পবিত্রতা

পবিত্রতা অর্জনের শিষ্টাচার

বযলুর রহমান

              ভূমিকা :

              ইসলামী শরী‘আতে ত্বাহারাৎ বা পবিত্রতা অর্জন ও  পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পবিত্রতা অর্জন করা মুসলিম জীবনের  একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, اَلطُّهُوْرُ شَطْرُ الْإِيْمَانِ ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক’।[1] ইসলামের পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির দ্বিতীয় ও অন্যতম  মৌল ভিত্তি হল ছালাত। যা প্রত্যেক মুসলিম  ব্যক্তির উপর আদায় করা ফরয। এই গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত পবিত্রতা অর্জন ছাড়া কবুল  হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ  غُلُولٍ ‘পবিত্রতা  অর্জন ব্যতীত ছালাত কবুল হয় না এবং হারাম মালের যাকাত কবুল হয় না’।[2] মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ ‘নিশ্চয়  আল্লাহ (অন্তর থেকে) তওবাকারী ও বাহ্যিকভাবে পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব এত বেশী যে, আল্লাহ তা‘আলা  পবিত্র কুরআনে মোট ১৮টি সূরায় ২৭ বার এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।[3] ‘কুতুবুস সিত্তাহ’ তথা হাদীছের প্রসিদ্ধতম ছয়টি গ্রন্থ  সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে ত্বাহারাৎ একটি বিরাট অধ্যায় দখল করে আছে। মুহাদ্দিছগণ  এই ত্বাহারাৎ সংক্রান্ত হাদীছ সমূহ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত কঠোর সাধনা ও  অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যার ঋণ মুসলিম জাতির পরিশোধ করার সাধ্য নেই। আর মহানবী  (ছাঃ)-এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আদব বা পবিত্রতা অর্জনের শিষ্টাচার কেমন ছিল তা  উপরোক্ত হাদীছ গ্রন্থ সমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত আলোচনা  পেশ করা হল-

             

ত্বাহারাৎ-এর  প্রকারভেদ :

              প্রত্যেক  মুসলমানের জন্য পবিত্রতা অর্জন করা যরূরী। কারণ সকল ইবাদতের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল  পবিত্রতা অর্জন করা। আর এটা দু’প্রকার। যথা : আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বা দৈহিক।[4] আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা বলতে যাবতীয় শিরকী আক্বীদা, রিয়া,  নিফাক্ব, হিংসা, অহংকার, কৃপণতা, শত্রুতা/ঘৃণা, আত্ম-বিদ্বেষ, আত্ম-অহংকার প্রভৃতি  থেকে হৃদয়কে পবিত্র রাখা এবং আল্লাহর ভালবাসার ঊর্ধ্বে অন্যের ভালবাসাকে হৃদয়ে  স্থান না দেওয়া।[5] আর দৈহিক পবিত্রতা বলতে শারঈ পদ্ধতি অনুযায়ী ওযূ, গোসল  ও তায়াম্মুমের মাধ্যমে শরীর, পোশাক ও স্থানের পবিত্রতাকে বুঝায়। দৈহিক পবিত্রতা  অর্জনের মাধ্যমে যেমন মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়, তেমনি অভিশপ্ত শয়তানের খারাপ  প্ররোচনা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা যায়।

             

মিসওয়াকের শিষ্টাচার

              মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার একটি  গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম মিসওয়াক। মিসওয়াক বলা হয়, যে কাঠের মাধ্যমে মুখের দাঁত সমূহ  ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়।[6] মিসওয়াকের মাধ্যমে মুখের দুর্গন্ধ দূরীভূত হয় এবং দন্ত  রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। মিসওয়াক করা সুন্নাত, যা প্রত্যেক ওযূর পূর্বে করতে হয়।

             

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ  صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى  أُمَّتِى لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ وُضُوءٍ.

