তথ্য-প্রযুক্তি/মিডিয়া

প্রয়োজন ইসলাম প্রচারে এফএম রেডিও প্রতিষ্ঠা

বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোয় বিশেষত রাজধানী ঢাকা শহরে ইদানীং পথে-ঘাটে এবং যানবাহনগুলোয় অহরহ চোখে পড়ে এফএম রেডিও শোনা মানুষ। আপনি চারপাশে তাকালেই দেখবেন কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা দুই কানে হেডফোন লাগিয়ে নাগরিক জীবনের শত কোলাহল উপেক্ষা করে নিবিষ্টচিত্তে কীসে যেন মজে রয়েছে। হ্যা, ওরা মজে আছে এফএম রেডিওর মিউজিক ও হালফ্যাশননির্ভর অনুষ্ঠানাদি শ্রবণে।

এক সময় এই রেডিও ছিল গ্রামীণ মানুষের বিনোদন ও সংবাদ সংগ্রহের একমাত্র অবলম্বন। সামাজিকভাবে তখনকার ট্রানজিস্টর বা রেডিওকে দেওয়া হত বেশ গুরুত্ব। আমাদের বাপ-দাদার বিয়ের সময় নতুন জামাইকে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় উপহার হিসেবে সিকো ফাইভ হাত ঘড়ি বা বাইসেকের সঙ্গে একটি ট্রানজিস্টর দেওয়ার রেওয়াজই এর প্রমাণ বহণ করে। এখনো বাংলাদেশে এমন পল্লী খুঁজে পাওয়া সম্ভব যারা কেবল রেডিও শুনেই তাদের বিনোদন ও সংবাদ জানার তৃষ্ণা নিবারণ করেন। এদেশের মুক্তিযু্দ্ধের ঘোষণা হয়েছিল এই মাধ্যমে- চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। এর সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গণ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সংবাদ এবং যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জেনেছেন। প্রেরণা ও দেশপ্রেমের উজ্জীবনী শক্তিও অর্জন করেছেন এই বেতার বা রেডিও থেকে। দেশের শিক্ষিত ও অগ্রসর জনগোষ্ঠীও দেশ-বিদেশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য এর প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন। এখনো কলকাতা ও বাংলাদেশে লন্ডনের বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস বা বিবিসি বাংলা এবং আমেরিকার ভয়েস অফ আমেরিকার সংবাদ বিবরণীমূলক অনুষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তা অন্য মিডিয়াগুলোর জন্য ইর্ষণীয়ই বটে।

টিভি আবিষ্কারের পর সহসা এ অবস্থায় পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। রাতারাতি কমে যায় বাংলার মানুষের বেতার নির্ভরতা। তথ্য প্রযুক্তির চরমোৎকর্ষ ও একাধিপত্বের যুগে রেডিও বা বেতার যখন যাদুঘরে ঠাঁই নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই এফএম রেডিওরূপে বেতার ফিরে এলো প্রবল প্রতাপে। এফএম রেডিও এখন তাই রাজধানীর তরুণ-তরুণীদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর আড্ডার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই এফএম রেডিও। আর একে আশ্রয় করে এদের জীবন হয়ে পড়ছে পুরোপুরি আমাদের দেশীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ পরিপন্থী কালচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।

বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, রক্ত দিয়ে কেনা মাতৃভাষাও আজ এই রেডিওগুলোর চালু করা শ্রুতিকটু ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত ‘বাংলিশে’র আধিপত্যে হুমকির সম্মুখীন। শুধু ধর্মীয় ও সমাজবিজ্ঞানী ব্যক্তিত্বগণই নয়; ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক সমাজও আজ তাই এই রেডিওগুলোর বিরুদ্ধে কলম ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। ইদানীং ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলিশের বিরুদ্ধে মিডিয়াগুলোয় বিশেষত প্রিন্টেড মিডিয়াসমূহে ঝড় ওঠে। বছর দুয়েক আগে ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও বাংলা ভাষার ওপর বিজাতি ভাষার এই অনভিপ্রেত হামলায় নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকেও গত বছর এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে বাংলিশের উৎপাত বন্ধে রুল জারি করা হয়েছে। অবশ্য এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রেডিওগুলোর দেখাদেখি এখন অন্য মাধ্যমগুলোতেও বাংলিশের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সাধারণ নাগরিক থেকে নিয়ে বিশিষ্ট লোকদের মুখেও ওঠে এসেছে অশ্রাব্য এই বাংলিশ।

