ইহকাল-পরকাল

পুনরুত্থান

‘পুনরুত্থান’ অর্থ পুনরায় উত্থান, পুনরায় উঠা, পুনঃপ্রাপ্ত জীবন, মৃত্যুর পর পুনঃপ্রাপ্ত জীবন, কবর হ’তে মৃতের উত্থান, পুনরায় জন্ম, নতুন জীবন, শাশ্বত জীবন লাভ ইত্যাদি। মূলতঃ পুনরুত্থানের প্রাথমিক স্তর জন্ম। অর্থাৎ জন্মের পর মৃত্যু আর মৃত্যুর পরে মানুষ পুনরুত্থিত হবে। মানব জাতির জন্য পুনরুত্থানে বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। যারা পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে না তারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতিও বিশ্বাস রাখে না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বিপুলায়তনের নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী  সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাণী। মহান রাববুল আলামীন তাঁর প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতিকে পৃথিবীতে জীবন যাপনের জন্য সাময়িক সুব্যবস্থা করে দিয়েছেন মাত্র। অতঃপর পৃথিবীতে তার নির্ধারিত বয়স শেষ হয়ে গেলে, আল্লাহর আদেশে তার মৃত্যু হবে। অতঃপর ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে এবং সকল মানুষকে বিচারের জন্য পুনরুত্থিত করা হবে। এই পুনরুত্থান আল্লাহ তা‘আলার মহাশক্তির প্রমাণ। এর প্রতি বিশ্বাসীরা হবে সফলকাম। আর এর প্রতি অবিশ্বাসীরা হবে সেদিন চরম ক্ষতিগ্রস্ত। আলোচ্য নিবন্ধে তাই পুনরুত্থান সম্পর্কে মানুষকে সংশোধনের ন্যূনতম চেষ্টা করব।

আসলে উত্থান ও পুনরুত্থানের মূল উপাদান ‘আত্মা’ হ’ল একটা অতি সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য বস্ত্ত, যার হদীছ লাভ করা সমগ্র মানব জাতির পক্ষে অসম্ভব। এর মহানিয়ন্ত্রক হ’লেন আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং। পবিত্র কুরআনে পুনরুত্থানের নিশ্চয়তা প্রদানকারী বহু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। তন্মধ্যে সূরা আর-রূম-এর ১১নং আয়াতে অত্যন্ত সরল ও সহজভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, اللهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ- ‘আল্লাহ প্রথমবার সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিনি পুনরায় সৃষ্টি করবেন। এরপর তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে’।

একই মর্মার্থে আলোচ্য সূরায় মহান আল্লাহ আরো বলেন,

وَلَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَّهُ قَانِتُوْنَ- وَهُوَ الَّذِيْ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ-

‘নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ। তিনিই প্রথমবার সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, অতঃপর পুনর্বার তিনি সৃষ্টি করবেন। এটা তাঁর জন্য সহজ। আকাশ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (রূম ২৬, ২৭)

পুনরুত্থানের বিষয়টিকে আরও সহজভাবে বুঝানোর জন্য মহান আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন, مَا خَلْقُكُمْ وَلاَ بَعْثُكُمْ إِلاَّ كَنَفْسٍ وَّاحِدَةٍ إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ ‘তোমাদের সৃষ্টি ও পুনরুত্থান, একটি মাত্র প্রাণীর সৃষ্টি ও পুনরুত্থানের সমান বৈ নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন’ (লোক্বমান ২৮)

আল্লাহ তা‘আলা হ’লেন দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, পালনকর্তা, রক্ষক ও সর্বময় কর্তা। আর একমাত্র মানব জাতিই এসব কিছু অনুধাবন করার যোগ্য। এদের জন্য একটা আইন-কানূন, একটা নিয়ম-প্রণালী, একটা বিধি-ব্যবস্থা ও একটা নির্ধারিত সময়সূচী রয়েছে। যারা উক্ত বিধি-বিধান ও নিয়ম-প্রণালী অনুযায়ী জীবন-যাপন করবে, তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির আলয় ‘জান্নাত’। পক্ষান্তরে যারা বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তির ব্যবস্থা ‘জাহান্নাম’। অবশ্য শান্তি ও শাস্তি উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ নিরপেক্ষ বিচার করবেন। আর এজন্যই ইহজগতের শেষে পুনরুত্থান ঘটিয়ে বিচারের জন্য সকলকে সমবেত করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيْعًا وَعْدَ اللهِ حَقًّا إِنَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ لِيَجْزِيَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ بِالْقِسْطِ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَهُمْ شَرَابٌ مِّنْ حَمِيْمٍ وَّعَذَابٌ أَلِيْمٌ بِمَا كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ-

