ইমান/আখলাক

আখলাকে হাসানা : গুরুত্ব ও ফযীলত

ভূমিকা :
আল্লাহ বলেন, يَوْمَ لاَ يَنْفَعُ مَالٌ وَلاَ بَنُوْنَ، إِلاَّ مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ- ‘সেদিন সন্তানাদি ও মাল-সম্পদ কোন উপকারে আসবে না। উপকৃত হবে কেবল সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিকট আসবে ‘ক্বালবে সালীম’ বা নিরাপদ অন্তর নিয়ে’ (শু‘আরা ৮৮, ৮৯)। বস্ত্তত ক্বালবে সালীমের বহিঃপ্রকাশই আখলাকে হাসানা বা উত্তম চরিত্র। আখলাকে হাসানা মানব চরিত্রের প্রতিটি বাঁকে ঈমানময় আভা বিকিরণ করে। ফলে মানব চরিত্র হয়ে ওঠে শরী‘আত নির্ভর ও সৌন্দর্যের প্রতিভূ।
খবরের কাগজ খুললে দেখা যায় কাগজের শুষ্ক দেহখানির অধিকাংশই পঙ্কিল খবরে ঢাকা। অতসব অসার, অনাকাঙ্খিত খবরে ঢেকে থাকতে থাকতে সে যেন আজ বড় বিপদগ্রস্থ। বর্তমান সামাজিক অবস্থা কোন অংশে জাহেলিয়াতের যুগের চেয়ে কম নয়। এগুলো থেকে মুক্তির উপায় কি? আরব জাহেলী সমাজ যখন নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, চরিত্রহীনতার অতলে হারিয়ে যাচ্ছিল, এমনিতর সময়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এলেন আখলাকে হাসানা পরিপূর্ণতার জন্য। তিনি আখলাকে হাসানার যে বাস্তব দৃষ্টান্ত দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছেন তার সংস্পর্শ থেকে মানব জাতি অনেক দূরে। উত্তম চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিকে ভাল করে রপ্ত করতে না পারলে আমাদের মুক্তি ও শান্তির আশা একেবারেই ক্ষীণ। উন্নত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদেরকে আবারও সমবেত হতে হবে আখলাকে হাসানার নিবিড় ছায়াতলে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা আখলাকে হাসানার পরিচয়, গুরুত্ব-ফযীলত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
আখলাকে হাসানার পরিচয় :
أخلاق শব্দটি বহুবচন। একবচনে خُلْقٌ বা خُلُقٌ। শাব্দিক অর্থ স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, অভ্যাস, বৈশিষ্ট্য, শিষ্টাচার প্রভৃতি। লুইস মা‘লূফ বলেন, الْخُلُقُ ج اخلاق : المَرُوْءَةُ، العَادَةُ، السَّجِيَّةُ، الطَّبْعُ ‘খুলুক শব্দটির বহুবচন اخلاق। আভিধানিক অর্থ ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, স্বভাব, জনমগত স্বভাব প্রভৃতি’ (আল মুনজিদ ফিল লুগাহ ওয়াল আ‘লাম, ১ম খন্ড (বৈরুত : দারুল মাশরিক, ১৯৭৩ইং), পৃঃ ৯৪)
حسنة শব্দের অর্থ সুন্দর, উৎকৃষ্ট, ভাল প্রভৃতি। সুতরাং আল- আখলাকুল হাসানা অর্থ : সুন্দর স্বভাব, উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব, ভাল অভ্যাস, উত্তম চরিত্র প্রভৃতি। পরিভাষায়, কথায়-কাজে নিরহংকার ও উত্তম আচরণ ফুটে ওঠার নাম আখলাকে হাসানা।
আল্লামা জুরজানী আখলাকে হাসানার একটি যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তৎপ্রণীত ‘কিতাবুত তা‘রীফাত’ নামক গ্রন্থে। তিনি বলেন,
الْخُلُقُ عِبَارَةٌ عَنْ هَيْئَةٍ لِلنَّفْسٍ رَاسِخَةٌ تَصْدُرُ عَنٍْهَا الْاَفْعَالُ بِسُهُوْلَةٍ وُيُسْرٍ مِنْ غَيْرٍ حَاجَةٍ اِلَى فِكْرٍ وَرَوِيَّةٍ فَإِنْ كَانَتِ الْهَيْئَةُ بِحَيْثُ تَصْدُرُ عَنْهَا الْاَفْعَالُ الْجَمِيْلَةُ عَقْلاً وَشَرْعًا بِسُهُوْلَةٍ، سُمِّيَتِ الْهَيْئَةُ خُلْقًا حَسَنًا-
‘খুলুক বা চরিত্র হচ্ছে আত্মার বদ্ধমূল এমন একটি অবস্থা, যা থেকে কোন চিন্তা-ভাবনা ব্যতীতই অনায়াসে যাবতীয় কার্যকলাপ প্রকাশ পায়। আত্মার ঐ অবস্থা থেকে যদি বিবেক-বুদ্ধি ও শরীআতের আলোকে প্রশংসনীয় কার্যকলাপ প্রকাশ হয় তবে তাকে আখলাকে হাসানা নামে অভিহিত করা হয় (শরীফ আলী বিন মুহাম্মাদ আল জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ১০১। অর্থাৎ কোন মানুষের নিকট থেকে যদি স্বভাবগতভাবে প্রশংসনীয় আচার-আচরণ প্রকাশ পায় তবে তাকে আখলাকে হাসানা বলা হয়।
