ছোটগল্প/উপন্যাস

গুড কোয়েস্চেন নাকি লেইম

ওমার ক্লাস এইটে পড়ে।এই বয়সেই ওর খুব busy schedule। সকালে ঘুম থেকে উঠে দু’টা প্রাইভেট। তারপর স্কুল।স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসাতেই থাকে।হয় ঘুমায়, নাহয় টিভি দেখে, নাহয় গেইম খেলে,নাহয় ছাদে গিয়ে বিল্ডিং এর অন্যান্যদের সাথে খেলে।সন্ধার পর আবার পর পর দু’টা প্রাইভেট। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯/১০টা। খেতে খেতে একটু টিভি, তারপর ঘুম।সামনে জে.এস.সি তাই নাকি এই বছরটা একটু কষ্ট করতেই হবে, ওর আম্মু বলে।কথাটা শুনলে বিরক্ত লাগে ওমারের।কি অদ্ভুত! প্রতিবছর এই একই কথা বলে আম্মু।আজ ৬-৭টার প্রাইভেটটা নেই। স্যার নাকি নতুন বিয়ে করেছে তাই এক সপ্তাহ পড়াবে না।বিয়ের সাথে প্রাইভেট ওফ রাখার কি সম্পর্ক কে জানে!বাসায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছে ওমার।পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলো না আগে।তবু ক্লাসে যেতে ভালোই লাগতো।কিন্তু গত ২/৩ মাস থেকে সে আগের থেকে অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করে।ভেবে দেখলো তার এই পরিবর্তনটা এসেছে তৃষা আপুর কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করার পর থেকে।গত ৭ মাস আগে পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটে হিসেবে এসেছিলো আপুটা।তাই প্রাইভেট শুরুর আগে থেকেই আপুকে চেনে ও।মাঝে মাঝে আপুর কথা ভাবলে ওমারের অবাক লাগে।কেমন অদ্ভুত ধরনের একজন মানুষ যেন উনি।প্রাইভেট শুরুর আগে আপু ছাদে বাচ্চাদের সাথে বাচ্চাদের মতই খেলতো।ওমারের মনে হত তৃষা আপু তারই সমবয়সী, নাহয় নাইনে পড়ে আর খুব বেশি হলে ক্লাস টেন এ।কিন্তু নাহ্! আপুর নাকি ভার্সিটি পড়া শেষ।এখন ঘরে বসে চাকরি আর পাত্র খোঁজে।বাসায় সময় কাটানোর জন্য বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ায়।প্রথমদিন ওমার যখন আপুর বাসায় পড়তে যাবে তখন কেমন যেন লাগছিলো ভাবছিলো,” এই আপু আর কি পড়াবে! নরমাল ক্রিকেট খেলাই তো পারে না।এত্ত ইজি খেলা আর আছে!”

মাত্র এক সপ্তাহের মাঝেই ওমার বুঝে গেলো, নাহ্! খেলার সময়ের তৃষা আপু আর পড়ার টেবিলের তৃষা আপু একই মানুষ মোটেই হতে পারে না।খেলার সময় যে আপুকে ওমারের সমবয়সী মনে হয় সেই আপুকেই পড়তে বসলে মনে হয় কোনো স্কুলের হেড ম্যাম।আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো আপু কাউকে মারে না কিন্তু চোখ মুখ কঠিন করে এমন ভাবে “পড়ো” বলে, তাতেই কাজ হয়ে যায়।যে ম্যাথ নিয়ে ওমারের এত্ত ভয় ছিলো সেটা এখন ওর ফেভারিট সাবজেক্ট। আরো অবাক লাগে, যখন এই কঠিন আপুটাই অন্যদের খুবই লেইম কোয়েস্চেন অনেক আগ্রহ নিয়ে মনযোগ দিয়ে শোনে।আবার ওই লেইম কোয়েস্চেনটার আন্সারও খুব সুন্দর করে বুঝায়ে বলে।ওমার নিজেও অনেক সময় অনেক লেইম কোয়েস্চেন করে বসে।বুঝার পর নিজেই আবার নিজেকে নিয়ে হাসে।ভাবে, এতোটা বোকা বোকা কোয়েস্চেন সে কি করে করলো।আজ ক’দিন থেকেই তার মাথায় একটা কোয়েস্চেন ঘুর ঘুর করছে।সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এটা কি গুড কোয়েস্চেন নাকি লেইম কোয়েস্চেন।একটা কোয়েস্চেন নিয়ে তার এতোভাবার কারণ, তৃষা আপুর কাছে পড়ার আগে সে মোবারক স্যার এর কাছে পড়তো।সেখনে স্যারকে কোনো কোয়েস্চেন করলে যদি সেটা লেইম কোয়েস্চেন হতো তাহলে বেতের বারি খেতে হতো।সেই ভয়টা তার এখনো কাটেনি। মোবারক স্যার খুবই ভুলো মনের ছিলো।হয়তো স্যারই বললো কাল ৫টায় যেতে।বলে উনি ভুলে গেছেন আমরা ৫টায় গেলাম কিন্তু এত দেরি করে যাওয়ার অপরাধে কান মলা বা বেতের বারি পেট ভরে খেয়ে নিতাম।তৃষা আপু আপু আবার এই দিক দিয়ে অনেক আলাদা।আপু অযথা বকাও দেয় না।আগে থেকে ওয়ার্নিং দিয়ে বকা দেয়।বলে দেয়,” কাল এই পড়াটা না করে আসলে কিন্তু তুমি অনেক বকা খাবা।” আর যা বলে ঠিক তাই করে।কিছুই ভুলে যায় না।হায় হায়! গত কাল তো ওমারকেও বলে দেয়া হয়েছিলো,” ঠিক ৮ টায় আসবা। ৫ মিনিটও যেন লেট না হয়।লেট হলে তোমার শাস্তি আছে।”

