সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

বড় দিন

শুভ বড় দিন মানে ঈসা মসীহের শুভ জন্মদিন। ঈসা মসীহের জন্ম এইভাবে হয়েছিল। ইউসুফের সঙ্গে ঈসার মা মারিয়ামের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তারা একসঙ্গে বসবাস করবার আগেই পাক রূহের শক্তিতে মারিয়াম গর্ভবর্তী হয়েছিলেন। মারিয়ামের স্বামী সৎ লোক ছিলেন… (মথি ১/১৮-২৫)। আল্লাহ মানুষকে এত মহববত করলেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে তিনি দান করলেন। যেন যে কেউ সেই পুত্রের উপর ঈমান আনে, সে বিনষ্ট না হয়। কিন্তু অনন্ত জীবন পায়’ (ইউহোন্না ৩/১৬)।

উপরের বক্তব্যগুলি খ্রিষ্টানদের ঢাকা কেন্দ্র (বিবিএস) থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তির অংশ বিশেষ। পুরা বিজ্ঞপ্তিটি বিভিন্ন অসঙ্গতি ও কল্পকথায় ভরা। লক্ষণীয় যে, তারা এখন ‘যীশুখ্রিষ্ট’ বলছে না। বরং মুসলমানদের কাছাকাছি হবার জন্য ‘ঈসা মসীহ’ বলছে। তাদের ব্যাপক প্রচারের ফলে বাংলাদেশে বহু হিন্দু-মুসলমান ও উপজাতীয়রা খ্রিষ্টান হয়ে যাচ্ছে। এখন সারা দেশকে তারা ৭টি ধর্মপ্রদেশে ভাগ করে প্রতি প্রদেশে একজন বিশপ হিসাবে মোট ৮জন বিশপ নিয়ে সুসংগঠিতভাবে কাজ চালাচ্ছে। প্রদেশগুলি হল : ঢাকা (১৮৮৬), দিনাজপুর (১৯২৭), খুলনা (১৯৫২), চট্টগ্রাম (১৯৭২), ময়মনসিংহ (১৯৮৭), রাজশাহী (১৯৯০), সিলেট (২০১১)। আগে যেখানে আমেরিকা-ইংল্যান্ড থেকে বিশপ আনা হ’ত, এখন সেখানে সব বিশপই বাংলাদেশী। তারা দেশে বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে এবং বিশেষ করে মানুষের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ও পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করছে ও এদেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করছে। পরাশক্তির সমর্থন আছে বিধায় সরকারও সর্বদা এদের ব্যাপারে দুর্বল। এদের উৎসবগুলিতে সরকারের মন্ত্রীদের অতি উৎসাহ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এবারের বড়দিনে একজন সদ্যনিযুক্ত মুসলমান মন্ত্রী বলেই ফেলেছেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। কি চমৎকার ধর্মনিরপেক্ষতা! অথচ সকলে ভালভাবেই জানেন যে, ইহুদী-খ্রিষ্টানরা যেদেশেই প্রভাব বিস্তার করেছে, সে দেশই পরাশক্তির করতলগত হয়েছে। যার বাস্তব উদাহরণ বৃটিশ-ভারত উপমহাদেশ এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন পূর্ব তিমুর ও সূদান থেকে বিচ্ছিন্ন দক্ষিণ সূদান। ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘খ্রিষ্টরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার পায়তারা চলছে বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ। এরা এক সময় বণিকের বেশে এসে সিরাজুদ্দেীলাকে হত্যা করে বাংলার রাজদন্ড হাতে নিয়েছিল। আজ তারা ধর্মের মুখোশ পরে এসেছে। তাই সরকার যদি সাবধান না হয়, তাহ’লে খাল কেটে কুমীর ডেকে আনা হবে। অতএব এদের থেকে সাবধান!

