ছোটগল্প/উপন্যাস

‘মুসলিম, তোমরা যারা হোলি খেলো’

সাদমানকে এই মূহুর্তে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। ফোনে কথা বলার সময় এতোটা উৎফুল্ল তাকে গত কয়েকদিনে দেখা যায়নি।
গত কয়েকদিন বলার কারন হলো, সাদমান এই রুমে উঠেছে মাত্র সপ্তাহ তিনেক। এই সময়ের ভেতরে তার সম্পর্কে যা ধারণা তা হলো, সে খুব স্মার্ট, বন্ধুবৎসল এবং ভদ্র।

আদনান আহমেদ। সাদমানের রুমমেট। বয়স আর ক্লাশ বিবেচনায় সাদমানের সিনিয়র। শুধু সাদমান নয়, এই মেসের সবার সিনিয়র এই লোক। সবাই উনাকে খুব ভক্তি আর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সবার জন্য উনি এই মেসে ‘বড় ভাই’ ভূমিকায় আছেন। সকলের সুবিধা,অসুবিধায়, সমস্যা-সমাধানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন এই লোক। সকলে উনাকে ‘আদনান ভাই’ বলে ডাকে।

আজ বুধবার। আজ সাদমানের ভার্সিটিতে ক্লাশ নেই। যেদিন ক্লাশ থাকে না, সেদিন সাদমান ভার্সিটির ছাঁয়াও মাড়ায় না সাধারণত। এই রোদ, জ্যাম, ধাক্কাধাক্কি উপেক্ষা করে বিনা প্রয়োজনে ভার্সিটিতে গিয়ে ঘুরাঘুরি করার কোন মানে হয় না। আজ যে ভার্সিটিতে সাদমানের ক্লাশ নেই, সেটা আদনান ভাই জানেন। যেহেতু বড় ভাই তুল্য, তাই এইটুকু দায়িত্ব পালনে কার্পণ্য করেন না কখনো।

সাদমান ফোনে কথা বলছে। ও’প্রান্তের কেউ একজনের কথার জবাবে সে বললো, ‘হ্যাঁ, আসবো শিওর। আমি একটু পরেই বেরুচ্ছি।’
আদনান ভাই উনার পড়ার টেবিলে ছিলেন। পড়ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে সাদমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার আজ ক্লাশ আছে, সাদমান?’
সাদমান ব্যাগ গোছানোতে ব্যস্ত ছিলো। আদনান ভাইয়ের কথায় ব্যাগ গোছানো থামিয়ে বললো, ‘জ্বি না, ভাইয়া…’
– ‘ও আচ্ছা।’- আদনান ভাইয়ের স্বভাবজাত উচ্চারণ। ‘তাহলে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছো নাকি?’
সাদমান বললো, ‘না ভাইয়া। একটু ভার্সিটিতে যাবো,এই আর কি…’
– ‘প্রোগ্রাম?’
– ‘জ্বি’
– ‘কিসের?’
সাদমান একটু থামলো। একমুহূর্ত ভেবে নিলো যে আদনান ভাইকে আসল কথা বলবে কি বলবে না।
‘আদনান ভাই রক্তের কেউ না হলেও, উনার কাছে মিথ্যে বলাটা ঠিক হবেনা’- সাদমান মনে মনে ভাবলো।
এরপর বললো, ‘জ্বি ভাইয়া, আসলে, আজকে তো হোলি উৎসব। তাই ডিপার্টমেন্টের ফ্রেন্ডরা মিলে চাচ্ছে একটু আনন্দ-টানন্দ করবে, তাই…….’
– ‘ও আচ্ছা’ বলে আদনান ভাই আবার ‘মা’ উপন্যাসে ডুব দিলেন।

