মুক্তবাসিনী

বেপর্দা ও ইভটিজিং : সহোদরার সহযাত্রা

খালি পায়ে হাঁটতে হঠাৎ সামনে সাপ পড়লে কিংবা নিরস্ত্র একাকী ব্যক্তি জঙ্গলে আচানক বাঘের সামনে পড়ে গেলে যেমন ভয়ে আঁতকে ওঠে, তেমনি এ সময়ের তরুণী, যুবতী ও তাদের অভিভাবকরা ইভটিজিংয়ের নাম শুনলে কেঁপে ওঠেন। ইভটিজিং এ সময়ের খুবই আলোচিত ও মানুষের মুখে-মুখে উচ্চারিত একটি শব্দ। আসুন, শব্দটি সম্পর্কে সাধারণ কিছু তথ্য জেনে নিই।

বস্তুত ‘ইভটিজিং’ শব্দটি এসেছে মত্তু ভাষা থেকে। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে শব্দটি বেশী ব্যবহৃত হয়। আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে এর স্থলে ব্যবহৃত হয় ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’। ইভটিজিং হচ্ছে- রাস্তা-ঘাটে বা প্রকাশ্য স্থানে নারীকে যৌন হয়রানী করা। তাদেরকে লক্ষ্য করে অশ্লীল ভাষা বা যৌনাত্মক কথাবার্তা ছুঁড়ে দেয়া। টিটকারী ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা অথবা পিছু লেগে থেকে নারীকে বিরক্ত করা।

আজ সহজ হয়েছে নারীকে উত্ত্যক্ত করা! ভয়াবহ ক্যান্সারের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই মহামারী- গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-পল্লীতে সবখানে। একদিকে শিক্ষকরা ইভটিজিং প্রতিরোধে বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছেন, তো অন্য দিকে শিক্ষকরাই ছাত্রীদের সঙ্গে ইভটিজিং করছেন! এ কারণে শাস্তিরও সম্মুখীন হচ্ছেন তারা বহুস্থানে। এই সম্প্রতি দুইজন শিক্ষককে এ কারণে শাস্তি দেয়া হয়েছে!

সভ্যতার এই বাজারে পানির শালুক আর বন্য বাইতার শাকের মূল্যও যেখানে কম নয়, সেখানে একমাত্র নারীর মূল্যটাই কম! নারী অহরহ লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে, তাদের ইজ্জত-আব্রু নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। কেন? কেন এতো ঠুনকো হলো চিরসম্মানী নারীর এই মর্যাদা? শুধু কি তা-ই? যারা তাদের মর্যাদা রক্ষার্থে প্রতিবাদ করছে, তাদেরকেও বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে। নিচের ঘটনা ৩টি পড়ুন :

ঘটনা-১ : মিজানুর রহমান মিজান। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে। আট বছর আগে নাটোর জেলার বাঘতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজের রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। শিক্ষাবিস্তারের মহান ব্রত নিয়ে নিজ জেলা থেকে ছুটে এসেছিলেন অন্য জেলায়। জাতিকে করতে চেয়েছিলেন শিক্ষিত, নন্দিত। কিন্তু মচকে যাওয়া পায়ের ওপর যে জাতির সভ্যতা দণ্ডায়মান, সেই জাতি তাকে আর কী-ইবা উপহার দিতে পারে? তাই তারা বন্দনার বদলায় দিল নিন্দা আর নিরাপত্তার পরিবর্তে করল প্রাণসংহার!

তিনি লক্ষ্মীপুর থেকে মোটরসাইকেলযোগে কলেজে যাতায়াত করতেন। ওই কলেজের ছাত্রীদের প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত বাঘতিপাড়া উপজেলার চকগোয়াম বেগুনিয়া গ্রামের বখাটে দুই যুবক। গোলাম রসূলের ছেলে আসিফ ও মনছুরের ছেলে আব্দুল আউয়াল রাজন। যৌনক্ষুধার জলাতঙ্ক রোগে কাতর এসব যুবক। নারী দেখলেই হামলে পড়া তাই এদের নেশা। যুবতী কলেজ ছাত্রীর শালীনতাবর্জিত পোশাক ও অবগুণ্ঠনমুক্ত চেহারা তাদের মাথায় নেশা ধরিয়ে দেয়। মাতাল করে তোলে তাদের। যে সমাজ তাদেরকে নারীর অবগুণ্ঠনমুক্ত চেহারা উপহার দিয়েছে, যুবতী নারীর উন্নতবক্ষের লোভনীয় দৃশ্য উপঢৌকন দিয়েছে, সেই সমাজ তাদের কামনার আগুন নির্বাপিত করতে বাধ সাধে কেন- এই প্রশ্নে তারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে যায়। তাই যুবতী নারীদেরকে দেখলে ওড়না ধরে টানাটানি করে। কুকথা বলে নারী সম্ভ্রমের শিকড় ধরে টান দেয়।

