জীবনের বাঁকে বাঁকে

মোহর বনাম কৌলিন্য

মানুষের লোভের পরিসীমা নেই, নির্দিষ্ট রূপ-ও নেই। যখন যেখানে সুযোগ পায় সেখানে সে চেহারা দেখায়। যেমন ধরা যাক বিয়ে। দুটি প্রাণকে আল্লাহ অনুমতি দেবেন এক সাথে থাকার, নতুন সংসার গড়ার। বাবার অভিভাবকত্ব থেকে মেয়েটির দায়িত্ব বুঝে নেবে ছেলেটি। সে যে লায়েক হয়েছে, বউকে যে উপোস করে থাকতে হবে না তার প্রমাণ কী? মোহর দেবে সে মেয়েকে। আয় থেকে টাকা জমিয়ে জমিয়ে যে সঞ্চয়টা সে করেছিল বিয়ে করবে বলে, তার একটা অংশ স্ত্রীর হাতে তুলে দেবে।
স্ত্রীর হাতে, স্ত্রীর পরিবারের হাতে নয়। এটা কন্যাপণ নয়। এটা মোহর। এ দিয়ে নারীকে সম্মানিত করেছেন আল্লাহ। বাউন্ডুলেদের রাশ টেনে ধরেছেন আল্লাহ, যিনি সব প্রজ্ঞার উৎস।
মোহর কতটা জরুরি তা নীচের হাদিসটা থেকে বোঝা যায়ঃ
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এক নারী এসে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি নিজেকে আপনার নিকট (বিবাহের উদ্দেশে) অর্পণ করলাম। এ কথা বলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। (কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন) এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আপনার যদি (বিয়ের) প্রয়োজন না থাকে, তবে তাকে আমার সাথে বিয়ে দিন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নিকট মোহর হিসেবে এমন কিছু আছে কি যা তুমি দিতে পার? সে বলল, আমার এ লুঙ্গি (জাতীয় পোশাক) ছাড়া আর কিছুই নেই।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, লোহার একটি আংটি হলেও সন্ধান করো। কিন্তু সে কিছুই খুঁজে পেল না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কুরআনের কিয়দংশ (মুখস্থ) আছে? সে বলল, হ্যাঁ, অমুক সূরা, অমুক সূরা আমার জানা আছে। তিনি বললেন, তোমার যতটুকু কুরআন (মুখস্থ) আছে তার বিনিময়ে তোমাকে তার সাথে বিবাহ সম্পাদন করলাম।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগে নিশ্চিত করেছেন মোহর হিসেবে যে সম্পদ দেওয়া হবে তা ঐ লোকের কাছে আছে কিনা।
আমাদের দেশে ‘মোহর’ বললে মানুষ ঠিকমতো বোঝে না। বলতে হবে ‘দেন মোহর’। ‘দেন মোহর’ কেন? কারণ এটা দেনাতেই থেকে যায়, স্ত্রী আর হাতে পায় না। মরার আগে স্ত্রীর কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া হয়। সে সুযোগ না পেলে স্ত্রীকে বলা হয় মৃত স্বামীকে মাফ করে দিতে। আল্লাহর বিধানের সাথে নির্লজ্জ উপহাস। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন এত টাকা মোহর নির্ধারণ করেছিলেন যদি দেওয়ার নিয়ত করে না-ই থাকেন?
ভয়ংকর সব উত্তর আসে। বেশি মোহর হলে নাকি মোহর পরিশোধের ভয়ে বউকে তালাক দেবে না স্বামী। এভাবে ভালোবাসা হয়? এভাবে বেঁধে রাখা যায়?
যায় না বলেই নববধূ লাশ হয়ে আসে বাবার ঘরে, জান নিয়ে ফিরতে পারে না।
এমন সব খুনের আবার নাম-ও আছে। ব্রাইড বার্নিং।
ঘরের বউকে বেঁধে কেরোসিনে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। সেই ১৯৯৬ সালের হিসেবে ভারতে প্রতি বছর এভাবে আড়াই হাজার মেয়েকে পুড়িয়ে মারা হতো। এখন সংখ্যাটা কত কে জানে?
২.
