মুক্তবাসিনী

অনিরাপদ মাতৃক্রোড়

৫ই জুলাই জন্ম দিবস[1]। জন্মদিবসে বাবার কাছে ছোট্ট বাইসাইকেল দাবি করে রেখেছে শিশু সামিউল। বয়স মাত্র পাঁচ। জন্মদিনকে ঘিরে আবেগে-অনুভূতিতে হৃদয়টা নাচছে তার। কিন্তু সেই জন্মদিন ফিরে আসেনি সামিউলের, আসবেও না আর কোনও দিন। কেননা, মায়ের পরকীয়া কেড়ে নিয়েছে তার নিরাপরাধ জীবন। কেড়ে নিয়েছে জন্মদিনে কেক কাটার স্বাদ।

ঘটনাটা ২০১০ইং সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহ। আদাবর থানা এলাকা। ২৪ই জুন বৃহস্পতিবার নবোদয় হাউজিংয়ের একটি প্লটে লাশ পাওয়া  যায় শিশু সামিউলের। ঘটনার বীভৎসতায় চমকে ওঠেন সবাই। ঘটনা ও ঘটনার কুশীলবদের কাহিনী শুনুন আগে :

এই ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বেশ কিছু দিন আগে নাদিরা জামান সাথী নামের এক মহিলা রেডিও আমার-এর ‘আমার ভালোবাসা’ অনুষ্ঠানে একটি লাইভ সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারে অশ্রুসিক্ত হন তিনি নিজে এবং অশ্রুসিক্ত করেন অসংখ্য শ্রোতাকে। তার কষ্টের কথা, দুঃখ ও আবেগের কথা শ্রবণ করে কাঁদেন নি সম্ভবত এমন শ্রোতার সংখ্যা খুব বেশি হবে না।

সেই সাক্ষাতকারে তিনি হুমায়রা আক্তার এশার সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়ার কথা উল্লেখ করেন। সাক্ষাৎকারে তিনি কয়েকবার রেডিওর মাধ্যমে এশার কাছে অনুরোধ করেন, যেন তার স্বামীকে সে ফিরিয়ে দেয়। তার আবেদনের ভাষা শুনে সেদিন বহু শ্রোতা চোখের অশ্রু ফেলেছিল, কেঁদেছিল সহমর্মিতায়।

পুরো ঘটনাটা শুনুন :

নাদিরা জামান সাথী বলেন, আমার সঙ্গে শামসুজ্জামানের পরিচয় হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আট বছর আগে। অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা শামসুজ্জামান আরিফ নামের লোকটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম দেড় বছর ফোনেই প্রেম। নতুন মোবাইল ব্যবহারকারী হিসেবে কথা বলতে-বলতে প্রেম। দেড় বছর গত হয়ে গেলে দুজন দুজনকে দেখার জন্য উদগ্রীব ও ব্যগ্র হয়ে উঠি। সেই ব্যগ্রতা থেকেই কথামতো শাহবাগ মোড়ে দেখা। মোবাইলের আরিফের সঙ্গে বাস্তব সুমনের মিল পাওয়া গেল না। কারণ, মোবাইলে শোনা আরিফের কণ্ঠস্বর সুন্দর হলেও দেখতে সুন্দর নন তিনি। তাই বাসায় ফিরে এসে অনেকক্ষণ কাঁদি।