শিক্ষক মিজান প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। এসব অনৈতিকতা তাকে মর্মাহত করে। তিনি জলাতঙ্ক রোগীদের ডেরায় হানা দেন। প্রতিবাদ করেন অন্যায়ের। তিনিসহ কলেজের কয়েকজন শিক্ষক মিলে দুই বখাটে যুবকের অভিভাবকদের ডেকে তাদের সন্তানদের এহেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানান।

কিন্তু উচ্ছন্নে যাওয়া বখাটে যুবকদের শাসন করে সাধ্য কার? মা-বাবা কিংবা অন্য কোনও অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব নয় তাদের নাকে লাগাম পরানো! কেননা, আল্লাহর ডর-ভয়হীন এসব যুবকের সামনে অভিভাবকের লাঠি তুলার দড়ির চেয়ে বেশি ভারি কিছু নয়!

তাই এই শাসনের কথায় আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে তারা। যারা তাদের কামনার আগুনে পানি ঢেলে দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে নমরুদের আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে তারা। এই আগুনের স্ফূলিঙ্গ প্রথমে নিক্ষিপ্ত হয় মিজানের গায়ে। আগুনের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় তার প্রতিবাদী শক্তকণ্ঠ।

২রা অক্টোবর কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আসিফ ও রাজন মিজানের গতিরোধ করে। মিজান কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা লোহার রড দিয়ে তার মাথায় আঘাত হানে। দুইজনের সাঁড়াশি আক্রমণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে একটি প্রতিবাদী ও সত্যাশ্রয়ী কণ্ঠ। আর মুখ কেলিয়ে হেসে সমাজের স্রোতে বীরদর্পে মিশে যায় রাজিন-আসিফ। স্থানীয়রা মিজানকে প্রথমে বাগতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে নেয়া হয় রামেক হাসপাতালে। সেখানেও অবস্থার অবনতি হলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার পিজি হাসপাতালে। সেখানে বারো দিন চিকিৎসা নিলেও শেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় তাকে। নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। ২৪ অক্টোবর শনিবার দিবাগত রাত একটায় তিনি পরপারের যাত্রী হন। [সূত্র : দৈনিক আমার দেশ ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা, ২৮/১০/২০১০ ইং]

মিজানের মৃত্যু এলাকাবাসীর অন্তরে বেদনার ঝড় তুলেছে। তাদের অন্তর ছেয়ে গেছে বিষাদের কালো ছায়ায়। তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা মিলি অল্প বয়সে বৈধব্যের গহনা পরলেন গলায়। স্বামীহারা মিলির অসহায় দৃষ্টি কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। হয়ত মিলিয়ে যায় খেলাফতে রাশেদার শাসনামলের অতীত গর্ভে। এই লুণ্ঠিত সভ্যতার সমাজ-সংসার থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান তিনি। ফিরে যেতে চান কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইসলামী আদর্শের সুনগরীতে।

তার চার বছরের কন্যা লুসাইবা রশিদ মম শুধু আব্বু-আব্বু বলে ডাকছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্না থামছে না। যেদিন থামবে কিংবা থামার বয়স হবে, সেদিন হয়ত লুসাইবা দেখবে এমন আরেকটি দৃশ্য। দেখবে, আরেকজন লুসাইবা তার বাবা কিংবা ভাই অথবা আপনজনের এমন করুণ পরিণতিতে কাঁদছে। এই সমাজে এ কান্না থামবে না। কেবল একজন আরেকজনের স্থান পূরণ করবে মাত্র। যদি না সমাজের মরণব্যাধি বেপর্দা ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচারকে ঝেঁটিয়ে না তাড়ানো হয়।

