দাওয়াত ও জিহাদ

বিবেকবান অমুসলিম বন্ধুর প্রতি একটি আহবান

সুপ্রিয় ভাই! এই পৃথিবীতে যত প্রকার লোক এবং যত প্রকার জাতি বসবাস করছে প্রায় সকলে এই বিষয়ে একমত যে, আমাদের তথা দৃশ্যমান পৃথিবীর এক জন না এক জন সৃষ্টিকর্তা আছেন।

আর এই বিশ্বাসের যুক্তিও স্পষ্ট। কারণ, আমরা আমাদের আসে-পাশে যা কিছু দেখছি, সেটা নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ হোক কিংবা বাড়ি-ঘর, কিংবা বাড়ি-ঘরের আসবাব পত্র, যেমন শয়নের খাট, বসার চেয়ার, খাবার খাওয়ার থালা-বাটি ইত্যাদি কিছুর কেউ না কেউ সৃষ্টিকর্তা বা আবিষ্কারক রয়েছে। তাই সহজ ভাবে স্বীকার করা যেতে পারে যে, এই বিশাল পৃথিবী, পৃথিবীর মাঝে সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত, রকমারি গাছ-পালা, বিভিন্ন পশু-প্রাণী, অথৈ সমুদ্র, আলোকময় সূর্য, জ্যোৎস্নাময় চন্দ্র, উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি ইত্যাদি সব কিছুর ও কেউ না কেউ সৃষ্টিকর্তা আছে। তাছাড়া যুক্তি এবং মানুষের স্বভাব ও এক জন সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করে।

পৃথিবীতে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি সেই সৃষ্টিকর্তাকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে। কেউ তাকে ঈশ্বর বলে ডাকে, কেউ ভগবান বলে ডাকে, কেউ গড বলে ডাকে, কেউ আল্লাহ বলে ডাকে, আর অনেকে নাম ধরে না ডাকলে ও বলে: উপর ওয়ালা বা সেই জন।

এটাও সত্য যে, সেই মহান স্রষ্টা বিনা বিনিময়ে আমাদের অনেক কিছু দিয়ে থাকেন। যেমন তিনি পৃথিবীতে বসবাস করার জন্য ভূমির ব্যবস্থা করেছেন। আহারের জন্য বিভিন্ন প্রকারের অন্ন, শস্য এবং ফল-মুল দিয়েছেন। জীবন বাঁচানোর জন্য আলো, বাতাস, পানি ও অক্সিজেন প্রদান করেছেন। আর এসব তিনি সকলকে বিনিময় ছাড়াই যুগ যুগ ধরে অবিরাম দিয়ে যাচ্ছেন।

আজ পৃথিবীতে কোন মানুষ অন্য মানুষের সামান্য সাহায্য করলে বা সাহায্য করার হাত বাড়ালে আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কিন্তু মহান স্রষ্টা কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই যখন, আমাদের এত কিছু প্রদান করেন এবং আমাদের প্রতি এত বড় বড় অনুগ্রহ করেন, তখন আমাদের প্রতি তাঁর উদ্দেশ্যে কিছু করণীয় আবশ্যিক হয় না কি?

জি, তাঁর অশেষ অনুগ্রহের কারণে আমাদের উপর অবশ্যই কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব চলে আসে। আর তা হচ্ছে, আমরা যেন শুধু তাঁর উপাসনা, আরাধনা, পূজা-পাট তথা ইবাদত করি। কেবল তাঁরই উপাসনা করি অন্যের না করি। কারণ তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা বাকি সব সৃষ্টি, তিনিই একমাত্র দাতা বাকি সব অনুগ্রহের পাত্র, তিনিই অমুখাপেক্ষী বাকি সব তাঁর মুখাপেক্ষী। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি কেবল তাঁর উপাসনা করি? কেবল তাঁকে উপাস্য মেনে তাঁরই পূজা-পাট করি? সকল ক্ষেত্রে তাঁকে ক্ষমতাবান মনে করি কি?