তার পরও সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। তখন আমার বয়স মাত্র বাইশ। যদিও এর আগে আমার একটি বিয়ে হয়েছিল। সেখানে বনিবনা না হওয়ার কারণে বিয়ে ভেঙে যায়। আরিফ তা জেনেই আমাকে বিয়ে করে। বিয়ের আগে জানতে পারি, সে বিবাহিত। এটা ছিল দ্বিতীয় আঘাত। কিন্তু এতদূর যাওয়ার পর ফিরে আসারও পথ খোলা ছিল না। তাই নিজের দ্বিতীয় বিয়ে হয় আরিফের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবেই। বিয়ের পর কিছুটা অবহেলিত অবস্থাতেই বসবাস শুরু হয় মোহাম্মাদপুরের ভাড়া বাসায়। প্রেম দিয়ে শুরু করা বিয়েতে একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। প্রথম আঘাতটা আসে আরিফের প্রথম স্ত্রীর পক্ষ থেকে। মোহাম্মাদপুরে যেখানে থাকতাম, একদিন আরিফের প্রথম স্ত্রী সেখানে হাজির হয়ে তাকে মারধর করে। স্ত্রীর কাছে ধরা খাওয়ার পর আরিফ জানায়, এই বাসা বদলাতে হবে। সতীনের রুদ্রমূর্তি দেখে আমি নিজেও ভয় পেয়ে যাই। তাই আরিফের কথামতো বাসা বদলিয়ে নতুন বাসা নিই শ্যামলীর নবোদয় হাউজিংয়ে। কিন্তু বাসা বদলালেও প্রথম স্ত্রীর নির্যাতন থেকে আরিফ রেহাই পাচ্ছিল না। স্ত্রীর চাপে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে আরিফ তার টঙ্গীর জায়গা প্রথম স্ত্রীর নামে লিখে দেয়। এর পরেও আরিফের সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপড়েন চলতে থাকে।

সাথী জানান, একপর্যায়ে আরিফ বড় বউয়ের কথামতো আদালতে গিয়ে তাকে তালাকও দিয়ে দেয়। কিন্তু তিনি অন্তঃসত্তা হওয়ার কারণে তালাক কার্যকর হয় নি (উল্লেখ্য, এটা ইসলামী বিধান নয়। কারণ, ইসলামী বিধানমতে স্ত্রী অন্তঃসত্তা হলেও তালাক কার্যকর হবে, তবে ইদ্দতে থাকাকালীন অন্য কারও সাথে বিয়ে বসতে পারবে না)।

আদালতের কারণে সাথীকে বিতাড়িত করতে না পেরে আরিফের প্রথম স্ত্রীর ক্রোধ যেন আগুনে পরিণত হয়। তাই তার প্ররোচনায় সাত মাসের অন্তঃসত্তা অবস্থায় আরিফ তাকে হত্যারও চেষ্টা করেছিল। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে- نِعْمَ الْحَارِسُ الاَجَلُ  ‘সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রহরী হচ্ছে মানুষের মৃত্যুভাগ্য।’ অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর নির্ধারিত দিনক্ষণই তাকে অপমৃত্যু থেকে পাহারাদারী করে রক্ষা করে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যুর সময় না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ তাকে মারতে পারে না। সাথীর ক্ষেত্রে এই প্রবাদ একশ ভাগ সত্য প্রমাণিত হলো। আরিফ তাকে হত্যা করার চেষ্টা করলেও সাথীর ‘আজাল’ তাকে এই অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে।

পরিকল্পনা ভেঙে যাওয়ার এক বছর পর আরিফ তা স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। সাথী নিজের সম্পর্কে জানান, ছোট একটি ভাই বাদে সংসারে আরও আছেন তার মা। বাবা থেকেও নেই। তবে তারা কেউই তার খোঁজখবর নেন না। আর স্বামী আরিফের আপন পাঁচ ভাই। নুরুজ্জামান নামের এক দেবরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রেডিওতে সাক্ষাতকার দিতে যান।

