ছোটগল্প/উপন্যাস

তাকদির বনাম স্বাধীন ইচ্ছা – স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?

সাজিদের ব্যাগে ইয়া মোটা একটি ডায়েরি থাকে সবসময়।

ডায়েরিটা প্রাগৈতিহাসিক আমলের কোন নিদর্শনের মতো। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া।ছেঁড়া জায়গার কোনটাতে সূতো দিয়ে সেলাই করা, কোন জায়গায় আঁটা দিয়ে প্রলেপ লাগানো, কোন জায়গায় ট্যাপ করা।

এই ডায়েরিতে সে তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিখে রাখে।এই ডায়েরির মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় সাজিদ আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও লিখে রেখেছে।তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টি.এস.সি তে।

সে আমার সম্পর্কে লিখে রেখেছে,-
‘ভ্যাবলা টাইপের এক ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হলো আজ।দেখলেই মনে হবে, জগতের কঠিন বিষয়ের কোনকিছুই সে বুঝেনা।কথা বলার পরে বুঝলাম, এই ছেলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান,কিন্তু বোকা।ছেলেটার নাম- আরিফ।’
নিচে তারিখ দেওয়া- ‘০৫/০৩/০৯

এই ডায়েরিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও লিখা আছে।

একবার কানাডার টরেণ্টোতে সাজিদ তার বাবার সাথে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলো।সেখানে অনেক সেলেব্রিটির সাথে বিলগেটসও আমন্ত্রিত ছিলেন।বিলগেটস সেখানে দশ মিনিটের জন্য বক্তৃতা রেখেছিলেন।সে ঘটনাটি লিখা আছে।

জাফর ইকবালের সাথে সাজিদের একবার বই মেলায় দেখা হয়ে যায়। সেবারের বইমেলায় জাফর স্যারের বই ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয়। সাজিদ জাফর স্যারের বই কিনে বের হওয়ার পথে জাফর স্যারের সাথে তার দেখা হয়ে যায়।সাজিদ স্যারের একটি অটোগ্রাফ নিয়ে, স্যারের কাছে হেসে জানতে চাইলো,- ‘স্যার, ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ পাইলাম।এরপর পাইলাম ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’। এটার পরে, ‘আরো আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ কবে পাচ্ছি?’

সেদিন নাকি জাফর স্যার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন,- ‘পাবে।’

নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম অনেক ঘটনাই ঠাঁই পেয়েছে সাজিদের ডায়েরিটাতে।

সাজিদের ডায়েরির আদ্যোপান্ত আমার পড়া ছিলো। কিন্তু, সেমিষ্টার ফাইনাল সামনে চলে আসায় গত বেশ কিছুদিন তার ডায়েরিটা আমার আর পড়া হয়নি।অবশ্য, ডায়েরিটা আমি লুকিয়ে লুকিয়েই পড়ি।

সেদিন থার্ড সেমিষ্টারের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে রুমে আসলাম। এসে দেখি সাজিদ ঘরে নেই।তার টেবিলের উপরে তার ডায়েরিটা পড়ে আছে খোলা অবস্থায়।

ঘর্মাক্ত শরীর। কাঠফাটা রোদের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছি।এই মূহুর্তে বসে ডায়েরিটা উল্টোবো, সে শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই নেই।

কিন্তু ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে একটি শিরোনামে আমার চোখ আটকে যায়। আমি সাজিদের টেবিলেই বসে পড়ি। লেখাটির শিরোনাম ছিলো,-
‘ভাগ্য বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি- স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?’
বেশ লোভনীয় শিরোনাম।শারীরিক ক্লান্তি ভুলেই আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম।ঘটনাটি সাজিদের ডায়েরিতে যেভাবে লেখা, ঠিক সেভাবেই আমি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি-

‘কয়েকদিন আগে ক্লাশের থার্ড পিরিয়ডে মফিজুর রহমান স্যার এসে আমাকে দাঁড় করালেন।বললেন,- ‘তুমি ভাগ্যে,আই মিন তাকদিরে বিশ্বাস করো?’
আমি আচমকা অবাক হলাম। আসলে এই আলাপগুলো হলো ধর্মীয় আলাপ। মাইক্রোবায়োলজির একজন শিক্ষক যখন ক্লাশে এসে এসব জিজ্ঞেস করেন, তখন খানিকটা বিব্রত বোধ করাই স্বাভাবিক। স্যার আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন।