বাস্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন। আমরা এক জনকে স্রষ্টা তথা উপাস্য মুখে স্বীকার তো করি বটে। কিন্তু উপাসনার সময় শুধু তাঁর উপাসনা করি না এবং সকল ক্ষেত্রে তাঁকে ক্ষমতাবান ও দাতা  মনে করি না; বরং তাঁর সৃষ্টির পূজা করি। ঈশ্বরের সৃষ্টি মাটি, বালি, পাথর, খোঁড়-কুটা ইত্যাদি একত্রিত করে আমরা মানুষেরাই একটি আকৃতি তৈরি করে, তা ভগবান মনে করে যথেষ্ট ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে তার পূজা-পাট করি। পরে তা কোথাও বিসর্জন দিয়ে দেই। অর্থাৎ আমরা মানুষ, ঈশ্বরের সৃষ্টিকুলের এক সৃষ্টি। তার পর আমারা সৃষ্টি করি আর এক সৃষ্টিকে। অতঃপর তাকে ঈশ্বর মেনে উপাসনা করি। এখানে তো সৃষ্টি যেন স্রষ্টার জনক! সৃষ্টি সৃষ্টির উপাসক! তাহলে স্রষ্টার উপাসনা কোথায়? সুস্থ বিবেকও এটা মেনে নেয় কি? না আমরা আসলে সমাজের পরম্পরার অনুসারী? অনেকে আমাকে অপবাদ দিয়ে বলবে: এ আমাদের ধর্মকে মন্দ বলছে। আমি বলবো: ভাই! আমরা শুধু আপনার বিবেককে একটু নাড়া দেয়ার চেষ্টা করছি, আপনাকে একটু চিন্তা করার সবিনয় আহ্বান জানাচ্ছি।

অন্যদিকে আমরা যেমন সেই মহীয়ান এক স্রষ্টার উপাসনা করছি না, তেমন তাঁকে সব বিষয়ে ক্ষমতাবান ও মনে করি না। তাই সব বিষয়ে তাঁর শরণাপন্ন না হয়ে অন্যের কাছে ছুটে চলেছি। অন্য কথায় তাঁর বহু অংশী ও পার্টনার তৈরি করে নিয়েছি। তাইতো আমরা শক্তির দেবতা অন্যকে মনে করি, বিদ্যার দেবতা আর কাউকে মনে করি, জীবিকা ও সম্পদের দেবতা আর কাউকে মনে করি, ভাল-মন্দের দেবতা আর কাউকে বিশ্বাস করি। স্বভাবত: প্রশ্ন আসে, কেন সেই মহান স্রষ্টা যাকে ভগবান মনে করা হচ্ছে, তিনি কি তাহলে এসব দায়িত্ব পাল করতে অক্ষম? অক্ষমতার গুণে গুণান্বিত সত্ত্বা কি ঈশ্বর হতে পারে? তাহলে অক্ষম সৃষ্টি এবং সক্ষম স্রষ্টার মধ্যে পার্থক্যই বা কি রইলো ?