এশার সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়ার সূত্রপাত সম্পর্কে সাথী বলেন- বিউটি পার্লার দিয়েছিলাম ব্যবসার জন্য। এ পার্লারের কারণেই আমি আজ স্বামীহারা। আয়শা হুমায়রা এশা নামের প্রতিবেশী এক কাষ্টমার একপর্যায়ে আমার বান্ধবী হয়ে যায়। দ্রুত আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। এশার বাড়ি চট্রগ্রামে। বাবা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে তার মায়ের বনিবনা না হওয়ার কারণে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এশা ও তার ভাই আকিব ও আলফিকে নিয়ে তার মা এক ডাক্তারকে বিয়ে করেন। এশার স্বামী আজম ওরফে রোজের বাড়ি রাজবাড়ির মাছবাড়িতে। সাথী বলেন, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হওয়ায় এশার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। আলোচনায় থাকত নানা অন্তরঙ্গ কথাও। এসব অন্তরঙ্গ আলোচনার এক পর্যায়ে এশা মুখ ফসকে বলেই ফেলল, সে পরকীয়া প্রেমে জড়াবে! তার স্বামীর কিছু (শারীরিক) সমস্যাও ছিল। আমার স্বামী কী পারে না পারে এসব বিষয়ে আমি আলোচনা করতাম (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীসুলভ দাম্পত্য বিষয়)। দেখতাম, এশা এতে বেশ আগ্রহ দেখায় এবং কৌতূহল অনুভব করে। স্বামীর শারীরিক সমস্যাই হয়ত তাকে অন্যের স্বামীর ব্যাপারে উৎসাহী এবং পরকীয়ায় জড়ানোর প্রতি অনুপ্রাণিত করত। কিন্তু তাই বলে যে সে আমার স্বামীর সঙ্গেই পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়বে, তা ভাবতে পারিনি কখনও।

আমার বাচ্চার জন্মদিনে এশা আসত। অনেক কাজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ হত, আড্ডা দেয়া হতো। ব্যবসায়িক কারণে টাকা লেনদেনের সময় আরিফের সঙ্গে এশার পরকীয়ার ব্যাপারটি বুঝতে পারি নি। এরপর নবোদয় হাউজিং থেকে মালেক সাহেবেরে বাড়িতে বাসা স্থানান্তর করি। বাসা বদলের পর এশার সঙ্গে আরিফের পরকীয়ার ব্যাপারটি আমারে নজরে আসে। তারপর লোকমুখেও শুনতে পাই তাদের গোপন সম্পর্কের কথা। বেড়াতে যাওয়া, নগদ তিন লাখ টাকা লেনদেন ইত্যাদি তথ্য আমার কাছে প্রকাশিত হয়।

টাকা লেনদেনসহ আরিফের সঙ্গে এশার ঘনিষ্ঠতার কথা তার স্বামী আজম ভাইকে বলেও কাজ হয় নি। আজম ভাইয়ের নিরুত্তাপ ভাব এবং ব্যবস্থা না নেয়া দেখে এশার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিও মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে যাই। এরপর নানা রকম তথ্য পেয়ে একদিন এশার স্বামী এবং নীলা ও ননী নামের তার দুই বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হই। এমনকি এশার সঙ্গে জুতা মারামারি পর্যন্ত হয়। এ সম্পর্ক নিয়ে অনেক সিনক্রিয়েট হয়েছে, আরিফ অনেকবার কুরআন ছুঁয়ে শপথও করেছে। তাতেও কাজ হয়নি। এশার স্বামী আজম ভাইকে তার শারীরিক সুস্থতার জন্য ডাক্তার দেখাতে বলেছি, যাতে তিনি এশার চাহিদা পূরণ করতে পারেন।

সাথী আরো বলেন, আরিফ ব্যবসার পাশাপাশি ইলেকট্রিক মিটার ট্যাম্পারিংয়ের কাজ করত। একাজে সে মাঝে-মধ্যেই ভৈরব যেত। অনেকদিন এশা তার সঙ্গে ভৈরব গেছে বলে জানতে পেরেছি। এশার ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, দুনিয়ায় হয় ও থাকবে, না হয় আমি থাকব। হয় ও মরবে, না হয় আমি মরব। আমি অসহায়। আমার শিক্ষা কম। এশাকে কতবার বলেছি, আমার স্বামীটাকে আমাকে ভিক্ষা দাও। আমার কাছে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। পৃথিবীতে এর চেয়ে হৃদয়বিদারক আবেদন আর কী হতে পারে যে, একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ভিক্ষা হিসেবে মাঙবে অন্য একজন নারীর কাছে?

