ছোটগল্প/উপন্যাস

এক টুকরো সুখের খোঁজে-০২

বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সূচনা। বেশী আদরে বড় হওয়া মেয়েরা একটু জেদি আর একরোখা হয়। সূচনার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যা সে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তা না করা পর্যন্ত কোন কিছুতেই শান্তি পায়না।
বাবা মায়ের স্বপ্ন মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে। সূচনাও বাবা মায়ের স্বপ্ন কে নিজের স্বপ্ন করে নিয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হলেও কখনো কোন অভাবে পড়তে হয়নি সূচনা কে। কিছু চাওয়ার আগেই সামনে পেয়েছে। বাবা মায়ের এত এত পরিশ্রমের এই সামান্য প্রতিদান টুকু সূচনা দিতে চায়। হ্যাঁ,ডাক্তার হয়েই দেখাবে সূচনা। বাবা মায়ের পরিশ্রম সার্থক করবে সে।
সূচনা এ যুগের আধুনিক,স্মার্ট মেয়ে। সুন্দরীও বটে। স্কুল,কলেজে কতই তো প্রপোজাল পেয়েছে কিন্তু স্বপ্ন তো ডাক্তার হওয়ার,প্রেম ভালবাসার সময় কোথায় সূচনার?
:
এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে একসাথে মেডিক্যাল কোচিংয়ে ভর্তি হয় সূচনা আর তার স্কুল জীবনের বান্ধবী মৌমিতা। ক্লাস সিক্স থেকে মৌমিতার সাথে সখ্যতা সূচনার। দুজন খুব ক্লোজ বান্ধবী।
কোচিং শুরুর কিছুদিন পূর্বে সূচনা কে ডিএমসি তে পড়ুয়া সোহেল নামের এক ছেলের সাথে ফ্রেন্ডশীপের প্রপোজ দেয় মৌমিতা। শুরুতে সূচনা রাজি হয়নি কিন্তু মৌমিতা যখন বলল, আমাদের স্বপ্ন তো মেডিক্যালে পড়ার,আমাদের স্বপ্ন পূরণের জন্যই মেডিক্যালের কারো সাথে জানাশোনা থাকা উচিৎ,এতে আমরা একটা গাইডলাইন পাব,প্রশ্ন কেমন হয় তারও একটা আইডিয়া পাব।তাছাড়া সোহেল খুব ভাল ছেলে,আমার বয়ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড। আমার বয়ফ্রেন্ড না থাকলে আমিই প্রেম করে ফেলতাম,এই বলে চোখ টিপল মৌমিতা।
প্রথম কথা গুলো সূচনার মনে ধরল।আর প্রেমের ইচ্ছা সূচনার নেই। সোহেলের সাথে ফ্রেন্ডশীপ হয়ে গেল তার। না দেখেই ফোনে কথা হত,আর চ্যাট হত। প্রথম প্রথম পড়াশোনা রিলেটেড প্রচুর কথা হত। কিন্তু আস্তে আস্তে এই টপিক ঐ টপিক ঘুরে এসে নিজেদের মধ্যে স্থির হত কথা। কে কি পছন্দ করে,কে কেমন সঙ্গী চায়,কার কি স্বপ্ন,কাকে কোন পোশাকে সুন্দর লাগে,অবসরে কে কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি…
সূচনার ভাল লাগত সোহেলের কথা। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতো সোহেল।একটা সময় এমন হল একদিন কথা না হলে অস্থির হয়ে যেত সূচনা। অন্যদিকে মেডিক্যালের প্রিপারেশনের দফারফা অবস্থা! পড়ায় মন নেই সূচনার। ভুলে গেল তার বাবা মায়ের স্বপ্ন, তার নিজের স্বপ্ন। সারাক্ষন মাথায় ঘুরত কখন কথা হবে সোহেলের সাথে! কবে দেখা হবে!
প্রথম যেদিন দেখা হল, দুজন দুজন কে দেখে মুগ্ধ। সূচনার মনে হল এই সেই মানুষ যার জন্য এতটা বছরের অপেক্ষা।
কিভাবে তাদের প্রেম হয়ে গেল সূচনা নিজেও জানেনা।
:
মেডিক্যাল পরীক্ষার ফল প্রকাশ হল। সোহেল ফোন করে জানাল চান্স হয়নি সূচনার। সূচনা কে উৎসাহ দিল পরের বার আবার চেষ্টা করতে। সোহেলের সাপোর্ট সূচনার কষ্ট অনেকটাই দূর করে দিল। আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলো এত ভাল একজন সঙ্গী তাকে দেয়ার জন্য। সোহেল সত্যিই ওকে অনেক ভালবাসে। কাউকে ভালবাসলেই শুধু এত কেয়ার করা যায়। সেদিন সোহেল ওকে অনেক সময় দিল,বেড়াতে নিয়ে গেল। সারাদিনের আনন্দে সূচনা ভুলেই গেল সে মেডিক্যালে চান্স পায়নি। এমন কি ফোন টাও অফ করে রেখেছে, বাবা মা কেও তার রেজাল্ট জানাতে ভুলে গেল।
দিন শেষে সোহেল সূচনার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। এত সুন্দর স্মৃতিময় একটা দিনের জন্য সোহেল কে ধন্যবাদ দিল সূচনা।
সূচনা বাসায় ফিরে দেখে বাবা মা তার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। ঘরে ঢুকতেই মা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সারাদিন কই ছিলি? ফোন টাও বন্ধ রেখেছিস! রেজাল্ট যা হওয়ার হয়েছে এজন্য ফোন কেন বন্ধ রাখতে হবে?