তাছাড়া হালআমলের এই রেডিওগুলো আমাদের ছেলে-মেয়েদের হাতে-কলমে অনৈতিক প্রেম-ভালোবাসা এবং অভিভাবক ও শিক্ষকদের চোখে ধূলো দিয়ে পড়াশোনার বারোটা বাজানোর সবকও দিচ্ছে। একটি রেডিওতে রাত বারোটার পর শুরু হয় ‘লাভগুরু’ নামক হাতে-কলমে ভালোবাসা শিক্ষার আসর। প্রতি অনুষ্ঠানে একটি করে জুটিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা কীভাবে অভিভাবকদের বোকা বানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করল, কিভাবে প্রেম-পিরিতি শুরু করল ইত্যাদির জীবন্ত ও আত্মজ অভিজ্ঞতা বয়ান করেন। তাদের বয়ান শেষে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ওরফে লাভগুরু ওই জুটি ও শ্রোতাদের উদ্দেশে ‘অমূল্য উপদেশ’ প্রদান করেন।

বড় উদ্বেগের বিষয় হলো আগামীর দিনগুলোয় এই রেডিওগুলোর আধিপত্য বাড়বে বৈ কমছে না। এখন প্রধানত বিভাগীয় শহরগুলোয় এসব বেতার তরঙ্গের সম্প্রচার কার্যক্রম চললেও অচিরেই তা জেলা শহরগুলো পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। উন্নত দেশগুলোয় বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সিটি করপোরেশনগুলোর নিজস্ব কমিউনিটি রেডিও রয়েছে। সেখান থেকে ছাত্র-ছাত্রী ও জনগণের উদ্দেশে প্রয়োজনীয় ঘোষণাগুলো জানিয়ে দেয়া হয়। আবহাওয়াবার্তা জানানো হয়। কাজেই কেউ যদি মনে করেন এই মাধ্যমটিকে গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই, তাহলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করবেন। আপনি আমি গুরুত্বে দেই আর না দেই আমাদের অনেকের ছেলে-মেয়েরা এসব থেকে অনেক অপবিদ্যা অহরণ করছে। অনেক মেয়ে আবার রেডিও জকিদের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পরিবার ও সমাজকে উপেক্ষা করে নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনছে।

রেডিও পরিচালকরা হয়তো বলবেন, আমরা তো কেবল গান-বাজনা বা মিউজিকনির্ভর অনুষ্ঠানই প্রচার করি না, নানা শিক্ষামূলক ও দরকারি বিষয়ও সম্প্রচার করে থাকি। তাদের উদ্দেশে বলা হবে, আপনারাই বলুন আপনাদের কোন প্রোগ্রামগুলো বেশি শ্রুত হয়? কারা প্রধানত এই অনুষ্ঠানগুলো শুনে নিজেদের পড়ালেখার অপূরণীয় ক্ষতি করছে? কাদের উদ্দেশে আপনাদের মিউজিকের রকমারি চটকদার বিজ্ঞাপন? কারা তৈরি করেছে ‘ডিজুস প্রজন্ম’ নামের অদ্ভুত এক প্রজন্মের?

আমরা যারা নিজের দেশ ও দীন নিয়ে ভাবি, মানুষকে অমঙ্গলের পথ থেকে কল্যাণের পথিক বানাতে চাই, তারা সময় ও বহমান স্রোতকে অস্বীকার না করলে অবশ্যই এ মাধ্যমকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। আমি তো বড় আশ্চর্য হই এই কথা ভেবে যে, মিডিয়ার সবচে নিরাপদ ও তুলনামূলক কম খরচের একটি মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও কেন আমরা একে গুরুত্ব দেই না। কেন দেশ ও দীনের কর্ণধারগণ এই মাধ্যমকে কাজে লাগান না। টিভিতে আলেমদের অংশগ্রহণ নিয়ে নানা মতবিরোধ থাকলেও বিমূর্ত এ শ্রুতি মাধ্যমকে কেন আমরা কাজে লাগাচ্ছি না! এটি কেন আমাদের বিবেচনায় অগ্রাধিকার পায় না! মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো এবং ইহ ও পরকালীন ক্ষতি থেকে রক্ষায় সম্ভাব্য সব উপায় গ্রহণ করাই তো নবী ও ইসলাম-প্রচারকদের শ্বাশত আদর্শ বা ‘সুন্নত’।

