আলোচনা-সমালোচনা

আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৪)

পূর্বের অংশ: আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৩)

যরূরী জ্ঞাতব্য :

সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এই বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, ইমাম মুসলিম উদ্ধৃত উক্ত হাদীছগুলির পর ৭০১৪ নং হাদীছটিأَبُو طَلْحَةَ الرَّاسِبِيُّ، عَنْ غَيْلَانَ بْنِ جَرِيرٍ، عَنْ أَبِي بُرْدَةَ সনদে উল্লেখ করেছেন। যার শব্দগুলি কিছুটা ভিন্ন। আর এতে অর্থগত নাকারাতও[1] রয়েছে। ইমাম বায়হাক্বী এই বর্ণনাকে যঈফ বলেছেন। হাফেয যাহাবী ও হাফেয ইবনু হাজারও আবূ ত্বালহা আর-রাসিবীর কারণে এর সমালোচনা করেছেন। শায়খ শু‘আইবও এই সমালোচনাটি মুসনাদের টীকায় (৩২/২৩২) উল্লেখ করেছেন। এমনকি শায়খ আলবানী (রহঃ)ও সিলসিলা যঈফা গ্রন্থে (হা/৫৩৯৯) একে ‘শায’ আখ্যা দিয়েছেন। সেখানে ছহীহ মুসলিমের উপরোল্লিখিত হাদীছের সেই ব্যাখ্যাটিও উল্লেখ করেছেন, যেটি ইমাম বায়হাক্বীর সূত্রে শায়খ শু‘আইব উল্লেখ করেছেন।

সম্মানিত পাঠকদের প্রতি আবেদন রইল যে, শায়খ শু‘আইবের সেই ব্যাখ্যাগুলিকে সামনে রেখে গভীরভাবে ভাবুন যে-

(১) শায়খ শু‘আইব ছহীহ মুসলিমের (হা/৭০১১-৭০১৩) উক্ত হাদীছটিকে যেটি আমরা উপরে উল্লেখ করেছি, মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ছহীহ হিসাবে মেনে নিয়েছেন কি-না?

(২) তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, এই হাদীছটি মূলতঃ ‘আমার উম্মাত রহমতপ্রাপ্ত উম্মত’-এর অংশ। বরং ইমাম মুসলিম সেখান থেকে এই অংশটি চয়ন করেছেন। তার বাক্যগুলি পড়ুন-[2]

والظاهر أن مسلما انتقاه من الرواية المطولة، التي فيها زيادة: إن أمتي أمة مرحومة، جعل اللهُ عذابَها بأيديها

যখন তার নিকটেই এই বিষয়টি স্বীকৃত, তাহ’লে এখন এক অংশকে স্বীকার করা এবং অন্য অংশকে অস্বীকার করার অর্থ কি দাঁড়ায়? বিশেষতঃ যখন এর ‘শাহেদ’ (সমর্থক হাদীছ) এবং হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর বক্তব্যও এর সমর্থক।

(৩) ছহীহ মুসলিমের বর্ণনা যেটাকে শায়খ শু‘আইব মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ছহীহ এবং তার রাবীদেরকে বুখারী ও মুসলিমের রাবী বলেছেন, ইমাম বুখারীর নিকটে তো সেটাও ত্রুটিযুক্ত। আর এর বিপরীতে শাফা‘আতের হাদীছগুলি أكثر وأبين وأشهر অর্থাৎ অধিক সংখ্যক, সুস্পষ্ট ও অধিক প্রসিদ্ধ। তাহ’লে এই হাদীছটি অধিক ও প্রসিদ্ধ বর্ণনাগুলির ভিত্তিতে শায়খ শু‘আইবের নিকটে ত্রুটিযুক্ত নয় কেন?

(৪) ছহীহ মুসলিমের এই হাদীছটি এবং শাফা‘আতের হাদীছগুলির মধ্যে যখন সমতা বিধানের অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে এবং সেই সমতা বিধানকে শায়খ শু‘আইব গ্রহণ করেছেন, তখন এটা ও এটা ব্যতীত সমতা বিধানের অন্যান্য পন্থাগুলি ‘আমার উম্মত রহমতপ্রাপ্ত উম্মত’ এবং শাফা‘আতের হাদীছগুলির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয় কেন? বিশেষভাবে যখন শায়খ শু‘আইব ছহীহ মুসলিমের হাদীছটিকে ‘আমার উম্মত রহমতপ্রাপ্ত উম্মত’ হ’তেই গৃহীত বলে স্বীকার করছেন।

(৫) ইমাম বায়হাক্বী তো ছহীহ মুসলিমের হাদীছের মধ্যে যে অর্থগত জটিলতা ছিল তাকে ‘আমার উম্মত রহমতপ্রাপ্ত উম্মত’-এর সাথে সম্পর্কিত মনে করেন। যেটা শায়খ শু‘আইব নিজেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শায়খ শু‘আইব তো এই হাদীছটিকে ছহীহ হিসাবে মেনে নিতে রাযী নন। কিন্তু কেন?

