ছোটগল্প/উপন্যাস

ফিরতি

দলিল উদ্দীন মন্ডল। বিরাট ব্যাবসায়ী। নিজের বাড়ী, একাধিক গাড়ী, চার ছেলেমেয়ে।

দলিল মন্ডলের জীবনে একমাত্র অর্থবহ বস্তু টাকা। সে পাকা ব্যাবসায়ী, সে জানে টাকায় টাকা আনে। নিজে বি এ পাশ হলেও বড় ছেলেকে ডাক্তারী পড়িয়েছে, ছোট ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং। ছেলেদের মেধা নেই তো কি হয়েছে, মেধায় যা অর্জন করা যায়না টাকায় তা ছিনিয়ে আনা যায়। ছেলেদের ডিগ্রী তার জন্য বিনিয়োগ। এবার সে দুই ছেলেকে চড়া মূল্যে বিক্রি করবে। তারপর ওরা মানুষ মারে তো মারুক, ওদের তৈরী বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে তো পড়ুক, তাতে দলিল মন্ডলের কিছু এসে যায়না।

বড় ছেলেকে অলরেডি নিলামে তোলা হয়েছে। দরদাম ভালোই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কয়েক জায়গায় পাকা দেখে এসেও বেচারা ছেলের বিয়ে দিতে পারেনি। দলিল মন্ডলের কি দোষ? আংটি পরিয়ে বাসায় এসে যদি দেখে আরো ভাল প্রস্তাব অপেক্ষা করছে তখন বরং আংটি গচ্চা দিয়ে প্রস্তাবটা লুফে নেয়াটাই বেশি লাভজনক মনে হয়। ছেলে অবশ্য প্রথম প্রথম সামান্য কোঁ কোঁ করছিল, কিন্তু দলিল মন্ডল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ‘তোমার নামের পাশে যে ডাক্তারীর সিল সেটা আমার পয়সায় কেনা, সুতরাং বিয়ে আমার কথামত হবে’। ছেলেও বাধ্য হয়ে কোরবানীর গরুর মত সেজেগুজে বাপের পাঞ্জাবীর খুট ধরে ঘুরতে থাকে এক মেয়ের বাসা থেকে আরেক মেয়ের বাসায়।

অবশেষে দলিল মন্ডলের এক মেয়ে পছন্দ হয়। মেয়ের বাবামা নেই। মামাদের কাছে মানুষ। মামারা যেমন ধনী তেমনি দিলখোলা মানুষ। মেয়ে অনার্স শেষ বর্ষে, যেমন সুন্দরী তেমনি গুনবতী। একমাত্র বোনের একমাত্র স্মৃতিচিহ্নটিকে মামারা যেমন আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন, বিয়েও দেবেন তেমনি ধুমধাম করে যেন কোনপ্রকার অপূর্ণতা না থাকে। দলিল মন্ডল বেজায় খুশি। আনন্দে গদ গদ হয়ে মেয়েকে আংটি পরিয়ে পাকা কথা দিয়ে ঘরে ফিরল।

বাসায় এসেই দেখে বৈঠকখানায় কালু ঘটক বসে আছে, মুখের হাসি আকর্ণবিস্তৃত। দলিল মন্ডল একটু আমতা আমতা করল, ‘না, আর দেখবনা। পাকা কথা দিয়ে এসেছি’, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কালু ঘটকও নাছোড়বান্দা, কমিশনের লোভ কি অত সহজে ছাড়া যায়? জিভে যত তেল আছে সব দিয়ে মিনিট দশেক দলাই মলাই করার পর দলিল মন্ডল হাল ছেড়ে দিল। কালু ঘটক যে প্রস্তাবের কথা বলল তা শুনে দলিল মন্ডলের জিভে জল এসে গেল। মেয়ের বাবার সম্পদের পরিমাণ দলিল মন্ডলের অন্তত দ্বিগুন, মেয়ে চিররুগ্না তাই ডাক্তার স্বামী চাই, বিনিময়ে কালক্রমে সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে একমাত্র মেয়েজামাই। বাহ! এ যেন আলৌকিকভাবে আশাপূরণ! দলিল মণ্ডল সাথে সাথে মেয়ের বাবাকে যোগাযোগ করল। বলা তো যায়না, অন্য কেউ যদি আগে পৌঁছে যায়! না, আর কেউ দলিল মন্ডলকে টেক্কা দিতে পারেনি। কথাবার্তায় সব খাপে খাপে মিলে গেল। কিন্তু দলিল মন্ডল এত কাঁচা লোক না। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল বুদ্ধি নিয়ে চললে সে এতবড় ব্যাবসায়ী হতে পারতনা। ব্যাক আপ হিসেবে পাকা দেখে আসা কনে হাতে থাকল। ওখানে বিয়ের কথা হয়েছে পনেরো দিন পর। এখানে সে বিয়ের ব্যাবস্থা করবে সাতদিনে। দলিল মন্ডলের জন্য তো ব্যাপার একই, খরচও একই। কেবল মেয়ে একটা না হলে অন্যটা।