              আবু  হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যদি আমি আমার উম্মতের উপর  কষ্টকর মনে না করতাম, তাহলে প্রত্যেক ওযূর পূর্বে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম’।[7] তবে অন্য বর্ণনায় على أمتى এর পরিবর্তে علي المومنين শব্দ এসেছে।[8] সুতরাং এটা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এটা শুধু মুসলিম  উম্মাহর উপর নির্দিষ্ট নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব মানবতার উপর পালনীয় এক অভ্যাসগত বিষয়।

              মিসওয়াক  করার গুরুত্ব ও ফযীলত :

             

 (1) عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صلى  الله عليه وسلم إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ يَشُوصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ.

              (১) হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন ঘুম থেকে  উঠতেন তখনই মিসওয়াক করতেন।[9]

             

(2)  عَنْ عَائِشَةَ عَنِ  النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ.

              (২) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, মিসওয়াক  হল মুখ পরিষ্কারকারী ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ।[10]

             

(3)  عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ أَكْثَرْتُ  عَلَيْكُمْ فِى السِّوَاكِ.

              (৩) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি  তোমাদেরকে অধিকহারে মিওসয়াক করার তাগিদ প্রদান করছি।[11]

             

(4) عَنْ عَلِيٍّ  رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ُأَنَّهُ أَمَرَ بِالسِّوَاك  وَقَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِنَّ  الْعَبْدَ إِذَا تَسَوَّكَ ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي قَامَ الْمَلَكُ خَلْفَهُ فَتَسَمَّعَ  لِقِرَاءَتِهِ فَيَدْنُو مِنْهُ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى  فِيهِ فَمَا يَخْرُجُ مِنْ فِيهِ شَيْءٌ مِنَ الْقُرْآنِ ، إِلاَّ صَارَ فِي جَوْفِ  الْمَلَكِ فَطَهِّرُوا أَفْوَاهَكُمْ لِلْقُرْآنِ.

              (৪) আলী (রাঃ) মিসওয়াক করার  নির্দেশ দান করতেন এবং বলতেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় বান্দা যখন মিসওয়াক করে  ছালাত আদায়ের জন্য দাঁড়ায়, তখন ফেরেশতা তার পিছনে দাঁড়ায়। অতঃপর তার ক্বিরাআত  শুনতে থাকে এবং তার কিংবা তার কথার নিকটবর্তী হয়। এমনকি ফেরেশতার মুখ তার মুখের  উপর রাখে। তার মুখ থেকে কুরআনের যা বের হয়, তা ফেরেশতার পেটে ভিতর প্রবেশ করে।  অতএব তোমরা কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মুখ পরিষ্কার কর।* ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,  بِتُّ عِنْدَ  النَّبِيِّ صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ  وَسَلّامَ فَاسْتَنَّ ‘আমি একদা নবী  (ছাঃ) এর নিকট রাত্রী যাপন করেছিলাম, তখন তিনি মিসওয়াক করেন’।[12] মিসওয়াক মানুষের স্বভাবজাত আচরণেরও একটি অংশ।[13] উল্লেখ্য যে, এটি শুধু মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সুন্নাত নয়।  বরং পূর্ববর্তী সকল আম্বিয়ায়ে কেরামেরও সুন্নাত ছিল।[14] আবু সালামাহ (রাঃ) বলেন, আমি যায়েদ ইবনু খালেদকে দেখেছি  যে, মিসওয়াক তাঁর কানে থাকত যেরূপ লেখক তার কলম কানে রেখে থাকে। অতঃপর যখনই তিনি  ছালাতের জন্য দাঁড়াতেন তখনই মিসওয়াক করতেন।[15]
              মিসওয়াক করার পদ্ধতি ও উপকরণঃ

              ইমাম নববী (রহঃ) (৬৩১-৬৭৬ হিঃ) বলেন,

             

يُسْتَحَبُّ أَنْ يُّسْتَاكَ يَعُوْدُ  مِنَ أَرَاكٍ وَ يُسْتَحَبُّ أَْنْ يُّبْدَأَ  بِالجََْانِبِ الْاَيْمَنِ مِنْ  فَمِهِ  عَرَضًا لَا طَوْلًا لَئَلَّ يَدَمِيُ  لَّحْمَ إِسْنَانِهِ.