(৬) শায়খ শু‘আইব ‘আমার উম্মত রহমতপ্রাপ্ত উম্মত’ শীর্ষক হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। কেননা মাস‘ঊদী হ’তে ইয়াযীদ বিন হারূন ও হাশেম বিন ক্বাসেম ইখতিলাতের পর শ্রবণ করেছেন। কিন্তু মু‘আয বিন মু‘আয আল-আম্বারীও তো এই হাদীছটি মাস‘ঊদী হ’তে বর্ণনা করেছেন। যার উদ্ধৃতি শায়খ শু‘আইব নিজেই প্রদান করেছেন। কিন্তু কোন কারণে একথা স্বীকার করার ব্যাপারে তিনি নীরব যে, মু‘আয মাস‘ঊদী হ’তে ইখতিলাতের পূর্বে এটি শ্রবণ করেছেন।

আমাদের উক্ত আলোচনার মাধ্যমে সম্মানিত পাঠকগণ অনুমান করতে পারেন যে, শায়খ শু‘আইবের অবস্থানের মর্যাদা কতটুকু? আর আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর সমালোচনায় তার অভিযোগের ধরনটি কেমন? এসব কিছুতো স্রেফ শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর বিরোধিতা করার জন্য করা হচ্ছে না? পরস্পর বিরোধী হাদীছের মধ্যে সমতা বিধান যদি মতনের সমালোচনার ভিত্তিতে না হয়ে থাকে, তবে আসলে কিসের ভিত্তিতে? ব্যাখ্যা করুন, প্রতিদান পাবেন।

শুযূয ও যিয়াদাতে ছিক্বাহর[3] মধ্যে পার্থক্য না করা : শায়খ শু‘আইব তো প্রথমে এটা বলেছেন যে, শায়খ আলবানী হাদীছের ইল্লাত (ত্রুটি) ও শুযূযের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না।

যার বাস্তবতা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। আর এ ব্যাপারে যেসকল বর্ণনা তিনি দলীলস্বরূপ পেশ করেছেন, আমরা সেগুলির স্বরূপও উন্মোচন করেছি। ছহীহ মুসলিমের (হা/৭০১৪) বর্ণনা, যে সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব সমালোচনা করেছেন। আল্লামা আলবানী সেটিকে ‘শায’ বলেছেন। এর বহু উদাহরণ তার গ্রন্থ সমূহে মওজুদ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা এখানে আরো দু’টি বর্ণনা উল্লেখ করছি যাতে এই ভুল ধারণার অবসান হয়ে যায়। যেমন একটি হাদীছের শব্দসমূহ নিম্নরূপ-

مَنِ اسْتَحَقَّ النَوْم وَجَبَ عَلَيْهِ الْوُضُوْءُ

‘যে ঘুমাল তার উপর ওযূ ওয়াজিব হয়ে গেল’।

সিলসিলা যঈফাতে (হা/৯৫৪) তিনি বলেছেন, شاذ لا يصح ‘শায; ছহীহ নয়’। এর ত্রুটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এর সকল রাবী ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য। কিন্তু তিনজন ছিক্বাহ রাবী মুহাম্মাদ বিন আববাদ আল-হানাঈর বিরোধিতা করেছেন এবং তারা একে মওকূফ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।فاتفاق هؤلاء الثلاثة الثقات على وقفه يجعل رواية الهنائي شاذة ‘এই তিনজন ছিক্বাহ রাবীর এর মওকূফ হওয়ার উপর ঐক্যমত পোষণ করা মুহাম্মাদ বিন আববাদ হানাঈর বর্ণনাটিকে শায বানিয়ে দেয়’।

অনুরূপভাবে মুসনাদে আহমাদ-এর (৬/৮৬) বরাতে তিনি একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। যার শব্দগুলি হ’ল-أوتيت مفاتيح كل شيء إلا الخمس: إن الله عنده علم الساعة… ‘পাঁচটি বস্ত্ত ব্যতীত সব বস্ত্তর চাবি আমাকে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের ইলম আল্লাহর নিকটে…।[4]

এই বর্ণনাটির প্রথমাংশের ব্যাপারে শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেছেন, شاذ أوله ‘এর প্রথম অংশটি শায’। এটা শায কেন? এর বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে সবশেষে তিনি লিখেছেন,أن هذه الزيادة أوتيت، لم يطمئن القلب لثبوتها، وإن كان إسنادها صحيحاً كما تقدم؛ لتفرد الراوي بها دون سائر الطرق، ولعدم وجود الشاهد المعتبر لها، فهي شاذة (أوتيت)، এই অতিরিক্ত অংশের প্রমাণে অন্তর প্রশান্ত নয়, যদিও এর সনদটি ছহীহ। যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে। কেননা কোন এক সূত্রে এর একজন রাবী একক। আর এর কোন গ্রহণযোগ্য শাহেদও নেই। এজন্য এই অতিরিক্ত অংশটুকু শায’।

