ। বরং বিশেষ যে সময়ের কথা হাদীছে এসেছে তা নিম্নরূপ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ فِى اللَّيْلِ لَسَاعَةً لاَ يُوَافِقُهَا  رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ إِلاَّ  أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ. ‘রাতের  মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি কোন মানুষ সে সময় লাভ করতে পারে, তবে আল্লাহর নিকট  ইহকাল ও পরকালের কোন কল্যাণ চাইলে আল্লাহ তাকে দান করেন। আর এ সময়টি প্রতি রাতেই  রয়েছে।[8]

জুম‘আর দিন সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,

إِنَّ  يَوْمَ الْجُمُعَةِ سَيِّدُ الأَيَّامِ وَأَعْظَمُهَا عِنْدَ اللهِ وَهُوَ أَعْظَمُ  عِنْدَ اللهِ مِنْ يَوْمِ الأَضْحَى وَيَوْمِ الْفِطْرِ فِيْهِ خَمْسُ خِلاَلٍ خَلَقَ  اللهُ فِيهِ آدَمَ وَأَهْبَطَ اللهُ فِيْهِ آدَمَ إِلَى الأَرْضِ وَفِيهِ تَوَفَّى  اللهُ آدَمَ وَفِيهِ سَاعَةٌ لاَ يَسْأَلُ اللهَ فِيْهَا الْعَبْدُ شَيْئًا إِلاَّ  أَعْطَاهُ مَا لَمْ يَسْأَلْ حَرَامًا وَفِيْهِ تَقُوْمُ السَّاعَةُ مَا مِنْ مَلَكٍ  مُقَرَّبٍ وَلاَ سَمَاءٍ وَلاَ أَرْضٍ وَلاَ رِيَاحٍ وَلاَ جِبَالٍ وَلاَ بَحْرٍ إِلاَّ  وَهُنَّ يُشْفِقْنَ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ.

‘জুম‘আর দিন সকল দিনের সরদার এবং আল্লাহর নিকট  বেশী সম্মানিত। এটা কুরবানীর দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন অপেক্ষাও আল্লাহর নিকট অধিক  সম্মানিত দিন। তাতে পাঁচটি গুরুত্ব রয়েছে। এদিনে আল্লাহ আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন,  এদিনেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এদিনেই তার মৃত্যু হয়েছে। এ দিন এমন একটি সময় আছে এ  সময়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তা পাওয়া যাবে, যদি তা হারাম না হয়। এ দিন ক্বিয়ামত  সংগঠিত হবে। এ দিন ফেরেশতা, আকাশ, পৃথিবী, বাতাস, পাহাড়, সমুদ্র সব কিছুই ভীত  থাকে।[9]

মুসলিম জীবনে আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে- ‘যা এক  হাযার মাসের চেয়েও উত্তম’ (ক্বদর  ৩)। এটিকে রামাযান মাসের  শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিতে অনুসন্ধান করতে আদেশ দেয়া হয়েছে।[10] এছাড়া মুসলিম জীবনে আর কোন বিশেষ মুহূর্ত নেই-  যেটাকে মানুষ অনুসন্ধান করতে পারে। বস্ত্ততঃ মানব জীবনের পুরো সময়টাই হীরন্ময়। যা  একবার গত হলে আর কখনো ফিরে আসে না। বরং বিশেষ সময়কে এভাবে উদযাপন করা শিরকী  সংস্কৃতি বৈ কিছুই নয়।

প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আবির্ভূত ইসলামকে  যারা সেকেলে মনে করে, ইসলামের নবায়নের জন্য মরিয়া যারা, তারাই আবার হাযার হাযার  বছরের পুরোনো সূর্য পূজাকে নিজস্ব সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে আধুনিক হওয়ার অপচেষ্টা  চালাচ্ছে। খৃষ্টপূর্ব ১৪ শতকে মিশরীয় ‘অ্যাটোনিসম’ মতবাদে সূর্যের পূজা হ’ত।  ইন্দো-ইউরোপীয় এবং মেসো আমেরিকান সংস্কৃতিতে সূর্য পূজারীর অস্তিত্ব রয়েছে।  খৃষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব ২৫ ডিসেম্বর ‘বড় দিন’ পালিত হয় মূলতঃ রোমক সূর্য পূজারীদের  ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুসরণে- যীশু খৃষ্টের প্রকৃত জন্ম তারিখ থেকে নয়।