              ‘আরাক[16] গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা মুস্তাহাব। অতঃপর  স্বাভাবিকভাবে মুখের ডান দিক থেকে মিসওয়াক আরম্ভ করা, যাতে দাঁতের গোড়ার মাংসপেশী  থেকে রক্ত বের না হয়’।[17]

              ১. মিসওয়াক করার পূর্বে বিসমিল্লাহ  বলা :

              মিসওয়াক করলে দাঁতের ময়লা, রোগ-জীবাণু ও দুর্গন্ধ  দূরীভূত হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে সজীবতা ফিরে আসে। দাঁত মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।  সুতরাং নিঃসন্দেহে তা শুভ কাজের অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। আর  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রত্যেক শুভ কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতেন ও বলার জন্য  উৎসাহিত করতেন।

             

(1) عَنْ أَبِيْ الْمَلِيْحِ عَنْ رَجُلٍ قَالَ كُنْتُ رَدِيْفَ النَّبِيِّ  صَلَّى الله ُعَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَثَرَتْ دَابَّتٌ فَقُلْتُ تَعِسَ الشَّيْطَانُ فَقَالَ لَاْ تَقُلْ تَعِسَ الشَّيْطَانُ فَإِنَّكَ إِذَا  قُلْتَ ذَلِكَ تَعَاظَمَ حَتَّى يَكُوْنَ مِثْلَ الْبَيْتِ وَيَقُوْلُ بِقُوَّتِيْ وَلَكِنْ قُلْ بِسْمِ اللهِ فَإِنَّكَ  إِذَا قُلْتَ ذَلِكَ تَصَاغَرَ حَتىَّ يَكُوْنَ مِثْلَ الذُّبَابِ.

              (১) আবুল  মালীহ একজন ছাহাবী হ’তে বর্ণনা করেন, ছাহাবী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর  বাহনের পিছনে ছিলাম। তাঁর বাহনটি হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ল। আমি বললাম, শয়তান অসুস্থ  হয়ে পড়েছে অথবা শয়তান ধ্বংস হয়েছে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, শয়তান অসুস্থ হয়ে পড়েছে  বলবে না। কারণ তুমি যদি এরূপ বল, তবে সে নিজেকে বড় ভাববে; এমনকি বাড়ির আকৃতির  ন্যায় (বড়) হয়ে যাবে এবং বলবে যে, আমার শক্তির দ্বারাই এরূপ ঘটেছে। তবে  ‘বিসমিল্লাহ’ বল। কারণ এর ফলে সে নিজেকে ছোট ভাববে; এমনকি সে মাছির ন্যায় (ছোট)  হয়ে যাবে’।[18]

             

(2) عَنَ جَابِرٍ عَنِ  النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَغْلِقْ بَابَكَ وَاذْكُرِ اسْمَ اللهِ فإِنَّ الشَّيْطَانَ لَاْ يَفْتَحُ  بَابًا مُغْلِقًا وَأَطْفِ مِصْباَحَكَ وَاذْكُرْ اسْمَ اللهِ وَخَمِّرْ ِإنَاءَكَ  وَلَوْ بِعُوْدٍ تَعْرِضْهُ عَلَيْهِ وَاذْكُرِ اسْمَ اللهِ وَأَوْكِ سِقَاءَكَ وَاذكُرْ  اسْمَ اللهِ.

              (২) জাবির  ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে  তোমার দরজা বন্ধ কর। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বাতি  নিভিয়ে দাও। একটু কাঠখড়ি হলেও আড়াআড়িভাবে রেখে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পাত্রের মুখ ঢেকে  রাখ এবং পানির পাত্র ঢেকে রাখ’।[19] উপরোক্ত হাদীছ দু’টি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে,  ‘বিসমিল্লাহ’ বললে শয়তান অপমানিত হয় এবং মাছির ন্যায় ছোট হয়ে যায়। ফলে সে আর ক্ষতি  করতে পারে না। এছাড়া প্রত্যেক কাজের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উম্মতের উপর  বিসমিল্লাহ বলার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং বিসমিল্লাহ বলে মিসওয়াক শুরু করা উচিৎ ।

              ২. ডান দিক দিয়ে শুরু করা :

              ডান দিক ইতিবাচক ইঙ্গিতের পরিচয়।  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিসওয়াকসহ প্রত্যেক ভাল কাজ ডান দিক দিয়ে আরম্ভ করতে ভালবাসতেন।[20] অন্য  বর্ণনায় রয়েছে যে,

             

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ  رَضِيَ الله ُعَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله ُعَلَيْهِ وَسَلَّمَ ِإذَا  لَبِسْتُمْ وَإِذَا تَوَضَّأتُمْ فَابْدُؤوَابِأَيْمانِكُمْ.