– মা, আমার চান্স হয়নি।
– তাতে কি হয়েছে? এজন্য মন খারাপ করতে হবে? বাবা মা থেকে দূরে গিয়ে ফোন বন্ধ রাখতে হবে? কি ভেবেছিস আমরা তোকে বকা দিব? কৈফিয়ত চাইব কেন চান্স হয়নি? কক্ষনো না.. আমাদের চেয়ে তুই নিজেই বেশী কষ্ট পাচ্ছিস তা না বললেও বুঝি।
সূচনার বাবা ও এসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল এবার হয়নি কিন্তু ইন শা আল্লাহ সামনের বার হবে। চিন্তা করিস না মা।।
সূচনার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগল। ছিঃ এটা কি করেছে সে! সোহেলের সঙ্গ পেয়ে বাবা মার কথাই ভুলে গিয়েছিল! একবার ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলেই হত। বাবা মা কত টেনশানে ছিল।
:
রাতে সূচনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফেসবুকে ঢুকল। তার ফ্রেন্ডলিস্টের কে কে চান্স পেয়েছে দেখার ইচ্ছে করছিল। অনেকেই চান্স পেয়েছে,হাসিমুখে V দেখিয়ে সেলফি ও দিয়েছে। মন টা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল তার। আজকে সেও হয়ত এভাবে সেলিব্রেইট করতে পারত। হঠাৎ সামনে এল ছোট একটা স্ট্যাটাস!
. “এত চেষ্টার পরও মেডিক্যালে চান্স হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ। নিশ্চয় এর মাঝেই আল্লাহ আমার কল্যান রেখেছেন যা আপাতঃ দৃষ্টিতে আমি দেখতে পাচ্ছিনা।”
আশ্চর্য তো! মেয়েটা চান্স না পেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলছে! আরও বলছে এটাতেই নাকি তার কল্যান আছে!
কথা বলতে ইচ্ছে হল জান্নাত নামের মেয়েটার সাথে।
সূচনা Hi দিল।
ওপাশ থেকে জবাব এল, ‘আসসালামু আলাইকুম’
একটা ধাক্কা খেল সূচনা। আগেই বুঝা উচিৎ ছিল যে মেয়ে মেডিক্যালে চান্স না পাওয়াকেই তার জন্য কল্যান হিসেবে মেনে নিয়েছে তাকে Hi বলা বোকামী!
‘ওয়ালাইকুম সালাম’ বলে সূচনা চুপ হয়ে গেল। কি বলবে আর! কিন্তু কথা বলার লোভ ও হচ্ছিল।
– আচ্ছা তুমিও তাহলে পরীক্ষা দিয়েছিলে? আমারও চান্স হয়নি। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব,আমারও স্বপ্ন ছিল কিন্তু হল না।
– আমারও হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি মনে করি এর মধ্যেও আমার জন্য কল্যান আছে যা আমি এখন বুঝতে পারছিনা।
একটা অপূর্ণতার মধ্যে কল্যান কিভাবে থাকতে পারে সূচনার বুঝে আসেনা! তারপরও জান্নাতের কথা ওর ভাল লাগছিল। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনেক বিশ্বাস জান্নাতের।
– সূচনা একটা কথা বলি কিছু মনে না করলে?
– হ্যাঁ বলো জান্নাত।
– প্রোফাইল পিকচার টা কি তোমার?
– হ্যাঁ।
– ছবিটা দেয়া কি ঠিক হয়েছে?
– বুঝতে পারিনি।
– তুমি কি সূরা আন নূর কখনো পড়েছ?
– ছোট বেলায় পড়েছি হয়ত।
– সূরা নূরের একটা আয়াতের বাংলা অনুবাদ দেই তোমাকে?
– আচ্ছা।
– ‘আর মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ না করে।তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের ছেলে,স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই-এর ছেলে,বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে,অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।আর তারা যেন নিজেদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে।হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’
(সূরা আন-নূর:৩১)
এটা হল নারীর জন্য পর্দার প্রধান আয়াত। এই আয়াতে আল্লাহ নারীর মাহরাম নির্ধারন করে দিয়েছেন। মাহরাম হল যাদের সামনে যাওয়া জায়েয এবং বিবাহ হারাম।
তোমার ছবি টা যারা দেখেছে তারা কেউই তোমার মাহরাম না। যতজনই দেখেছে গুনাহে জারিয়া তোমার আমলনামায় যোগ হচ্ছে।
সূচনা ছোটবেলায় কোরআন পড়েছে কিন্তু বুঝে পড়েনি। জান্নাতের দেয়া বাংলা অর্থ পড়ে সূচনা স্তম্ভিত হয়ে গেল! কত সুন্দর,সাবলিল ভাবে বলা হয়েছে পর্দার কথা। অথচ এতদিন সে জানতোই না কোরআনে পর্দার কথা এভাবে বলা হয়েছে!