আমি বললাম,- ‘জ্বি, স্যার।এ্যাজ এ্যা মুসলিম, আমি তাকদিরে বিশ্বাস করি।এটি আমার ঈমানের মূল সাতটি বিষয়ের মধ্যে একটি।’
স্যার বললেন,- ‘তুমি কি বিশ্বাস করো যে, মানুষ জীবনে যা যা করবে তার সবকিছুই তার জন্মের অনেক অনেক বছর আগে তার তাকদিরে লিখে দেওয়া হয়েছে?’
– ‘জ্বি স্যার’- আমি উত্তর দিলাম।
– ‘বলা হয়, স্রষ্টার ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি ক্ষুদ্র পাতাও নড়েনা, তাই না?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘ধরো, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করলাম। এটা কি আমার তাকদিরে পূর্ব নির্ধারিত ছিলো না?’
– ‘জ্বি, ছিলো।’
– ‘আমার তাকদির যখন লেখা হচ্ছিলো, তখন কি আমি জীবিত ছিলাম?’
– ‘না, ছিলেন না।’
– ‘আমার তাকদির কে লিখেছে? বা, কার নির্দেশে লিখিত হয়েছে?’
– ‘স্রষ্টার।’
– ‘তাহলে, সোজা এবং সরল লজিক এটাই বলে- ‘আজ সকালে যে খুনটি আমি করেছি, সেটি মূলত আমি করি নি।আমি এখানে একটি রোবট মাত্র।আমার ভেতরে একটি প্রোগ্রাম সেট করে দিয়েছেন স্রষ্টা।সেই প্রোগ্রামে লেখা ছিলো যে, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করবো।সুতরাং, আমি ঠিক তাই-ই করেছি, যা আমার জন্য স্রষ্টা পূর্বে ঠিক করে রেখেছেন।এতে আমার কোন হাত নেই।ডু ইউ এগ্রি,সাজিদ?’
– ‘কিছুটা’- আমি উত্তর দিলাম।

স্যার এবার হাসলেন।হেসে বললেন,- ‘আমি জানতাম তুমি কিছুটাই একমত হবে,পুরোটা নয়।এখন তুমি আমাকে নিশ্চই যুক্তি দেখিয়ে বলবে,- স্যার, স্রষ্টা আমাদের একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন।আমরা এটা দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার করে চলি,রাইট?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘কিন্তু সাজিদ, এটা খুবই লেইম লজিক,ইউ নো? ধরো, আমি তোমার হাতে বাজারের একটি লিষ্ট দিলাম।লিষ্টে যা যা কিনতে হবে, তার সবকিছু লেখা আছে।এখন তুমি বাজার করে ফিরলে।তুমি ঠিক তাই তাই কিনলে যা আমি লিষ্টে লিখে দিয়েছি।এবং তুমি এটা করতে বাধ্য।’
এতটুকু বলে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন,- ‘বুঝতে পারছো?’
আমি বললাম,- ‘জ্বি স্যার।’
– ‘ভেরি গুড! ধরো, তুমি বাজার করে আসার পর, একজন জিজ্ঞেস করলো, সাজিদ কি কি বাজার করেছো? তখন আমি উত্তর দিলাম,- ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, তা-ই তা-ই কিনেছে। বলতো, আমি সত্য বলেছি কিনা?’
আমি বললাম,- ‘নাহ, আপনি মিথ্যা বলেছেন।’
স্যার চিৎকার করে বলে উঠলেন,- ‘এক্সাক্টলি। ইউ হ্যাভ গট দ্য পয়েণ্ট,মাই ডিয়ার।আমি মিথ্যা বলেছি।আমি লিষ্টে বলেই দিয়েছি তোমাকে কি কি কিনতে হবে।তুমি ঠিক তা-ই তা-ই কিনেছো যা আমি কিনতে বলেছি।যা কিনেছো সব আমার পছন্দের জিনিস। এখন আমি যদি বলি,- ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে,সে তা-ই তা-ই কিনেছে’, তাহলে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা,না?’
– ‘জ্বি,স্যার।’
– ‘ঠিক স্রষ্টাও এভাবে মিথ্যা বলেছেন।দুই নাম্বারি করেছেন। তিনি অনেক আগে আমাদের তাকদির লিখে তা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন।এখন