অথচ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত সম্পর্কে  আল্লাহ বলেন, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত্রি-দিন, সূর্য-চন্দ্র। তোমরা  সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না। সিজদা কর আল্লাহকে- যিনি এগুলোকে সৃষ্টি  করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর (৪১ঃ৩৭)

সাবার রাণী বিলকিসের এরূপ কর্মকান্ডকে তিরস্কার  করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে  সিজদা করছে। শয়তান তাদের কর্মকান্ডকে তাদের নিকট সুন্দর করেছে এবং তাদেরকে বিরত  রেখেছে ফলে তারা সৎপথ পায়নি’ (নামল  ১৪)

মূলতঃ দুই ঈদ ব্যতীত মুসলিম জীবনে আর কোন ধর্মীয়  উৎসব নেই। এছাড়া সংস্কৃতির নামেই হোক আর ধর্মের নামেই হোক- সব ধরনের উৎসব  পরিত্যাজ্য। বৈশাখ বরণের নামে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত গানে সম্ভাষণ জানানো,  মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন, মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রদর্শন- এগুলো পৌত্তলিক, সূর্যপূজারীদের  ধর্মীয় আচার। এসব অনুষ্ঠান কখনো মুসলিম সংস্কৃতির অংশ নয়; হতে পারে না। কত মায়ের  সন্তান যে মুশরিকত্ব বরণের উৎসবে আটকা পড়েছে- তা ভাবার কেউ নেই। ধর্মহীনতার  চোরাবালিতে তারা তলিয়ে যাচ্ছে। আর তারা সার্বজনীন উৎসবের নামে একতার বাণীতে শান  দিচ্ছে। মেকী ঈমানের পরহেযগার ব্যক্তিরা হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার আগে উপলব্ধি করবে  কি?

বাদ্য-বাজনার ব্যবহার :

বর্ষবরণের এসব অনুষ্ঠানে গান-বাজনা যেন  পূর্বশর্ত। ঢেউ খেলানো আনন্দে বাজনা-সঙ্গীত যেন ফেনিল রাশি হয়ে বয়ে চলে। অথচ  বাদ্য-বাজনার ব্যবহার ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ  عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ  مُهِيْنٌ ‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা   মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞভাবে অনর্থক কথা  (বাদ্য-বাজনা) ক্রয় করে এবং তাকে আনন্দ-ফূর্তি হিসাবে গ্রহণ করে, তাদের জন্য রয়েছে  যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (লুকমান  ৩১/৬)

আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ تعالى حَرَّمَ الْخَمْرَ  وَالْمَيْسِرَ وَالْكُوبَةَ وَقال : كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মদ, জুয়া ও  সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’।[11]

নাফে‘ (রাঃ) বলেন, একদিন ইবনু ওমর (রাঃ)  বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেয়ে দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে যান।  অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে‘ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি  তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে  ছিলাম তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিলেন  এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম।[12]

মূর্তি-রেপলিকা ব্যবহার :

