ছোটগল্প/উপন্যাস

সততা

স্বপ্ন ভেঙ্গে বাস্তবতার সিঁড়িতে পা সামলে চলতে শিখে গেছে জালাল।

বসের অযথা চোখ রাঙ্গানি…
কলিগদের উপড়ি কামাইয়ের নাঙ্গা প্রদর্শন…
অফিসের সুন্দরী সেক্রেটারীর চোখের ইশারার গভীরতার পরিমাপ…
দুনম্বরীতে চ্যাম্পিয়ন তারেক সাহেবের টেন্ডার পাইয়ে দেবার ইনাম স্বরূপ ৯০০ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট…
লাল ফিতের আড়ালে চলা নোংরামী…
মুখোশধারী আমলাদের সাধু সাজবার কুতসিত সব কর্মকান্ড…
প্রমোশন পাবার জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া…

এ সব কিছুর বিপরীত দিকে ছুটে চলার কিংবা উপেক্ষা করার মত সাহস সহজে কারো হয় না – যেখানে প্রতি পদে পদে থাকে ক্ষমতাসীনদের কড়াল গ্রাসের ভয়। এমনকি নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে তথাকথিত গুম হয়ে কোথাও দাফন হয়ে যাবার ভয়। এ সব কিছুকে পায়ের নীচে কচলে ফেলে দিয়ে এসেছে সে।

“নাহ, আর এমন দাসত্ব করবো না যেখানে নিজের সততার এক কানাকড়ি মূল্য নেই” – মুচকি হাসে জালাল।

ট্রেন সাই সাই করে ছুটে চলছে। শহর পেড়িয়ে, গ্রাম ছাপিয়ে, ফসলি মাঠের গায়ে লেগে থাকা সোনালী রোদ মাড়িয়ে, দিগন্ত রেখা ছুয়ে ট্রেন যাচ্ছে ছোট্ট মফস্বলের কোন এক পুরনো রেল জংশন ছুঁতে; যার সাথে জালালের নাড়ীর টান মিশে আছে। আজ জালাল আবার ফিরে এসেছে সব পিছুটানের জন্ঞ্জাল ছিঁড়ে।

ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় করে সোজা সেই পুরনো হলুদ রং এর দোতলা বাড়িটার সামনে এসে থামল। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে গেটের দিকে পা বাড়াল। জং ধরা গেট টান মেরে খুলতেই ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে প্রতিবাদ করতে লাগল।
উঠোনের ঘাস হয়তো কাটাহয়নি অনেক দিন, কেমন জংলী জংলী ভাব চলে এসেছে। দরজা আধ ভেজাই ছিল। জালাল ঘরে ঢুকে সোজা করিডোর ধরে সামনে এগিয়ে গেল।

বেশ বড় একটা রুম, একপাশে ময়ূর খাটের উপরে অদ্ভুত শব্দ তুলে ভারী মাথার একটা পুরনো ফ্যান ঘেঁষটে ঘেঁষটে চলছে। খাটের এক কোনে গুটি শুটি মেরে আয়েত আলী সাহেব শুয়ে আছেন। জালাল কে দেখে ইশারায় বসতে বললেন। অসময়ে তাকে আসতে দেখে বেশ অবাক। জালাল আয়েতআলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাবা! আমার প্রমোশন হয়েছে।”

ছেলের কথায় আয়েত আলী বুঝে যান সে কী বলতে চাইছে। তিনি হেসে বলেন, “কিসের প্রমোশন? নিশ্চয়ই তোর নৈতিকতার!
কিরে ঠিক বলেছি না?”

জালাল চুপ করে থাকে। আয়েত আলী কাঁপা কাঁপা হাতে তাকে কাছে টেনে আনেন। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “খুব ভাল করেছিস, আই এ্যাম প্রাউড অফ ইউু। যাহ তোর মায়ের সাথে দেখা করে আয়, সে কিচেনেই আছে।”

জালাল মায়ের সাথে দেখা করে। মা তাকে দেখে বিচলিত হন – অসময়ে ছেলেটা এখানে! কিন্তু কেন? মায়ের মন তো খুব খারাপ মন, শুধু বাজে চিন্তাগুলোই বিস্তার করতে থাকে।
জালাল বলল, “মা বড্ড খিদে পেয়েছে, খাবার দাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একসাথেই খাব।”

খাবার টেবিলে পিনপতন নিরবতা। শুধু চামচ আর চিনেমাটির বাটিতে হওয়া টুংটাং শব্দ ছাড়া। বাইরে জানালার পাশে বসে একটা কাক কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। মা বললেন, “অমন সময় কাক ডাকা তো ভালো নয়! অমঙ্গল হয়।”

জালাল হেসে বলল, “বেচারা অসহায় কাকের উপর কেন দোষ দিচ্ছ মা! আমরা একজনের দোষ অন্যের ঘাড়ে দিয়েই কিন্তু ক্ষ্যান্ত হচ্ছিনা , বেজুবান প্রাণীদেরকেও এই বলয় থেকে রক্ষা দিচ্ছিনা।”
ঢাকা যাচ্ছিস কবে?

– আর যাচ্ছিনা এখানেই থাকব। গরু পালবো, হাঁস মুরগী পালবো, ব্যবসা করবো – কিছু একটা করবোই। তোমার ছেলে বেকার থাকবেনা মা।

– কিন্তু তুইনা বললি তোর প্রমোশন হয়েছে?

– হয়েছে তো মা সততার প্রমোশন। আমি পারিনি দুর্নীতিকে গলায় লাগিয়ে তাকে পুঁজি করে উপরে উঠতে। আমার বিবেক আমাকে ছেড়ে দিবেনা। আমি পাগল হয়ে যাব মা! এতো সব মিথ্যার উপরে বসত করা যায়না মা। রিজিকের মালিক আল্লাহ। আমি মনুষ্যত্ববিহীন চাকরির বেড়ি পা থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে চলে এসেছি মা!

আবারো পিনপতন নিরবতা ফিরে এলো খাবার টেবিলে। জালাল একটানা ডেকে চলা কাকটার জন্য কিছু খাবার বাইরে ছুঁড়ে মারল।

বাইরের পরিবেশটা বেশ রৌদ্রজ্জল। তারচে’ বেশি সততার আলোয় ঝলমল করছে আয়েত আলীর ঘরের ভেতরটা।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button