আমরা সেটাই করি, যা স্রষ্টা সেখানে লিখে রেখেছেন।আবার, এ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, এই কাজের জন্য কেউ জান্নাতে যাচ্ছে, কেউ জাহান্নামে।কিন্তু কেনো? এখানে মানুষের তো কোন হাত নেই।ম্যানুয়ালটা স্রষ্টার তৈরি। আমরা তো জাষ্ট পারফর্মার।স্ক্রিপ্ট রাইটার তো স্রষ্টা।স্রষ্টা এরজন্য আমাদের কাউকে জান্নাত,কাউকে জাহান্নাম দিতে পারেন না। যুক্তি তাই বলে,ঠিক?’
আমি চুপ করে রইলাম। পুরো ক্লাশে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে তখন।
স্যার বললেন,- ‘হ্যাভ ইউ এ্যানি প্রপার লজিক অন দ্যাট টিপিক্যাল কোয়েশ্চান,ডিয়ার?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
স্যার মুচকি হাসলেন। মনে হলো- উনি ধরেই নিয়েছেন যে, উনি আমাকে এবার সত্যি সত্যিই কুপোকাত করে দিয়েছেন।বিজয়ীর হাসি।
আমাকে যারা চিনে তারা জানে, আমি কখনো কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিই না।আজকে যেহেতু তার ব্যতিক্রম ঘটলো, আমার বন্ধুরা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকালো।তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, এই সাজিদকে তারা চিনেই না।কোনদিন দেখে নি।
আর, ক্লাশে আমার বিরুদ্ধ মতের যারা আছে, তাদের চেহারা তখন মূহুর্তেই উজ্জ্বল বর্ণ ধারন করলো।তারা হয়তো মনে মনে বলতে লাগলো,- ‘মোল্লার দৌঁড় অই মসজিদ পর্যন্তই।হা হা হা’।

আমি মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম।মুচকি হাসিটা স্যারের মুখে তখনও বিরাজমান।

আমি বললাম,- ‘স্যার, এই ক্লাশে কার সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?’

স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। স্যার জিজ্ঞেস করেছেন কি আর আমি বলছি কি।

স্যার বললেন,- ‘বুঝলাম না।’

– ‘মানে, আমাদের ক্লাশের কার মেধা কি রকম, সে বিষয়ে আপনার কি ধারনা?’

– ‘ভালো ধারনা। ছাত্রদের সম্পর্কে একজন শিক্ষকেরই তো সবচেয়ে ভালো জ্ঞান থাকে।’
আমি বললাম,- ‘স্যার, আপনি বলুন তো, এই ক্লাশের কারা কারা ফাষ্ট ক্লাশ আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে?’
স্যার কিছুটা বিস্মিত হলেন। বললেন,- ‘আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করেছি।তুমি ‘আউট অফ কনটেক্সট’ এ গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছো,সাজিদ।’

– ‘না স্যার, আমি কনটেক্সটেই আছি। আপনি উত্তর দিন।’

স্যার বললেন,- ‘এই ক্লাশ থেকে রায়হান, মমতাজ, ফারহানা, সজীব, ওয়ারেশ, ইফতি, সুমন,জাবেদ এবং তুমি ফাষ্ট ক্লাশ পাবে। আর বাকিরা সেকেন্ড ক্লাশ।’

স্যার যাদের নাম বলেছেন, তারা সবাই ক্লাশের ব্রিলিয়্যাণ্ট ষ্টুডেণ্ট।সুতরাং, স্যারের অনুমান খুব একটা ভুল না।
আমি বললাম,- ‘স্যার, আপনি এটা লিখে দিতে পারেন?’

– ‘Why not’- স্যার বললেন।

এই বলে তিনি খচখচ করে একটা কাগজের একপাশে যারা ফাষ্ট ক্লাশ পাবে তাদের নাম, অন্যপাশে যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে,তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিলেন।

আমি বললাম,- ‘স্যার, ধরে নিলাম যে আপনার ভবিষ্যৎবাণী সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে।মানে, আপনি ফাষ্ট ক্লাশ পাবে বলে যাদের নাম লিখেছেন,তারা সবাই ফাষ্ট ক্লাশ পেয়েছে,আর যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে লিখেছেন, তাদের সবাই সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে।’

– ‘হুম, তো?’

