জীবনের বাঁকে বাঁকে

কোথায় যাচ্ছো?

#মার্চ, ২০১৭
ডায়রীর পাতা থেকে

আমার নাম সাইফ। রাজধানী ঢাকার এক কোণে আমি থাকি। এ শহরেরই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। সাজানো, গোছানো, ছোট্ট মধ্যবিত্ত পরিবার আমার। ছোট থেকেই নামাজ পড়ি নিয়মিত। মাঝেমধ্যে কুর’আন তিলাওয়াত করি। ছোটো থেকেই শিখে এসেছি কুর’আন তিলাওয়াতে সাওয়াব অনেক। সে থেকেই পড়ি।

আমি সাইফ যার ধারণা সে যথেষ্ট সামাজিক একজন ছেলে। আমি সবার সাথে মিশি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই। আমার বন্ধুতালিকায় ছেলেমেয়ে সবাই আছে। আমি পার্টিতে যাই, ভ্রমণ করি, সেলফি তুলি, চিল করি।

এই আমার একজন খুব কাছের বন্ধু আছে। মজার বিষয় হচ্ছে ওর নামও সাইফ। সাইফুল্লাহ। আমার নাম সাইফুর রহমান। ওর আমার স্বভাব চরিত্রে বহু মিল। ও আমাকে যথেষ্ট সঙ্গ দেয়। আমিও নামাজ পড়ি সেও পড়ে। কিন্তু ছেলেটা একটু কেমন কেমন যেন। সবকিছু তেই অতিরিক্ত চিন্তা করে। এটা করা কি ঠিক হচ্ছে, ওটা কি ঠিক হচ্ছে? যেদিন আমি ওকে বলেছিলাম, “দ্যাখ্, আমি আমার মেয়ে বন্ধুগুলোকে বোন হিসেবেই দেখি” সেদিন ও আমাকে খুব কড়া কিছু কথা শুনিয়ে গিয়েছিল। আমিও ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিলাম তুমুল। ”পশ্চাতমনা” হুজুরকে নিয়েছিলাম একহাত।সে থেকে আমাদের মধ্যে কথা বন্ধ। আর কথা হয়নি। সাইফ আমাকে প্রায়ই বলত, “তুই কী করছিস, কোথায় যাচ্ছিস রে?” গল্প করতে করতে হুট করে বলে উঠত কথাটা। ছেলেটা ভালো আরবি জানত। ওর কাছে থেকেই জেনেছিলাম আ’উযু আর নাউযুর পার্থক্য। বড় জ্ঞানী ও ভাবুক ছেলে ছিল। মাঝেমধ্যে ভাবি শুধু শুধু ঝগড়াটা বাধাতে গেলাম কেন!

সাইফ একদিন বলেছিল, “জানিস তোকে যে আমি কোথায় যাচ্ছিস এই প্রশ্ন করি তা কুর’আনে আছে? আল্লাহও আমাদের এমনি প্রশ্ন করেছেন। খালি তো তিলাওয়াত করে যাচ্ছিস। জানিস ওর ভেতরে আল্লাহ কী বলেছেন?”

ওর কথাকে বরাবরের মতই তেমন গুরুত্ব দেইনি।
ওকে ছাড়াও আমার জীবন আনন্দেই চলছে।

#রমাদ্বান ২০১৭

আজকের ডায়রি লিখার সময় গতবছরের টা নিয়ে বসেছি। কিন্তু পাতাগুলো কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গিয়েছে। ভিজেছিল ছয়মাস আগে খুব তাই এমন দশা। সাইফের সাথে কতদিন দেখা হয়না। ছয়মাস আগে একবার দেখা হয়েছিল শেষ। আজকেও দেখা করতে যাবো। তার সাথে নাকি দেখা করা যাবে না। তবে আমি আমার কথা বলে যাবো। সে যতোই অভিমান করুক।

সাত আট মাস আগে আমার আব্বু মারা যান। হঠাৎ করে একের পর বিপদ আসতে থাকে পরিবারের। কষ্ট দুর্দশার সময়ে সুসময়ের বন্ধুগুলোকে হারাই। আড্ডা সিগারেট, মিউজিক কিছুই করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। টিউশনি করে পরিবার চালাতে হচ্ছিল। প্রায় ছ’মাস আগের কথা এটা। হুট করে একদিন সাইফ আমাদের বাসায় আসে। যেই বন্ধুকে আমি গালিগালাজ করে দূর হতে বলেছিলাম সে আমার দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। সান্তনা দিয়ে বুঝায় যে প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। সেদিন ওর কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল। এত ভালো লেগেছিল যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এতদিনে নামাজ কালাম সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। কুর’আনের অর্থ দূরে থাক তিলাওয়াত ই করতাম না। হঠাৎ সেদিন আমার মনে হচ্ছিল, “আমি কোথায় যাচ্ছি”। সেদিন অনেক কথা হল। ও বার বার নিজের ভুলের জন্য সেদিন আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল। অথচ ওর কোনো দোষ ছিলনা। জিজ্ঞেস করবো করবো করে আর করতে পারিনি ঐ আয়াতটির আরবি কী। রাত হয়ে গিয়েছিল আর তার তাড়া আছে বলে ভাবলাম পরের দিন জিজ্ঞেস করে নেবো।

আমার জীবনের সবচে কষ্টের একটা দিন এর পরের দিন। আমি আগ্রহের আতিশয্যে ঐ আয়াতটি কোন সূরায় আছে তা জানতে সাইফের কাছে যাই ওর বাসায়। গিয়ে ওকে পাইনি। একটুকরো সাদা কাপড়ে জড়ানো দেহের শুধু মুখটাই উন্মুক্ত ছিল সেদিন। কী এক অদ্ভুত নূর মাখানো শ্মশ্রুশোভিত মুখটা সেদিনই শেষ দেখার তাওফিক আল্লাহ দিয়েছিলেন।

আজকে সূরা তাকউইর পড়ছিলাম। ২৬ নাম্বার আয়াতটিতে এসে চোখ আটকে গেল। “অতপর, তোমরা কোথায় যাচ্ছো?” ছয়মাসে কাউকে না জিজ্ঞেস করে নিবিষ্ট মনে প্রতিদিন অল্প অল্প করে খুঁজেছি এই আয়াতটি। এরই মধ্যে পড়া হয়ে গেছে আলিফ লাম মিম থেকে তাবারাকাল্লাযির মত ২৯ টি পারা। অতঃপর জুয আম্মায় খুঁজে পেলাম তাকে। যে আয়াতে কারিমা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে এসেছে। সাইফ! আজ তোকে দেখতে আসব রে! তোর জন্য খুব করে আল্লাহর কাছে কথা বলে নেবো। আজিমপুরের বাসে উঠেছি…

‘কোথায় যাচ্ছো?’
– শেখ আসিফ

©ঘুড়ি-Ghuri

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button