ঘটনা-২ :  চাঁপারানী ভৌমিক। নিহত হয়েছেন মোটরের চাপায়। তাকে চাপা দিয়ে হত্যা করার ঘটনাটি পরিকল্পিত, ইচ্ছাকৃত এবং ঘাতকের প্রতিশোধের চাপা আগুনের নির্ধূম প্রজ্জ্বলন। চাঁপারানীর অপরাধ, তিনি একজন মা এবং মায়ের অধিকার বলে নিজ সন্তানকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করেছিলেন।

তার দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত মধুখালী বাজারের মদ ব্যবসায়ী রতন সাহার ছেলে দেবাশীষ সাহা রনি (২৪)।  ছুঁড়ে দিত যৌনাত্মক বিষবাক্য। ‘ওয়াও! মাই ডার্লিং!’ বলে নারী মর্যাদার ওপর কলঙ্কের আবর্জনা ছুঁড়ে মারত সে।

তবে লজ্জার ভয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই পাপবাষ্পকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন চাঁপারানী। কিন্তু বাতাস-বাষ্প এসব পদার্থকে আর কতক্ষণ আটকে রাখা যায়? তাই অপারগ হলেন দুর্বার শক্তির বাঁধন খুলেও দিতে। প্রকাশ করলেন রনির কীর্তিকলাপের কথা। বিচার চাইলেন মধুখালী উপজেলার চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুরাইয়া সালাম এবং চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির কাছে। এসব লোকজন রনির বাবাকে ডেকে সতর্ক করে দিলেন।

তাদের এই সতর্ক-সংকেত হিতে বিপরীত হলো। যে সমাজে রনিদের বীরদর্প পদচারণা, সম্ভ্রমলুটেরাদের নির্বিঘ্ন পদযাত্রা, সে সমাজে ভালো মানুষের চোখরাঙানী বা শাসন তেমন কোনও কাজে আসে না। বরং হিতে বিপরীত হয়, পাপের দাবানলে অপ্রতিরোধ্যের জ্বালানী সরবরাহ করা হয়।

আমার কথার সত্যতা দেখুন : ২৬ই অক্টোবর চাঁপারানী বিকালে স্বামী স্বপন বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেশী হারানচন্দ্র সরকারের মেয়েকে বিদায় জানাতে রেলগেট পর্যন্ত এগিয়ে যান। বিদায় দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে উন্মত্ত দানবের বর্বরতার শিকার হন তিনি। ভারী মোটরসাইকেল দিয়ে পেছন থেকে চাঁপারানীকে চাপা দেয় সেই রনি। মারাত্মক যখমী হলে তাকে প্রথমে মধুখালী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে নেয়া হয় ফরিদপুর মেডিক্যাল হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বড়ই দুর্দমনীয় এই সমাজ! এখানে প্রতিবাদের ভাষা নগণ্য ও ক্ষীণ। কিন্তু পরিণাম মৃত্যু! চাঁপারানীর হত্যাকাণ্ড এই বিবর্ণ সমাজের রুগ্নদশার একটি ক্ষুদ্র নাটিকা মাত্র! [সূত্র : দৈনিক আমার দেশ, ২৮/১০/২০১০ ইং]

ঘটনা-৩ : মিজান ও চাঁপারানী হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি হত্যাকাণ্ড মানুষের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। এবারের ঘটনা সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থানার নিঝুড়ি গ্রামের। এলাকাবাসী জানান, রায়গঞ্জ উপজেলার নিঝুড়ি গ্রামের শম্ভুনাথ মলের ছেলে সুশীল কুমার বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার খলীসাবাড়ী গ্রামের সুনীল কুমার বরাতীর মেয়ে চান্দাইকোনা-সীমাবাড়ি এস আর গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রূপালী বরাতী টুনিকে স্কুল ও প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত।

এখানেই থেমে থাকেনি উন্মত্ত যুবক। মেয়েটিকে আপন করে নেয়ার উগ্রবাসনা তাকে পাগল করে তোলে। স্ত্রী বানানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে দিশেহারা বানিয়ে দেয়। তাই চূড়ান্ত পর্ব বিয়ের পয়গাম পাঠায় সে অভিভাবকদের কাছে। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তার এই পয়গাম প্রত্যাখ্যাত হয়। নারীর প্রতি পুরুষের অধিকার যেন অলঙ্ঘনীয়। যে কেউ তাকে প্রস্তাব দিক তাতে সাড়া দিতেই হবে। সাজুগুজু করে বধূবেশে স্বামীর পদধূলি নিতেই হবে! এর ব্যতিক্রম কিছু হলে ঘটবে হেনস্থা করা, এসিড ছোঁড়া কিংবা হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা।