বহুদিন আগের কথা। ভারতে তখন আর্যদের নতুন প্রবেশ। অনার্য দেশিরা বড় বড় চোখ করে উঁচু জাতের আর্যদের দেখে। গোড়া বরণ। কটা চোখ। কারো কারো শখ হয় জাতে ওঠার। উপায় কী? মেয়ে নিয়ে গেল আর্য বীরের দ্বারে।
– মশায় আমার কন্যাটিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করুন।
– কেন?
– আপনাকে অনেক সম্পদ দেব।
গেল সে কাল।
পুরুষ মানুষ বুঝে গেল বিয়ে করা ভালো ব্যবসা।
উনবিংশ শতাব্দীর আগের কথা। বাংলাপিডিয়ার ভাষ্যে,
উচ্চবর্ণের বাহ্মণরা প্রচুর যৌতুক পাওয়ার আশায় শতাধিক বিবাহ করত। এসব স্ত্রী তাদের পিতৃগৃহেই থাকত। স্বামীরা বছরে একবার দেখা করতে আসত এবং প্রচুর আতিথেয়তা ভোগ করে যাওয়ার সময় অনেক যৌতুক নিয়ে যেত।
উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও কুলীনত্বের মর্যাদা লাভ করে। তখন হিন্দুসমাজে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম হয়। তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ডিগ্রী অর্জন করে। এতে চাকুরির বাজারে তাদের দাম বেড়ে যায় এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তখন কন্যাপক্ষ বিভিন্ন উপহার-উপঢৌকন দিয়ে বরপক্ষকে আকর্ষণের চেষ্টা করত। তাদের উপহারের মান ও পরিমাণের উপর নির্ভর করত পাত্রের পিতা-মাতার সন্তুষ্টি। এক কথায় এটি দাবি করে নেওয়ার পর্যায়ে চলে যায়।
আশা ছিল শিক্ষার ফলে কুলীনত্বের ক্ষতিকর দিকগুলো দূরিভূত হবে। কিন্তু তা না হয়ে বরং কুলীনত্ব আরো শক্তিশালী হয়েছে।
৩.
একবিংশ শতাব্দীর কথা। এখন কুলীনত্বে নতুন মাত্রা এসেছে। মেয়ে আমার অনেক পড়াশোনা করেছে। বিয়ের বাজারে তার একটা দাম নেই? এত কম মোহরে চলে?
অথচ উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেছিলেন, তোমরা স্ত্রীদের মোহর নির্ধারণে সীমালঙ্ঘন করো না। কেননা যদি উক্ত মোহর নির্ধারণ দুনিয়াতে সম্মান এবং আল্লাহর নিকট তাকওয়ার বিষয় হতো, তবে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই তোমাদের চেয়ে তা নির্ধারণে অধিক অগ্রগামী হতেন। কিন্তু ১২ উকিয়্যার বেশি পরিমাণ মোহর নির্ধারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোনো সহধর্মিণীকে বিয়ে করেছেন কিংবা কোনো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
আবু সালামাহ ইবন আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আইশাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত মোহর দিয়েছিলেন। উত্তরে তিনি বলেন, ১২ উকিয়্যা এবং এক নাশ।
এক নাশ বলতে বোঝায় অর্ধ উকিয়্যা। সাড়ে বারো উকিয়্যা মানে ৫০০ দিরহাম। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ের এক দিরহামের ভর ছিল আমাদের হিসেবে ২.৯৭৫ গ্রাম।
অর্থাৎ ১৪৮৭.৫ গ্রাম রূপা ছিল রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী এবং কন্যাদের মোহরের পরিমাণ। গড় হিসেবে দেড় কেজি। আজ ২৫ শাউয়াল ১৪৩৮ হিজরির রূপার দর হিসেবে আসে ৬৩,৬৫০ টাকা।
তাহলে ৬৪ হাজার টাকার বেশি মোহর ধার্য করা যাবে না?