এজন্য শায়খ শু‘আইবের এটা বলা যে, ‘আল্লামা আলবানী শায ও ইল্লাত-এর প্রতি খেয়াল রাখতেন না’- নিশ্চিতরূপে সঠিক নয়। এর দ্বারা এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুযূয ও যিয়াদাতে ছিক্বাহ-এর মধ্যে তিনি পার্থক্য করতেন, নাকি করতেন না? যদি তিনি পার্থক্য না করে থাকেন তবে উপরোল্লিখিত হাদীছ দু’টিকে শায বলার অর্থ কি? ছিক্বাহ রাবীর যিয়াদাত (অতিরিক্ত অংশ) গ্রহণ করা উচিত।

বাকী থাকল সেই উদাহরণটি যেটি প্রমাণের জন্য শায়খ শু‘আইব পেশ করেছেন তা হ’ল- হযরত ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ)-এর হাদীছ। যা তাশাহহুদে আঙ্গুল নাড়ানোর সাথে সম্পর্কিত। আর এতে يحركها ‘তিনি তা নাড়াতেন’ শব্দ স্রেফ যায়েদাহ বিন কুদামাহ উল্লেখ করেছেন। অথচ আছেম বিন কুলাইবের অন্য দশ-এগারোজন ছাত্র এই শব্দটি উল্লেখ করেননি। কিন্তু শায়খ আলবানী (রহঃ) ‘ছহীহাহ’ (হা/৩১৮১) গ্রন্থে একে ছহীহ বলেছেন। আর এটিকে ছহীহ বলার কারণ এটা বর্ণনা করেছেন যে, ইশারা করা শব্দটি আঙ্গুল নাড়ানোর বিরোধী নয়। খুব বেশী হ’লে এই শব্দটি নাড়ানোর অর্থবহনে সুস্পষ্ট না হ’তে পারে, কিন্তু এর বিরোধীও নয়’। পূর্ববর্তীদের রীতি অনুযায়ী এই শায শব্দকে ছহীহ আখ্যা দেওয়ার জন্য কি এ কথাটুকুই যথেষ্ট? [5]

প্রথমত : এখানে এটা দেখুন যে, কেবল শায়খ আলবানী (রহঃ)-ই একে ছহীহ বলেননি; বরং তিনি উলেলখ করেছেন যে, ইমাম ইবনু খুযায়মা (হা/৭১৪), ইবনু হিববান এবং ইবনুল জারূদও একে ছহীহ বলেছেন। যেখানে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এই হাদীছটি তাদের নিকটেও ছহীহ। আল্লামা নববী এবং হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)ও একে ছহীহ বলেছেন। যেমনটি ইরওয়াউল গালীল (২/৬৯), ছহীহ আবূদাঊদ (হা/৭১৭) গ্রন্থদ্বয়েও আল্লামা আলবানী উল্লেখ করেছেন। যার মাধ্যমে এই বিষয়টি তো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লামা আলবানী (রহঃ) একে একাই ছহীহ বলেননি। বরং আল্লামা আলবানী ছহীহাহ গ্রন্থে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, স্বয়ং শায়খ শু‘আইব ছহীহ ইবনু হিববানের টীকায় (৫/১৭১) যায়েদার এই বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন, إِسْنَادُهُ قَوِيٌّ ‘এর সনদ শক্তিশালী’।

দ্বিতীয়ত : আল্লামা আলবানী (রহঃ) একে শায বলেননি। কেননা আরো কতিপয় বর্ণনাও তাশাহহুদের সময় শাহাদাত অঙ্গুলি নাড়ানোর সমর্থক। যেখানে ইশারার উল্লেখ আছে। আর ‘ইশারা’ নাড়ানোর বিরোধী নয়। তার শব্দগুলি হ’ল- أن حديث وائل من رواية زائدة في التحريك صحيح، وله متابعون ثقات في معناه، وأن الذين أعلوه بالشذوذ تغافلوا عن روايات الثقات الموافقة له… ‘তাশাহহুদে আঙ্গুল নাড়ানো মর্মে যায়েদা বর্ণিত হযরত ওয়ায়েল (রাঃ)-এর হাদীছ ছহীহ। এই ম©র্ম বর্ণিত নির্ভরযোগ্য রাবীদের সমর্থনও রয়েছে। আর যারা একে শায বলে ত্রুটিযুক্ত আখ্যা দিয়েছেন তারা ছিক্বাহ রাবীদের বর্ণনাসমূহ সম্পর্কে গাফেল রয়েছেন। যা এই আঙ্গুল নাড়ানোর বর্ণনাটির অনুকূলে’।

এর মাধ্যমে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শায়খ আলবানী (রহঃ) يُحَرِّكُهَا শব্দটিকে এজন্য শায বলেননি যে, এর মর্মগত সমর্থন বিদ্যমান। আর তিনি ইশারাকে নাড়ানোর বিরোধী মনে করেন না।

তৃতীয়ত : শাহাদাত আঙ্গুল নাড়ানোর বিষয়টি আল্লামা আলবানীর ‘আবিষ্কার’ নয়। ইমাম আহমাদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, মুছল্লী কি ছালাতে ইশারা করবে? তিনি বললেন, نَعَمْ شَدِيْدًا ‘হ্যাঁ। প্রচন্ডভাবে নাড়াবে’।[6]

