রামাযান ও ছিয়াম

ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল

ফাযায়েল :

(ক) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[1]

(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের দশগুণ হ’তে সাতশত গুণ ছওয়াব প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, কিন্তু ছওম ব্যতীত, কেননা ছওম কেবল আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার পুরস্কার প্রদান করব। সে তার যৌনাকাঙ্খা ও পানাহার কেবল আমার জন্যই পরিত্যাগ করে। ছিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারকালে, অন্যটি তার প্রভুর সাথে দীদারকালে। তার মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকটে মিশকে আম্বরের খোশবুর চেয়েও সুগন্ধিময়। ছিয়াম (অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে) ঢাল স্বরূপ। অতএব যখন তোমরা ছিয়াম পালন করবে, তখন মন্দ কথা বলবে না ও বাজে বকবে না। যদি কেউ গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন বলবে, আমি ছায়েম’।[2]

মাসায়েল :

১. ছিয়ামের নিয়ত : নিয়ত অর্থ- মনন করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়ামের সংকল্প করাই যথেষ্ট। হজ্জের তালবিয়া ব্যতীত ছালাত, ছিয়াম বা অন্য কোন ইবাদতের শুরুতে আরবীতে বা বাংলায় নিয়ত পড়ার কোন দলীল কুরআন ও হাদীছে নেই।

২. ইফতারকালে দো‘আ : ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু ও ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শেষ করবে।[3] তবে ইফতারের দো‘আ হিসাবে প্রসিদ্ধ দু’টি দো‘আর প্রথমটি ‘যঈফ’ ও দ্বিতীয়টি ‘হাসান’। তাই ইফতার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়া যাবে- ‘যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল্লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ’। অর্থঃ ‘পিপাসা দূরীভূত হ’ল ও শিরাগুলি সঞ্জীবিত হ’ল এবং আল্লাহ চাহে তো পুরস্কার ওয়াজিব হ’ল’।[4]

৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘খাদ্য বা পানির পাত্র হাতে থাকাবস্থায় তোমাদের কেউ ফজরের আযান শুনলে সে যেন প্রয়োজন পূর্ণ করা ব্যতীত পাত্র রেখে না দেয়’।[5]

৪. তিনি আরো বলেন, ‘দ্বীন চিরদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন লোকেরা ইফতার তাড়াতাড়ি করবে। কেননা ইহুদী-নাছারারা ইফতার দেরীতে করে’।[6] ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ লোকদের মধ্যে ইফতার সর্বাধিক জলদী ও সাহারী সর্বাধিক দেরীতে করতেন’।[7]

৫. সাহারীর আযান : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান বেলাল (রাঃ) দিতেন এবং ফজরের আযান অন্ধ ছাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) দিতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বেলাল রাত্রে আযান দিলে তোমরা খানাপিনা কর, যতক্ষণ না ইবনু উম্মে মাকতূম ফজরের আযান দেয়’।[8] বুখারীর ভাষ্যকার হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বর্তমান কালে সাহারীর সময় লোক জাগানোর নামে আযান ব্যতীত (সাইরেন বাজানো, ঢাক-ঢোল পিটানো ইত্যাদি) যা কিছু করা হয় সবই বিদ‘আত’।[9]

৬. ছালাতুত তারাবীহ : ছালাতুত তারাবীহ বা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রাতের ছালাত বিতর সহ ১১ রাক‘আত ছিল। রাতের ছালাত বলতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টোকেই বুঝানো হয়। উলে­খ্য যে, রামাযান মাসে তারাবীহ পড়লে আর তাহাজ্জুদ পড়তে হয় না।

(১) একদা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, রামাযান ও রামাযান ছাড়া অন্য মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রাতের ছালাত ১১ রাক‘আতের বেশী ছিল না।[10]

(২) সায়েব ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) ওবাই বিন কা‘ব ও তামীম দারী নামক দু’জন ছাহাবীকে রামাযান মাসে ১১ রাক‘আত তারাবীহর ছালাত জামা‘আতের সাথে পড়াবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।[11] তবে উক্ত বর্ণনার শেষদিকে ইয়াযীদ বিন রূমান প্রমুখাৎ ওমর ফারূক  (রাঃ)-এর যামানায় লোকেরা ২০ রাক‘আত তারাবীহ পড়তেন’ বলে যে বাড়তি অংশ বলা হয়ে থাকে, তার সূত্র ছহীহ নয়।[12]

(৩) জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাসে আমাদেরকে ৮ রাক‘আত তারাবীহ ও বিতর ছালাত পড়ান।[13] তিনি প্রতি দু’রাক‘আত অন্তর সালাম ফিরিয়ে আট রাক‘আত তারাবীহ শেষে কখনও এক, কখনও তিন, কখনও পাঁচ রাক‘আত বিতর এক সালামে পড়তেন। কিন্তু মাঝে বসতেন না।[14]