কিন্তু এমন একটি আকুল আবেদনেও কাজ হয় নি। মন গলে নি এশার। পিছু ছাড়ে নি সে আরিফের। তাই একপর্যায়ে হতাশ হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। কিন্তু যেকোনও কারণে হোক, তাতেও সফল হতে পারি নি। অবশেষে নিজ স্বামীকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করি। কিন্তু এই প্রচেষ্টায় সফলতা পাওয়ার আশা করা ছিল বাতুলতা মাত্র। আরিফ প্রথম বিয়ে করেছে ভালোবেসে। আমাকেও বিয়ে করেছে ভালোবেসে। এখন আবার এশার সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত! এশাকেও এবিষয়টি বুঝিয়েছি। তাকে বুঝিয়েছি, আজ তোমাকে ভালোবাসার প্রলোভন দেখাচ্ছে, কাল তোমার সামনে অন্যকে প্রলোভন দেখাবে না, এর কোনও নিশ্চয়তা আছে? কিন্তু সে কিছুতেই দমেনি। কানে তোলেনি এসব অকাট্য যু্ক্তি। যে কোনও মূল্যে সে আমার স্বামী আরিফকে পেতে চেয়েছে।

আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে এশার পিছনে পড়ল কেন তা বুঝতে চেষ্টা করেছি। সে কি আমার চেয়ে সুন্দরী? আমি অনেক সময় রাস্তায় নেমে মানুষকে বলতাম, আচ্ছা ভাই, বলুনতো আমি কি অসুন্দর? পাগলের মতো আমি বহুদিন রাস্তায় নেমে এ ধরনের কথা বলেছি।

শুনেছিলাম ইয়াবা খেলে মানুষ সুন্দর হয়। আমি আরও সুন্দর হওয়ার জন্য কিছুদিন ইয়াবা খেয়েছিলাম। আরিফ এশাকে নিয়ে অন্য কোথাও ইয়াবা খায় শুনে আমারও আগ্রহ বেড়েছিল এ ব্যাপারে। তাই তাকে আটকানোর জন্য শেষ পর্যন্ত ইয়াবা ধরেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি।

আমি ভাবতাম, এশাতো আমার চেয়ে সুন্দরী নয়। তাহলে কেন আমার স্বামী তার পিছু নিল? তাই স্বামীর সামনে নিজেকে আরও সুন্দর করে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই এই সর্বনাশা ইয়াবা ধরেছিলাম। শুধু তা-ই নয়, আমি বহুদিন রাস্তায় নেমে পাগলের মতো প্রলাপ বকেছি এবং রাস্তার মানুষকে থামিয়ে থামিয়ে বলেছি, আচ্ছা ভাই, বলুনতো আমি সুন্দরী না! আমার জীবনটা ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেছে। শেষবারের মতো আবার আমি এশার কাছে আমার স্বামীটাকে ভিক্ষা চাই। এশা! তোমার সম্পদ-বিত্ত সবই আছে। আছে ফ্লাটবাড়ি। কিন্তু দেখ, আমার কিছুই নেই। স্বামী হারালে দুটি সন্তান নিয়ে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো?

এই হলো সাথীর দেয়া নিজের সাক্ষাতকার। এবার ঘটনা বিশ্লেষণে আসুন :

পরিচয় থেকে প্রেমালাপ এবং শেষে গভীর প্রেম। দুজন দুজনকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা। দেখা করার স্পট শাহবাগ। কথামতো দুজন দুজনকে দেখা। ভালোবাসার মানুষ আরিফ তথা শামসুজ্জামান বাক্কুকে দেখে প্রথমে হকচকিয়ে যান সাথী। চেহারা ও বয়স তাকে মর্মাহত করে। তবু ভালোবাসার মর্যাদা দিতে গিয়ে তিনি তার সম্পর্ক অটুট রাখার ঘোষণা দেন। প্রথম সাক্ষাতে আরেকটি বিষয় জানতে পারেন সাথী, শামসুজ্জামান বিবাহিত। ঘরে তার জ্বলজ্যান্ত স্ত্রী ও ছেলেসন্তান আছে। আরও মর্মাহত হন সাথী। ভালোবাসার তাগিদে এটাও মেনে নিতে হয় তাকে। তাছাড়া সাথী সুন্দরী হলেও তিনিও আগে অন্যের ঘর করে এসেছেন। তাই এবিষয়টাও মাথায় থাকে তার এবং একারণে সতীনের ঘর করতে রাজি হতে হয় তাকে।