– জান্নাত আমি জানতাম না পর্দার হুকুম এমন।!
– শুধু তুমি একাই না, অনেক বোন আছে যারা পর্দা ফরজ জানে কিন্তু কিভাবে পর্দা করতে হবে আর কোরআনেই বা কেমন হুকুম এসেছে তা জানেনা। মানুষ না জেনেই ভুল করে বেশী আর এজন্যই তোমাকে বলেছি। কষ্ট পেলে মাফ করে দিও।
– এই না! মাফের কথা কেন আসছে? তুমি বরং আজ আমার অনেক উপকার করলে। আমি সত্যিই জানতাম না পর্দার এত কঠিন হুকুম।
– শুধু পর্দা ই না সূচনা, কোরআনে নামাযের হুকুম এসেছে,রোজার হুকুম এসেছে,হালাল-হারামের হুকুম এসেছে,দান-সাদাকাহর হুকুম এসেছে,পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরনের হুকুম এসেছে,স্বামী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন,প্রতিবেশী সহ দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু প্রয়োজন সমস্ত কিছুর বিধান কিছু সরাসরি কোরআনে এসেছে আর কিছু হাদিসের মাধ্যমে এসেছে।
আমরা একটি কে বাদ দিয়ে অন্যটি মানতে পারিনা।নামায আদায় করলেই পর্দার জন্য ছাড় পাব,পর্দা করলেই রোজার জন্য ছাড় পাব,রোজা করলেই হারামের জন্য ছাড় পাব,হারাম বর্জন করলে পিতা-মাতা,স্বামী-সন্তান,আত্মীয়-প্রতিবেশীর হক্বের জন্য ছাড় পাব ব্যাপার টা এমন নয় সূচনা। বরং আল্লাহর প্রতিটি হুকুম একটির সাথে অন্যটির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিদ্যমান।
– জান্নাত! আমাকে এভাবে কেউ কখনো বলেনি। আজ মনে হচ্ছে আমি এতটাদিন সম্পূর্ণ ভুলের উপর অতিবাহিত করেছি।
– ‘ভুল করেছি’ এই অনুভূতি টুকুই তো হেদায়াত লাভের প্রথম সোপান ইন শা আল্লাহ! দেখো আল্লাহ কি বলেছেন পবিত্র কালামে,
. ‘যে গোনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।
(সূরা নিসাঃ১১০)
সুবহানআল্লাহ!! রব্বুল ‘আলামীনের কত দয়া! আমাকে ভুল পথ এবং সঠিক পথ সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে দেয়ার পরও আমি যদি ভুল পথ কেই বেছে নিয়ে নিজের অনিষ্ট করি,অতঃপর ভুল বুঝতে পেরে রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি তবে আল্লাহ ক্ষমার প্রকাশ্য ঘোষনা দিয়েছেন,সুবহানআল্লাহ!
– সত্যিই তাই। আমি আজই তওবা করে নামায শুরু করব।
– কোন কাজ আমরা করতে পারব এই নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারিনা। সকল ভাল কাজই আল্লাহর ইচ্ছায় হয় তাই কোন কাজ করব বলার সাথে বলতে হবে ইন শা আল্লাহ।
– আমি আজই তওবা করে নামায শুরু করব ইন শা আল্লাহ।
– শুধু নামায না, সাথে আগামীকাল থেকে পর্দা ও করবে ইন শা আল্লাহ।
– ইন শা আল্লাহ পর্দা ও করব। তোমাকে ধন্যবাদ জান্নাত,তোমার জন্য আজ অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
– আল্লাহ তোমাকে কবুল করুন। সত্যি বলতে তুমি নিজেই জানতে আগ্রহী হয়েছ। আর এজন্যই আমার কথা গুলো তুমি ইতিবাচক অর্থেই নিয়েছ।
আল্লাহ বলেছেন,
. ‘আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষন পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না,যতক্ষন না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।’
(সূরা রা’দঃ১১)
নিজের অবস্থার পরিবর্তনের প্রথম উদ্যোগ টা নিজেরই নিতে হয়। এরপর আল্লাহর সাহায্য পৌঁছে।
:
এতক্ষন পর সূচনার যেন হুঁশ ফিরল। কি করেছে সে! সোহেলের জন্য ভুলে গিয়েছিল তার বাবা মায়ের স্বপ্ন,ভুলে গিয়েছিল তার স্বপ্ন। কি করে মুখ দেখাবে সে বাবা মা কে!