মূর্তি-রেপলিকা ব্যবহার বৈশাখের আরেকটি অপরিহার্য  অংশ। ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম যশোরে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন ঘটে। ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস ইনসটিটিউটের কিছু ছাত্র যশোর ‘চারুপীঠ’ নামের একটি  সংস্কৃতিশালা গড়ে তোলে। চারুপীঠের উদ্যোগে প্রদর্শিত এ শোভাযাত্রায় উদ্যোক্তারা  মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ফুল-পাখি, ভূত-প্রেত-দানব, ও জীব-জন্তুর  রেপলিকা-মুখোশ ব্যবহার করে (পরবর্তীকাল থেকে অবশ্য মূর্তি-মুখোশ মঙ্গল কামনার  প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে)। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে ১৯৮৮  সালে এ শোভাযাত্রা বের হয়। তাতে ব্যবহৃত হয় চারু শিল্পীদের তৈরী দশটি ছোট আকৃতির  ঘোড়া, একটি বিরাটাকার হাতি, (যাকে হিন্দুরা গণেশ বলে পূঁজা করে) এছাড়া ৫০টি মুখোশ।  অনেকেই জানে না এ শোভাযাত্রায় কেন মুখোশ-মূর্তি ব্যবহৃত হয়। তাতে শামিল হওয়ার  ফলইবা কি? অথচ অজান্তে অসম্ভব শাস্তির দিকে যাত্রা করেছে তারা। যাত্রা করেছে  বরকতহীনতার দিকে।

ছবি-মূর্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ صَوَّرَ صُورَةً، عُذِّبِ وَكُلِّفَ أَنْ يَنْفُخَ  فِيْهَا، وَلَيْسَ بِنَافِخ ‘যে ব্যক্তি একটিমাত্র ছবি তৈরী  করবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে এবং তাতে আত্মা দিতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু তার জন্য  এটি কখনোই সম্ভব নয়’।[13] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ঘরে কুকুর ও ছবি  থাকে সে ঘরে রহমত ও বরকতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।[14]

নগ্ন নারীর পুংমিশ্রণ :

বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীদের অবিমিশ্রণ  জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। নারী নগ্নতার এই অপসংস্কৃতি দেশকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে  নিম্ন সংস্কৃতিতে। নতুন প্রজন্মের জন্য চরিত্রবান মায়ের সংকট তৈরী করছে তারা।  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন- দুই শ্রেণীর জাহান্নামী রয়েছে, যাদের আমি এখনও দেখিনি।  এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে। তা দ্বারা তারা মানুষকে  প্রহার করবে। আর নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট  করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের  ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।  অথচ উহার সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়’।[15]

অত্র হাদীছে অাঁটসাঁট, অশালীন, অমার্জিত পোষাক  পরিধানকারী দুর্বলচিত্ত, মাথার চুল উপরে তুলে বাধা নারীদের তীব্র নিন্দা জানিয়ে  তাদেরকে জান্নাতহৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি জান্নাত দেখলাম।  লক্ষ্য করলাম তাতে অধিকাংশ অধিবাসী দরিদ্র। জাহান্নাম দেখলাম। লক্ষ্য করলাম, তাতে  অধিকাংশ অধিবাসী নারী’।[16] এরূপ বহু হাদীছ রয়েছে, যেগুলোতে অশালীন নারীর  নিশ্চিত ক্ষতির হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

এখানে যে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, তা হল- নারী  খেল-তামাসা, উল্লাস-নৃত্য করে তার যৌবন উপভোগ করার কারণে শাস্তি পাবে। তেমনিভাবে  যুবকও শাস্তি পাবে। কিন্তু যে পুরুষ পরিবারের দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনি যদি পাঁচ  ওয়াক্ত ছালাত পড়েন, তাহাজ্জুদ পড়েন, নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত হন, মুখে দাড়ি রেখে ভাব-গাম্ভীর্যের  সাথে চলাফেরা করেন, সমাজেও ভদ্রজন হিসাবে পরিচিতি পান, কিন্তু তিনি পরিবারের  সদস্যদেরকে উত্তমভাবে নজরদারি করেন না, এমনতরো ভদ্রজনকেও হাদীছে ‘দাইয়ূস’ বলা  হয়েছে। দাইয়ূস হলো- যে ব্যক্তি তার পরিবারকে বেহায়াপনার সুযোগ দেয়। রাসূলুল্লাহ  (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثَةٌ  قَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِمْ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ الْخَمْرِ وَالْعَاقُّ وَالدَّيُّوْثُ  الَّذِيْ يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخَبَثَ ‘নিশ্চয়ই  আল্লাহ তিন ব্যক্তির উপরে জান্নাত হারাম করেছেন; মদ্যপায়ী, পিতামাতার অবাধ্য ও  দায়ূছ। যে তার পরিবারে অশ্লীলতাকে স্বীকৃতি দেয়’।[17] দাইয়ূসী এমন একটি পাপ- যাতে নিজে পাপ করার  প্রয়োজন হয় না, অন্যের পাপ দেখে নিরব থাকলেই পাপ অর্জিত হয়। তবে কোন ব্যক্তি যদি  পরিবারকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, তাতে তার কোন পাপ নেই।  আল্লাহ বলেন, لاَ  يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের  অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না’ (বাক্বারাহ  ২/২৮৬)