রূপালীর ভাগে জুটেছিল এর শেষটা। ঘটনার দিন রূপালীকে সুশীল জোর করে বাড়িতে নিয়ে যায় এবং জোরপূর্বক তার কপালে সিঁধুর মেখে দেয়। হিন্দুধর্মে কারও কপালে সিঁধুর মাখিয়ে দিলে সে তার স্ত্রী হয়ে যায়। কিন্তু রূপালী চায় নি এমন প্রীতিহীন, মমতাহীন সিঁধুরে নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে। চায় নি এই কলঙ্কিত পথে সুশীলকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিতে।

এদিকে এই ঘটনা তাকে জীবন সম্পর্কে নিরাশ করে তোলে। এই অবাঞ্ছিত সিঁধুরের দাগ নিয়ে বাকি জীবন বাঁচতে চায় না সে। তাই ঝাঁপ দিয়েছে মৃত্যুসাগরে। এভাবেই মানববৃক্ষ থেকে ঝরে পড়ে অল্পবয়সী একজন তরুণীর জীবনপাতা।

এসব বিনাশী মৃত্যু কেবল মিজান, চাঁপারানী আর রূপালীদের ঘাড়েই বিষাক্ত ছোবল এঁকে দেয়নি, বরং যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে এই নৃশংসতা। খোলাসা করে বললে, ইসলামী সভ্যতা ও জীবনাচার থেকে মানুষের দূরত্ব যতই বাড়ছে, এসব অমানবিক ঘটনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার ঘোষণা করেছিলেন, ইসলাম একদিন প্রত্যেকের ঘরে এভাবে প্রবেশ করবে যে, সুদূর সান‘আ থেকে একজন মানুষ হাজরামাউত পর্যন্ত সফর করবে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে, একাকী। কিন্তু সে সময় এক আল্লাহর ভয় ছাড়া অন্য কোনও ভয় তাকে চিন্তিত করবে না।

ইসলামের আদর্শে হয়েছিলও তা-ই। সুদূর বালাবাক্কু শহর থেকে একজন নারী গায়ে গহনা জড়িয়ে মক্কা-মদীনায় এলেও কেউ তার দিকে মুখটা পর্যন্ত তুলে তাকাতো না। সম্ভ্রম থাকত সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু আজ! জনসম্মুখে নারীকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। গণধর্ষণ করে ধর্ষিতা নারীর সম্ভ্রমলুটের চটকদার দৃশ্য ধারণ করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হচ্ছে আর তা দেখে দর্শকরা শিহরণে চোখ কচলাচ্ছে!

ইভটিজিংয়ের এই ছোঁয়াচে রোগটা ইদানিং খুব বেড়ে গেছে। পেপার-পত্রিকা, রেডিও-টিভি ও সভা-সমাবেশ করে এর বিরুদ্ধে যতই প্রচারণা চালানো হচ্ছে, এসম্পর্কে যুবক-তরুণদের আগ্রহ ততই বাড়ছে। আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, এটি আরও বেশি মহামারী আকার ধারণ করেছে আদালতের একটি রায়ের কারণে। ইভটিজিং একটি ব্যধি, একটি আযাব। আর আযাব আসে আল্লাহর নাফরমানীর কারণে। আদালত সেই ‘আসা’টাকে সহজ করে দিয়েছে। কারণ, তারা রায় দিয়েছেন বোরকার বিরুদ্ধে। আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে। এই রায়ের মাধ্যমে প্রকারান্তরে ইভটিজিংকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কোনও কৃষক যদি ঘরের দরজা উন্মুক্ত রাখে, সেই দরজা দিয়ে ঢুকে চুরি করা চোরের জন্য কিছুমাত্র কঠিন থাকে না।