ধনীর দুলালীর সাথে বিয়েটা আগামীকাল ফাইনাল করে ফেলা গেছে। সাতদিনে পারা যায়নি অবশ্য, বারোদিন চলে গিয়েছে। দলিল মণ্ডল সিদ্ধান্ত নিলো এবার ওদের জানানো প্রয়োজন। হাজার হোক সেও তো একজন মানুষ, তারও কিছু মানবিক অনুভূতি আছে! দলিল মণ্ডল পাকা দেখা কনের বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল এই বিয়ে হচ্ছেনা। মেয়ের মামারা আকাশ থেকে পড়লেন। দলিল মণ্ডল পাত্তা দিলোনা। দুনিয়া বড় স্বার্থপর জায়গা। এখানে নিজেরটা নিজে বুঝে না নিলে কেউ দলিল মন্ডলের হক যেচে বুঝিয়ে দিতে আসবেনা।

আজ বড়ছেলের বিয়ে। দলিল মন্ডলের বৌয়ের মুখে হাসি যেন আর ধরেনা। অবশেষে তার ছেলের বিয়ে হচ্ছে। যার সাথেই হোক, দলিল মণ্ডল এবার পিঠটান দেয়নি এতেই তার খুশির অন্ত নেই। ছেলেও মহাখুশি। বিয়ের স্বপ্ন দেখে কেটেছে কত প্রহর, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর! বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে! মুখের হাসি রুমালের ভেতর আর আঁটছে না।

২/

দীপ্তি হঠাৎ পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পাশের চেয়ারে বসা ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমার সাথে একটু চল তো, এক জায়গায় যাই’।

জামাল অবাক হয়ে বলল, ‘একটু পর সন্ধ্যা নামবে, এখন কই যাবি?’

‘আহা, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসব, এবার তাড়াতাড়ি গাত্রোত্থান কর’।

‘তোর এই অবস্থায় তোকে নিয়ে বাইরে গেছি শুনলে বড়ভাবী আমাকে খুন করে ফেলবে’।

‘মামী একটু আগে শুয়েছে, কিচ্ছু টের পাবেনা, এখনই ভাল সময়। কাপড় বদলাতে হবেনা, তুমি জামা বদলালেও দেখতে তোমার মতই দেখাবে। চল! আহা, তাড়াতাড়ি কর!’

জামাল পকেটে মানিব্যাগটা ভরতে ভরতে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় দীপ্তি। বাসার সামনেই রিক্সা পেয়ে উঠে পড়ে দু’জনে।

৩/

সন্ধ্যা হয় হয়। কিন্তু এতবড় বাড়ীটাতে এখনও কেউ আলো জ্বালেনি। দারোয়ান তো বলল সবাই বাসায় আছে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ও ঘামছে একটু একটু। ওর অবস্থা দেখে জামালই বেল টিপল। অনেকক্ষণ সময় চলে গেল। দীপ্তি চলে যাবার জন্য দরজার দিকে পেছন ফিরেছে, তখন দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল।