              আবু  হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যখন তোমরা পোশাক পরিধান করবে অথবা  ওযূ করবে তখন ডান দিক থেকে আরম্ভ করবে।[21] সুতরাং ডান দিক থেকে মিসওয়াক শুরু করা সুন্নাত।

              . মাড়ির দাঁতের উপর এবং দুই ঠোঁট উঁচু করে সম্মুখের  দাঁতগুলো ভালভাবে পরিষ্কার করা :

              শক্তিশালী  মাড়ি ও সুস্থ দাঁতের জন্য মাড়ির দাঁতগুলো সুন্দর করে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে। আবু  মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাঁর জিহবার উপর মিসওয়াক  করতে দেখেছি।[22] এ মর্মে অন্য বর্ণনায় এসেছে,

             

عَنْ أَبِى مُوسَى قَالَ أَقْبَلْتُ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ  عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعِى رَجُلاَنِ مِنَ الأَشْعَرِيِّينَ أَحَدُهُمَا عَنْ يَمِينِى وَالآخَرُ عَنْ يَسَارِى وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ  عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْتَاكُ فَكِلاَهُمَا سَأَلَ الْعَمَلَ قُلْتُ  وَالَّذِى بَعَثَكَ بِالْحَقِّ نَبِيًّا مَا أَطْلَعَانِى عَلَى مَا فِى أَنْفُسِهِمَا وَمَا شَعَرْتُ أَنَّهُمَا  يَطْلُبَانِ الْعَمَلَ فَكَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَى سِوَاكِهِ تَحْتَ شَفَتِهِ قَلَصَتْ.

              ‘আবু মূসা আশ‘আরী  (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এলাম। আমার সাথে আশ‘আর গোত্রের  দু’জন লোক ছিল। তারা একজন আমার ডান পাশে আর অন্যজন আমার বাম পাশে ছিল। তখন  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিসওয়াক করছিলেন। তারা উভয়ই কোন কাজের জন্য প্রার্থনা করল। আমি  তখন বললাম, সেই সত্তার ক্বসম! যিনি আপনাকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, তাদের অন্তরে কী  ছিল তা আমাকে অবগত করেনি আর আমি বুঝতেও পারিনি যে, তারা কাজ চাইবে। একপর্যায়ে আমি  লক্ষ্য করে দেখলাম, মিসওয়াক তাঁর ঠোঁটকে উঁচু করে রেখেছে’।[23]

              ৪. হাত  দিয়ে জিহবা ভালভাবে রগড়ানো :

              দাঁত ও  মুখ পরিষ্কার করার জন্য হাত দিয়ে দাঁতের চারপাশে ও জিহবার উপর ভালভাবে রগড়াতে হবে।  যাতে কোন জীবাণু ও ময়লা থাকতে না পারে।

             

عَنْ أَبِى بُرْدَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ أَتَيْتُ النَّبِىَّ  صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَجَدْتُهُ يَسْتَنُّ بِسِوَاكٍ بِيَدِهِ يَقُولُ  أُعْ أُعْ  وَالسِّوَاكُ فِى فِيهِ كَأَنَّهُ  يَتَهَوَّعُ.