(৪) জামা‘আতের সাথে রাতের ছালাত (তারাবীহ) আদায় করা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং দৈনিক নিয়মিত জামা‘আতে আদায় করা ‘ইজমায়ে ছাহাবা’ হিসাবে প্রমাণিত।[15] অতএব তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

৭. লায়লাতুল ক্বদরের দো‘আ : ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুব্বুন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পসন্দ কর। অতএব আমাকে তুমি ক্ষমা কর’।[16]

৮. ফিৎরা : (ক) ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায়ের নির্দেশ দান করেছেন’।[17] এক ছা‘ বর্তমানের হিসাবে আড়াই কেজি চাউলের সমান অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল।

৯. ঈদের তাকবীর : ছালাতুল ঈদায়নে প্রথম রাক‘আতে সাত, দ্বিতীয় রাক‘আতে পাঁচ মোট অতিরিক্ত ১২ তাকবীর দেওয়া সুন্নাত।[18] ছহীহ বা যঈফ সনদে ৬ (ছয়) তাকবীরের পক্ষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে কোন হাদীছ নেই।[19]

১০. ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ : (ক) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাযা আদায় করতে হয়। (খ) যৌনসম্ভোগ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাফফারা স্বরূপ একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন অথবা ৬০ (ষাট) জন মিসকীন খাওয়াতে হয়।[20] (গ) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ক্বাযা আদায় করতে হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হ’লে, ভুলক্রমে কিছু খেলে বা পান করলে, স্বপ্নদোষ বা সহবাসজনিত নাপাকী অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে, চোখে সুর্মা লাগালে বা মিসওয়াক করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।[21] (ঘ) অতি বৃদ্ধ যারা ছিয়াম পালনে অক্ষম, তারা ছিয়ামের ফিদইয়া হিসাবে দৈনিক একজন করে মিসকীন খাওয়াবেন। ছাহাবী আনাস (রাঃ) গোস্ত-রুটি বানিয়ে একদিনে ৩০ (ত্রিশ) জন মিসকীন খাইয়েছিলেন।[22] ইবনু আববাস (রাঃ) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদেরকে ছিয়ামের ফিদইয়া আদায় করতে বলতেন।[23] (ঙ) মৃত ব্যক্তির ছিয়ামের ক্বাযা তার উত্তরাধিকারীগণ আদায় করবেন অথবা তার বিনিময়ে ফিদইয়া দিবেন।[24]


[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত (আলবানী) হা/১৯৮৫।

[2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৫৯।

[3]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৯৯; মুসলিম, ঐ, হা/৪২০০।

[4]. আবূদাঊদ, মিশকাত হা/১৯৯৩-৯৪

[5]. আবূদাঊদ, মিশকাত হা/১৯৮৮।

[6]. আবূদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৯৯৫।

[7]. নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৯৭৮) ৫/২৯৩ পৃঃ।

[8]. বুখারী হা/১৯১৯, মুসলিম হা/১০৯২, নায়ল ২/১২০ পৃঃ।

[9]. নায়ল ২/১১৯ পৃঃ।

[10]. বুখারী হা/২০১৩; মুসলিম হা/৭৩৮; আবূদাঊদ হা/১৩৪১; নাসাঈ হা/১৬৯৭; তিরমিযী হা/৪৩৯; আহমাদ হা/২৪১১৯; মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৯৪।

[11]. মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৩০২।

[12]. দ্রঃ ঐ, হাশিয়া, তাহ্ক্বীক্ব-আলবানী।

[13]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১০৭০ ‘সনদ হাসান’ ২/১৩৮ পৃঃ; মির‘আত ৪/৩২০।

[14]. মুসলিম ১/২৫৪ পৃঃ, ঐ (বৈরূত ছাপা) হা/৭৩৬-৩৭-৩৮।

[15]. মিশকাত হা/১৩০২।

[16]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৯১।

[17]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৫, ১৮১৬।

[18]. আহমাদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৪৪১।

[19]. আলোচনা দ্রষ্টব্যঃ নায়লুল আওত্বার ৪/২৫৩-৫৬ পৃঃ।

[20]. নিসা ৯২, মুজাদালাহ ৪।

[21]. নায়ল ৫/২৭১-৭৫, ২৮৩, ১/১৬২ পৃঃ।

[22]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২২১।

[23]. নায়ল ৫/৩০৮-১১ পৃঃ।

[24]. নায়ল ৫/৩১৫-১৭ পৃঃ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button