Oxford dictionary তে বলা হয়েছে- Character is the particular combination of qualities in a person that makes him different from other. It is such a quality which leads a man to be determined and able to bear dificulties. ‘চরিত্র হচ্ছে কোন মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো স্বতন্ত্র গুণাবলীর সমাবেশ, যা মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। এগুলো এমন কিছু গুণ, যা মানুষকে সংকল্পবদ্ধ হতে ও কঠিন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে।
হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, حُسْنُ الخُلُقِ بَسْطُ الْوَجْهِ وَبَذْلُ النَّدَى وَكَفُّ الْأََذَىَ ‘সচ্চরিত্র হল হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, দানশীলতা এবং কাউকে কষ্ট না দেয়া’ (আবূ বকর আল জাযাইরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃঃ ১১৫)।
আখলাকের প্রকারভেদ :
আখলাক বা চরিত্র দুই প্রকার। যেমন (১) আখলাকে হাসানা বা সচ্চরিত্র (২) আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্র (সম্পাদনা পরিষদ, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৬ইং), পৃঃ ৭১৫)। শরী‘আত যে সমস্ত স্বভাব-কর্মের জন্য মানুষকে প্রশংসিত ও উৎসাহিত করে তাকে আখলাকে হাসানা বলে। আর যে সমস্ত স্বভাব-কর্মের জন্য নিন্দিত ও তিরষ্কৃত করেছে তাকে আখলাকে সায়্যিয়াহ বলে। আল্লামা জুরজানী বলেন, অন্তর থেকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও শরী‘আতের আলোকে যে সমস্ত প্রশংসনীয় আচরণ প্রকাশ পায় তার নাম সচ্চচিত্র। আর যদি স্বভাবগতভাবে মন্দকর্ম সমূহ প্রকাশ পায় তার নাম মন্দ চরিত্র (আল-আখলাকুল ফাযেলা, পৃ: ৩১)
উল্লেখ্য, মানুষের দু’এক দিনের আচরণ তার স্বভাব বা চরিত্র হতে পারে না। বরং সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র তখনই বলা হবে যখন এগুলো স্বভাবগতভাবে প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ বিন সাইফুল্লাহ বলেন, আমরা বলি, এটি (সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র) একটি বদ্ধমূল বা স্থায়ী অবস্থা। যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পদ ব্যয় করে তাকে দানশীল বলা যাবে না। কারণ এটি তার নিজস্ব স্বভাবে নেই। অনুরূপভাবে কেউ রাগের সময় কষ্ট করে চুপ করে থাকার ভান করলে তাকেও ধৈর্যশীল বলা যাবে না  (আল-আখলাকুল ফাযেলা, পৃঃ ৩১)। মোট কথা, স্বভাবগত উত্তম ও প্রশংসনীয় কর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে হাসানা। আর স্বভাবগত মন্দ কর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে সায়্যিয়াহ।
আখলাকে হাসানার গুরুত্ব ও ফযীলত :
আখলাকে হাসানার প্রতি শরী‘আত যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে ঔষধ প্রয়োগ করলে যেমন তা সহজেই শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যায়, তেমন আখলাকে হাসানা নামের সজীব বৃক্ষটির মযবুত পরশে মানব জীবনের প্রতিটি পরত হয়ে ওঠে ক্লেশমুক্ত, নির্ঝঞ্ঝট ও পরিচ্ছন্ন। তাই উভয় জাহানে সফলতা লাভের মানদন্ড নিরূপণ করা হয়েছে আখলাকে হাসানাকে। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিকে প্রর্বোত্তম মানুষ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمُ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভাল’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৪, ৯/১৬৮, ‘কোমলতা, লাজুকতা ও সচ্চরিত্রতা’ অনুচ্ছেদ)
তিনি বলেন, مَا شَيْئٌ اَثْقَلَ فِىْ مِيْزَانِ المُؤْمِنِ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ خُلْقٍ حَسَنٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের দাঁড়িপাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে জিনিসটি রাখা হবে তা হচ্ছে উত্তম চরিত্র’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০২, সনদ ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূদাঊদ হা/৪৭৯৯, ‘সচ্চরিত্র’ অধ্যায়)। আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَا مِنْ شَيْئٍ يُوْضَعُ فِى المِيْزَانِ اَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الخُلْقِ، شَأنَ صَاحِبِ حُسْنِ الخُلْقِ لَيَبْلُغُ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلاَةِ. ‘মুমিনের মিযানের পাল্লায় সচ্চরিত্র অপেক্ষা ভারী কোন কিছুই রাখা হবে না। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বদা (দিনে) ছিয়াম পালনকারী ও (রাতে) ছালাত আদায়কারীর ন্যায়’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০৩, সনদ ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৭৯৮)। দিনভর ছিয়াম রেখে, রাতভর ছালাত আদায় করে কোন ব্যক্তি যে নেকী পাবেন, সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সচ্চরিত্রের কারণে সে পরিমাণ নেকীর ভাগীদার হবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে তার চরিত্রকে সুন্দর করেছে, আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য যামিন হব’ (তাহক্বীক্ব আবূদাঊদ, হা/৪৮০০, সনদ ছহীহ)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَكْمَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ اِيْمَامًا اَحْسَنُكُمْ خُلُقًا، وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا- ‘ঈমানের দিক দিয়ে সর্বাধিক কামিল সে ব্যক্তি, যার চরিত্র সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা স্ত্রীদের সাথে সর্বোত্তম আচরণকারী’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/১১৬২; সনদ হাসান ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৬৮২)। কামিল মুমিন হওয়ার জন্য অত্র হাদীছে চরিত্রের কামালিয়াত শর্তারোপ করা হয়েছে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল কোন জিনিস মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বলেন, আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র। আবারও জিজ্ঞাসা করা হল, কোন জিনিস বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০৪, সনদ হাসান)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, সৎ কাজ হল উত্তম স্বভাব। আর পাপ কাজ হল,  যে কাজ তোমার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তুমি ঐ কাজটি জনসমাজে প্রকাশ পাওয়াটা অপছন্দ কর (মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫২, ৯/১৬৭)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَىَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلاَقًا  ‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র সর্বোত্তম সে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। আর ক্বিয়ামত দিবসেও সে আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০১৮, সনদ ছহীহ)। এমন আশাব্যঞ্জক হাদীছ গভীরভাবে পড়লে নিশ্চয়ই তাক্বওয়াশীল হৃদয় উত্তম চরিত্র অর্জনে উদ্বুদ্ধ হবে। মুযায়না গোত্রের এক ব্যক্তি বলেন, সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোন জিনিসটি সর্বোত্তম যা মানব জাতিকে দেয়া হয়েছে? তিনি বলেন, সচ্চরিত্র (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৭৮, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৭, ৯/১৬৯)
রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ لِاُتَمِّمَ حُسْنَ الاخلاقِ ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৯৭, সনদ হাসান, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৭০, ৯/১৭২)। রাসূল (ছাঃ) ছিলেন সচ্চরিত্রের মূর্তিমান আদর্শ। তাঁর চরিত্রের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন, واِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْم ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলাম ৪)। তিনিও তার চরিত্রকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য বলতেন, اللهم حَسَّنْتَ خَلْقِىْ فَاَحْسِنْ خُلُقِىْ ‘হে আল্লাহ তুমি আমার গঠন সুন্দর করেছ, সুতরাং আমার চরিত্রকে সুন্দর