              ‘আবু বুরদাহ (রাঃ) তাঁর পিতা আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন,  একবার আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে তাঁকে হাত দিয়ে মিসওয়াক করা অবস্থায় পেলাম।  তিনি এমন করে আ‘ আ‘ শব্দ করছিলেন মনে হচ্ছিল যেন তিনি বমি করছেন।[24] আবু মূসা  (রাঃ) বলেন, আমি তাকে জিহবার উপর মিসওয়াক করতে দেখেছি।[25]

              ৫. ঘুম  থেকে উঠে প্রত্যেক ওযূর পূর্বে মিসওয়াক করা :

              ঘুমন্তাবস্থায় মুখে জমে থাকা জীবাণুগুলো বেশী আক্রমণ করে  থাকে। ফলে দন্তক্ষয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই দন্তক্ষয়রোধ করার জন্য  প্রত্যহ ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মিসওয়াক বা ব্রাশ করা যরূরী। সাথে সাথে মুখের  পবিত্রতা রক্ষার জন্য ওযূর পূর্বে মিসওয়াক করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

             

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ  وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى  أُمَّتِى لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ وُضُوءٍ.

              আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)  বলেন, যদি আমি আমার উম্মতের উপর কষ্টদায়ক মনে না করতাম তাহ’লে প্রত্যেক ওযূর  পূর্বে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।[26]

              . কমপক্ষে  দুই/তিন মিনিট ধরে মিসওয়াক করা :

              আধুনিক  চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী সুস্থ দাঁত ও শক্তিশালী মাড়ির জন্য  প্রয়োজন কমপক্ষে দুই/তিন মিনিট ধরে সুন্দর করে মিসওয়াক করা। কারণ স্বল্প সময়ের  জন্য মিসওয়াক করলে দাঁতের জীবাণু দূরীভূত হয় না। ফলশ্রুতিতে দাঁতের উপর জীবাণু  বাসা বাঁধে, দাঁতের ক্ষয়রোগ বৃদ্ধি পায় ও মাড়ির পাশে পাথর জমে মুখের দুর্গন্ধ  বৃদ্ধি করে। যা মানুষকে কষ্ট দেয় এবং দাঁতও অবিলম্বে নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং মিসওয়াক  বা ব্রাশ করার সময় কমপক্ষে দুই/তিন মিনিট সময় ক্ষেপন করতে হবে, যা স্বাস্থের জন্য  উপকারী।[27]

              ৭. শেষে  মিসওয়াক ধুয়ে ফেলা এবং আল-হামদুলিল্লাহ বলে শেষ করা :

              দাঁত পরিষ্কার করার পর ব্যবহৃত মিসওয়াকটি সুন্দর করে  ধুয়ে ফেলতে হবে যেন ময়লা-আবর্জনা না থাকে।

             

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ كَانَ نَّبِيُّ  صَلَّى الله ُعَلَيِهِ وَسَلَّمَ يُسْتَاكُ فَيُعْطِيْنِيِ الْسِّوَاكَ لَأَغْسِلُهُ  فَأَبْدَأ ُبِهِ فَأَسْتَاكَ ثُمَّ أَغْسِلْهُ وَأَدْفَعَهُ إِلَيْهِ.

              ‘আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) মিসওয়াক করার পর তা  পরিষ্কার করার জন্য আমাকে দিতেন। অতঃপর আমি প্রথমে তা দিয়ে মিসওয়াক করতাম তারপর  পরিষ্কার করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ফিরিয়ে দিতাম।[28] পরিশেষে আল-হামদুলিল্লাহ বলে মিসওয়াক করার পর্ব সমাপ্তি  করতে হবে। হাদীছে এসেছে,

             

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ  عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ  أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا.

              ‘আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)  বলেছেন, বান্দা খাদ্য খেয়ে অথবা পানি পান করে আল-হামদুলিল্লাহ বললে আল্লাহ খুশি হন।[29] সুতরাং প্রত্যেকের উচিৎ মিসওয়াকের পরে আল-হামদুলিল্লাহ  বলা।

              ৮. ছিয়াম অবস্থায় মিসওয়াক করা :