ইমাম ইবনু খুযায়মা যায়েদার একক হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার পরও এ বিষয়ে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন যে,بَابُ صِفَةِ وَضْعِ الْيَدَيْنِ عَلَى الرُّكْبَتَيْنِ فِي التَّشَهُّدِ وَتَحْرِيْكِ السَّبَّابَةِ عِنْدَ الْإِشَارَةِ بِهَا ‘তাশাহহুদে দু’হাটুর উপর দু’হাত রাখা এবং ইশারা করার সময় শাহাদত অঙ্গুলি নাড়ানো’।[7]

ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) আস-সুনানুল কুবরা (১/১৩২) গ্রন্থে প্রথমে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। যেখানে لَا يُحَرِّكُهَا ‘তিনি আঙ্গুল নাড়াতেন না’ শব্দগুলি আছে। অতঃপর يُحَرِّكُهَا ‘তিনি আঙ্গুল নাড়াতেন’ মর্মের হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। তারপর উভয়ের মধ্যে এই সমতা বিধান করেছেন যে, নাড়ানো দ্বারা উদ্দেশ্য ইশারা করা। বারবার নাড়ানো উদ্দেশ্য নয়। যাতে উভয় বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান হ’তে পারে। অথচ ‘তিনি আঙ্গুল নাড়াতেন না’ শব্দের হাদীছ ছহীহ নয়। ইবনু আজলান হ’তে স্রেফ যিয়াদ বিন সা‘দ এই শব্দগুলি উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে লায়ছ বিন সা‘দ, আবূ খালেদ আহমার, ইবনু উয়ায়নাহ, ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ বিন আজলান হ’তে এই শব্দ উল্লেখ করেননি। বরং ইবনু আজলান ব্যতীত ওছমান বিন হাকীম, মাখরামা বিন বুকাইর, আমের বিন আব্দুল্লাহ হ’তে এই শব্দগুলি উল্লেখ করেননি। ইবনু আজলান একাই এটি উল্লেখ করেছেন। যেমনটা শায়খ আলবানী ‘আছলু ছিফাতি ছালাতিন নাবী (ছাঃ)’ গ্রন্থে (২/৮৫৩) উল্লেখ করেছেন। বরং ইবনু আজলান নিজেই মুদাল্লিস রাবী। আর তার এই বর্ণনাটি মু‘আনআন।[8] আর তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এজন্য তাদলীস ও দু’জন ছিক্বাহ রাবীর বিরোধিতার কারণে لَا يُحَرِّكُهَا ‘মর্মের বর্ণনাটি ছহীহ নয়। একই কারণে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)ও যাদুল মা‘আদ (১/৭৩৮) গ্রন্থে এর বিশুদ্ধতা অস্বীকার করেছেন। আর প্রসিদ্ধ মূলনীতি হ’ল ‘হ্যঁা বোধক বক্তব্য না বোধক বক্তব্যের উপরে প্রাধান্য পাবে’-এর ভিত্তিতেও يُحَرِّكُهَا শব্দকে ছহীহ বলেছেন। আরো বিস্তারিত জানার জন্য যঈফা (হা/৫৫৭২) এবং যঈফ আবূদাঊদ (হা/১৭৫) অধ্যয়ন করুন।

ইমাম ইবনুল মুনযির (রহঃ) আল-আওসাত্ব (৩/৩৮৮) গ্রন্থে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে তা‘লীক হিসাবে উল্লেখ করেছেন যে তিনি বলেছেন,فِيْ: تَحْرِيْكُ الرَّجُلِ أُصْبُعَهُ فِي الصَّلَاةِ، قَالَ: ذَاكَ الْإِخْلَاصُ ‘ছালাতে আঙ্গুল নাড়ানো ইখলাছের বহিঃপ্রকাশ’।

শায়খ শু‘আইব হোন বা অন্য কেউ হোন তিনি আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর এই অবস্থানের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু এর দ্বারা এই অপপ্রচার চালানো ঠিক নয় যে, তিনি শায ও ছিক্বাহ রাবীর যিয়াদাতের মধ্যে পার্থক্য করতেন না ‘এক স্থানের ইট আরেক স্থানের সুড়কি’-এর মত।

স্মর্তব্য যে, শায়খ শু‘আইবের ভক্ত আদেল মুরশিদاَلْمَنْهَجُ الصَّحِيْحُ فِي الْحُكْمِ عَليَ الْحَدِيْثِ النَّبَوِيِّ الشَّرِيْفِ শিরোনামে একটি পুস্তিকা রচনা করেছেন। সেখানে তিনি চারটি হাদীছ উল্লেখ করে বলেছেন যে, এগুলি শায। অথচ শায়খ আলবানী সেগুলিকে ছহীহ বলেন। তন্মধ্যে এই হাদীছটিও রয়েছে। এর জবাব শায়খ আলবানী ছহীহাহ গ্রন্থে প্রদান করেছেন। আর দ্বিতীয় হাদীছটি সম্পর্কেও শায়খ সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কিন্তু আমরা মরহূম শায়খের বরাতে এ কথা প্রমাণ করেছি যে, তিনি শায ও ছিক্বাহ রাবীর যিয়াদাতের মধ্যে পার্থক্য করতেন এবং শুযূয-এর ভিত্তিতে হাদীছকে যঈফ বলতেন। এজন্য শায ও ইল্লাত এবং যিয়াদাতে ছিক্বাহ সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব যে অপবাদ দিয়েছেন তা কখনোই সঠিক নয়।