অন্যদিকে সোহেলের ভালবাসার মোহে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কত কিছুই তো করেছে সে! নিজের সততা,পবিত্রতা, আত্মসম্মান,ব্যক্তিত্ববোধ সবই সে হারিয়ে ফেলেছে!
এই জীবনের আর কি ই বা মূল্য এখন!
কিন্তু না! জান্নাতের কথা গুলো বার বার মনে হচ্ছে। কোরআনের অর্থ সে কখনো বুঝে পড়েনি। আল্লাহ কত সুন্দর জীবন ব্যবস্থার বিধান দিয়েছেন কোরআনে! কি যেন আয়াত টা!!
. ‘যে গোনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।
নাহ! অনেক দেরি করে ফেলেছে সূচনা! নামায পড়া হয়নি বহু বছর। ছোট বেলায় শিখেছিল নামাযের নিয়ম। শেখার উৎসাহে কিছুদিন নামায ও পড়েছিল। কিন্তু সে উৎসাহ হঠাৎই যেন উধাও হয়ে গেল পড়াশোনার চাপে। বাবা মা ও কখনো বলেনি নামাযের কথা।
সূচনার বাবা শিখিয়েছে কিভাবে ক্যারিয়ার গড়তে হয়! কিভাবে ভাল রেজাল্ট,ভাল জব,বেটার পজিশনের জন্য লড়াই করতে হয়! মা ওকে শিখিয়েছে আধুনিকতা!কোন কালারের ড্রেস বেশী মানায়! কোন ফ্যাশন এখন জনপ্রিয়! কোন অর্নামেন্ট কোন ড্রেসের সাথে ম্যাচ করে বেশী! শেখায়নি যোহরের নামায কত রাকায়াত! শেখায়নি পর্দা কি! মাহরাম/গায়রে মাহরাম কি!
আজ সূচনা বহু বছর পর নামাযে দাঁড়াল। হার্টবিট ক্রমেই বাড়ছে। কি জানি নামায এটা? ওহ! সন্ধ্যার পর তো এশার নামায পড়তে হয়! সূচনা নিয়াত করে দাঁড়িয়ে গেল নামাযে। কিসের যেন একটা জড়তা জাপটে ধরে আছে ওকে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারি হতে লাগল সূচনার। জানেনা যে সূরা পড়ছে তার অর্থ তবে নিঃসন্দেহে তা সুন্দর,সুমধুর। দুচোখের জল দুগাল ভিজিয়ে দিল তার। কান্নার মাঝে এত স্বস্তি থাকে এই প্রথম অনুভব করল সূচনা।
:
সকালে সূচনা মায়ের কাছে গিয়ে বসল। সূচনার উসখুস আচরন দেখে মা জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবি?
– হুমম
– বল
– আমাকে একটা বোরকা কিনে দিবে আম্মু? প্লিজ…
সূচনার মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এতটা অবাক হত না! কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– তুমি বাচ্চা মেয়ে। এখনই বোরকা পরার কি দরকার? লোকে হাসাহাসি করবে। আর বোরকাই পরতে হবে এমন তো না,তুমি তো শালিন ভাবেই বাইরে যাও।
– আম্মু প্লিজ,তুমি না করো না। গতরাত থেকে আমি নামায শুরু করেছি। অসম্ভব এক প্রশান্তি পেয়েছি আম্মু যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।
– নামায পড়ো,শালিন ভাবে বাইরে যাও তাহলেই তো হল।
– না আম্মু তাহলেই হল না। কারন নামায যাঁর হুকুম পর্দা ও তাঁরই হুকুম। গতকাল রাতে আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ডের সাথে অনেক কথা হয়েছে আম্মু। আমি আশ্চর্য হয়েছি ওর কথা শুনে! আমি এসব আগে ভাল ভাবে জানতাম ই না। মেয়েটা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমার জন্য এখন পর্দা করাটাও ফরজ।
– কার না কার পাল্লায় পড়েছিস! এসব মেয়েদের কে বিশ্বাস নেই। তোকে আবার বিপদে না ফেলে।
– কেন এভাবে বলছো আম্মু? ওর তো কোন স্বার্থ দেখিনা আমি নামায পড়লে,পর্দা করলে। এমন কি আমাকে চিনেও না। এমনো না আমাকে কথা গুলো বলার বিনিময়ে সে কিছু দাবি করে বসেছে। তার তো কোন লাভ নেই এখানে! আমি এতকিছু শুনতে চাইনা আম্মু। আমাকে বোরকা,নিকাব কিনে দাও। দরকার হলে এ বছর আর কোন ড্রেস কিনব না তবু কিনে দাও।
মেয়ের জেদের কাছে মা কে হার মানতেই হল। কিন্তু তাই বলে প্রচেষ্টা বন্ধ থাকেনি। বোরকা পরে কে কবে কি করেছে তার উদাহরন নিত্যই সূচনার সামনে উপস্থাপিত হত। সূচনা সেসব নিয়ে আলোচনা করত জান্নাতের সাথে। জান্নাত ওকে বুঝাল কেউ নিজের অপকর্ম আড়াল করার জন্য পোশাকের সহায়তা নিলে দোষ টা কি পোশাকের হবে? নাকি যে পোশাকের অপব্যবহার করেছে তার?