              মুসলিম  সমাজে একটা ভুল প্রথা চালু আছে যে, ছিয়াম অবস্থায় মিসওয়াক করলে ছিয়াম নষ্ট হয়ে  যায়। অথচ উক্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বরং কাঁচা হোক শুকনা হোক যেকোন ডাল বা  পেস্টযুক্ত ব্রাশ দ্বারা মিসওয়াক করা যাবে। ‘আমের ইবন রাবী‘আ (রাঃ) বলেন, رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله  عليه وسلم يَسْتَاكُ وَهُوَ صَائِمٌ مَا لاَ أُحْصِى أَوْ أَعُدُّ ‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে ছিয়াম অবস্থায় অসংখ্যবার  মিসওয়াক করতে দেখেছি’।[30] জাবের ও যায়েদ ইবনু খালেদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ছিয়াম অবস্থায় বা  ছিয়াম অবস্থায় নয় এরূপ অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।[31] ওছমান (রাঃ)ও এদু’টির মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।[32] (চলবে)
             



                 


                 

                    ১. মুসলিম হা/৫৫৬; মিশকাত হা/২৮১, সনদ ছহীহ।

                 

               

                    ২. বুখারী হা/১৩৫; ছহীহ মুসলিম ১ম  খন্ড ১১৯ পৃঃ, হা/৫৫৭।

               

               

                    ৩. মুহাম্মাদ ফুয়াদ ‘আব্দুল বাক্বী, আল মু‘জামুল  মুফাহ্হারাস লি আলফা-যিল কুরআনিল কারীম, (তেহরান, তাবি), পৃঃ  ৫৮১ ।

               

               

                    ৪. ইবরাহীম মুসত্বফা, আল মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (দারুদ দা‘ওয়াহ  ১৯৮৯ খৃঃ/১৪১০ হিঃ) ২/৫৬৮ পৃঃ; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছালাতুর রাসূল  (ছাঃ), ৪র্থ সংস্করণ ৫৬ পৃঃ।

               

               

                    ৫.  ছালাতুর  রাসূল (ছাঃ) ৫৬ পৃঃ।

               

               

                    ৬. ‘আওনুল মা‘বুদ ১/৪৬ পৃ:।

               

               

                    ৭. মুসনাদে আহমাদ হা/১০১৮৬; বুলূগুল মারাম হা/২৯, ছহীহুল  জামে‘ হা/৫৩১৭, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ৮. ‘আওনুল মা‘বুদ ১/৪৬ পৃঃ, হা/৪৬; মুসলিম ১/১২৮ পৃ:,  হা/৬১২।

               

               

                    ৯. ছহীহ বুখারী ১/৩৮ পৃঃ, হা/২৪৫; মুসলিম ১/১২৮ পৃ:,  হা/৬১৬-৬১৯; রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন বাড়ীতে প্রবেশ করতেন তখনই মিসওয়াক করতেন,  মুসলিম হা/৬১৩,৬১৪।

               

               

                    ১০. আহমাদ ইবনু শো‘আইব নাসাঈ  (২১৫-৩০৩হি:), সুনানু নাসাঈ (দেউবন্দ : মাকতাবাতুল আশরাফিইয়াহ, তাবি) ১/৩ পৃঃ,  হা/৫, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ১১.  নাসাঈ ১/৩  পৃঃ, হা/৬, সনদ ছহীহ।

                  *    মুসনাদে বাযযার হা/৬০৩, ১/১২১ পৃঃ; সিলসিলা  ছহীহাহ হা/১২১৩, ৩/২৮৭ পৃঃ; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২১৫, ১/৫১ পৃঃ, সনদ  জাইয়িদ।

               

               

                    ১২.  বুখারী ১/৩৮  পৃঃ।

               

               

                    ১৩.  عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ قَصُّ الشَّارِبِ  وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ وَالسِّوَاكُ -মুসলিম  হা/৬২৭; আবুদাঊদ হা/৫৩; ইবনু মাজাহ হা/২৯৩; তিরমিযী হা/২৭৫৭; মিশকাত হা/৩৭৯, সনদ  ছহীহ।

               

               

                    ১৪.  السنة القديمة للأنبياء السابقين -আওনুল মা‘বুদ ১/৫৩ পৃঃ।

               

               