স্বীয় মাযহাবের সমর্থক বর্ণনাসমূহকে ছহীহ বলার অপবাদ :

শায়খ শু‘আইব আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর উপর এই অপবাদও আরোপ করেছেন যে, ‘অনেক সময় তিনি এমন হাদীছকেও ছহীহ বলতেন যেগুলি তার মাযহাবের অনুকূলে। যদিও তার কোন শক্তিশালী শাহেদ বিদ্যমান না থাকে’।[9]

আফসোস হ’ল, শায়খ শু‘আইব আল্লামা আলবানী (রহঃ)-কে প্রচলিত তাক্বলীদী মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অপবাদ দিয়েছেন, যার খন্ডনে আল্লামার সারা জীবন অতিবাহিত হয়েছে। তিনি কোন প্রসিদ্ধ মাযহাবী গোষ্ঠীর মুখপাত্র ছিলেন না। কুরআন মাজীদ ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করাই ছিল তাঁর মাযহাব। আর তিনি এরই দাঈ (আহবায়ক) ছিলেন। তাঁর সকল গ্রন্থ এর জীবন্ত প্রমাণ। তিনি ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এর প্রবক্তা ছিলেন। তথাপি হযরত ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনা যেটি সাধারণত রাফ‘উল ইয়াদায়েন না করার পক্ষে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা হয়ে থাকে- তাকে ছহীহও মনে করতেন। যার বিস্তারিত আলোচনা তার রচিত ছহীহ আবূদাঊদ (হা/৭৩৩, ৩/৩৩৮) ইত্যাদি গ্রন্থগুলিতে দেখা যায়।

অনুরূপভাবে আল্লামা আলবানী (রহঃ) ছালাতে বুকের উপর হাত বাঁধার প্রবক্তা। কিন্তু এ সম্পর্কে হযরত ওয়ায়েল-এর হাদীছ যেটি ইমাম ইবনু খুযায়মা স্বীয় ছহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-একে যঈফ বলেছেন।[10] এর দ্বারা অত্র অপবাদের স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে যায়।

এখন আসুন! এই দলীলটির বাস্তবতাও দেখে নিন যাকে শায়খ শু‘আইব স্বীয় দাবীর প্রমাণে পেশ করেছেন। সেটি হযরত আদী বিন হাতেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমতে হাযির হ’লাম তখন আমার গলায় ক্রুশ ছিল। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে আদী! এই মূর্তিটি নামিয়ে ফেল। তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে এই আয়াতটি তেলাওয়াত করতে শুনলেন-اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’ (তওবা ৯/৩১)

হযরত আদী বিন হাতেম (রাঃ) আরয করলেন যে, আমরা তো আমাদের আলেম ও মাশায়েখদের ইবাদত করি না। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তারাও তাদের আলেমদের ইবাদত করত না। কিন্তু যখন ইহূদী ও নাছারাদের আলেমগণ তাদের জন্য কোন বস্ত্ত হালাল আখ্যা দিত তখন তারা সেটাকে হালাল মনে করত এবং তাদের উপর যখন কোন বস্ত্তকে হারাম করে দিত তখন তারা সেটাকে হারাম মনে করত। এটাই হ’ল তাদের ইবাদত। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) একে যঈফ বলেছেন। কিন্তু শায়খ আলবানী ছহীহ তিরমিযী ও সিলসিলা ছহীহাহ (হা/৩২৯৩) গ্রন্থে একে ছহীহ বলেছেন। এর কোন শক্তিশালী শাহেদও নেই’।[11]

এই হাদীছটি কি ছহীহ, না যঈফ? আল্লামা আলবানী (রহঃ) ছহীহাহ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং পরিশেষে বলেছেন যে, এর আসল ত্রুটি এই যে, এর রাবী গুত্বাইফ বিন আ‘য়ুন মাজহূল (অপরিচিত)। শায়খ আলবানী (রহঃ) আরো বলেছেন যে, ‘এর সমর্থন হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর আছার থেকে হয়। যেখানে তিনি বলেছেন যে, তাদের মাশায়েখ ও আলেমগণ এজন্য মা‘বূদ ছিল যে, তারা যেটাকে হালাল আখ্যা দিত তারা সেটাকে হালাল জানত। আর যেটাকে হারাম আখ্যায়িত করত সেটাকে হারাম জানত। এই বর্ণনাটি মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক্ব, শু‘আবুল ঈমান এবং জামেউ বায়ানিল ইলম গ্রন্থে ছহীহ সনদে মুরসাল হিসাবে হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) ‘তাখরীজুল কাশশাফ’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই বর্ণনাটি ইবনু মারদাওয়াইহ গ্রন্থে আরেকটি সনদেও ‘আত্বা বিন ইয়াসার হ’তে, তিনি আদী হ’তে’ বর্ণিত আছে। আর হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ)-এর শক্তিশালী হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।[12]