– ‘এখন, স্যার বলুন তো, যারা ফাষ্ট ক্লাশ পেয়েছে, আপনি এই কাগজে তাদের নাম লিখেছেন বলেই কি তারা ফাষ্ট ক্লাশ পেয়েছে?’

– ‘নাহ তো।’

– ‘যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে বলে আপনি এই কাগজে লিখেছেন বলেই কি তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে?’
স্যার বললেন,- ‘একদম না।’

– ‘তাহলে মূল ব্যাপারটি কি স্যার?’

স্যার বললেন,- ‘মূল ব্যাপার হলো, আমি তোমাদের শিক্ষক।আমি খুব ভালো জানি পড়াশুনায় তোমাদের কে কেমন।আমি খুব ভালো করেই জানি, কার কেমন মেধা। সুতরাং, আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কে কেমন রেজাল্ট করবে।’

আমি হাসলাম। বললাম,- ‘স্যার, যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা যদি আপনাকে দোষ দেয়? যদি বলে, আপনি ‘সেকেন্ড ক্লাশ’ ক্যাটাগরিতে তাদের নাম লিখেছেন বলেই তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে?’

স্যার কপালের ভাঁজ লম্বা করে বললেন,- ‘ইট উড বি টোট্যালি বুলশিট! আমি কেন এর জন্য দায়ী হবো? এটা তো সম্পূর্ণ তাদের দায়। আমি শুধু তাদের মেধা,যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা রাখি বলেই অগ্রিম বলে দিতে পেরেছি যে কে কেমন রেজাল্ট করবে।’
আমি আবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। পুরো ক্লাশ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

আমি থামলাম।বললাম,- ‘স্যার, তাকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এরকম। আপনি যেমন আমাদের মেধা, যোগ্যতা,ক্ষমতা সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখেন, স্রষ্টাও তেমনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে ধারনা রাখেন।আপনার ধারনা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার ধারনায় কোন ভুল নেই।স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব।তিনি ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন।

আপনি যেরকম আমাদের সম্পর্কে পূর্বানুমান করে লিখে দিয়েছেন যে, আমাদের মধ্যে কারা কারা ফাষ্ট ক্লাশ পাবে, আর কারা সেকেন্ড ক্লাশ।এর মানে কিন্তু এই না যে, আপনি বলেছেন বলে আমাদের কেউ ফাষ্ট ক্লাশ পাচ্ছি, কেউ সেকেন্ড ক্লাশ।

স্রষ্টাও সেরকম পূর্বানুমান করে আমাদের তাকদির লিখে রেখেছেন।তাতে লেখা আছে দুনিয়ায় আমরা কে কি করবো।এর মানেও কিন্তু এই না যে, তিনি লিখে দিয়েছেন বলেই আমরা কাজগুলো করছি।বরং, এর মানে হলো এই- তিনি জানেন যে, আমরা দুনিয়ায় এই এই কাজগুলো করবো।তাই তিনি তা অগ্রিম লিখে রেখেছেন তাকদির হিসেবে।

আমাদের মধ্যে কেউ ফাষ্ট ক্লাশ আর কেউ সেকেন্ড ক্লাশ পাবার জন্য যেমন কোনভাবেই আপনি দায়ী নন, ঠিক সেভাবে, মানুষের মধ্যে কেউ ভালো কাজ করে জান্নাতে, আর কেউ খারাপ কাজ করে জাহান্নামে যাবার জন্যও স্রষ্টা দায়ী নন।স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ সকালে একজনকে খুন করবেন।

তাই তিনি সেটা আগেই আপনার তাকদিরে লিখে রেখেছেন।এটার মানে এই না যে- স্রষ্টা লিখে রেখেছে বলেই আপনি খুনটি করেছেন।এর মানে হলো- স্রষ্টা জানেন যে,আপনি আজ খুনটি করবেন।তাই সেটা অগ্রিম লিখে রেখেছেন আপনার তাকদির হিসেবে।

স্যার, ব্যাপারটা কি এখন পরিষ্কার?