দলিল মণ্ডল দরজা খুলে দেখে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, সমবয়সীই হবে। মেয়েটার পরনে হলুদ সালোয়ার কামিজ, লাল ওড়না। ছেলেটা পাজামার সাথে চেক ফতুয়া পরা। শেষ বিকেলের ছায়া পড়েছে মেয়েটার মুখে, চেহারাটা ঠিকমত দেখা যাচ্ছেনা। ছেলেটাকে দলিল মণ্ডল চিনতে পারলনা। মেয়েটা ইতস্তত করে সামনে এগিয়ে এলো, হাতের মুঠো খুলে একটা আংটি দলিল মন্ডলের দিকে এগিয়ে দিলো। দলিল মণ্ডল মানুষ না চিনতে পারে কিন্তু স্বর্ন চিনতে তার ভুল হোলনা। এটাতো সেই মামাদের আদরের দুলালী কনেকে দেয়া আংটি, তার মানে এই মেয়েটি …! দলিল মণ্ডল স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাত বাড়াল, মেয়েটি সেখানে আংটিটি ফেলে দিলো। দলিল মণ্ডল খেয়াল করল ওর যে আঙ্গুলে ওরা আংটি পরিয়েছিল সেখানে আরেকটি আংটি শোভা পাচ্ছে, ওজনে অনেক কম কিন্তু কারুকার্যখচিত, সযত্নসঞ্চিত। বোবা দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকায় সে, মেয়েটি বলে, ‘আপনার এই আংটির ভার আমি আর বহন করতে পারছিলাম না। তাই আপনার জিনিস আপনাকে বুঝিয়ে দিতে এলাম। আপনি কেন এমন করলেন আমি জানিনা। কিন্তু প্লিজ আর কোন মেয়ের সাথে এমন করবেন না। একটা আংটির সাথে কতগুলো মানুষের কত স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে! দিনের পর দিন সেই স্বপ্ন আরো ঘনীভূত হয়ে আশা আকাঙ্ক্ষার রূপ ধারণ করে। এভাবে সেই আকাঙ্খাকে পদদলিত করবেন না’। এতক্ষণে দলিল মন্ডলের মনে পড়ে ছেলেটি ওর ছোটমামা। চলে যাচ্ছিল মেয়েটি, কি মনে করে ফিরে আসে দীপ্তি, ‘আপনি জেনে হয়ত খুশি হবেন, আপনার ব্যাবহারে আমার পরিবারের সদস্যরা ভেঙ্গে পড়ে। তখন পাশের বাসার এক চাচী তাঁর ছেলের জন্য প্রস্তাব পাঠান। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন আমার পরীক্ষা শেষ হলে প্রস্তাব করবেন, কিন্তু পরে জানতে পারেন মামারা আপনাদের সাথে কথা বলেছেন। আপনি যখন বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন তখন আর তাঁরা দেরী করেননি। তাঁরা আপনাদের মত ধনী নন, যৌতুকও নেবেন না, কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনারা তাঁদের নখের যোগ্যও নন। বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে এই অসাধারন পরিবারটির সদস্য হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ’।

মেয়েটা চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ হোল। দলিল মন্ডলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ছোট্ট একটা ছেলের করুন মুখ, এক পাত ভাতের জন্য সৎমায়ের দিকে চেয়ে বসে আছে সেই সকাল থেকে। তারপর আরেকটা ছেলে, আরেকটু বড়। স্কুলের সব ছেলেরা তাকে ক্ষেপাচ্ছে কারণ অনটনের কারণে আজ ছ’মাস হোল সেই ছেঁড়া শার্টটাই সে প্রতিদিন স্কুলে পরে আসে। তারপর এক কিশোর, রিক্সার গ্যারেজে কাজ করে সে, অবসর সময়ে লেখাপড়া, অল্প পয়সা দিয়ে নিজে চলে আবার বস্তির হতদরিদ্র মানুষগুলোকেও কিছু দেয়। তারপর এক যুবক, সে তখন নতুন নতুন পয়সার ঘ্রান পেয়েছে, এখন আর মানুষকে দিতে ইচ্ছে করেনা, মনে হয় সব টাকা তার নিজের প্রয়োজন। এক সময় সে আর টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা। একদিন সে ছেলের বিয়ে দিতে যায়। গিয়ে দেখে লোকজন বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, উৎসবের আমেজ নেই। কি ব্যাপার? মেয়ে পালিয়েছে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে, মেয়ের বাপের মাথায় হাত।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বৈঠকখানায় আলো জ্বালিয়ে ছোট মেয়ে মল্লিকা বাবাকে ডাকতে ডাকতে এসে দেখে বাবা খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হু হু করে কাঁদছে।

– রেহনুমা বিনতে আনিস

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button