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের বিজ্ঞপ্তিতে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেটাই কি সত্য, না কুরআনের বাণী সত্য? যদি কুরআনের বাণী সত্য হয়, তাহ’লে যেসব মুসলিম মালিকানাধীন পত্রিকা ও মিডিয়া টাকার লোভে এদের মিথ্যা বিজ্ঞপ্তি সমূহ প্রচার করছে, তারা কি আল্লাহর কাছে দায়ী হবে না? যেসব নেতা এদের অনুষ্ঠানে যোগদানে উৎসাহবোধ করেন এবং সকল ধর্মকে সমান গণ্য করেন, তারা সম্ভবতঃ ইসলাম ও অন্যধর্ম কোন সম্পর্কেই জ্ঞান রাখেন না। আমরা এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে সকলের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিতে চাই যে, কুরআন আগমনের পর পৃথিবীতে বিগত সকল ইলাহী গ্রন্থের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তওরাত, যবূর, ইনজীল বলে যা কিছু চালানো হচ্ছে, সবকিছুই বাতিল ও বিকৃত। ‘ইহুদী-নাছারা ধর্মনেতারা নিজেরা এগুলো মনমত লিখে আল্লাহর কেতাব বলে চালিয়ে দিয়েছে দু’পয়সা রোজগারের আশায়’(বাক্বারাহ ৭৯)। পক্ষান্তরে কুরআনের হেফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন (হিজর ৯)। তাই তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে। এখন পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য একমাত্র অনুসরণীয় ইলাহী কিতাব হ’ল আল-কুরআন। ‘যা মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক, সুপথের ব্যাখ্যাতা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ১৮৫)। আর একমাত্র নবী হ’লেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যার আগমন বার্তা বিগত সকল নবীসহ হযরত ঈসা (আঃ) নিজেই দিয়ে গেছেন (ছফ ৬)। সকল নবী ছিলেন গোত্রীয় নবী। কিন্তু শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন বিশ্বনবী। তিনি সৃষ্টিজগতের নবী, জিন ও ইনসানের নবী এবং তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না’ (সাবা ২৮; মিশকাত হা/৫৭৪৫, ৪৭, ৪৮, ৭৩)। এখন যদি মূসা (আঃ) বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তাঁকেও ইসলামের অনুসরণ ব্যতীত উপায় থাকতো না (মিশকাত হা/১৭৭)। ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে যখন ঈসা (আঃ) অবতরণ করবেন, তখন তিনি ইমাম মাহদীর পিছনে ছালাত আদায় করবেন এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন কায়েম করবেন (মিশকাত হা/৫৪৭৫, ৫৫০৬-০৭)। ইহুদী শত্রুদের ও শাসকদের  হত্যা চক্রান্ত থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ তাঁকে জীবিতাবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান ৫৫)। ‘তার অনুসারীদের পাপের বোঝার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তিনি শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন’ বলে খ্রিষ্টানরা যে প্রচার করে থাকে, তা স্রেফ প্রতারণা বৈ কিছু নয়। এজন্যেই কি তাহ’লে খ্রিষ্টান পরাশক্তিগুলো সারা বিশ্বে সশস্ত্র সন্ত্রাস চালিয়ে লাখ লাখ বনু আদমকে হত্যা করছে ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির মাধ্যমে বিশ্বকে ভ্যামপায়ারের মত শোষণ করে চলেছে? নিজেরা পাপ করে তার বোঝা নির্দোষ ঈসা (আঃ)-এর উপরে চাপিয়ে দেবার এই ধর্মীয় দাবী কি স্রেফ অপবাদ ও ভন্ডামি নয়? আল্লাহ বলেন, ‘তারা তাকে হত্যাও করেনি, শূলেও দেয়নি, বরং তাদের জন্য ধাঁধাঁ সৃষ্টি করা হয়েছিল মাত্র। এ বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই। তারা কেবলই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি’। ‘বরং আল্লাহ তাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ১৫৭-৫৮)।

খ্রিষ্টানদের প্রচারপত্রে মারিয়ামের যে স্বামীর কথা বলা হয়েছে, তা ডাহা মিথ্যা। কেননা কুরআনে ও হাদীছে সর্বত্র ঈসাকে ‘মারিয়ামপুত্র’ বলা হয়েছে। স্বামী থাকলে ঈসাকে তাঁর পিতার দিকেই সম্বন্ধ করা হ’ত। আল্লাহ বলেন, ঈসার দৃষ্টান্ত হ’ল আদমের মত’… (আলে ইমরান ৫৯)। আদমকে যেমন আল্লাহ পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়াই কেবল মায়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন (ঈসার জন্ম ইতিহাস জানার জন্য সূরা মারিয়াম ১৬-৩৬ আয়াতগুলি পাঠ করুন)।