‘তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে তোমাদের সবাইকে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, তিনিই সৃষ্টি করেন প্রথমবার, আবার পুনর্বার তৈরী করবেন, তাদেরকে বদলা দেয়ার জন্য, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে ইনছাফের সাথে। আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের পান করতে হবে ফুটন্ত পানি এবং ভোগ করতে হবে যন্ত্রণাদায়ক আযাব, এজন্য যে তারা কুফরী করছিল’ (ইউনুস ৪)

এ সম্পর্কে অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,

أَوَلَمْ يَرَوْا كَيْفَ يُبْدِئُ اللهُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيْرٌ- قُلْ سِيْرُوْا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوْا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ-

‘তারা কি দেখে না যে, আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টিকর্ম শুরু করেন, অতঃপর তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন? এটাতো আল্লাহর জন্য সহজ। বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম’ (আনকাবূত ১৯, ২০)

يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللهُ جَمِيْعاً فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوْا أَحْصَاهُ اللهُ وَنَسُوْهُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ-

‘সেদিন স্মরণীয়, যেদিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন, অতঃপর তাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা তারা করত। আল্লাহ তার হিসাব রেখেছেন, আর তারা তা ভুলে গেছে। আল্লাহর সামনে উপস্থিত আছে সব বস্ত্তই’ (মুজাদালাহ ৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন,

هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُوْلاً فَامْشُوْا فِيْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِّزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ-

‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিযিক আহার কর। তাঁরই কাছে পুনরুজ্জীবন হবে’ (মুল্ক ১৫)

আলোচ্য সূরায় ধর্মভীরু ও মুমিনদের প্রতি লক্ষ্য করে প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, إِنَّ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَّأَجْرٌ كَبِيْرٌ ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তাকে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’ (মুল্ক ১২)

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর বাণী ক্বিয়ামত পর্যন্ত অকাট্য সত্য থাকবে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সর্বোত্তম ও সর্বশেষ নির্দেশাবলী দ্বারা মানুষের প্রথমবার সৃষ্টি, অতঃপর মৃত্যু, অতঃপর পুনর্বার সৃষ্টির ওয়াদা উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া চলমান পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির বস্ত্তগুলি মনোযোগ সহকারে অবলোকন করার কথাও ইঙ্গিত করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ অসংখ্য প্রাণীর জীবন-যাপন বা খাদ্য উপযোগী, অসংখ্য উদ্ভিদরাজি সূর্য কিরণে এক সময় শুকিয়ে বা পুড়ে মৃতপ্রায় হয়ে শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে বৃষ্টির পানিতে সেই মৃত যমীন পুনরায় শস্য-শ্যামল উদ্ভিদে ভরে যায়। এটাও মানুষের পুনরুত্থানের এক বড় নিদর্শন এবং বাস্তব কল্যাণের এক অপূরণীয় অবদান।

মৃত্যুর পর কবর হ’তে পুনরুত্থানের বন্দোবস্ত নিঃসন্দেহে মানব জাতির চিরস্থায়ী কল্যাণের উৎস। তবে সেটা কেবলমাত্র আল্লাহর বিশ্বস্ত বান্দাদের জন্য প্রযোজ্য, অবিশ্বাসীদের জন্য মোটেও নয়। অবিশ্বাসীরা কখনও পুনরুত্থানে বিশ্বাসী নয়, মৃত্যুই তাদের শেষ পরিণতি এবং পুনরুত্থান তাদের জন্য এক অলিক কল্পনার বস্ত্ত। এ বিষয়ে ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্য হ’তে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর সকাল-সন্ধ্যায় জান্নাত কিংবা জাহান্নামস্থ ঠিকানা তার সামনে পেশ করা হয়। আর তাকে বলা হয়, এটাই তোমার বাসস্থান। ক্বিয়ামতে পুনরুত্থান পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকবে’ (বুখারী)। অর্থাৎ প্রত্যেক বান্দাকে কবরস্থ করার পর, পুণ্যবানগণ জান্নাতের খোশখবর পান বা জান্নাতের সাথে তাদের কবরের যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। অপরদিকে পাপীরা জাহান্নামের ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সম্মুখীন হয় বা তাদের কবরের সাথে জাহান্নামের দরজা উন্মুক্ত করা হয়।

অপর এক হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘পৃথিবীতে আগন্তুক অথবা পথিকের ন্যায় জীবন-যাপন কর’। ইবনু ওমর প্রায়ই বলতেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত (বেঁচে) থাকলে সকাল পর্যন্ত (বেঁচে) থাকার আশা কর না। আর সকাল পর্যন্ত (বেঁচে) থাকলে সন্ধ্যা পর্যন্ত (বেঁচে) থাকার আশা কর না এবং সুস্থতা থেকে রোগাক্রান্ত অবস্থার জন্য ও জীবন থেকে মৃত্যুর জন্য পাথেয় সঞ্চয় করো’ (বুখারী)