কর (আহমাদ, তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৯৯, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৭২, ৯/১৭৩)। সুতরাং সচ্চরিত্র মানব জীবনের জন্য কতটা প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ, তা এই হাদীছ থেকে সহজেই অনুমেয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলব না, তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি কে? তাঁরা বললেন, অবশ্যই। তিনি (ছাঃ) বলেন, তোমাদের মধ্যে তিনিই সর্বোত্তম, যিনি বয়সে বড় এবং স্বভাব-চরিত্রে ভাল (আহমাদ, মিশকাত হা/৫১০০, সনদ ছহীহ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দিব না, যার উপর জাহান্নাম হারাম আর জাহান্নাম যার জন্য হারাম? তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার মেজায নরম, কোমল স্বভাব, মানুষের সাথে মিশুক এবং সহজ-সরল (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৮৪, সনদ ছহীহ)। উল্লিখিত হাদীছগুলো থেকে আমরা সচ্চরিত্রের ফযীলত জানতে পেরেছি। সচ্চরিত্রের কারণে একজন মানুষকে সর্বোত্তম ঘোষণা করা হয়েছে। বিভীষিকাময় ক্বিয়ামত কালে আল্লাহ যখন চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ চুকাতে মানব আমল মিযানের পাল্লায় তুলবেন, তখন সচ্চরিত্র সেŠভাগ্যের স্বপ্নকাঠি হয়ে সবচেয়ে বেশি ভারী হবে। ব্যক্তির উত্তম-ভাল স্বভাবগুলো তার দুর্দিনে কতটা ফলদায়ক হবে, তা সে কল্পনাও করতে পারবে না। সচ্চরিত্রের জন্য সে ‘ছাহেবুছ ছাওম’ অর্থাৎ সারা বছর ছিয়াম পালনকারী ও ‘ছাহেবুছ ছালাত’ অর্থাৎ সারারাত ছালাত আদায়কারীর ন্যায় ছওয়াব পাবে। হাদীছে সচ্চরিত্রের জন্য এত এত নেকী ও মর্যাদা ঘোষণা করাতে সচ্চরিত্রের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুটে ওঠেছে। বস্ত্তত সচ্চরিত্র সামাজিক শৃংখলার হাতিয়ার। এটি ব্যতীত সুখ-শান্তির কল্পনা অবান্তর। সচ্চরিত্র অর্জনে আমাদের অনুপ্রাণিত হওয়া, প্রচেষ্টা চালানো একান্ত কর্তব্য।
আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্রের পরিণতি :
শরী‘আত বিভিন্ন ফযীলতের ঘোষণা দিয়ে যেমন আখলাকে হাসানা অর্জনে উৎসাহিত করেছে ও তাকীদ দিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন মন্দ পরিণতি ও শাস্তির হুঁশিয়ার করে অপছন্দনীয় ও নিন্দিত স্বভাব বর্জনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ব্যক্তির মন্দ স্বভাব তার জান্নাত হারানোর অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الجَّوَّاظَ وَلاَ الْجَعْظَرِىُّ ‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে যাবে না’ (তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৮০১, সনদ ছহীহ)। মন্দ স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য তো এই একটি হাদীছই যথেষ্ট যে, তার লালিত মন্দ স্বভাব জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম বাধা হবে।
অন্য একটি হাদীছে এসেছে-
عن ابى هريرة رضي الله ان رسول الله صلى الله عليه وصلم قال اَتَدْرُوْنَ مَا لْمُفْلِسُ قَالُوْا الْمُفْلِسُ قِيْنَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ فَقَالَ اِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ اُمَّتِىْ مَنْ يَأْةِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بصَّلَوةٍ وَّصِيَامٍ وَزَكَاَةٍ وَّيَأْتِىْ قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَف هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَ سَفََكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فاِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ اَنْ يَقْضَى مَا عَلَيْهِ اُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِمْ … طُرِحَ فِى النَّار-