অন্যান্য কার্যক্রম :

এছাড়াও বৈশাখে আলপনা অংকন, বৈশাখী-পোষাক পরিধান,  পান্তা-ইলিশ ভোজ প্রভৃতিতে বিনোদনের নামে লক্ষ লক্ষ্য টাকা ব্যয় হয়। ‘আলপনায়  বৈশাখ-১৪২১’ শিরোনামে এবার জাতীয় সংসদের বিপরীতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ১৩ এপ্রিল  রাত থেকে ১৪ এপ্রিল ভোর পর্যন্ত অাঁকা হয় দীর্ঘ আলপনা। অথচ অপচয়ের এই টাকা যদি  অন্নহীন বনু আদমের দু’মুঠো ভাতের জন্য ব্যয় করা হ’ত তাহ’লে উভয়ই কত উপকৃত হ’ত!  অথবা অন্য কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয়িত হলে তা পরকালের পাথেয় হ’ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)  বলেন, নিশ্চয়ই দান কবরের শাস্তিকে নিভিয়ে দেয় এবং মুমিন কিয়ামতের দিন তার দানের  ছায়াতলে ছায়া গ্রহণ করবে’।[18] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَا  تَصَدَّقَ أَحَدٌ بِصَدَقَةٍ مِنْ طَيِّبٍ وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ  إِلاَّ أَخَذَهَا الرَّحْمَنُ بِيَمِيْنِهِ وَإِنْ كَانَتْ تَمْرَةً فَتَرْبُو فِى  كَفِّ الرَّحْمَنِ حَتَّى تَكُوْنَ أَعْظَمَ مِنَ الْجَبَلِ وَيُرَبِّيْهَا لَهُ كَمَا  يُرَبِّى أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ أَوْ فَصِيْلَهُ.

‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর  পরিমাণ দান করে, আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত গ্রহণ করেন না। আল্লাহ উহা ডান হাতে গ্রহণ  করেন। অতঃপর দানকারীর জন্য এটা লালন-পালন করতে থাকেন যেমনভাবে তোমাদের কেউ ঘোড়ার  বাচ্চাকে লালন-পালন কর। অবশেষে উহা পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।[19]

আমাদের আহবান :

মুমিন হৃদয়! কল্পনা করুন, নতুন বছরের কি মূল্য  থাকবে যদি প্রাণপক্ষী পিঞ্জর ভেঙ্গে বেরিয়ে যায় পুরাতন বছরে? শুভকামনায় প্রতিটি  নববর্ষ উদযাপন করে পুরাতন বছর থেকে নতুন বছর কিছুটা এগিয়েছে কি? তবে কি স্বার্থকতা  রয়েছে এই উদযাপনে? সুতরাং আমাদের আহবান-

আল্লাহ জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার  জন্য, কে সবচেয়ে বেশী সুন্দর আমল করতে পারে (মুলক ২)। আসুন, আমরা আমলনামা সমৃদ্ধকরণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হই।

যে উৎসব পৌত্তলিক-খৃষ্টান সমাজ গ্রহণ করেছে তাকে  কেন আমরা বর্জন করছি না? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ  مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোন  সম্প্রদায়ের অনুসরণ করল, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হল’।[20]

প্রিয় অভিভাবক! আপনার স্নেহের সন্তানকে যে বয়সে  আপনি রশি ছেড়ে রেখেছেন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করতে, সে বয়সে মুস‘আব বিন উমাইর  (রাঃ) গিয়েছেন ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হতে।