রাজধানীর চিরাচরিত জ্যামে যখন আটকে থাকি কিংবা যখন অনাকাঙ্ক্ষিত লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে সন্ধ্যায় অন্ধকারে আটকা পড়ি, যখন আর কিছু পড়ার সুযোগ থাকে না তখন আমি নিজেও চাই এফএম রেডিও থেকে উপকৃত হতে। ভাবি, যদি কোনো ভালো ইসলামী রেডিও থাকত তবে তো এ সময়টাকেও গঠনমূলক বা নিজেকে নির্মাণের কাজে লাগাতে পারতাম। সন্দেহ নাই আমার মতো হাজারো ইসলামপ্রিয় তরুণ-তরুণীও এমনটি প্রত্যাশা করেন। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই আমাকে জানিয়েছেন এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহের কথা। অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছেন এ ব্যাপারে জাতির কর্ণধারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু লিখতে। আমার বাল্যবন্ধু সদ্য এমবিবিএস পাশ করে এফসিপিএস এ ভর্তি হওয়া ডা. আমিনুর রহমান তো দীর্ঘদিন যাবৎ এ বিষয়ে তার স্বপ্ন ও প্রয়োজনের কথা বারবার বলে আসছে। সে আমাকে প্রায়শই বলে, বন্ধু, তুমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখ একটি এফএম রেডিও প্রতিষ্ঠায় কি রকম অর্থের প্রয়োজন? আর এমন ভাবনা যে শুধু আমার ডাক্তার বন্ধুর মাথায় উঁকি দিয়েছে তা কিন্তু নয়, বরং এ ভাবনা বহু দীন দরদীর।

আমরা যারা মানুষের কাছে সত্য ও সুন্দর তুলে ধরতে চাই তাদেরকে অবশ্যই মানুষের মেজাজ-মর্জি, আবেগ-অনুভূতি এবং সর্বোপরি রুচি-অভিরুচি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে হবে। মানুষের রুচি না বুঝলে কখনো তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সমাজের সবচে বড় অংশ এখন তরুণ-তরুণী। এরাই আগামী দিনে দেশের কর্ণধার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করবে। অতএব এদের রুচি-অভিরুচি এবং লাইফস্টাইল নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। তাছাড়া একটি জাতির ভবিষ্যত জড়িয়ে থাকে সে জাতির আগামী প্রজন্মের সঙ্গে। তরুণরাই সব সময় দেশ, জাতি ও ইতিহাসের নায়ক হয়। তাই এদের নিয়ে আমাদের আলাদা ভাবনা থাকা উচিত। এদের দিকে তাকিয়ে হলেও আমাদের এফএম প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনা করা উচিত। এদের বাঁচাবার স্বার্থে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া দরকার।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবের দেশগুলোয় অনেক এফএম রেডিও রয়েছে, যেখান থেকে গঠনমূলক, দীনী ও সামাজিক শিক্ষা সম্পর্কিত দারুণ সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের জীবনী, তাফসীর, ফিকহ ও সিরাত বিষয়ে চমৎকার সব প্রোগ্র্রাম ব্রডকাস্ট হয়। এছাড়া আরও রয়েছে অনলাইন রেডিও। অনলাইনে রেডিওর সম্প্রচার চালু হবার মধ্য দিয়ে এটি এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। একজন ব্যক্তি একাই একটা রেডিও ব্রডকাস্ট করতে পারছেন। আধুনিক ইসলামী ওয়েবসাইটগুলোয় এখন এই রেডিও সংযোজন অপরিহার্য ব্যাপার।

অতএব বাংলা ভাষায় এফএম রেডিও এখন বড্ড প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এজন্য এখন থেকেই আমাদের কিছু আরজে বা রেডিওজকি গড়ে তুলতে হবে। রেডিওতে আমরা পবিত্র কুরআনের আন্তর্জাতিক সব কারীদের তিলাওয়াত, সংক্ষিপ্ত তাফসীরের দারস, দারসুল হাদীস, ইসলামী সঙ্গীত ও হামদ-নাত উপস্থাপন, ইসলামী মনীষীবৃন্দের জীবনী, সীরাত, সমাজের জন্য ইতিবাচক সংবাদ প্রচার করতে পারি। ইসলাম শিক্ষামূলক ও ক্যারিয়ার উন্নয়ন বিষয়ক নানা আয়োজনও রাখতে পারি। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে যারা বুঝে না বুঝে অপপ্রচার চালায় তাদের সদুত্তর ও সমুচিত জবাব দিতে পারি। আরও পারি সকল অন্যায় ও অবিচারের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, হে রব, আপনি আমাদের ভেতর থেকে ইসলামী রেডিও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোক্তা, পরিচালক, উপস্থাপক ও কুশীলব তৈরি করে দিন। তাঁর দীন প্রচারে প্রয়োজনীয় সকল উপায় গ্রহণ করবার তাওফীক দিন। আমীন।

– আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button