সূচনা বুঝে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল সে এখন আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় করে তাই এসব অহেতুক যুক্তি তার মাথায় আসেনা। মনে মনে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করল সূচনা কারন সে এখন ৫ওয়াক্ত নামায আদায় করে আর বোরকা,নিকাব ও পরে।
:
সূচনা এখন সোহেল কেও নামাযের কথা বলে। শুরুতে খুশি মনে পড়বে বললেও এখন বিরক্ত হয় সোহেল। আর কত সহ্য করা যায়? একটা মানুষ দিনে রাতে ৫বার ফোন দিয়ে যদি বলে নামায পড়ে নাও তবে কেমন লাগে! সবচেয়ে বিরক্ত লাগে ফজর ওয়াক্তে যখন ফোন দেয়। ঘুম থেকে জাগিয়ে যদি বলে নামাযে যাও তখন মেজাজ টা কন্ট্রোল রাখতে পারেনা সোহেল! কঠিন ঝাড়ি দিয়ে ফোন রেখে দেয়। সূচনার প্রতিটা আচরন এখন অসহ্য লাগে সোহেলের। আগে এত যন্ত্রনা করত না। ইদানিং এমন পাগল হল কেন কে জানে। সোহেলের মেয়ে ফ্রেন্ড গুলো কে সহ্যই করতে পারেনা এখন সূচনা। বলে কিনা, এত মেয়ে ফ্রেন্ডের কি দরকার? তোমার জন্য আমি আছি আমার জন্য তুমি আছ এটুকু কি যথেষ্ট না?
আশ্চর্য কথা! সব ফ্রেন্ডদের সাথে কি প্রেম করে বেড়ায় নাকি সোহেল! ওরা তো জাস্ট ফ্রেন্ড। তবু একসাথে সেলফি দেখলে,ট্যুরে গেলে,পিকনিকে গেলে সূচনা কান্নাকাটি করে মাথা খারাপ করে ফেলে। অসহ্য এক যন্ত্রনা। সিগারেট খেতেও নিষেধ করে!
আর আজকাল বোরকা,নিকাব পরে দেখা করতে আসে সূচনা! হাত টাও ধরতে দেয়না। বলে,গুনাহ হবে। আরে এত গুনাহের চিন্তাই যখন করবি তাহলে প্রেম করতে আসছিলি কেন?
হাস্যকর লাগে সোহেলের! মাঝে মাঝে খুব লজ্জা ও পায় বোরকা পড়ুয়া আনস্মার্ট টাইপ গার্লফ্রেন্ডের পাশে বসে থাকতে। এভাবে আর সহ্য করা সোহেলের জন্য অসম্ভব।
:
সোহেল কে সত্যিই ভালবাসে সূচনা। কিন্তু জান্নাতের কাছে শুনেছে এটা নাকি হারাম সম্পর্ক। তাই ইদানিং কথা বলা,দেখা করা কমিয়ে দিয়েছে সূচনা। বিয়ের কথা বলেছিল সোহেল কে কিন্তু সোহেলের কাছে এটা অত্যন্ত মজার জোকস মনে হয়েছে। বলে দিয়েছে আরও ৮/১০ বছর পর বিয়ের চিন্তা করবে,ডাক্তারী পড়া শেষ করে সামনে তার ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করার সময়। এর মধ্যে বিয়ে করে সে ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চায়না।
কি বলবে খুঁজে পায়না সূচনা আবার ভালবাসার টানে ছাড়তেও পারেনা। গুনাহের ভয়ে সে কথা কম বলে,দেখা কম করে অথচ সোহেল এই সময় টা ভালোই কাজে লাগাচ্ছে। ইচ্ছামত সার্কেল নিয়ে চলে যাচ্ছে ট্যুরে,পিকনিকে! বান্ধবী দের সাথে কত্ত ক্লোজ হয়ে ছবি তুলে তা আপলোড ও করছে! সূচনা ফোন দিলে বলে পরে কথা বলব ব্যস্ত আছি এখন! সূচনা বুঝে সোহেল এখন ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে চলে। কষ্টে কলিজা ফেটে যায় সূচনার। কেন এমন করছে সোহেল! কি তার অপরাধ? সে তো সবসময় সোহেলের ভালই চেয়ে এসেছে। সোহেলের খুশি-অখুশি কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভুল টা কোথায় সূচনার? তবে কি এখন পুরনো হয়ে গেছে সূচনা? আর কি ভাল লাগেনা ওকে? বোরকা পরে বলে সোহেল কি লজ্জিত ওকে নিয়ে? নামাযের কথা বলে দেখে বিরক্ত হয় সোহেল? শুধু এসবই দেখল! সূচনার ভালবাসা টা একবারও দেখলোনা কেন সোহেল?