তরুণ-তরুণী ভাইবোন! নিজেকে অবমূল্যায়ন করো না।  তোমার মত যুবকের হাতে ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। তোমার মত তরুণীরা কত পুরুষকে দ্বীনের  পথে অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছে।

আরেকটি আবেদন রাখতে চাই- অভিভাবক মহলে, আপনার  সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয় তবে আপনি ব্যর্থ অভিভাবক। জেনে রাখুন!  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلاَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسئُوْلٌ عَنْ  رَعِيَّتِهِ ‘তোমাদের  প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[21] সুতরাং   আসুন! সেদিন আসার আগেই আমরা সচেতন হই, যেদিন আমার সন্তান আমার জান্নাতের  গতিরোধ করবে।

সমাপনী :

পরিশেষে  বলব, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ইসলামী শরী‘আতের সাথে সাংঘর্ষিক একটি অনুষ্ঠান। অথচ মুমিন  জীবন এলাহী বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে পালনীয় ছিল না,  এমন কিছু এ যুগেও পালনীয় হ’তে পারে না। কাজ করার আগেই জবাবদিহিতার চিন্তা করতে  হবে। যদি ভুল করে ফেলে, তবে সে তওবা করবে। বর্ষবরণের এই অপসংস্কৃতির থাবায় পড়ে কত  তরুণ-তরুণী যে জীবনের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে, তা দেখার কেউ নেই। সচেতন মুমিনদের  উচিত বর্ষবরণের মতো এমন বেলেল্লাপূর্ণ এবং অর্থ ও সময়ের অপচয় সর্বস্ব অনুষ্ঠান হতে  বিরত থাকা এবং সর্বস্তরের মুসলমানদের এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক  প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!!

লেখিকা: শরীফা বিনতে  আব্দুল মতীন



   


   

     

* শিক্ষিকা,  মহিলা সালাফিইয়াহ মাদরাসা, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

     

[1]. বাংলাদেশ  প্রতিদিন, ১৪ এপ্রিল ২০১৪, পৃঃ ৭

   

 

     

[2]. Akber had over five  thousand wives. Vindication of Hurangz. p. 143.

 

 

     

[3]. গোলাম আহমাদ  মোর্তাযা, ইতিহাসের ইতিহাস, পৃঃ ১০৫

 

 

     

[4]. নয়াদিগন্ত,  ১৪ এপ্রিল, পৃঃ ৭

 

 

     

[5]. মুসলিম,  মিশকাত হা/১২২৩

 

 

     

[6]. আবু দাউদ  হা/৩৯১২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৩৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৫৮৪

 

 

     

[7]. সিলসিলা  ছহীহাহ হা/২১৯৫

 

 

     

[8]. মুসলিম,  মিশকাত হা/১২২৪

 

 

     

[9]. ইবনু মাজাহ  হা/১০৮৪; মিশকাত হা/১৩৬৩

 

 

     

[10]. বুখারী,  বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৯৮৩, ৪/২৬৫

 

 

     

[11]. মিশকাত  হা/৪৫০৩

 

 

     

[12]. আবূদাঊদ  হা/৪৯২৪; সনদ ছহীহ

 

 

     

[13]. বুখারী,  মিশকাত হা/৪৪৯৯

 

 

     

[14]. বুখারী,  মিশকাত হা/৪৪৮৯

 

 

     

[15]. মুসলিম,  মিশকাত হা/৩৫২৪

 

 

     

[16]. মুত্তাফাক্ব  আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪

 

 

     

[17]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৫২

 

 

     

[18]. সিলসিলা  ছহীহাহ হা/৩৪৮৪

 

 

     

[19]. মুসলিম হা/১০১৪; তিরমিযী হা/৬৬১; ইবনু মাজাহ  হা/১৮৪২

 

 

     

[20]. আহমাদ, আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৪৩৪৭, সনদ হাসান।

 

 

     

[21]. মুত্তাফাক্ব  আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৮৫।

 

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button