স্যারের চেহারাটা কিছুটা ফ্যাকাশে মনে হলো। তিনি বললেন,- ‘হুম।’

এরপর স্যার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন।তারপর বললেন,- ‘আমি শুনেছিলাম তুমি ক’দিন আগেও নাস্তিক ছিলে।তুমি আবার আস্তিক হলে কবে?’
আমি হা হা হা করে হাসলাম। বললাম,- ‘এই প্রশ্নটা কিন্তু স্যার আউট অফ কনটেক্সট।’

এটা শুনে পুরো ক্লাশ হাসিতে ফেঁটে পড়লো।

পিরিওডের একদম শেষদিকে, স্যার আবার আমাকে দাঁড় করালেন।বললেন,- ‘বুঝলাম স্রষ্টা আগে থেকে জানেন বলেই লিখে রেখেছেন।তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন কে ভালো কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার কি দরকার? যারা জান্নাতে যাওয়ার তাদের জান্নাতে, যারা জাহান্নামে যাওয়ার তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো,তাই না?’

আমি আবার হাসলাম। আমার হাতে স্যারের লিখে দেওয়া কাগজটি তখনও ধরা ছিলো।আমি সেটা স্যারকে দেখিয়ে বললাম,- ‘স্যার, এই কাগজে কারা কারা ফাষ্ট ক্লাশ পাবে, আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে, তাদের নাম লেখা আছে। তাহলে এই কাগজটির ভিত্তিতেই রেজাল্ট দিয়ে দিন।বাড়তি করে পরীক্ষা নিচ্ছেন কেনো?’

স্যার বললেন,- ‘পরীক্ষা না নিলে কেউ হয়তো এই বলে অভিযোগ করতে পারে যে,- ‘স্যার আমাকে ইচ্ছা করেই সেকেন্ড ক্লাশ দিয়েছে।পরীক্ষা দিলে আমি হয়তো ঠিকই ফাষ্ট ক্লাশ পেতাম।’

আমি বললাম,- ‘একদম তাই,স্যার। স্রষ্টাও এইজন্য পরীক্ষা নিচ্ছেন,যাতে কেউ বলতে না পারে- দুনিয়ায় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আজকে জান্নাতে থাকতাম। স্রষ্টা ইচ্ছা করেই আমাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে।’

ক্লাশের সবাই হাত তালি দিতে শুরু করলো। স্যার বললেন,- ‘সাজিদ, আই হ্যাভ এ্যা লাষ্ট কোয়েশ্চান।’
– ‘ডেফিনেইটলি, স্যার।’- আমি বললাম।
– ‘আচ্ছা, যে মানুষ পুরো জীবনে খারাপ কাজ বেশি করে,সে অন্তত কিছু না কিছু ভালো কাজ তো করে,তাই না?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘তাহলে, এই ভালো কাজগুলোর জন্য হলেও তো তার জান্নাতে যাওয়া দরকার,তাই না?’

আমি বললাম,- ‘স্যার, পানি কিভাবে তৈরি হয়?’

স্যার আবার অবাক হলেন। হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন যে, এই প্রশ্নটাও আউট অফ কনটেক্সট, কিন্তু কি ভেবে যেন চুপসে গেলেন।বললেন,- ‘দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে।’

আমি বললাম,- ‘আপনি এক ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন দিয়ে পানি তৈরি করতে পারবেন?’

– ‘কখনোই না।’
– ‘ঠিক সেভাবে, এক ভাগ ভালো কাজ আর এক ভাগ মন্দ কাজে জান্নাত পাওয়া যায়না। জান্নাত পেতে হলে হয় তিন ভাগই ভালো কাজ হতে হবে, নতুবা দুই ভাগ ভালো কাজ, এক ভাগ মন্দ কাজ হতে হবে। অর্থাৎ, ভালো কাজের পাল্লা ভারি হওয়া আবশ্যক।’
সেদিন আর কোন প্রশ্ন স্যার আমাকে করেন নি।’

এক নিশ্বাঃসে পুরোটা পড়ে ফেললাম।কোথাও একটুও থামিনি। পড়া শেষে যেই মাত্র সাজিদের ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাবো, অমনি দেখলাম, পেছন থেকে সাজিদ এসে আমার কান মলে ধরেছে।সে বললো,- ‘তুই তো সাংঘাতিক লেভেলের চোর।’

