সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

কেমন আছে মিয়ানমারের অন্য মুসলমানরা?

মিয়ানমারের ইয়াঙগুনে এমন এলাকা বিরল নয় যেখানে গির্জা, মন্দির ও প্যাগোডার পাশাপাশি মসজিদও শহরটির বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এই শহরেরই পাশে এমন গ্রাম আছে, যেখানে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ‘মুসলমানমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে’। বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক (বিএইচআরএন) গত বছরের ৫ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ রকম ২১টি গ্রামের বিবরণ দিয়েছে। এসব গ্রামের বাসিন্দারা বলছে, তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। এটা দেশটিতে পদ্ধতিগতভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রাতিষ্ঠানিকতার ইঙ্গিত দেয়। অথচ ‘বার্মা ইউনিয়নের’ প্রতিষ্ঠাতা আং সাংয়ের প্রধান কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন মুসলমান এবং দেশটির সব শহর-উপশহরেই অল্প-বিস্তর মুসলমান কয়েক শতাব্দী ধরে বাস করে আসছে।

বহির্বিশ্ব এখন মিয়ানমারের মুসলমান বিদ্বেষের কথা চূড়ান্তভাবেই অবহিত। কিন্তু শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, সংখ্যায় বড় না হ’লেও মিয়ানমারজুড়ে আরও এমন মুসলমান জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা এখন চরম অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। যেমন মিয়ানমারের ওপরের অংশে ‘পানথে’ মুসলমানদের কথাই ধরা যাক। মান্দালে ও শান রাজ্যে এদের বসতির ইতিহাস কয়েক শ’ বছরের। মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্দালেতে পানথেদের এমন মসজিদও আছে, যা ১৮৬৮ সালে নির্মিত। ব্রিটিশদের ১৯০০-০১ সালের গেজেটেও ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী হিসাবে পানথেদের উল্লেখ আছে। কিন্তু ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার নতুন নাগরিকত্ব আইনে ‘মিয়ানমারের জাতিসত্তাসমূহের’ যে তালিকা করে, তাতে ১৩৫টি জাতিসত্তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের মতো পানথেদেরও ঠাঁই হয়নি। পরিচয়হীন জনগোষ্ঠী হিসাবে হানাফী মাযহাবের প্রায় এক লাখ পানথে মুসলমান এখন চেষ্টা করছে এটা প্রমাণ করতে যে তারা রোহিঙ্গা নয়। চীনা ধাঁচের মুখাবয়বের কারণে শারীরিকভাবে এটা প্রমাণ করা তাদের জন্য কঠিন হয় না। কিন্তু মুসলমান পরিচয়জনিত অন্যান্য বঞ্চনা এড়ানো সামান্যই সম্ভব হয়।

পানথেদের চেয়েও করুণ অবস্থা কামিয়ানদের। যদিও তারা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ১৩৫টি ন্যাশনাল রেইস-এর একটি। মিয়ানমার সরকার একমাত্র যে মুসলমান সম্প্রদায়কে আইনগতভাবে ঐ দেশের জাতিসত্তা হিসাবে স্বীকার করে তারাই কামিয়ান বা কামান। নৃতাত্ত্বিকভাবে এরা মূলত ১৬৬০-এ আরাকানে আশ্রয় নেওয়া মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা ও তাঁর সহযোগীদের বংশধর। চরম ধর্মীয় উগ্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কামিয়ানরাও এখন আমরা রোহিঙ্গা নই প্রমাণ করতে সচেষ্ট, যা কার্যত একধরনের স্বপ্রণোদিত বার্মারাইজেশন-এর জন্ম দিয়ে চলেছে। কামিয়ানদের অন্তত দু’টি রাজনৈতিক দলও রয়েছে কামিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পার্টি এবং কামিয়ান ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি নামে। মাঝে মাঝে সরকারের চাপের মুখে উভয় দলের নেতৃত্বকেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে হয়।