এভাবে বেশ কিছুদিন গড়াবার পর শামসুজ্জামানকে বিয়ে করেন সাথী। মুখোমুখি হন এক তিক্ত অভিজ্ঞতার। প্রথম স্ত্রী তাকে নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত করে। এটাও মেনে নেন সাথী। মোটকথা, নতুন সংসার আর ভাঙতে চান না বলে সব অপ্রিয়তাকে মাথা পেতে বরণ করে নেন তিনি। অনেক যুদ্ধ-সংগ্রাম করে এগিয়ে নিয়ে যান সংসার। এরই মধ্যে মতিগতি পরিবর্তন হয় শামসুজ্জামানের। প্রথম স্ত্রীর যোগসাজশে একবার সাথীকে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করেন। কোনো মতে সেবার বেঁচে যান সাথী। এভাবে আরও অনেকবার মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছেন।

সাথী বাস করতেন আদাবরে। প্রথম স্ত্রী ও তার ছেলে-সন্তান থাকায় সংসার চালাতে বেগ পেতে হয় শামসুজ্জামান বাক্কুকে। সাথী এখানে জোর খাটাতে পারেন না। কেননা, একে তো স্বামীর দ্বিতীয় ঘর, তারপর আবার তিনি নিজেও স্বামীফেরত। তাই সংসারে গতি আনতে এবং নিজের প্রয়োজন পূরণ করতে উদ্যোগী হন। আদাবরে শ্রাবণী বিউটি পার্লার নামে একটি বিউটি পার্লার শুরু করেন। নিজেই ছিলেন বিউটিশিয়ান। নিজ পার্লার আর নিজেই পরিচালনায় বেশ ভালোই চলছিল পার্লার। পার্লারসূত্রেই পরিচয় ঘটে এশার সঙ্গে। এশা পার্লারে আসত সাজুগুজো করার জন্য। এই সূত্রে সাথীর সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। তাদের বন্ধুত্ব বেশ জমে ওঠে এক সময়। এশা ধনাঢ্য স্বামীর স্ত্রী। হাত ভরে টাকা থাকত তার। সাথী মাঝেমধ্যে তার দ্বারা উপকৃত হতেন। বিশেষ করে সাথীর স্বামী যখন তেজগাঁওয়ে জামান প্লাষ্টিক কারখানা স্থাপন করে তখন এশার বেশি স্বরণাপন্ন হন তিনি। তার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা এনে স্বামীর হাতে তুলে দেন সাথী। আর এ সময়েই সাথীর স্বামী সম্পর্কে ধারণা পান এশা। সাথী এশার কাছে তার স্বামীর খুব প্রশংসা করতেন। তার পৌরুষের কথা চিবিয়ে বর্ণনা করতেন। এতে এশার মন হাহাকার করে ওঠে। কারণ, সাথীর বর্ণনা অনুযায়ী এশার স্বামী তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারতেন না। এখানেই মারাত্মক ভুলটা করেন সাথী। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে :

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : لاَ تُبَاشِرُ الْمَرْأَةُ الْمَرْأَةَ حَتَّى تَصِفَهَا لِزَوْجِهَا كَأَنَّمَا يَنْظُرُ إِلَيْهَا –

কোনও নারী যেন কোনও নারীর সঙ্গে একসঙ্গে শয়ন না করে অতপর এমনভাবে স্বামীর কাছে অপরজনের বিবরণ না দেয়, যেন স্বামী তাকে স্বচক্ষে দেখছে। [তিরমিযী : ২৭৯২]