আমি হেসে বললাম,- ‘হা হা হা। স্যারকে তো ভালো জব্দ করেছিস ব্যাটা।’

কথাটা সে কানে নিলো বলে মনে হলো না।নিজের সম্পর্কে কোন কমপ্লিমেন্টই সে আমলে নেয় না। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো।

আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম,- ‘সাজিদ……’
– ‘হু’
– ‘একটা কথা বলবো?’
– ‘বল।’

– ‘জানিস, একসময় যুবকেরা হিমু হতে চাইতো।হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, মরুভূমিতে গর্ত খুঁড়ে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন দেখতো।দেখিস,এমন একদিন আসবে, যেদিন যুবকেরা সাজিদ হতে চাইবে। ঠিক তোর মতো……’

এই বলে আমি সাজিদের দিকে তাকালাম।দেখলাম, ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঘোর ঘুম……..

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৩টি মন্তব্য

  1. https://pratyabartan.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a7%87/
    নাস্তিক প্রশ্ন : কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা আল্লাহ ও তাঁর নবীর পছন্দ নয় (কুরআন ৫:১০১, ৫:১০২)! কেন এই চিন্তার পরাধীনতা? এর কারণ কি এই যে, তাতে করে ধর্মের মিথ্যা দিকগুলো প্রকাশ হয়ে যেতে পারে?

    উত্তর : আল কুরআনে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ! তোমরা সেসব বিষয়ে প্রশ্ন কোরো না, যা তোমাদের কাছে প্রকাশ হলে তা তোমাদের কষ্ট দেবে। আর কুরআন নাযিলের সময় তোমরা যদি সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করো তবে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। অতীত বিষয় আল্লাহ ক্ষমা করেছেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।

  2. —–“আচ্ছা “কুন-হও” অর্থাৎ এটা হলো স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি শক্তি। স্রষ্টা বলেন হও আর হয়ে যায়। এখন কেউ যদি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ত্বের প্রমাণ দিতে গিয়ে বলে, সে পূর্বানুমান অনুযায়ী কাজ করে তাহলে বুঝতে হবে স্রষ্ঠা তার ক্ষেত্রে যে কুন শব্দটির গুরুত্ব বুঝিয়েছেন সেটা নিতান্ত কথার কথা, সেটা কোনো শক্তি নয়।

    ইতিমধ্যে বাজারে একটি বই খুব সাড়া ফেলেছে “প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ” যা আরিফ আজাদ নামের এক লেখকের লেখা। আমি জানিনা কোরআন ও হাদীসের জ্ঞানে তিনি কতদূর? তবে আল্লাহ পূর্বানুমান অনুযায়ী কাজ করে, যেরকম আমরা অনুমান করে চিন্তা করি, কথা বলি, কাজ করি, যার ফলাফল ভবিষ্যৎকালে ভালো খারাপ যেকোনো একটি হতে পারে। (নাউজুবিল্লা) আল্লাহ আনুমান, আন্দাজ, চিন্তাভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কারণ আল্লাহ শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, যার মানেই হচ্ছে তিনি সব জানেন, বুঝেন, করেন। যার জন্য আল্লাহ কে অনুমান আন্দাজ করার মধ্যে শামিল করা কুফরি ও শেরেকি।

    প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ বইটায় এরকম একটি যুক্তি ব্যাখ্যা করেছেন। যার মূল বিষয় ছিলো তকদির বা ভাগ্য। সেই ভাগ্য বিষয়টির যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন আল্লাহ পূর্বানুমান অনুযায়ী কাজ করেন।

    যদি কেউ কোরআন সম্পূর্ণ পড়ে থাকেন তাহলে সেখানে পাবেন যে, অনুমান দ্বারা কাজ হয় মানুষের, অর্থাৎ কাফির মুশরিক অনেকেই অনুমান করে কাজ করে। মানুষ যে অনুমান ভিত্তি দ্বারা কাজ করে এই কথা আল্লাহ কোরআনে দশের অধিক বার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ যে তার বিপরীত সেটার উল্লেখ ও সমপরিমাণ।