এই কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করার পর আমি আপনাদের যা, অবগত করতে চাই তা হচ্ছে, মহান স্রষ্টা আমাদের অবশ্যই কোন না কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। কারণ পৃথিবীর কোন বস্তুই উদ্দেশ্যহীন নয়। তাঁর উদ্দেশ্য কি এবং তিনি আমাদের কাছে কি চান? এসব কিছু জানানোর জন্য তিনি যুগে যুগে মানুষের মধ্য থেকেই কোন সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে নির্বাচন করেন। তার মাধ্যমে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য ও প্রত্যাদেশ পৌঁছে দেন। যুগে যুগে এই রকম বহু ব্যক্তি মানব সমাজে প্রেরিত হয়েছেন। যাঁদেরকে ঈশ্বরের দূত, রাসূল ও নবী বলা হয়। সেই সমস্ত দূতের মধ্যে শেষ দূত হচ্ছেন মক্কায় জন্মগ্রহণকারী সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যার সুসংবাদ বিগত সকল দূত দিয়ে গেছেন। এমন কি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ হিন্দু শাস্ত্র বেদ সমূহেও তাঁর উল্লেখ ও সুসংবাদ এসেছে। অথর্ব বেদের ২০তম কাণ্ড, নবম অনুবাক, একত্রিংশ সূক্ত, ৪৭২ পৃষ্ঠার প্রথম মন্ত্রে উল্লেখ হয়েছে:  ইদং জনা উপশ্রুত নরাশংস স্তবিষ্যতে। ষষ্টিং সহস্রানবতিংচ কৌরম আ রুশমেষু দন্মহে’। অর্থাৎ, হে মানব মণ্ডলী! মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর! ‘নরাশন্স’ এর প্রশংসা করা হবে। আমি এই দেশ ত্যাগকারী (মুহাজির) বা প্রশান্তির ঝাণ্ডা বাহী ৬০ হাজার শত্রুর মাঝে সুরক্ষিত রাখবো। সংস্কৃত শব্দ নরাশন্স। এর অর্থ হল, এমন নর বা ব্যক্তি যার বেশী বেশী প্রশংসা করা হয়। যেই শব্দটির হুবহু আরবী শব্দ মুহাম্মদ’। শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য শুধু  এই যে, নরাশন্স’ সংস্কৃত আর মুহাম্মদ’ আরবী শব্দ।  (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন অথর্ব বেদ পৃঃ ৪৭২-৪৭৩)

হিন্দু ধর্মের আর এক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ পুরাণ। তাতেও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমনের পূর্বাভাস স্পষ্ট ভাবে বর্ণিত হয়েছে। কল্কী পুরাণ গ্রন্থের ২য় অধ্যায়ের ১১তম শ্লোকে উল্লেখ হয়েছে: সুমতি বিষ্ণুযশাসা গর্ভামা বিষ্ণুওয়ামু’’। অর্থাৎঃ কল্কী অবতার সূমতী’ এর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করবে আর তার পিতার নাম হবে বিষ্ণুযশা। সূমতী এর আরবী অর্থ আমিনা আর ‘বিষ্ণুযশা’ এর অর্থ আব্দুল্লাহ’। আর একথা সবার নিকট জানা যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাতার নাম ছিল আমিনা এবং তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ। কল্কী অবতারের মাধ্যমেই আল্লাহর দূত তথা নবীর আবির্ভাব সমাপ্ত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবত পুরাণের প্রথম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ে ২৫তম শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে, “ বড় বড় পয়গম্বর (অবতার) ২৪ জন। কল্কী অবতার সর্বশেষ অবতার হবে, যিনি সমস্ত অবতারের পরিসমাপ্ত কারী হবেন। আর এটাও সত্য যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ নবী, তাঁর পরে আর কোন নবী আগমন করবেন না।

প্রিয় পাঠক! অতএব আমাদের মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা জরুরী। কারণ পূর্বের নবীগণের ভবিষ্যৎ বাণী ও বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে শেষ নবীর (দূতের) শুভাগমনের সুসংবাদ হিসেবে তিনিই শেষ ও সত্য নবী। যিনি পৃথিবীর মানুষকে শুধু এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের আহ্বান করেন নি; বরং এক আল্লাহর বিশ্বাসের পর শুধু তাঁরই ইবাদত (উপাসনা) করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাঁর সাথে পৃথিবীর কোনও সৃষ্টির উপাসনা করতে নিষেধ করেছেন। সেই সৃষ্টি সম্মানীয় ব্যক্তি হোক কিংবা আকাশ-যমীন হোক কিংবা আকাশ ও যমীনের কোন মূল্যবান অংশ হোক। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সঠিক পথ দেখাও এবং সঠিক জ্ঞান অর্জন করে ইসলাম গ্রহণ করার সুমতি দাও। আমীন।

লেখক: আব্দুর রাকীব বুখারী ।

দাঈ, দাওয়াত সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব।

সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button