এই হাদীসে অন্যের কাছে নিজ স্বামীর বিবরণ কিংবা কোনও পুরুষের কাছে নিজ স্ত্রীর বিবরণ দিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা নারী পুরুষের সম্ভ্রম রক্ষার নিরাপদ পরামর্শ। কিন্তু এখানে ভুল করেছিলেন সাথী। বান্ধবী এশার কাছে তিনি মন খুলে স্বামীর বিবরণ দিয়েছিলেন, স্বামীর পৌরুষের কথা রঙ চড়িয়ে বয়ান করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এশার নারীমন তখন পরপুরুষের জন্য হাহাকার করে উঠত। এই দুর্বলতার সুযোগে হয়ত নিজের অজান্তেই তিনি শামসুজ্জামানের প্রতি দুর্বল হতে থাকেন।

হাদীসে নিজ স্বামী কিংবা নিজ স্ত্রীকে নিরাপদ রাখার যে পন্থা বাতলে দেয়া হয়েছিল, তাতে কমতি করায় সূচনা ঘটে এশা, সাথী ও আরিফের পতনের। কারণ, সাথীর বর্ণনা অনুযায়ী আরিফ মোটেও সুদর্শন কোনও ব্যক্তি নয়। তাছাড়া বয়সটাও তো কম হলো না। তাই তার প্রতি এশার দুর্বল হওয়ার মূল কারণ তার স্বামীর ফিজিক্যালি সমস্যা। যে সমস্যার দৃশ্যপট এশাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সাথী নিজে। আর এশাও এখানে শরীয়ত ও দেশীয় আইনের লঙ্ঘন করেছেন। কারণ, বাংলাদেশের নিকাহ রেজিস্ট্রি আইনের ১৮ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনও স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম হলে সে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে। শর‘ঈ বিধানও এরূপ।

একবার রিফাআ নামক এক সাহাবীর স্ত্রী স্বামীর অক্ষমতার অভিযোগ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হলে তিনি তাকে এই অক্ষম স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার  অনুমতি দিলেন। তবে সেই সঙ্গে একথাও বললেন যে, তুমি তোমার এই স্বামীকে বর্তমান রেখে তা করতে পারবে না। অর্থাৎ একজনের ঘাড়ে থেকে অন্যজনের মাধ্যমে কামনা পূরণ করার সুযোগ নেই। নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রথম স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তবেই পরবর্তী কোনও স্বামীর কাছে যাওয়া যাবে। কিন্তু এশা-সাথীদের বেলায় শরীয়তের এসব মৌলিক বিধানগুলো পালিত হয়নি বলে দুঃখ ও পতন নেমে এসেছে পদে-পদে। পরকীয়া সাধন পূরণ করতে গিয়ে এশা হত্যা করেছেন পাঁচ বছরের নিষ্পাপ সন্তানটিকে। তার অপরাধ একটাই। সে আরিফের সঙ্গে মা এশাকে অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখে ফেলেছিল! এশা কথাটা আরিফ ওরফে বাক্কুকে বারবার বলতও। সে বলত, আমাদের জন্য সামিউল হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে! তাকে দুনিয়া…

যেই ভাবা সেই কাজ। মায়ের অবৈধ প্রেম বৈধ সন্তান সামিউলকে পাঠিয়ে দিল এমন এক জগতে, যেখান থেকে সে আর মায়ের অবৈধ প্রণয়ের রাজসাক্ষী হয়ে তাদের বিঘ্ন ঘটাবে না কোনোদিন। মা থাকবেন না সন্তানকে নিয়ে শঙ্কিত। সামিউলের সবচেয়ে বড় দুঃখটা বোধ হয় জন্মদিনে ছোট্ট সাইকেলটা না পাওয়া! একটি শিশুর কাছে খেলনার বস্তুর চেয়ে প্রিয় আর কী হতে পারে!


[1] যদিও ইসলামে জন্মদিবস পালন সমর্থিত নয়। [সম্পাদক]

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button