যাবে।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার মহিলাদের জন্য চল্লিশ উকিয়্যার বেশী মোহর নির্ধারণ করলে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নেয়ার ঘোষণা দেন। এ কথা শুনে এক মহিলা প্রতিবাদ করে বললেন, কে আপনাকে এ কথা বলার অধিকার দিল? কারণ আল্লাহ বলেছেন,
‘‘যদি তোমরা তাদের কাউকে রাশি রাশি সম্পদও মোহর দিয়েও থাকো তবে তা থেকে কোনো কিছুই তোমরা গ্রহণ করো না।’’
এ যুক্তিভিত্তিক দলীল শুনে উমার বললেন, মহিলাটি ঠিক বলেছেন, আর উমার ভুল করেছেন।
কিন্তু মোহর বেশি করা যাবে কার জন্য? যার অনেক আছে।
যে ছেলেটার ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকা জমানো আছে সে তার স্ত্রীকে দুই লাখ টাকা মোহর দিতেই পারে। কিন্তু যে ছেলেটা পরিবারের খরচ আর মায়ের চিকিৎসার ব্যয় বয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমিয়েছে তার কাছে দুলাখ টাকা মোহর চাওয়ার যুক্তি কী? কোথা থেকে দেবে সে? চুরি করে?
নাকি বাকী রেখে দেবে? কেন বাকী রাখবে?
পরে মাফ নেবে বলে? পরে যদি মাফ চেয়েই নেয় তবে সে আগে বাকী রাখল কেন?
কাকে দেখানোর জন্য মোহরের অঙ্কটাকে বড় করতে হবে?
সমাজকে?
এই সমাজ কয় টাকা দেয় ছেলেটার বিয়ের সময়? এই সমাজ বিয়ে ভাঙা মেয়েটাকে কী চোখে দেখে আমরা কী জানি না? মানুষ ঋণের দায়ে নিঃস্ব হয়ে গেলে এই সমাজের কী যায় আসে?
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ তাই বলেছেন, সাহাবাদের সময়ে মোহরের অঙ্ক লিখে রাখার বিধান ছিল না কারণ তারা বিয়েতে মোহর বাকি রাখতেন না। পরে আস্তে আস্তে মানুষ মোহর বাকী রাখা শুরু করাতে সেই হিসাব বিয়ের চুক্তিপত্রে লিখে রাখা শুরু হয়।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সেই বিয়ে সর্বোত্তম যা সবচেয়ে সহজে হয়। তিনি আরো বলেছেন সবচেয়ে উত্তম সেই মোহর যা সবচেয়ে সহজ।
ভাইয়েরা, যৌতুকের কথা চিন্তাও করবেন না, এটা হারাম। খেয়াল রাখবেন বিয়েতে যেন মেয়ের বাবা-মা কোনো খরচ করতে বাধ্য না হয়। বিয়ের সময় সমাজের কথা চিন্তা না করে নিজের সামর্থ্যের কথা চিন্তা করুন। যে মেয়ে আপনার সামর্থ্যের হিসেব করবে না, তাকে বিয়ে করতেই হবে এমন কথা নেই। যে মেয়ে, যে মেয়ের পরিবার ইসলাম বোঝে সেখানে সম্পর্ক করুন। পরে শান্তি পাবেন।
যে পরিমাণ মোহর ঠিক করবেন তা আদায় করে দিন। যদি কেউ বাকী রেখে বিয়ে করে থাকেন তিনি জেনে রাখুন, তিনি ঋণের দায়ে জড়িয়ে আছেন। অবিলম্বে স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করুন।
বোনেরা, অন্যের মোহরের অঙ্কের সাথে নিজের সম্মানকে মেলাবেন না। আল্লাহর কাছে যে সম্মান পায় সেই আসল সম্মানিত। আর আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত যার তাকওয়া বেশি।
হে কন্যার অভিভাবকগণে, ইসলামে কুলীনত্ব বলে কিছু নেই। সম্পদের জাঁকজমকে জাতে ওঠার কিছু নেই। আল্লাহকে ভয় করুন। বিয়েকে সহজ করুন। সমাজে হালাল রিযকে চলছে এমন তরুণদের আপন সতীত্ব রক্ষার্থে সাহায্য করুন। সৎ চরিত্র আর দ্বীনদারীতা দেখে বিয়ে দিন, ছেলেটা মেয়েকে নিজে যা খায়, খাওয়াবে। পুড়িয়ে কাবাব বানাবে না। মানসিক গঞ্জনা আর দৈহিক অত্যাচার করবে না। আল্লাহকে ভয় পাওয়া একটা ছেলে আপনার মেয়েকে সবচেয়ে আদরে রাখবে, ভালো রাখবে।
আল্লাহ আমাদের তাঁর অসম্ভব সুন্দর এই দীন – ইসলামকে আমাদের জীবনে পালন করার তাওফিক দিন। আমীন।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button