পবিত্র কুরআন ও হাদীছের এসব বাণী সমূহ অবগতির পরও অনেক বান্দা শয়তানের প্ররোচনায় ও নফসের প্রভাবে পুনরুত্থানের প্রতি অবিশ্বাসীই থেকে যায়। আল্লাহ তা‘আলা এদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন যে, زَعَمَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَن لَّنْ يُّبْعَثُوْا قُلْ بَلَى وَرَبِّيْ لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيْرٌ- ‘কাফেররা দাবী করে যে, তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। বলুন, অবশ্যই হবে, আমার পালনকর্তার কসম, তোমরা নিশ্চয়ই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমাদেরকে অবহিত করা হবে যা তোমরা করতে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (তাগাবুন ৭)

পুনরুত্থান বিষয়ে কাফেরদের ধারণা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

قَالُوْا أَئِذَا كُنَّا عِظَامًا وَّرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوْثُوْنَ خَلْقًا جَدِيْدًا- قُل كُوْنُوْا حِجَارَةً أَوْ حَدِيْداً- أَوْ خَلْقاً مِّمَّا يَكْبُرُ فِيْ صُدُوْرِكُمْ فَسَيَقُوْلُوْنَ مَنْ يُّعِيْدُنَا قُلِ الَّذِيْ فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ فَسَيُنْغِضُوْنَ إِلَيْكَ رُؤُوْسَهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ مَتَى هُوَ قُلْ عَسَى أَنْ يَّكُوْنَ قَرِيْباً- يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيْبُوْنَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّوْنَ إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلاَّ قَلِيْلاً-

‘তারা বলে, যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হব? বলুন, তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্ত্ত, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন, তথাপি তারা বলবে, আমাদেরকে পুনর্বার কে সৃষ্টি করবে? বলুন, যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, এটা কবে হবে? বলুন, হবে সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই। সেদিন তিনি তোমাদেরকে আহবান করবেন। অতঃপর তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে চলে আসবে এবং তোমরা অনুধাবন করবে যে, সামান্য সময়ই (পৃথিবীতে) অবস্থান করেছিলে’ (বানী ইসরাঈল ৪৯-৫২)

কাফেরদের সম্বন্ধে মহান আল্লাহ অন্যত্র আরও বলেন,

وَأَقْسَمُوْا بِاللهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ لاَ يَبْعَثُ اللهُ مَنْ يَّمُوْتُ بَلَى وَعْداً عَلَيْهِ حَقًّا وَلـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ- لِيُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِيْ يَخْتَلِفُوْنَ فِيْهِ وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّهُمْ كَانُوْا كَاذِبِيْنَ-

‘তারা আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে যে, যার মৃত্যু হয় আল্লাহ তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন না। অবশ্যই এর পাকাপোক্ত ওয়াদা হয়ে গেছে, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। তিনি পুনরুজ্জীবিত করবেনই, যাতে যে বিষয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল তা প্রকাশ করা যায় এবং যাতে কাফেররা জেনে নেয় যে, তারা মিথ্যাবাদী ছিল’ (নাহল ৩৮-৩৯)

মানব সৃষ্টির ইতিকথার বিবরণগুলি পর্যালোচনা করলে একমাত্র মানুষকেই সর্বশ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান, চিরজীবি ও আল্লাহর নিকটতম প্রাণী হিসাবে পাওয়া যায়। এ নশ্বর পৃথিবীতে মানুষের আগমন, বিচরণ ও মৃত্যুবরণ মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার মহাক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং মানুষের জ্ঞান আহরণের কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই মানুষকে কিছু সময়ের জন্য এ নশ্বর পৃথিবীতে প্রেরণ করেন, তাদের ভাল ও মন্দ কাজের হিসাব রাখেন, মৃত্যু ঘটান। অতঃপর পুনরুত্থানের মাধ্যমে অনন্ত জীবন দান করার ওয়াদা পূর্ণ করবেন। কিন্তু এই সুপ্রতিষ্ঠিত মহাসত্যের অভ্যন্তরে বিশৃংখলা ও অরাজকতা সৃষ্টির ধারণা নিয়ে শয়তানের আবির্ভাব হয়। শয়তান তার মিথ্যা ভাষণ ও শপথ দ্বারা প্রথম অভিযানেই সাফল্য অর্জন করে। অতঃপর ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান মজবুত করে নেয়। অথচ সে সর্বজন পরিচিত এক মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কিছুই নয়। শয়তান আবহমানকাল ধরে তার বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, চাতুর্যপূর্ণ যুক্তি, কূটকৌশল, মিথ্যার আশ্রয় দ্বারা মানুষের মাঝে বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়ে বিশ্বাসীর ভূমিকা পালন করে। শয়তানের এই অসামান্য প্রচেষ্টা তার শিষ্যবর্গের দ্বারা সাধারণ্যে সম্প্রচারিত হয় এবং কাফের সম্প্রদায়ের প্রসার ঘটে এবং তারা ইসলাম ধর্মের অন্যান্য বিধানাবলীর সঙ্গে পুনরুত্থানকেও অবিশ্বাস ও অস্বীকার করে। পুনরুত্থানের প্রতি কাফের সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, পুনরুত্থান হবেই। আর মানব জাতিকে চিরজীবন বা অনন্ত জীবন দানের জন্য পুনরুত্থানের ব্যবস্থা।