:
সোহেলের কল দেখে খুশি তে আত্মহারা হয়ে গেল সূচনা! আজ বিকালে দেখা ও করতে বলেছে সোহেল। সূচনা নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে হাজির। অনেক কথা যে বলার বাকি। আজ ইচ্ছামত বকে দিবে সুন্দরী ঐ বান্ধবী টার সাথে এত কিসের খাতির সোহেলের! হিংসে হয়না বুঝি সূচনার!
সোহেল এসেই সূচনা কে বলল, একটা জরুরী কথা বলতে চাই যদিও জানি তুমি কষ্ট পাবে তবুও বলতে হচ্ছে।
সোহেলের গম্ভীর চেহারা দেখে সূচনার হার্টবিট বেড়ে গেল। কি বলতে চায় সোহেল? এমন কিছু নিশ্চয় না যা সূচনা সহ্য করতে পারবেনা! সূচনা শুকনো গলায় ঢোক গিলার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, হ্যাঁ বলো, কি কথা?
– সূচনা, আমার মনেহয় আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিৎ।
– এটা কেন বলছো সোহেল? তুমি না আমাকে ভালবাসো?
– আমিও তাই জানতাম কিন্তু সময় এখন বদলে গেছে। আমি তোমার সাথে নিজেকে আর মানাতে পারছিনা।
– এমন বলোনা সোহেল। আমি তোমাকে ভালবাসি। কখনো তোমার খারাপ চাইনি,আজও চাইনা। তোমার খুশিকে সবসময় অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি।
– আমার খুশি? তাহলে চলো এখন আমার রুমে…
– এসব বলো না সোহেল, এমনিতেই এতদিন অনেক গুনাহ করেছি আমরা। আর গুনাহ চাইনা। বিয়ে করি চলো।
– পাগল নাকি! এখন বিয়ে করে আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করব! আমাকে কেমন ভালবাসো বুঝা হয়ে গেছে সূচনা। এত গুনাহের চিন্তা করলে প্রেম করতে আসছো কেন? তোমার সাথে আর কথা বলতে চাইনা।
– কিন্তু আমার দোষ টা কি?
– দোষ তোমার না,দোষ আমার। তোমাকে ভালবাসতে যাওয়াই আমার জীবনের চরম ভুল। তোমার সাথে আমার আর মিলেনা। এতদিন পর বুঝতে পারছি আমরা দুজন দুজনের জন্য নই।
নির্বাক হয়ে গেছে সূচনা। কেন এমন করলো সোহেল! কেন ওকে প্রতারিত করল! কি অপরাধ ছিল সূচনার? শুধুমাত্র পর্দা করে বলে আজ সোহেল ওকে ছেড়ে যাচ্ছে? নামাযের কথা বলে দেখে ছেড়ে যাচ্ছে? স্পর্শ করতে দেয়না বলে সোহেল বুঝে নিল সূচনা ভালবাসে না?
হায় রে! দিন শেষে এসব কার জন্য ভাল ছিল বুঝল না সোহেল! বুঝল না ভালবাসার মানুষ টিকে সে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল!
প্রতারনা করেছে সোহেল। সূচনা সোহেল কে কোনদিন ক্ষমা করবেনা.. কোনদিন না.. এভাবে সূচনা কে প্রতারিত করার শাস্তি এই দুনিয়ায় না পেলেও শেষ বিচারের দিন ঠিকই পাবে সোহেল।
বিষন্ন মনে বাসায় ফিরল সূচনা। বাসায় ফিরেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু কেন আল্লাহ এখন ওকে এমন শাস্তি দিলেন? সূচনা তো এখন ৫ ওয়াক্ত নামায পড়ে,পর্দা করে। আস্তে আস্তে আরও মানবে তবু কেন এখন আল্লাহ সোহেল কে কেড়ে নিলেন? কেন?
আগে তো নামায পড়তোনা, বেপর্দায় বাইরে যেত! কই তখন তো কোন ঝামেলা হয়নি! এখন যখন ভাল হতে চাইছে তখন কেন সবাই সূচনা কে এমন কষ্ট দিচ্ছে? সোহেল চলে গেল.. বাবা মা ও আজকাল সূচনার কাজকর্ম পছন্দ করছে না! নিকাব না পরতে বলে! কেন সব এমন হয়ে যাচ্ছে!
নিজেকে একটু কন্ট্রোল করে জান্নাত কে ফোন দিল।
ওপাশ থেকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ ভেসে এল।
সূচনা সালামের জবাব দিয়ে বলল, আজ নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছে জান্নাত। আজ আমি সব হারিয়ে এসেছি।
– কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?