এখানে এ কথাটিও গভীরভাবে চিন্তার বিষয় যে, আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেছেন, হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) তাখরীজু আহাদীছিল কাশশাফ গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ূত্বী (রহঃ) আদ-দুর্রুল মানছূর গ্রন্থে ইমাম তিরমিযী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এই হাদীছটি ‘হাসান গরীব’। কিন্তু আমার সামনে তিরমিযীর যে কপিটি রয়েছে তাতে ‘হাসান’ নয় স্রেফ ‘গরীব’ লিখিত আছে।

উল্লেখ্য যে, জামে তিরমিযী (তুহফাসহ ৪/১১৭)-এর নুসখায় এভাবেই ‘হাসান গরীব’ লেখা আছে। অনুরূপভাবে তিরমিযীর (২/১৩৬) মুজতাবাঈ ছাপা, দিল্লী এবং মাকতাবা রশীদিয়া, দিল্লী-এর নুসখাতেও ‘হাসান গরীব’ আছে। বরং আল্লামা যায়লাঈ তাখরীজু আহাদীছিল কাশশাফ (২/৬৬) গ্রন্থে এবং হাফেয ইবনু কাছীর জামেউল মাসানীদ (৪/৪৩০) গ্রন্থেও ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হ’তে ‘হাসান গরীব’-ই উল্লেখ করেছেন। আল্লামা মিযযী (রহঃ) যদিও ‘তুহফাতুল আশরাফ’ গ্রন্থে স্রেফ ‘গরীব’-ই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আল্লামা যায়লাঈ (যিনি তার সমকালীন) এবং হাফেয ইবনু কাছীরও ‘হাসান গরীব’ উল্লেখ করেছেন। যা এ কথার প্রমাণ যে, এ সম্পর্কে জামে তিরমিযীর কপিগুলিতে ভিন্নতা রয়েছে। আর জামে তিরমিযীর কপিগুলিতে এ ধরনের পার্থক্য সম্পর্কে আলেমগণ অবগত। এই অধম জামে তিরমিযীর ঐ কপির ফটোকপিও দেখেছেন যেটি প্যারিসের লাইব্রেরীর শোভাবর্ধন করেছে। আর এর পৃষ্ঠা নং ২০৪ (বা) নীচ হ’তে উপরের দিকে চতুর্থ লাইনে ‘হাসান গরীব’ শব্দ রয়েছে। এই কপিটি ইমাম আবুল ফাৎহ আব্দুল মালেক বিন আবুল ক্বাসেম আব্দুল্লাহ কারখী আল-হারবীর (মৃঃ ৫৪৮ হিঃ) নিজ হাতে লেখা। আর এতে তার স্বাক্ষর ‘আব্দুল মালেক’ও আছে। আল্লামা ইবনু দাকীকুল ঈদ বলেছেন, অধিকাংশ পরববর্তী আলেম এই কপির উপর নির্ভর করেছেন। ড. খালেদ বিন মানছূর আদ-দুরাইস (রহঃ) ‘আল-হাসান লি-যাতিহি ও লি-গায়রিহি’ শীর্ষক গবেষণায় এই কপিটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রদান করেছেন এবং বলেছেন যে, এটিই সে সময় তিরমিযীর সবচয়ে উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ কপি। হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ)-এর নিকটেও কারখীর এই কপিটি ছিল। যার বিস্তারিত আলোচনা ‘আল-হাসান লি-যাতিহি ও লি-গায়রিহি’ (৩/১০১৫-১০১৬) গ্রন্থে দেখা যেতে পারে। আর এই গ্রন্থের ১৫০০ পৃষ্ঠায় ড. খালেদও উল্লেখ করেছেন যে, কারখীর নুসখাতে ‘হাসান গরীব’ লেখা আছে।

এখানে একথা বাকী থাকল যে, যখন ইমাম তিরমিযী (রহঃ) নিজেই ‘গুত্বাইফ বিন আ‘য়ুন’-কে মাজহূল বলেছেন। তাহ’লে তিনি একে হাসান কিভাবে বলতে পারেন? কিন্তু এই প্রশ্নটি জামে তিরমিযীতে ইমাম তিরমিযী (রহঃ)-এর পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত না থাকার উপর ভিত্তিশীল। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) দুর্বল মুখস্থশক্তি, ভুল ও ভ্রান্তির দোষে অভিযুক্ত, মুখতালিত্ব, মুদাল্লিস, মুনক্বাত্বি‘, মুরসাল, মাজহূল ও মাসতূর[13] রাবীদের বর্ণনাসমূহকে সমর্থনের ভিত্তিতে হাসান বলেন। যেমনটি হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) ‘আন-নুকাত’ (১/৩৮৮-৩৯৬) গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি মাসতূর রাবীদের সম্পর্কে তো তিনি লিখেছেন যে, তিরমিযীতে এদের অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যা বিস্তারিত আলোচনা করার দরকার নেই। তার বাক্যগুলি হ’ল-[14]