পুনরুত্থানের ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,

وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَإِذَا هُمْ مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُوْنَ- قَالُوْا يَا وَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَّرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُوْنَ- إِنْ كَانَتْ إِلَّا صَيْحَةً وَّاحِدَةً فَإِذَا هُمْ جَمِيْعٌ لَّدَيْنَا مُحْضَرُوْنَ-

‘সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল? রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন। এটা তো হবে কেবল এক মহা নাদ। সে মুহূর্তেই তাদের সবাইকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে’ (ইয়াসীন ৫১-৫৩)

পুনরুত্থান সম্পর্কে অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, يَوْمَ نَطْوِي السَّمَاءَ كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيْدُهُ وَعْداً عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِيْنَ- ‘সেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব, যেমন গুটানো হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমাকে তা পূর্ণ করতেই হবে’ (আম্বিয়া ১০৪)

এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَّنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُّحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيْمٌ- قُلْ يُحْيِيْهَا الَّذِيْ أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَّهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيْمٌ- ‘মানুষ আমার সম্পর্কে এক অদ্ভূত কথা বর্ণনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়। সে বলে, কে জীবিত করবে অস্থি সমূহকে যখন সেগুলো পচে-গলে যাবে? বলুন, যিনি প্রথমবার সেগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই জীবিত করবেন। তিনি সর্বপ্রকার সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (ইয়াসীন ৭৮-৭৯)

পবিত্র কুরআনে মানুষের প্রথম সৃষ্টি এবং কবর হ’তে পুনরুত্থান উভয় সৃষ্টিকেই একটা পরিপূর্ণ ও সমান সৃষ্টিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে প্রথম সৃষ্টির একটা সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা আছে। পুনরুত্থান বা দ্বিতীয় সৃষ্টিতে তা নেই, এটা পুনরুত্থান। হঠাৎ করে ও একই সময়ে সুসম্পন্ন হবে। সিংগায় ফুঁক দেওয়ার পরপরই পুনরুত্থান হবে। অবশ্য সিংগায় প্রথম ফুঁকে পৃথিবীর সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর সিংগার দ্বিতীয় ফুঁকে কবরস্থ সহ সকল মানব জীবিত হয়ে মহিমাময় আল্লাহর দিকে ছুটে চলবে।

মৃত্যু মানব জীবনের একটি সাময়িক বন্দোবস্ত মাত্র। অতঃপর পুনরুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ জীবনের সূচনা। অবশ্য মৃত্যু ও পুনরুত্থান একটি অপরটির পরিপূরক। আবার মৃত্যুর বিভীষিকায় পুণ্যবানগণ কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়নি, পুনরুত্থানেও তাদের সামনে কোন সমস্যা উত্থাপিত হবে না। কিন্তু পাপী মৃত্যুর বিভীষিকায় পুরোপুরি আক্রান্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়। পুনরুত্থানেও তাদের জন্য এক ভয়াবহ ও লোমহর্ষক পরিণতি অপেক্ষা করছে। আর চূড়ান্ত ফায়ছালা হবে ক্বিয়ামতের মহাবিচারালয়ে।

আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনের কঠিন স্তরগুলি অতিক্রম করার জন্য তাঁর বিধান ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপনের আদেশ করেছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালনের ক্ষেত্রে অন্য কোন যুক্তি বা ধারণার অবতারণাই অযৌক্তিক। তাই পুণ্যবানদের জন্য পুনরুত্থান ও ক্বিয়ামত হবে সর্বোত্তম কল্যাণ লাভের প্রবেশ দ্বার। অপরদিকে অপরাধী ও পাপীদের জন্য উক্ত প্রবেশ পথ হবে অকল্যাণের দ্বার।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে পুনরুত্থানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে তার অকল্যাণ হ’তে আত্মরক্ষা করার তওফীক্ব দান করুন-আমীন!

– রফিক আহমদ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button