১৯৩১-এর শুমারিতে কামিয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাযার। বর্তমানে সমগ্র দেশে এই সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৫০ হাযারের মতো হবে বলে মনে করা হয়। তাদের ২০ হাযারই রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা। এর তিন-চতুর্থাংশই আবার ২০১২ সালের দাঙ্গার পর থেকে থাকছে উদ্বাস্ত্ত শিবিরে। রোহিঙ্গাদের মতো এদেরও নিজ এলাকায় ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। বস্ত্তত ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের আগেই রাখাইনের কামিয়ানদের অধিকাংশই উদ্বাস্ত্ত।

সরকারের আইনগত অবস্থান অনুযায়ী কামিয়ানদের স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত মূল সমাজ ও প্রশাসন রোহিঙ্গাদের মতো তাদেরও বাঙালী প্রমাণ করতে সচেষ্ট। ফলে তাদের নাগরিকত্ব সনদ পেতে চরম হয়রানি পোহাতে হয়। উদ্বাস্ত্ত শিবিরের বাইরের কামিয়ানদেরও রাখাইন রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই। রাখাইন ছেড়ে যাওয়া সব যানবাহন সব সময় নযরদারীতে রাখা হয় রোহিঙ্গা বা কামিয়ান কেউ দেশের অন্যত্র যাচ্ছে কি না, সেটা দেখতে। কামিয়ানরা দেখতে রোহিঙ্গাদের মতোই। ফলে তাদের নাগরিকত্বের আইনগত অধিকার থাকলেও বাস্তব স্বীকৃতি নেই।

কামিয়ানদের পুনর্বাসন নিয়ে গত ৫ই মার্চ মিয়ানমারের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে (প্লিথু হুলুথ) একটি বিতর্ক উঠেছিল। বিতর্কে অংশ নিয়ে দেশটির সাগাইন অঞ্চলের একজন সংসদ সদস্য মুসলমানদের ক্যানসার হিসাবে অভিহিত করে তাদের পুনর্বাসনেরও বিরোধিতা করেন। কিন্তু পার্লামেন্টের স্পিকার বা অন্য সদস্যরা আইনগতভাবে বৈধ একটা জাতিসত্তা সম্পর্কে এমন বিদ্বেষী ভাষণের বিরোধিতা করেননি।

২০১২ সালের রাখাইন দাঙ্গার দুই বছর পর মিয়ানমারের মান্দালেতে আরেকটি যে বড় দাঙ্গা হয়, তার শিকার পাথি মুসলমানরা। পাথিরা বহু শতাব্দী ধরে ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা এবং দেশটির ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এরা খুবই সক্রিয় জনগোষ্ঠী ছিল। তবে স্বাধীনতার পর তারাও রোহিঙ্গাদের মতোই ন্যাশনাল রেইস-এ ঠাঁই পায়নি এবং যথারীতি যাবতীয় বৈরীতার মুখোমুখি। একই ভাগ্যলিখন ঘটেছে দেশটির সর্বদক্ষিণের পাসু নামে পরিচিত মালয়ভাষী প্রায় ৩০ হাযার মুসলমানের ক্ষেত্রেও। এরাও মিয়ানমারের ১৩৫ জাতিসত্তার তালিকায় ঢুকতে পারেনি। মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে অতি সোচ্চার থাকায় পাসুদের ব্যাপারেও বার্মার বৌদ্ধদের মনোভাব অনেক রক্ষণশীল এখন।