গোসল-টোসল সেরে সাদমান একেবারে প্রস্তুত। নীল রঙা পাঞ্জাবি, সাদা রঙা পায়জামা। চোখে কালো সানগ্লাস। হাতে ঘড়ি।
বের হতে যাবে, অমনি আদনান ভাই বললেন, ‘সাদমান শোনো……’
– ‘জ্বি ভাইয়া, বলুন’
– ‘হোলি উৎসবে তুমি কি নিজ ইচ্ছায় যাচ্ছো, নাকি বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে?’
– ‘ভাইয়া, আমি নিজ থেকেই যাচ্ছি। আসলে, আমার কিছু হিন্দু ফ্রেন্ড আছে। ওরা চাইছে আমরা একসাথে আজ কিছুক্ষণ মজা করি, তাই….’
– ‘বেশ’ – আদনান ভাই বললেন। এরপর আবার বললেন, ‘তুমি কি মনে করোনা, এই উৎসবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে, তুমি এমন একটা কিছুকে স্বীকৃতি দিচ্ছো, মেনে নিচ্ছো, যার সাথে তোমার ঈমানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে?’
সাদমান বললো, ‘ভাইয়া কি রকম?’
– ‘তুমি কি হোলি উৎসবের কাহিনী জানো? ইতিহাস?’
– ‘না ভাইয়া।’- সাদমান বললো।
– ‘আমি যতোদূর জানি, হিন্দুদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক হোলিকা নামের এক রাক্ষসী বধ হয়। হোলিকা রাক্ষসীর দুষ্কর্মের সাজা সে পেয়ে গেছে ইহকালেই। তাই, দয়াপরবশ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাকে রঙের মাদুলিতে পরিণত করে যাতে পরবর্তীতে সকল হিন্দুরা এই রঙ দিয়ে উৎসব করতে পারে।’
এতোটুকু বলে আদনান ভাই বললেন, ‘তুমি বুঝতে পারছো,সাদমান?’
– ‘জ্বি ভাইয়া।’
– ‘এখন বলো, তুমি কি হিন্দু না মুসলিম?’
– ‘মুসলিম’
– ‘এই রঙ দিয়ে হোলিখেলার উৎসব কি তোমার জন্য চালু হয়েছে?’
সাদমান চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘ভাইয়া, আমি হোলি উৎসব তো পালন করছিনা, কেবল তাদের একটু সঙ্গ দেবো, এই যাহ! আর, রঙ মাখলেই যে আমি হোলি উৎসবকে স্বীকৃতি দিচ্ছি, শ্রীকৃষ্ণ, হোলিকা রাক্ষসীকে স্বীকৃতি দিচ্ছি,তাও না। এটা আসলে আমার ইন্টেনশানের ব্যাপার। আমি কোন ইন্টেনশান থেকে যাচ্ছি বা করছি।একজন হিন্দু যে ইন্টেনশান নিয়ে এটা পালন করে, আমিও কী সে ইন্টেনশান থেকে যাচ্ছি, নাকি এমনি যাওয়ার জন্যই যাচ্ছি- এটার উপর ডিপেন্ড করে।’
– ‘সাদমান……’- আদনান ভাই বললেন।
– ‘জ্বি ভাইয়া।’
– ‘তুমি একজন মুসলিম,তাই না?’
– ‘জ্বি অবশ্যই।’
– ‘তুমি কি মনে করো দ্বীন ইসলাম একজন ব্যক্তির ইন্টেনশানের উপর ভিত্তি করে চলে? তোমার ইন্টেনশানই যদি আসল কথা হতো, তাহলে পশ্চিম দিকে ক্বেবলা নির্ধারণের কোন দরকার ছিলো না। তুমি যেকোন একদিকে মুখ করে পড়ে নিলেই হয়ে যেতো। হয় কি? হয় না। যদি তোমার ইন্টেনশানই সব হতো, তাহলে ফজ্বর সালাতের জন্য নির্দিষ্ট একটা টাইম ফিক্সড থাকতো না। তুমি দুপুর বারোটায় ধপাস করে ঘুম থেকে উঠে ফজ্বর পড়ে নিলেই হয়ে যেতো। এরকম হয় কি?’
সাদমান মাথা নিঁচু করে ফেললো। আদনান ভাইয়ের জায়গায় অন্য কেউ হলে সাদমান এসব কথাকে স্রেফ ‘লেকচার’ বলে উড়িয়ে দিতো। কিন্তু মানুষটা যেহেতু আদনান ভাই, তাই বুঝেই নিলো, এই কথাগুলোর নিশ্চই কোন রিজন আছে। তবু সে কাঁচুমাচু করে বললো, ‘কিন্তু ভাইয়া………’
তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আদনান ভাই বললেন, ‘একজন মুসলিম তার সবকিছুই সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছেই সোপর্দ করে। সুতরাং, তাতে কোন ‘কিন্তু’ ‘যদি’ ‘অথবা’ থাকতে পারেনা। থাকার কোন সুযোগ নেই।’
সাদমান আবার চুপ মেরে গেলো। আদনান ভাই আবার বলতে লাগলেন, – ‘তুমি জানো, ঈমান এনেও যারা এসব ইন্টেনশানের দোহাই দিয়ে, মনোরঞ্জনের দোহাই দিয়ে, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এরকম আপ্তবাক্যের দোহাই দিয়ে এসব অন্য ধর্মের কালচার নিজেদের মধ্যে প্রচলন করে, তাদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ সূরা ঈউসুফের ১০৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘অধিকাংশ লোক ঈমান আনা সত্বেও মুশরিক।’
আয়াতখানা পড়তে যতোটাই হালকা মনে হচ্ছে, ওজনে,ভাবে আয়াতটা ততোটাই ভারি। এখানে সেইসব ঈমান আনা মুসলিমদের কথাই বলা হচ্ছে, যারা একইসাথে মুসলিম, আবার অন্তরে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ টাইপ আপ্তবাক্য ধারণ করে। এদেরকেই আল্লাহ বলছেন,- এরা ঈমান আনে,তবুও এরা মুশরিক….’

সাদমান এবারও কিছু বললো না। আদনান ভাই এতোটুকু বলে আবার উপন্যাসের পাতায় ডুব দিলেন। ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস- ‘মা’…

দুপুরের আজান হলো। মসজিদের মুসল্লিরা আসছে একে একে। তাদের মধ্যে নীল রঙা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা সাদমানও আছে। সে অজূ করছে। মুখে হাত দিয়ে ছড়াচ্ছে অজূর পানি। অথচ, এই মুখ, এই হাতে এখন অজূর পানির বদলে হোলির রঙ লেগে থাকার কথা ছিলো…….

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button