অলরেডি ৭:৩০ বেজে গেছে! এক লাফে শোয়া থেকে উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলো ওমার।খুব দ্রুত সিড়ি ভেঙ্গে ঠিক ৭:৫৮ তে আপুর বাসার বেল বেজালো।আপু নিজেই দরজা খুলে খুব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো,”ভেরি গুড! একদম পার্ফেক্ট টাইম। ” ওমারের মনটা খুবই ভালো হয়ে গেলো আর মনে মনে ভাবলো গুড হক আর লেইম হোক আজ কোয়েস্চেনটা করবেই সে।আপু অলওয়েজ প্রথমে আগের দিনের পড়া রিভিউ করে তারপর নতুন টপিক স্টার্ট করে।তো আজ রিভিউ শেষে ওমার বললো,” আপু একটা কোয়েস্চেন করি?” আপু খুবই আগ্রহ নিয়ে বললো,” হুম বলো।” ওমার বললো, “আচ্ছা আপু, আমার অনেক ফ্রেন্ড আছে যারা স্কুলে জোহরের নামাজ পড়ে না।ওদের নামাজ পড়তে বললে বলে যে আল্লাহ নাকি সব মুসলিম কেই একটা সময় ক্ষমা করে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।জাহান্নামে নাকি শুধু কাফিররা থাকবে তাহলে আর এখন নামাজ পড়ার দরকার কি!আমরা তো মুসলিমই, তো জান্নাতে তো যাবোই। এইটা কি ঠিক?”

আপু বললো,”ওমার, তোমাকে কোরআন এর কিছু আয়াত পড়ে শোনাই।তুমি নিজেই সব বুঝবা।”এই বলে আপু ফোন থেকে কোরআনের সূরা বাক্বারাহ ওপেন করে পড়া শুরু করলো,”তারা বলেঃ আমাদিগকে কখনও আগুন স্পর্শ করবে না; কিন্তু গণাগনতি কয়েকদিন। বলে দিনঃ তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার পেয়েছ যা, তিনি কখনও খেলাফ করবেন না- না তোমরা যা জান না, তা আল্লাহর সাথে জুড়ে দিচ্ছ।”

ওমার বলে উঠলো,”ঐ কথাটা কি তাহলে ভুল, আপু?” তৃষা আপু বললো,”পড়াটা শেষ করি! তুমি মনযোগ দিয়ে শোনো, এই বলে আপু আবার পড়া শুরু করলো,”হ্যাঁ যারা গোনাহ করে এবং যাদের গোনাহ তাদের পরিবেষ্টন করে তারাই জাহান্নামবাসী যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকাজ করে তারাই জান্নাতবাসী সেখানে তারা চিরস্থায়ী। ”

“এইত্ত আপু, এখানে তো বললোই যারা বিশ্বাস করে তারা জান্নাতবাসী! ” খুশি হয়ে বলে ওঠে ওমার।

তৃষা আপু শান্ত চেহারায় বললো,”ওমার, একটু মনযোগ দিয়ে শোন।”এই বলে আপু একই আয়াতগুলো আরো দু’বার পড়লো। দু’বারই “বিশ্বাস” শব্দটা খুব স্পষ্ট ও দৃঢ় করে পড়লো। যেন এই শব্দের মধ্যে ভাবার মত কিছু আছে।ওমার কনফিউজড হয়ে বললো,”আমরা তো বিশ্বাস করিই যে আল্লাহ্‌ আছেন।”

আপু হালকা হাসি ঠোট করে বললো,” আচ্ছা, তুমি তাহলে বিশ্বাস করো যে আল্লাহ্‌ আছেন, তাইনা?” ওমার অবাক হয়ে গেলো।এটা আবার কেমন কোয়েস্চেন! আল্লাহ্‌ আছেন এটা বিশ্বাস না করার প্রসঙ্গ এলো কোথা থেকে! তবু সব বিষ্ময় গোপন করে ওমার বললো,”হ্যাঁ আপু! আমি বিশ্বাস করি।”