                    ১৫. قَالَ أَبُو سَلَمَةَ فَرَأَيْتُ زَيْدًا  يَجْلِسُ فِى الْمَسْجِدِ وَإِنَّ السِّوَاكَ مِنْ أُذُنِهِ مَوْضِعُ الْقَلَمِ مِنْ  أُذُنِ الْكَاتِبِ فَكُلَّمَا قَامَ إِلَى الصَّلاَةِ اسْتَاكَ -আবুদাঊদ হা/৪৭, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ১৬. দীর্ঘ কান্ড বিশিষ্ট কাঁটাদার  বৃক্ষ, আবুল ফযল মাওলানা আব্দুল হাফিয বালয়াভী, অনুবাদ : হাবীবুর রহমান নদভী,  মিসবাহুল লুগাত (আরবী বাংলা), (থানবী লাইব্রেরী, ৫৯ চকবাজার, ঢাকা ১৪২৪ হিঃ/২০০৩  খৃঃ) ৯ পৃঃ।

               

               

                    ১৭. ‘আওনুল  মা‘বুদ ১/৪৬ পৃঃ, ‘মিসওয়াক করা’ অনুচ্ছেদ-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

               

               

                    ১৮. আবুদাঊদ সুলায়মান ইবনুল আশ‘আছ আস-সাজাস্তা-নী (২০২-২৭৫হি:),  সুনানু আবীদাঊদ (দেউবন্দ : মাকতাবাতুল আশরাফিইয়াহ তাবি) ২/৬৮০ পৃ:, হা/৪৯৮২, সনদ  ছহীহ।

               

               

                    ১৯. আবুদাঊদ ২/৫২৪ পৃ:, হা/৩৭৩১; বুখারী ১/৪৬৩-৪৬৪ পৃ:,  হা/৩২৮০, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ২০. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত  হা/৪০০।

               

               

                    ২১. মুসনাদে আহমাদ, আবুদাঊদ,  মিশকাত হা/৪০১, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ২২. মুসলিম হা/৬১৫; নাসাঈ ১/২ পৃঃ,  হা/৩।

               

               

                    ২৩.  নাসাঈ ১/২-৩ পৃঃ, হা/৪; মুসলিম হা/৪৮২২, সনদ  ছহীহ।

               

               

                    ২৪. বুখারী ১/৩৮ পৃঃ, হা/২৪৪;  নাসাঈ ১/২ পৃঃ, হা/৩; ‘আওনুল মা‘বুদ ১/৫০-৫১ পৃঃ, হা/৪৯।

                  ২৫. মুসলিম হা/৬১৫; ‘আওনুল মা‘বুদ  ১/৫০-৫১ পৃঃ, হা/৪৯; নাসাঈ ১/২ পৃঃ, হা/৩।

               

               

                    ২৬.  মুসনাদে  আহমাদ হা/১০১৮৬; বুলূগুল মারাম হা/২৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩১৭, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ২৭. চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা ও  মুখগহবরের যন্ত্রসমূহের পিড়া ও তাহার চিকিৎসা, ড: অভয়পদ চট্টোপাধ্যায় (১৬৫  বিপিনাহিয়ী গাঙ্গুলী স্ট্রীট, কলিকাতা ৭০০০১২, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৫  বৈশাখ) ২৮৭ পৃঃ।

               

               

                    ২৮. ‘আওনুল মা‘বুদ ১/৫২ পৃঃ, হা/  ৫১; মিশকাত হা/৩৮৪, সনদ হাসান।

               

               

                    ২৯. তিরমিযী হা/১৮১৬; মুসনাদে আহমাদ হা/১২১৮৯; ছহীহুল  জামে‘ হা/১৮১৬, সনদ ছহীহ।

               

               

                    ৩০. ছহীহ বুখারী ১/২৫৯ পৃঃ, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়-৩০,  ‘ছিয়াম অবস্থায় কাঁচা বা শুকনো মিসওয়াক ব্যবহার করা’ অনুচ্ছেদ-২৭।

               

               

                    ৩১. প্রাগুপ্ত।

               

               

                    ৩২. قَالَ فِيهِ مَنْ تَوَضَّأَ  وُضُوئِي هَذَا وَلَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ صَائِمٍ وَمُفْطِرٍ -ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী  (রহঃ), ফাৎহুল বারী শারহ ছহীহ বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফ, ১৩৭৯ হিঃ), ৪/১৫৮  পৃঃ।

               

             

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button