আইনগত স্বীকৃতি থাকলেও এ রকম বহুমুখী সামাজিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষের পরিবেশে স্বস্তিতে বসবাস যে কঠিন, সেটাই দেখা যায় জারবেদী ও তামিল মুসলমানদের ক্ষেত্রে। জারবেদীদের একরকম বার্মার মুসলমানই বলা যায়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বা তারও আগে কর্মসূত্রে আসা যেসব বিদেশী মুসলমান পুরুষদের সঙ্গে স্থানীয় বামার নারীদের বিয়ে হয়েছিল, তাদের বংশধর মুসলমানরাই মিয়ানমারে জারবেদী নামে পরিচিত। মূলত তাদের হাতেই ১৯০৯ সালে বার্মা মুসলিম সোসাইটি নামের সংগঠনের জন্ম। মিয়ানমারে প্রায় এক শ’ বছর ধরে জারবেদীরা নিজেদের বার্মিজ মুসলমান হিসাবে আলাদা জাতিগত পরিচয়কে আইনসিদ্ধ করতে লড়ছে। প্রাণপণে চেষ্টাও করে যাচ্ছে মূলধারায় মিশে থাকতে। কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতিতে এরা অন্য সব বার্মাদের মতো হ’লেও পৃথক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির সংগ্রামে সফলতা আসেনি। উপরন্তু সাম্প্রতিক উদীয়মান মুসলমান বৈরীতায় তারাও আক্রান্ত।

তাদেরও কা-লা ডাক শুনতে হয়। যে শব্দটি মিয়ানমারে মূলত মুসলমানদের জন্য অপমানসূচক সম্বোধন হিসাবে ব্যবহৃত। বার্মার জাতীয়তাবাদীদের একাংশ বলছে, বার্মার জাতির অন্তর্ভুক্ত হ’তে হ’লে কেবল বৌদ্ধই হ’তে হবে। এভাবেই জারবেদীরাও বিভেদরেখা পেরোতে পারছে না।

মিয়ানমারের আরেক বিড়ম্বিত মুসলমান জনগোষ্ঠী ব্ল্যাক কারেন। স্বাধিকারের দাবীতে কারেনদের সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বিশ্ব জানে। কিন্তু সেই জানাশোনার মধ্যে কারেন জনপদের মুসলমানরা কীভাবে বিড়ম্বিত, সেটা চাপা পড়ে গেছে। কারেনদের মূল সংগঠন ‘কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন’ ঐতিহাসিকভাবে সেক্যুলার আদর্শের অনুসারী হ’লেও একে দুর্বল করতে সেনাবাহিনীর মদদে বৌদ্ধপন্থী কারেনরা ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি (ডিকেবিএ) নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। তাদের প্রভাবিত এলাকা থেকে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা বিতাড়িত ২০০১-এর সেপ্টেম্বর থেকে। কারেন রাজ্যের এসব এলাকায় সেনা স্থাপনা নির্মাণের জন্য মুখ্যত ব্ল্যাক কারেনদের গ্রামগুলোই বেছে নেওয়া হয়।

মিয়ানমারজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বহুমুখী নিপীড়নের শিকার মুসলমানের প্রকৃত সংখ্যার নির্ভরযোগ্য কোন শুমারী নেই। ২০১৪ সালে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে শুমারী কার্যক্রমে বাদ রেখেই জনসংখ্যার যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, তাতে দেশটিতে মুসলমান জনসংখ্যা ১১ লাখ ৪৭ হাযার বলে উল্লেখ করা হয়। এই সংখ্যাকে অনেকে বাস্তবতার থেকে কম বলেই মনে করেন। তবে এ থেকে অনুমান করা যায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ছাড়া অন্যান্য মুসলমান জনগোষ্ঠী প্রায় ১০ লাখের ওপরে। দশকের পর দশক এদের বিড়ম্বিত জীবনকাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়ন সংবাদগুলোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব রোহিঙ্গাদের সংকটের কথা যতটা জানে, ততটা জানে না পানথে, জারবেদী ও ব্ল্যাক কারেনদের কথা।

মিয়ানমারের মুসলমান সম্প্রদায়গুলোর আরেক সমস্যা হ’ল, তারা পরস্পর থেকে সামাজিক ও সাংগঠনিকভাবে বিচ্ছিন্ন। তাদের কোন একক সংগঠন নেই। তাদের সবার অবস্থানও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। ফলে বার্মারদের সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদের সামনে তারা কার্যত অতীতের সাজানো জীবনযাপন থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছে।

-আলতাফ পারভেয
[প্রথম আলো ৮ই মে ২০১৮]

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button