فأما أمثلة ما وصفه بالحسن وهو من رواية المستور فكثير لا نحتاج إلى الإطالة بها

মাসতূর-ই নয়, মাজহূল রাবীদের হাদীছগুলিকেও এবং যেগুলিকে তিনি নিজেই যঈফ বলেন, তাদের বর্ণনা সমূহকেও ইমাম তিরমিযী (রহঃ) সমর্থনের ভিত্তিতে হাসান বলেছেন। ‘আল-হাদীছুল হাসান লি-যাতিহি ওয়া লি-গায়রিহি’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করলে যেটা প্রতীয়মান হয়। প্রয়োজন হ’লে এর উদাহরণও দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ্।

নিকট অতীতে দেওবন্দী গোষ্ঠীর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ মাওলানা মুহাম্মাদ সরফরায ছফদর (রহঃ)ও স্বীকার করেছেন যে, ইমাম তিরমিযী একে ‘হাসান গরীব’ বলেছেন। আল-কালামুল মুফীদ (পৃঃ ৩২৯) এবং গুলদাস্তায়ে তাওহীদ (পৃঃ ৪২, ৪৪) গ্রন্থদ্বয়ে এই হাদীছ থেকে দলীলও গ্রহণ করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া এই হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।[15] হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) এই বর্ণনাটি উল্লেখ করে বলেছেন,وَهَكَذَا قَالَ حُذَيْفَةُ بْنُ الْيَمَانِ، وَعَبْدُ اللهِ بْنُ عَبَّاسٍ، وَغَيْرُهُمَا ‘হযরত হুযায়ফা ইবনুল (রাঃ) ইয়ামান এবং আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) প্রমুখ এ আয়াতটির অনুরূপ তাফসীর করেছেন’।[16]

যার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, হাফেয ইবনু কাছীরও এই তাফসীরকে বিশুদ্ধ বলেছেন। বিশেষতঃ যখন তিনি জামেউল মাসানীদ গ্রন্থে ইমাম তিরমিযী থেকে এর তাহসীন[17] উল্লেখ করেছেন। আল্লামা আলসূীও ‘রূহুল মা‘আনী’ গ্রন্থে একে ছহীহ বলেছেন। ইমাম ইবনু আবী হাতেম হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর তাফসীর উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এই তাফসীর-ই আবুল আলিয়া, আবূ জা‘ফর, মুহাম্মাদ বিন আলী বিন হুসাইন, যাহ্হাক ও সুদ্দী হ’তে বর্ণিত আছে।[18] আর এই তাফসীরই আবুল বাখতারী সাঈদ বিন ফায়রূয হ’তে বর্ণিত আছে’।[19]

এজন্য হযরত আদী বিন হাতেম (রাঃ)-এর আগমনে যদিও ব্যাখ্যা রয়েছে, কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযামের এ অর্থগত তাফসীর অত্র হাদীছটির সমর্থক। এজন্য শায়খ আলবানী যদি একে ‘হাসান’ বলে থাকেন তাহ’লে মূলনীতি বিরোধী কোন কাজ করেননি। এখানে শায়খ শু‘আইবের ‘দুঃসাহস’ দেখুন যে, তিনি বলেছেন, ‘আল্লামা আলবানী একে ছহীহ বলেছেন’। অথচ সিলসিলা ছহীহাহ ও ছহীহ তিরমিযী (হা/৩০৯৫) গ্রন্থে তিনি একে হাসান বলেছেন, অবশ্যই ছহীহ বলেননি। ড. হিকমত বিন বাশীরও আত-তাফসীরুছ ছহীহ (৩/১৬৪) গ্রন্থে এবং শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর কিতাবুল ঈমান ও শায়খ আলবানী হ’তে এর হাসান হওয়াই উল্লেখ করেছেন।فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ ‘অতএব হে দূরদর্শী ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ হাছিল কর’ (হাশর ৫৯/২)

আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, শায়খ শু‘আইব বলেছেন, ‘এর কোন শক্তিশালী শাহেদও (সমর্থক বর্ণনা) নেই’। তাঁর কাছে আমাদের ছাত্রসুলভ প্রশ্ন রইল যে, হাদীছকে শক্তিশালী করার জন্য কি স্রেফ শাহেদই প্রয়োজন? নাকি অন্য কোন নিয়ম-কানূন দ্বারাও যঈফ-যার দুর্বলতা বেশী নয় সেটা শক্তিশালী হয়ে যায়? আর তা যঈফের সীমানা থেকে বের হয়ে হাসান লি-গায়রিহি-এর স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়? যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিবাদ ও বিরোধিতার ঊর্ধ্বে উঠে এ বিষয়ে চিন্তা করতেন তাহ’লে এই অভিযোগটি করতেন না।

পরবর্তী অংশ: আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৫)

মূল (উর্দূ) : শায়খ ইরশাদুল হক আছারী
অনুবাদ : আহমাদুল্লাহ


[1]. হাদীছের নির্ভরযোগ্য হাফেযদের বর্ণনার বিরোধী হাদীছকে নাকারাত বলা হয় (দ্রঃ যারাকশী, আন-নুকাত আলা মুক্বাদ্দামা ইবনুছ ছালাহ ২/১৫৬)।-অনুবাদক।  