আমার মতে এই রায়ের মাধ্যমে যেন এই উদার কৃষকের ভূমিকা পালন করা হয়েছে। যেদিন এই লেখাটি লিখছি (৩০/১০/২০১০ইং), সেদিনের একটি সংবাদ আমাকে খুব আশান্বিত করেছে। প্রধান বিচারপতি এবি এম খায়রুল হক বলেছেন, বিচারকরা আল্লাহ ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ[1]

প্রধান বিচারপতির এমন একটি বাস্তব উপলব্ধি মিডিয়ায় প্রকাশ করায় আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। তিনি ঠিকই বলেছেন যে, একজন বিচারক কখনই দায়মুক্ত নন। বিশেষ করে আল্লাহর কাছে। মানবজাতির কল্যাণের জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিচারকগণকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি একটি সামগ্রিক কল্যাণকর বিধানও দান করেছেন। যে কোনও বিচারক আল্লাহর সেই বিধান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য দায়বদ্ধ এবং যারা খামখেয়ালীবশত এই দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ফাসেক-পাপী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :

﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ٤٧ ﴾ [المائ‍دة: ٤٧]

‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই ফাসেক-পাপী।’ {সূরা আল-মায়েদা, আয়াত : ৪৭}

এই সূরার ৪৫ নং আয়াতে তাদেরকে জালেম আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٤٥ ﴾ [المائ‍دة: ٤٥]

পর্দা করা আল্লাহর বিধান। এর বিরুদ্ধে রায় দেয়া আল্লাহর বিরুদ্ধে রায় দেয়ার নামান্তর। আর আল্লাহর বিরুদ্ধে রায় দিলে ওই সমাজে শান্তি আসবে কোত্থেকে? পর্দা-হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে বৃটেন, ফ্রান্স এই সব বিধর্মী দেশে। সেই ঢেউ আমাদের মতো মুসলিম দেশগুলোতে আছড়ে পড়বে কেন?

কেন ‘পর্দার জন্য বাধ্য করা যাবে না’ মর্মে রায় দেয়া হবে? অথচ কুরআনের নির্দেশ হলো পর্দার বিধান পালন করা। পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ হয়েছে :

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ﴾ [الاحزاب: ٥٩]

‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিন নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের কাপড়ের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত : ৫৯}

আমরা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করছি যে, এই রায়ের পর থেকেই দেশে উদ্বেগজনকহারে ইটভিজিং, নারী নির্যাতন, ইভটিজিংয়ের কারণে খুন, হত্যা এবং আত্মহত্যা অধিকমাত্রায় বেড়ে গেছে। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর গযব। এভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার বিধান প্রকাশ্যে লংঘন ও বিরোধিতা করা হলে সেই সমাজে আল্লাহর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটা স্বাভাবিক। আজ সারা দেশে ইভটিজিংয়ের যে মাত্রা, তার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। এটা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় সবাই উৎকণ্ঠিত। সবাই চাচ্ছে এর আশু সমাধান। কিন্তু যাতে সমাধান রয়েছে, সেই সমাধানটাকেই আদালত নিষেধ করে দিয়েছেন! কারণ, নারী উত্ত্যক্ত না হওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে এই আয়াতে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে- فلا يُؤذين ‘পর্দার বিধান পালনের ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া (উত্ত্যক্ত করা) হবে না।

অবাক হতে হয় সৃষ্টিকর্তার অসীম জ্ঞানের কাছে মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং এই ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে দুঃসাহস দেখানো দেখে। আল্লাহর আদালতের বিরুদ্ধে যাওয়া যে দুনিয়ার আদালতের জন্য শুভ নয়, তার প্রমাণ বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থার নাজুকতা থেকে আমরা কেবল তখনই পরিত্রাণ পাব, যখন আমরা সৃষ্টিকর্তার বিধানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা দেখিয়ে, পরম ভক্তিভরে তার বিধান পালন করা শুরু করব।

– আবু বকর সিরাজী


[1] আসলে এভাবে বলা জায়েয হয় নি। বলার দরকার ছিল, ‘বিচারকরা আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। তারপর জনগণের কাছেও তারা দায়বদ্ধ।’ কারণ, মুমিন আল্লাহর সাথে কাউকে (এবং) শব্দ দিয়ে বর্ণনা করে না। জনগণের ভয়ে কাজ করলে সেটা শির্ক হয়, তাকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছেই জবাবদিহীর চিন্তায় কাজ করতে হবে। [সম্পাদক]

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button