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কি জান অভাবী কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-কড়ি ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত আদায় করে আসবে এবং সাথে সাথে সেই লোকেরাও আসবে, কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাত করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই হক্বদারকে (ছালাত-ছিয়াম নিয়ে আগমনকারী) তার নেকী দেয়া হবে। আবার ঐ হকদারকেও (পূর্বোক্ত হক্বদার যার উপর যুলুম করেছিল) তার নেকী দেয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার (প্রথমতো ব্যক্তির) নেকী শেষ হয়ে যায় তবে তাদের (পরের হক্বদারের) গুণাহসমূহ ঐ ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে (প্রথম হক্বদারকে) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯০০, ৯/১৮৪)
ব্যক্তির মন্দ চরিত্র কিভাবে তাকে নাজেহাল করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে অত্র হাদীছটি তার বাস্তব চিত্র। সে আমলকারী কতই না হতভাগা, যে আমল করেছে কিন্তু মজ্জাগত বদ অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারেনি। ফলে এই অভ্যাসগুলো তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছেড়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لايَدْخُلُ الجَّنَّةَ قَتَّاتٌ ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (মুত্তাফাক্ব, মিশকাত হা/৪৬১২,  ৯/৮০, ‘জিহবার সংযম, গীবত ও গাল-মন্দ অনুচ্ছেদ)। যেসব ব্যক্তি নিজের স্বার্থের জন্য সত্য ও ন্যায়কে পাশ কাটিয়ে পরিস্তিতির অনুকূলে কথা বলে তাদের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَجِدُوْنَ شَرَّ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ذَا الْوَجْهَيْنِ الذِّىْ يَأْتِىْ هَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ وَهَؤُلاَءِ بِوْجْهٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তিকে তোমরা সর্বাধিক মন্দ অবস্থায় পাবে, যে দ্বিমুখী। সে এক মুখ নিয়ে এদের কাছে আসে, আরেক মুখ নিয়ে ওদের কাছে যায় (মুত্তাফাক্ব, মিশকাত হা/৪৬১১, ৯/৮০)
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنَّانٌ ولاعَاقٌ ولامُدْمِنُ خَمْرٍ ‘উপকার করে খোঁটা দানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও সর্বদা মদ পানকারী জান্নাতে যাবে না’ (মিশকাত হা/৪৭১৬, ৯/১১৯, ‘সৎ কাজ ও সদ্ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ; তাহক্বীক্ব নাসাঈ হা/৫৬৭২, সনদ ছহীহ)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, المؤمِنُ غِرٌّكَرِيْمٌ وَالفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ ‘মুমিন হয় সরল ও ভদ্র, পক্ষান্তরে পাপী হয় ধূর্ত ও দুশ্চরিত্রের (তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৭৯০, সনদ হাসান)
রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, اَلاَ اُخْبِرُكُمْ بِاَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ وفى روابة لمسلم جَوَّاظٍ رَنِِيْمٍ مُتَكَبِّرٍ- ‘আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নাম বাসীদের সম্পর্কে সংবাদ দিব না? তারা হচ্ছে অনর্থক কথা নিয়ে বিবাদকারী, বদ মেজাজী, অহংকারী’ (মুত্তাফাক্ব আলইহ)। মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে তারা হচ্ছে বদ মেজাজী, কুখ্যাত, অহংকারী (মিশকাত হা/৪৮৮৯, ৯/১৭৬, ক্রোধ ও অহংকার অনুচ্ছেদ)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَىَّ وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الثَّرْثَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ وَالْمُتَفَيْهِقُونَ ». قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَدْ عَلِمْنَا الثَّرْثَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ فَمَا الْمُتَفَيْهِقُونَ قَالَ «الْمُتَكَبِّرُونَ». ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিরা আমার নিকট ঘৃণ্য ও ক্বিয়ামতের দিন আমার নিকট থেকে দূরে অবস্থান করবে যারা বাচাল, নির্লজ্জ ও মুতাফাই-হিকুন। ছাহাবীগণ বললেন, বাচাথ ও নির্লজ্জ তো বুঝলাম। কিন্তু মুতাফাইহিকুন  কারা, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, অহংকারীরা (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০১৮, সনদ ছহীহ)। কোন মানুষের গঠন-আকৃতি, পোষাক-আষাক নিম্নমানের হলেই তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাকে হেয় মনে করা উচিত নয়। আল্লাহ বলেন,   ‘হে ঈমানদারগণ! পুরুষরা যেন পুরুষদের ঠাট্টা না করে। হতে পারে (যাদেরকে ঠাট্টা করা হচ্ছে) তাদের মধ্যে এদের চেয়ে উত্তম লোক আছে। আর মহিলারা যেন মহিলাদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তাদের মধ্যে এদের চেয়ে ভালো লোক আছে (হুজুরাত ১১)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, কোন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে (মুসলিম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করব। (১) যে আমার সাথে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে (২) যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে (৩) যে ব্যক্তি কোন শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ আদায় করে কিন্তু তার মজুরী পরিশোধ করে না (বুখারী, ৪/৯১; ‘ওয়াদা খেলাফ করা হারাম’ অনুচ্ছেদ)। ক্বিয়ামতের দিন ওয়াদা খেলাফকারীর জন্য তার ওয়াদা খেলাফের মাত্রা অনুযায়ী দুই নিতম্ব বরাবর পতাকা উত্তোলন করা হবে (ঐ, হা/১৫৮৬, ৪/৯১)। আর বলা হবে এটি অমুকের ওয়াদা খেলাফের পতাকা (ঐ, হা/১৫৮৫, ৪/৯০)
কোন মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট দেয়া ও তার দোষ খোঁজা মন্দ স্বভাব। তার পরিণতিও মন্দ। আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَاناً وَإِثْماً مُّبِيْنًا- ‘যারা মুমিন নর-নারীকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা অতি বড় মিথ্যা দোষ ও জঘন্য পাপের শাস্তি তাদের নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয় (আহযাব ৫৮)
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া মন্দ স্বভাব। আর তার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তার সহচর হিসাবে একজন শয়তান নিয়োগ করেন। আর শয়তান যার বন্ধু হয় তার মন্দের ব্যাপারে আর কি-ই-বা বলা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَاناً فَهُوَ لَهُ قَرِيْنٌ ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয়, আমি তার জন্য নিয়োগ করি এক শয়তান। আর সে হয় তার বন্ধ’ু (যুখরূফ ৩৬)। শুধু তাই নয়, এমন ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠবে। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنكاً وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى- قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْ أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا- ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ, তার জীবন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠাব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’ (ত্বহা ১২৪, ১২৫)
মানুষের মন্দ স্বভাব ও তার পরিণতির যৎসামান্যই এখানে উদ্ধৃত হল। আসল কথা এগুলোর একেকটির পৃথক পৃথক প্রবন্ধ হওয়া প্রয়োজন। যাই হোক, হাদীছগুলো থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তির মন্দ স্বভাব, চাই তা কাউকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধ হোক কিংবা বদ মেজাজের মত ব্যক্তিগত দোষই হোক পরিণামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় তাকে অনন্ত শাস্তির দিকে।
সুতরাং আমাদের মধ্যে যত ছোট-বড় বদ অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এগুলোকে গুরুত্বের সাথে নাফসে লওয়্যামার পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। অতঃপর তাক্বওয়া নামক শক্তিশালী ক্লিনার দিয়ে ক্রমে এগুলো পরিস্কার করে ফেলতে হবে। যদি আমরা তাতে অক্ষম হই তাহলে উপরোক্ত হাদীছের পরিণাম ফল কারা ভোগ করবে?