    ভাই, কোরআন পড়ুন আল্লাহ সম্পর্কীয় সম্যক জ্ঞান লাভ করুণ। ইসলাম যুক্তিতর্ক সমর্থন করেন। কিন্তু গায়েব বিষয়ে অতিরিক্ত যুক্তি আল্লাহ অপছন্দ করেন না, বরং সে বিষয়ে শুধু বিশ্বাস রাখার গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন, ভাগ্যটাও গায়েবের অধিভুক্ত। এটা নিয়ে যদি কেউ যুক্তি দিতে যায় তাতে বরং শেরেকি ও কুফুরি যুক্তি চলে আসতে পারে।সুতরাং,

    (ইউনুস – ২০)
    বস্তুতঃ তারা বলে, তাঁর কাছে তাঁর পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ এল না কেন? বলে দাও গায়েবের কথা আল্লাহই জানেন। আমি ও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় রইলাম।

    তাকদির বিষয়ে করণীয়,
    হে আল্লাহ! যাদের আপনি হিদায়াত করে তাদের সাথে আমাকেও হিদায়াত করুন, যাদের আপনি অকল্যাণ থেকে দূরে রেখেছেন তাদের সাথে আমাকেও অকল্যাণ থেকে দূরে রাখুন, যাদের আপনি আপনার অভিভাবকত্বে রেখেছেন তাদের সাথে আমাকেও আপনসার অভিভাবকত্বে রাখুন। আপনি যা দিয়েছেন তাতে আপনি বরকত দিন। আপনি আমার তাকদিরে যা রেখেছেন এর অসুবিধা থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনই তো ফয়সালা দেন, আপনার বিপরীত তো ফয়সালা দিতে পারে না কেউ। আপনি যার বন্ধু তাকে তো লাঞ্ছিত করতে পারবে না কেউ। হে আমার রব! আপনি তো বরকতময় এবং সুমহান।’’ – ইরওয়া ৪২৯, মিশকাত ১২৭৩, তা’লীক আলা ইবনু খুজাইমাহ ১০৯৫, সহিহ আবু দাউদ ১২৮১, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ [আল মাদানী প্রকাশনী]

    আদম (রহঃ) … আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক জানাজায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশ নিয়েছিলেন। এসময় তিনি কিছু একটা কাঠি হাতে নিয়ে তা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কোন ব্যাক্তি নেই যার স্থান জান্নাত বা জাহান্নামে নির্ধারিত হয়নি। একথা শুনে সবাই বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে কি আমরা আমল করা বাদ দিয়ে আমাদের লিখিত তাকদিরের উপর নির্ভর করে বসে থাকব? উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা আমল করতে থাক। কেননা যাকে যে আমলের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সে আমলকে সহজ করে দেয়া হবে। সৌভাগ্যের অধিকারী লোকদের জন্য সৌভাগ্য লাভ করার মত আমল সহজ করে দেয়া হবে। এবং দুর্ভাগ্যের অধিকারী লোকদের জন্য দুর্ভাগ্য লাভ করার আমল সহজ করে দেয়া হবে। এরপর তিনি পাঠ করলেন, “সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকী হলে এবং যা উত্তম তা গ্রহণ করলে, আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ এবং কেউ কার্পণ্য করলে ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে, এবং যা উত্তম তা বর্জন করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ” ।
    [সহীহ বুখারী (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ ৫২/ তাফসীর (كتاب تفسير), হাদিস নম্বরঃ ৪৫৮৬]

    1. আমি থামলাম।বললাম,- ‘স্যার, তাকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এরকম। আপনি যেমন আমাদের মেধা, যোগ্যতা,ক্ষমতা সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখেন, স্রষ্টাও তেমনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে ধারনা রাখেন।আপনার ধারনা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার ধারনায় কোন ভুল নেই।স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব।তিনি ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন
      – এখানে মূলত উদাহরণ সৃষ্টির জন্য রূপক অর্থে আল্লাহ অনুমান করেছেন সেটা বলা হয়েছে।এই অনুচ্ছেদে এটা স্পষ্ট যে লেখক নিজেও জানেন আল্লাহর অনুমান নির্ভূল।তিনি সকল ভুলের উর্ধ্বে।ধন্যবাদ।।

মন্তব্য করুন

Back to top button