[2]. মুসনাদে আহমাদ ৩২/২৩২, তা‘লীক শু‘আইব আরনাঊত।  

[3]. রাবী কর্তৃক কোন বর্ধিত অংশ বর্ণনা করাকে যিয়াদাত বলা হয়। ছিক্বাহ তথা আস্থাভাজন রাবীর বর্ধিত অংশকে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এই বর্ধিতকরণ কয়েকভাবে হয়ে থাকে। (১) শব্দ বা বাক্যের বৃদ্ধি। (২) মওকূফকে ‘মারফূ’ হিসাবে বর্ণনা করা বা মুরসালকে ‘মুত্তাছিল’ হিসাবে বর্ণনা করা ইত্যাদি। হুকুম : মতনের ক্ষেত্রে এর হুকুম হ’ল, ছিক্বাহ রাবী কতৃর্ক বর্ধিতাংশটুকু যদি একাধিক ছিক্বাহ রাবী অথবা ততোধিক ছিক্বাহ রাবীর বিরুদ্ধে না যায় তবে তা গ্রহণীয় হবে। নতুবা প্রত্যাখ্যাত হবে। যেমন কুকুরের লালা পাত্রে লেগে যাওয়া সম্পর্কে ইমাম মুসলিম একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সেটা হ’ল-إِذَا وَلَغَ الْكَلْبُ فِي إِنَاءِ أَحَدِكُمْ فَلْيُرِقْهُ ثُمَّ لِيَغْسِلْهُ سَبْعَ مِرَارٍ ‘যখন তোমাদের কারো পাত্রে কোন কুকুর লালা ফেলবে তখন যেন সে পাত্রের বস্ত্ত ঢেলে দেয় এবং সেটাকে সাতবার ধৌত করে’।

    এখানে فليرقه (সে পাত্রের বস্ত্ত ঢেলে দেয়) শব্দটি অতিরিক্ত রয়েছে যা অন্য কোন বর্ণনায় নেই। বরং অন্যরা বর্ণনা করেছেন যে,إِذَا وَلَغَ الْكَلْبُ فِي إِنَاءِ أَحَدِكُمْ فَلِْيَغْسِلْهُ سَبْعَ مِرَارٍ ‘যখন তোমাদের কারো পাত্রে কোন কুকুর লালা ফেলবে তখন সে যেন সেটাকে সাতবার ধৌত করে’। তবে এটা অন্যান্য বর্ণনার বিরোধী নয় বিধায় তা গ্রহণযোগ্য (বিস্তারিত দ্রঃ তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ (রিয়ায: মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, প্রকাশকাল : ১৯৯৬), পৃঃ ১৩৭-১৪০)।-অনুবাদক।  

[4]. যঈফাহ হা/৩৩৩।

[5]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩৪।

[6]. মাসায়েলে ইমাম আহমাদ ১/৮০, ক্রমিক ৩৯৩, ইবনু হানীর বর্ণনা।

[7]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ ১/৩৫৪।   

[8]. মু‘আনআন : ‘আন (عَنْ) শব্দ দ্বারা বর্ণিত সনদের হাদীছকে মু‘আনআন বলা হয়। যেমন রাবী বলেন, عَنْ  اَِبيْ ‘আমার পিতা হ’তে’ বর্ণিত।

[9]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩৪।

[10]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহর টীকা ১/২৪৩।

[11]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩৪।

[12]. ছহীহাহ ৭/৮৬৫।

[13]. ‘মাজহূল’ হ’ল ঐ রাবী, যার ইলমী অবস্থা, ন্যায়পরায়ণতা ও স্মরণশক্তি সম্পর্কে মুহাদ্দিছগণ অবগত নন। মাজহূল রাবী দু’প্রকার। ১. মাজহূলুল ‘আইন : যার নাম জ্ঞাত হ’লেও অন্যান্য বিষয়াদি অজ্ঞাত এবং তার নিকট থেকে মাত্র একজনই হাদীছ বর্ণনা করেছেন, এমন রাবীকে ‘মাজহূলুল ‘আইন’ বলা হয়। তাওছীক না করা হলে এমন রাবীর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। ২. মাজহূলুল হাল : যে রাবী থেকে দুই  কিংবা দু’জনের অধিক ব্যক্তি হাদীছ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তার তাওছীক করা হয়নি তাকে মাজহূলুল হাল বা ‘মাসতূর’ বলা হয়। জমহূরের নিকটে এমন রাবীর বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: ড. মাহমূদ আত-তহহান, তায়সীরু মুছত্বালাহিল হাদীছ, পৃঃ ১২০-১২১; ডক্টর সুহায়েল হাসান, মু‘জামু ইছতিলাহাতে হাদীছ, পৃঃ ৩০৪-৩০৬)।-অনুবাদক।

[14]. আন-নুকাত ১/৩৮৮।

[15]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৭/৬৭।

[16]. তাফসীর ইবনু কাছীর ২/৩৮৪।

[17]. হাদীছকে হাসান আখ্যায়িত করাকে ‘তাহসীন’ বলা হয়।-অনুবাদক।

[18]. তাফসীর ইবনু আবী হাতেম ৬/১৭৮৪।

[19]. ইবনু জারীর ১১/১১৪, ১১৫।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button