শিক্ষামূলক গল্প

একজন মহিলা ও তার জুতার গল্প

লিখেছেনঃ রিহাব রামাদান

মহিলাটি নিঃশব্দে ট্রেনে উঠে পড়ল; যদি তার চোখে চোখ না পড়ে যেত, আমি বুঝতেও পারতাম না যে তার চোখ ছলছল করছিল। যেকোনো মুহূর্তে সেই অশ্রু যেন ঝরে পড়বে। আমি তার পায়ের দিকে তাকালাম, দেখলাম খালি পা, এক জোড়া জুতা তার হাতে। কোলে কম্বলে মোড়ানো একটি ছোট শিশু; শিশুটি কোন শব্দ করছেনা। মহিলাটি যাত্রীদের কাছে এসে নিচুস্বরে কি যেন বলছিল, কিন্তু তার কথা ফেরিওয়ালার কণ্ঠ ঢেকে দিচ্ছিল। মহিলাটি ট্রেনের এক পাশে আমার কাছাকাছি আসলো। তার পুরনো ব্যবহৃত ক্ষয়ে যাওয়া জুতা জোড়ার দিকে লজ্জিতভাবে তাকিয়ে আস্তে বলল, ‘কারও কি এটা লাগবে? কেউ কি আমার কাছ থেকে জুতা তা কিনবেন?’ সবাই বিব্রতভাবে না করে দিল, কেউ বুঝে পেল না কেনই বা কেউ ব্যাবহার করা, পুরনো, ক্ষয় হয়ে যাওয়া জুতা কিনবে। অন্য একজন মহিলা ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে তাকে দান করতে চাইল। কিন্তু মহিলাটি এমন কিছু গ্রহন করতে অস্বীকার করল; তার ঘুমন্ত শিশুর হাতের মধ্যে দেওয়ার পরও সে তা ফিরিয়ে দিল। সে তখন জুবুথুবু হয়ে পরাজিতের মত ট্রেনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

মহিলাটি তার মুখ এমনভাবে নীচু করে রাখল যেন অন্য যাত্রীরা তার চোখ থেকে গড়িয়ে পরা অশ্রু দেখতে না পায়। তখন একজন মহিলা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল, ‘আমি তোমার কাছ থেকে জুতা জোড়াটা কিনব।’ তখন জুতা হাতে সেই মহিলাটি আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিনবেন, তাইতো? আপনি কিনে নেবেন? দান না তো, আমি কিন্তু ভিক্ষা চাচ্ছি না।’ অন্য মহিলাটি তখন হেসে মাথা ঝাকাল, তারপর বড় একটি নোট তার হাতে গুজে দিয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে চলে গেল।

এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় কুরআনের একটি আয়াত ঘুরতে লাগলোঃ

যারা আল্লাহর পথে অবরুদ্ধ রয়েছে বলে ভূপৃষ্ঠে গমনাগমনে অপারগ সেই সব দরিদ্রদের জন্য ব্যায় কর; (ভিক্ষা হতে) নিবৃত থাকার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অবস্থাপন্ন মনে করে, তুমি তাদেরকে তাদের লক্ষণের দ্বারা চিনতে পার, তারা লোকের নিকট ব্যাকুলভাবে যাচ্ঞা (ভিক্ষা করে না) করে না এবং তোমরা শুদ্ধ সম্পদ হতে যা ব্যায় কর বস্তুতঃ সে সমস্ত বিষয় আল্লাহ সম্যকরূপে অবগত।” [সূরা বাকারাঃ ২৭৩]

আমি জানিনা এই মহিলার ঘটনা কি, টাকাটা তার কেন দরকার, অথবা টাকাটা দিয়ে সে কি করবে; আমি যা জানি তা হল তার চোখে যন্ত্রণার চিহ্ন, তার কাধে যেন অনেক ভারী বোঝার ভার। এই আয়াতটি আমি আগে বহুবার পড়েছি, এই আয়াত নিয়ে বহু আলোচনা শুনেছি, কিন্তু কখনও এই আয়াতের ওজন বুঝিনি; আজ বুঝলাম যখন আমার চোখের সামনে আয়াতটিকে এভাবে জলজ্যান্ত ঘটে যেতে দেখলাম।

আবারও আমার মাথায় নানান কথা ঘুরতে থাকল, এবার হাদিসের কথা। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একজন লোক এসে রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করল, আমি কি আমার উট বেঁধে রাখব আর তারপর আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখব, নাকি উটকে খোলা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখব? উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘তাকে বেঁধে রাখ, এবং সেই সাথে আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখো।’ [তিরমিযী]

মহিলাটির জন্য হাল ছেড়ে দেওয়াই সহজ ছিল, যদি সে এইটা ভাবত যে তার কাছে বিক্রি করার মতও কিছু নেই, কাজেই এমন কোন উপায় নেই যাতে সে কিছু টাকা পেতে পারে। তা সত্ত্বেও সে এই হাদিসটি বাস্তবায়িত করে দেখাল। তার কাছে যাই অকিঞ্চিৎকর ছিল তাই সম্বল করল, যেটা আসলে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে মুল্যহীন ছিল। সে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখল, এবং এমন মুল্য পেল যা সে দর কষাকষি করে কখনই পেতে পারত না। যেমন, আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’আলা বলেনঃ

…যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ সহজ করে দিবেন। আর তাকে তার ধারনাতীত  উৎস হতে দান করবেন রিজিক; যে ব্যাক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, আল্লাহ তার ইচ্ছা পুরন করবেনই, আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।” [সূরা তালাকঃ ২-৩]

ট্রেনের মধ্যে নিজস্ব ব্যাক্তিগত সমস্যা সমাধানে ব্যাস্ত এক অচেনা মহিলা আমাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কত গভীর শিক্ষা দিয়ে গেল। সেই মহিলার হাতে খুব সামান্য কিছুই ছিল, কিন্তু আমি এটা বলতে পারি, তার অন্তর পরিপূর্ণ ছিল। তার কাছ থেকেই আমারা বুঝতে পারি, সব কিছু দেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর- তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী দেন, আমাদের আশা অনুযায়ী নয়। আমরা যদিও ভাবি, কোন পরিস্থিতিতে আমাদের হয়তো তেমন কিছুই করার নেই, আমাদের আবার ভেবে দেখা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাদের সেই সামান্য পুঁজিই আমাদের আশাতীত হারে বহুগুনে বাড়িয়ে দিতে পারেন। এবং সবশেষে আমরা সেই সব অভাবী মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করব যাদের কথা আল্লাহ বলেছেন, তাদের অন্তরের সেই ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্যের কথা ভাবব যেমন এই মহিলাটি দেখিয়েছেন।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button