তৃষা আপু এবার যেন আগের সব কথা হঠৎ ভুলে গেলো।বললো,”ওকে, বাদ দাও এই টপিক।বলো তুমি আজ একদম পার্ফেক্ট টাইমে কি করে এলে?ডেইলি তো লেট করো।”

“কি ব্যাপার তৃষা আপুও কি মোবারক স্যারের মত ভুলো মনা হয়ে যাচ্ছে!” ভাবতে ভাবতে ওমার বললো,”কারণ, তুমিই তো গত কাল বলসিলা যে আজকে ৫ মিনিট লেট হলেও তুমি শাস্তি দিবা।” তৃষা আপুঃ তার মানে, তুমি আমার কথটা বিশ্বাস করেছিলা যে লেট করে আসলে তুমি সত্যিই শাস্তি পাবা। ওমার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।

তৃষা আপুঃ তুমি তো বললা যে তুমি আল্লাহ্‌ কে বিশ্বাস কর।তাহলে আল্লাহ যখন বললেন যে নামাজ না পড়লে শাস্তি পাবা, খারাপ কাজ করলে শাস্তি পাবা। তো সব জেনেও বুঝেও কেন তাহলে নামাজ না পড়ে থাকো, খারাপ কাজ করো?” এইটুকু বলে তৃষা আপু থামলো।হয়তো ওমারের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আশা করছিলো।কিন্তু ওমার চোখ বড় বড় করে শুধু শুনছে।

তৃষা আপু আবার বলা শুরু করলো,”শোনো ওমার, মানুষ যখন কোন কিছু বিশ্বাস করে তখন সেই বিশ্বাসটা তার এক্টিভিটিতে ফুটে ওঠে।যেমন ধরো, টিভিতে কিছুদিন থেকে নিউজ আসছে যে আমাদের এলাকাজুড়ে ছিন্তাই ও হত্যা বেড়েছে।তখন দেখা যাবে যে, তোমার আম্মু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় খুব অল্প টাকা নিয়ে অনেক কম সেজে বের হচ্ছে।সে এমনটা করেছে কারন সে বিশ্বাস করেছে যে টিভিতে যে নিউজটা সে দেখেছে তা সত্যি।আর তা সত্যি মানে যে কোনো সময় এমন বিপদের মুখোমুখি সে নিজেও হতে পারে।তাই যতটা সম্ভব নিজেকে সেফ করে চলার চেষ্টা করছে।ঠিক কিনা?”

ওমার মাথে নেড়ে বললো,”হ্যাঁ ঠিক।”

আপু বললো,” আল্লাহ্‌ বলেছেন,’যারা গোনাহ করে এবং যাদের গোনাহ তাদের পরিবেষ্টন করে তারাই জাহান্নামবাসী সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।’ তুমি বললে যে তুমি আল্লাহ্‌ কে বিশ্বাস করো।অথচ তুমি সৎকাজ করছো না, গোনাহ করছো, আবার এটাও বলছো যে, ‘আমি তো আল্লাহ্‌ কে বিশ্বাস করি।’ এটা কেমন বিশ্বাস, ওমার?”

কেনো যেনো ওমারের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো।কোনো উত্তর দিতে পারলো না সে।

আপু বললো,” আচ্ছা ওমার, ধরো আজ তুমি আমার বাসায় আসতে লেট করে ফেললা, তাই আমি তোমাকে ১০ বার কানে ধরে উঠা বসা করার শাস্তি দিলাম।তাই তুমি বললা,’ আমি কেন শাস্তি পাবো আপু, আমি তো তোমার কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম।’ এটা কি লজিকাল হবে?”

ওমার মাথা নিচু করে না সূচক মাথা নাড়ে।

আপু জিজ্ঞেস করলো,”তুমি কি তোমার কোয়েস্চেনের আন্সার পেয়েছ, ওমার?”

ওমার বললো, “হুম!” একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,”এটা কোন আয়াত, আপু?”

তৃষা আপুঃ সূরা বাক্বারাহ এর ৮০-৮২। পড়া শুরু করো এখন।এমনিতেই অনেক টাইম ওয়েস্ট হয়েছে আজ।

ওমারের আর পড়ায় মন বসছে না।সে বার বার শুধু একটা কথাই ভাবছে,”সত্যিই কোরআনে এত ইজি করে এই আয়াতগুলো আছে!! বাসায় গিয়ে অবশ্যই মিলিয়ে দেখতেই হবে তাকে।সে সব বুঝবে তো।থাক তাও সে দেখবেই এখন না বুঝলেও আপুর মত বড় হলে তো বুঝবেই।” [কাল্পনিক]

– নুসরাত জাহান মুন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button