– তোমাকে আগে বলা হয়নি। আমি একজন কে ভালবাসতাম। একটু বেশীই ভালবাসতাম। এতদিন সম্পর্ক ভালই ছিল, কিন্তু যখন থেকে আমি পর্দা শুরু করলাম,নামায শুরু করলাম,ওকেও নামাযের কথা বলা শুরু করলাম তখন থেকে ওর সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করল। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে অনেক কষ্ট দেয়া শুরু করল। আর আজ একদম ব্রেকআপ ই করে দিল! আমি এই কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা জান্নাত। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তো জাহান্নাম থেকে ওকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম।
– আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! এটা তো সুখবর! আর তুমি কষ্ট পাচ্ছো! কান্না করছো! ওকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই জাহান্নামী হওয়ার কোনই মানে হয়না। যা হয়েছে ভাল হয়েছে।
জান্নাতের কথা শুনে থমকে গেল সূচনা! আশ্চর্য মেয়ে তো ! যাকে এত ভালবাসে তার সাথে ব্রেকআপ হয়েছে আর জান্নাত এতে খুশি হচ্ছে! নিজের বিরক্তিভাব আড়াল না করে সূচনা বলল, কিছু মনে করোনা জান্নাত, আমি এতদিন ধারনা করতাম তুমি আমার ভাল চাও বলেই আমাকে এটা সেটা জানাও,আমল করার তাগিদ দাও কিন্তু এখন দেখছি তুমি আমার কষ্ট দেখে খুশি হও!
– তুমি ঠিকই ধারনা করতে। আমি নিঃস্বার্থ ভাবে তোমার ভাল চাই।
– তাহলে আমার ব্রেকআপের কথা শুনে খুশি হয়েছ কেন?
– ওহহ সূচনা! কেন বুঝতে পারছোনা আল্লাহ তোমাকে কত্ত ভালবাসেন! তুমি তওবা করেছ বলেই আল্লাহ তোমার পথ কে সহজ করে দিচ্ছেন। প্রেম একটি জঘন্য হারাম সম্পর্ক তা এতদিনে তোমার বুঝে যাওয়ার কথা। আল্লাহর প্রিয় একজন বান্দা একটা হারাম সম্পর্কে লিপ্ত থাকবে আল্লাহ তা সহ্য করবেন কিভাবে? তুমি যেহেতু পর্দা করার চেষ্টা করছো এজন্য আল্লাহ তোমার চলার পথ কে মসৃন করে দিতেই তোমার বয়ফ্রেন্ড কে নিজ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন! সুবহানআল্লাহ!
দুনিয়ায় কত শত মানুষ আছে যারা হারামে লিপ্ত আছে,মাঝে মাঝে তাদের বিবেকবোধও জাগ্রত হয় সে হারামে লিপ্ত কিন্তু হারাম থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা। আর আল্লাহ তোমার জন্য গুনাহের উৎস টাকেই দূর করে দিয়েছেন। একটা হারাম সম্পর্কের এতটাই শক্তি যে তা ধীরে ধীরে তোমার সব নেক আমল গুলোকেও গুনাহের অন্তভূর্ক্ত করে নিবে। ঐ ছেলে তোমাকে ছেড়ে গেছে,এজন্য তুমি শেষ হয়ে যাওনি বরং বেঁচে গেছ। মৃত্যুর আগে আরেক মৃত্যু থেকে বেঁচে গেছ তুমি।
উম্মুল মু’মিনীনগণ সকল যুগের নারীর জন্য আইডল। তোমাকে একটা হাদিস শুনাই.. দেখো তোমার আইডলের তাকওয়া কেমন। দেখো কেমন পূণ্যবতী নারীর অনুসরন আমরা করি…
. ‘আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,আমি আমার সে ঘরে প্রবেশ করতাম যেখানে রাসূল (সাঃ) শুয়ে আছেন,তখন আমি আমার বড় চাদর খুলে রাখতাম আর ভাবতাম ইনি হলেন আমার স্বামী আর অপরজন আমার পিতা।পরে যখন হযরত উমর (রাঃ) কে এই ঘরে দাফন করা হল, আল্লাহর কসম আমি কখনো পুরো শরীর কাপড়ে না ঢেকে সেখানে প্রবেশ করিনি উমর (রাঃ) কে লজ্জা করার কারনে।’
(মুসনাদে আহমাদ,মিশকাতঃ১৬৭৪)
আমরা যাঁর অনুসরনে জীবন গড়তে চাই তিনি তো গায়রে মাহরাম ব্যক্তির কবরের সামনেও পর্দা করতেন! আর আমরা বয়ফ্রেন্ডের জন্য সবচেয়ে সুন্দর ড্রেস পরে,সুন্দর করে সেজেগুজে আমাদের দিকে আকর্ষন করি। বয়ফ্রেন্ড আমাদের সৌন্দর্যের পূজা করে আর আমরা ভাবি কত্ত ভালবাসে!!