আখলাকে হাসানার উপাদান :
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আখলাক বিস্তৃত। আমলনামা শুরু হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটি পরিব্যপ্ত। সে দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের আখলাক তার প্রতিটি কাজই। ফলে মানুষের ভাল-মন্দ গুণাগুণের শেষ নেই। তথাপি কিছু ভাল বা মন্দগুণের কারণে সে সমাজে উত্তম চরিত্র বা মন্দ চরিত্রে অভিহিত হয়। এমন কিছু উল্লেখযোগ্য উত্তম চরিত্রের উপাদান হচ্ছে- তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি, বিনয়-নম্রতা, সত্যবাদিতা, মিতভাষিতা, দানশীলতা, ছবর বা ধৈর্য, ক্ষমা-উদারতা, শোকর ও যিকির-আযকার, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, লজ্জাশীলতা, আমানতদারিতা, সুধারণা পোষণ, সৃষ্টিজীবের সকলের প্রতি সহনশীল হওয়া, আদল-ইনছাফ প্রভৃতি।
সমাপনী :
আনাস (রাঃ) বলেন, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَضَحِكَ فَقَالَ « هَلْ تَدْرُونَ مِمَّ أَضْحَكُ ». قَالَ قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ « مِنْ مُخَاطَبَةِ الْعَبْدِ رَبَّهُ يَقُولُ يَا رَبِّ أَلَمْ تُجِرْنِى مِنَ الظُّلْمِ قَالَ يَقُولُ بَلَى. قَالَ فَيَقُولُ فَإِنِّى لاَ أُجِيزُ عَلَى نَفْسِى إِلاَّ شَاهِدًا مِنِّى قَالَ فَيَقُولُ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ شَهِيدًا وَبِالْكِرَامِ الْكَاتِبِينَ شُهُودًا – قَالَ – فَيُخْتَمُ عَلَى فِيهِ فَيُقَالُ لِأَرْكَانِهِ انْطِقِى. قَالَ فَتَنْطِقُ بِأَعْمَالِهِ – قَالَ – ثُمَّ يُخَلَّى بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْكَلاَمِ -قَالَ – فَيَقُولُ بُعْدًا لَكُنَّ وَسُحْقًا. فَعَنْكُنَّ كُنْتُ أُنَاضِلُ- ‘একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ছিলাম, হঠাৎ তিনি হেসে ওঠলেন, এমনকি তাঁর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে পড়ল। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা কি জান আমি কেন হাসলাম? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামত দিবসে বান্দা তার প্রতিপালকের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে; একারণে আমি হেসেছি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমাকে যুলুম থেকে রক্ষা করেননি? আল্লাহ বলবেন, কেন নয়, অবশ্যই। সে বলবে, আমার জন্য আমি ব্যতীত অন্য কাউকে সাক্ষী হিসাবে গ্রহণ করব না। আল্লাহ বলবেন, আজকের দিনে তোমার হিসাবের জন্য তুমিই যথেষ্ট। আর সম্মানিত ফেরেশতাগণ সাক্ষী হিসাবে থাকবে। অতঃপর তার মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, কথা বল। অতঃপর তারা তার আমল সম্পর্কে বলে দেবে। অতঃপর তার যবান খুলে দেয়া হবে। সে বলবে, দূর হও, অভিশাপ তোমাদের জন্য। তোমরা আমার শত্রু হয়ে গেলে? অথচ তোমাদের জন্যই আমি ঝগড়া-বিবাদ করছিলাম (মুসলিম, মিশকাত/ ৫৫৫৪)।
কি ভয়ংকর হাদীছ! আদর-যত্নে লালিত, বিলাস-ব্যসনে পরিবেষ্টিত, সুদৃষ্টিতে সংরক্ষিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এই আচরণ! সার্বক্ষণিক সাথী দেহের এই নিষ্ঠুর নির্দয় ও বিরুদ্ধ সাক্ষ্য প্রদান কতই না মর্মান্তিক। আর তা বান্দার অস্বীকার করার কোন উপায় থাকবে না। দুশ্চরিত্রের সাঁড়াশি যেভাবে মানব জাতির শ্বাসরোধ করে রেখেছে তাতে সেদিন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? নিজ ঘরের নীরব কোণে একাকী বসে সে ব্লু ফিল্ম দেখেছে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল প্রভৃতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কত মন্দ কাজে জড়িত হয়েছে, মোবাইলে কত পাপ বিজড়িত কথা বলেছে, কত ভ্রান্ত-বাতিল পরিকল্পনা করেছে! কেউ দেখেনি, কেউ শুনেনি। কারো দেখার বা শুনার অধিকারও ছিল না। আজ কি-না তা বিশ্ববাসীর নিকট ওপেন সিক্রেট! এমন অনিবার্য, অলংঘণীয় কঠিন দিনের উপস্থিতির স্মরণে মুমিন হৃদয় ডুকরে না কেঁদে পারে? যে স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, আমল মানুষকে এমনতর বিপদ ও অপমানের বদ্ধভূমিতে নিক্ষেপ করবে, আমরা তা থেকে হাতজোড় করে আমাদের রবের নিকট পানাহ চাই। আর যে চরিত্র ক্বিয়ামতের দিন মিযানকে হেলিয়ে দিয়ে বান্দার মুখ উজ্জ্বল করবে, অনাবিল জান্নাতী সুখানুভূতিতে অবগাহন করাবে, আমরা সে চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি। আল্লাহ তুমি সহায় হও। আমীন!!

লেখক-শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button