– আলহামদুলিল্লাহ বুঝলাম। সত্যিই.. বেঁচে গেছি আমি। প্রেম শারীরিক আকর্ষন ব্যতীত কিছুই না। এতটা দিন নিজেকে সোহেলের খেলার পুতুল মনে হত। আজ প্রথম অনুভব করলাম আমি মেয়ে। আমার সম্মান স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারন করে দিয়েছেন।
– একদম তাই। আমাদের সম্মান স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারন করে দিয়েছেন। অসম্ভব সুন্দর কথা বলেছে তুমি। সুতরাং তোমার উচিৎ আল্লাহর এত বড় অনুগ্রহের জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা। আল্লাহর কাছে খুব অনুনয় করে চাও যেন রব্বুল ‘আলামীন তোমার মন থেকে ঐ ছেলের সব স্মৃতি ভুলিয়ে দেন। কেননা যতবারই ওর কথা তোমার মনে হবে তুমি ওর প্রতি দূর্বল হয়ে যাবে,নিজেই কষ্ট পাবে,শয়তানের ওয়াসওয়াসায় হয়ত কথা বলারও ইচ্ছা হবে। এজন্যই প্রতি নামাযের পর বিশেষ করে তাহাজ্জুদে বেশী করে চাও যেন প্রেমের সব স্মৃতি আল্লাহ তোমার মন থেকে মুছে দেন। ইন শা আল্লাহ এমন একটা সময় আসবে তুমি ভুলেই যাবে তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল।
– আমি তাই করব জান্নাত। আমাকে করতেই হবে। আমি এতদিন ভুল করেছি,অনেক পাপী আমি। দুনিয়ার কেউ জানেনা শুধু আমি আর আমার রব জানি আমি কত গুনাহ করেছি। কিন্তু জান্নাত, আমি তো এখন ভাল হতে চাই,সৎপথে থাকতে চাই তাহলে এখন কেন আমাকে কষ্ট পেতে হয়? আমার কাজকর্মে আমার বাবা-মা,আত্মীয়-স্বজন খুব বিরক্ত। আমি কোথাও গিয়ে স্বস্তি পাইনা। আমি এটা কেন করেছি,সেটা কেন করেছি ইত্যাদি সবই দোষের মনেহয় সবার কাছে।
– সূচনা, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল নবী রাসূল গণ। আর নবী রাসূল গণই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। যেমন বলি…
ইউনুস (আঃ) কে আল্লাহ মাছের পেটে নিয়ে গিয়েছিলেন,
মুসা (আঃ) কে শত্রুর ঘরে বড় করেছেন,
আইয়ুব (আঃ) কে কঠিন রোগ দিয়েছিলেন,
ইব্রাহিম (আঃ) কে প্রিয় পুত্র কোরবানি করার পরীক্ষায় ফেলেছিলেন,
ইউসুফ (আঃ) কে কূপে নিক্ষেপ করেছিলেন,
ঈসা (আঃ) কে শত্রুদের ক্রোশে বিদ্ধ হওয়ার মুখোমুখি করেছিলেন।
সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা নিয়েছেন আমাদের নবী (সাঃ) এর উপর। ৬৩ বছরের জীবনে পদে পদে তিনি পরীক্ষা দিয়ে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন। এমন কি সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে যুগে যুগে যারাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়েছেন তারাই আল্লাহর কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আর আল্লাহ ও কোরআনুল কারীমে বলেছেন,
. ‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।’
তিরমিযী (২৪০২) শরীফের এক হাদিসেও দেখতে পাই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
. ‘দুনিয়ায় যারা বিপদ-আপদে নিপতিত হয়েছে তাদেরকে যখন কিয়ামতের দিন বিনিময় প্রদান করা হবে তখন বিপদ-আপদ মুক্ত ব্যক্তিরা আশা করবে, দুনিয়ায় যদি তাদের চামড়া কাচি দিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেলা হত।’
দুনিয়ার জীবনে দুঃখ-কষ্ট থাকবেই।আল্লাহ চান পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনে সামান্য দুঃখ-কষ্টের বিনিময়ে মুমিন বান্দারা অনন্তকালের জন্যে জান্নাতে প্রবেশ করুক। এজন্য দুঃখ-কষ্ট কে আল্লাহর পরীক্ষা মনে করতে হবে।
– জান্নাত! তুমি না থাকলে যে আমার কি হত! তোমার কারনেই আজ আমার এত পরিবর্তন।
– কি আর হত! আল্লাহ হয়ত অন্য কাউকে দিয়ে এই কাজ টা করিয়ে নিতেন যেহেতু তোমার জন্য হেদায়াত নির্ধারিত ছিল আর আমি তোমার মত দুষ্ট একটা বান্ধবী কে হারাতাম। ক্ষতি কিন্তু আমারই হত!
……. সূচনা বেশ শব্দ করেই হেসে উঠল। বহুদিন এমন প্রাণখোলা হাসি আসেনি সূচনার। মনে মনে বলল, সোহেল তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার চলে যাওয়ায় আমি ঠকিনি বরং জিতে গেছি আমিই। মাফ করে দিলাম তোমাকে।
আজ নিজেকে খুব সুখি মানুষ মনে হচ্ছে সূচনার। সেই সুখ! যার খোঁজে কত ভুল পথের অলিতে-গলিতে হেঁটে বেড়িয়েছে সে। আজ পেয়েছে সে সেই কাঙ্ক্ষিত এক টুকরো সুখ। আলহামদুলিল্লাহ!

লিখেছেন→ (MarJaana IsRaa)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button