প্রচারপত্রে ঈসা (আঃ)-কে ‘ইবনুল্লাহ’ (আল্লাহর বেটা) বলা হয়েছে। একথা তারা আগেও বলত (তওবাহ ৩০)। এমনকি ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানরা তাঁকে সরাসরি আল্লাহ সাব্যস্ত করে বলেছে, ‘তিনি তিন আল্লাহর একজন’ (মায়েদাহ ৭৩)। তারা এটাকে ‘বুদ্ধি বহির্ভূত সত্য’ বলেছে। অথচ এরূপ ধারণা পোষণ কারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ বলেছেন এবং এদের জন্য জান্নাত হারাম করেছেন’ (মায়েদাহ ৭২-৭৩)। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন। তিনি মহাপবিত্র। যখন তিনি কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! সাথে সাথে হয়ে যায়’ (মারিয়াম ৩৫)।

বর্তমান পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম (আলে ইমরান ১৯)। ‘ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন আল্লাহ কখনোই কবুল করবেন না এবং কেউ তা তালাশ করলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (আলে ইমরান ৮৫)। এই দ্বীন ‘স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন’ (মিশকাত হা/১৭৭)। ‘এই দ্বীন সত্য ও ন্যায় দ্বারা পরিপূর্ণ। এর বিধানসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই’ (আন‘আম ১১৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত তার কসম করে বলছি, ইহুদী হৌক বা নাছারা হৌক পৃথিবীর যে কেউ আমার আবির্ভাবের খবর শুনেছে, অথচ আমি যা নিয়ে আগমন করেছি তার উপর ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি জাহান্নামী হবে’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১০)। ছালাতের প্রতি রাক‘আতে সূরা ফাতিহার শেষে অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট বলতে ইহুদী ও নাছারাদের বুঝানো হয়েছে, যাদের পথে না চলার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয় (তিরমিযী হা/২৯৫৪)। অথচ আমরা তাদের পথেই চলছি। তাদের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদের ছেড়ে কাফিরদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করে তাদের অনিষ্টের আশংকা থেকে আত্মরক্ষা ব্যতীত। যে ব্যক্তি এরূপ করে আল্লাহর সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই (আলে ইমরান ২৮)।

২৫ ডিসেম্বরকে ঈসা (আঃ)-এর জন্মদিবস হিসাবে পালন করার পিছনে কোন প্রমাণ নেই, কেবল ধারণা ও কল্পনা ব্যতীত। কেননা কুরআনের বর্ণনায় বুঝা যায় যে, ওটা ছিল খেজুর পাকার মৌসুম। সেখানে মারিয়ামকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দিতে বলা হয়েছে, যাতে সুপক্ক খেজুর নীচে পতিত হয় (মারিয়াম ২৫)। আর খেজুর পাকে গ্রীষ্মকালে,  ডিসেম্বরের শীতকালে নয়।

পরিশেষে বলব, ইহুদীরা হ’ল ঈসা (আঃ)-এর জাতশত্রু এবং খৃষ্টানরা তাঁর কপট অনুসারী। ঈমানদার ঈসায়ীগণ শুরুতেই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং আজও ঈমানদার ইহুদী ও নাছারাগণ ইসলাম কবুল করে ধন্য হবেন। এর মাধ্যমে তারা দ্বিগুণ নেকীর অধিকারী হবেন’ (ক্বাছাছ ৫২-৫৪)। খাঁটি মুসলমানেরাই ঈসা (আঃ)-এর প্রচারিত তাওহীদের প্রকৃত অনুসারী। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র নবী এবং ইসলাম আল্লাহ মনোনীত একমাত্র ধর্ম। তাই সকল অমুসলিমকে আমরা ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির স্বার্থে দ্রুত ‘মুসলিম’ হওয়ার আহবান জানাই। ইসলাম ও কুফর কখনোই এক নয়। তাই কোন মুসলিম মুরতাদ হলে অর্থাৎ ইসলাম ত্যাগ করলে এবং তওবা করে ফিরে না এলে তার একমাত্র শাস্তি হ’ল মৃত্যুদন্ড (বুখারী, মিশকাত হা/৩৫৩৩)। পক্ষান্তরে কুফর ও শিরক পরিত্যাগ করে ইসলাম কবুল করলে তার নেকী হ’ল দ্বিগুণ। অতএব সরকারের উচিৎ কুফরকে উৎসাহিত না করা এবং অমুসলিমরা যাতে ইসলাম কবুল করে পরকালে মুক্তি লাভের পথ খুঁজে পায়, সেজন্য সর্বতোভাবে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা ও সহযোগিতা করা। দ্বীনদার ধনিক শ্রেণীর প্রতিও আমরা একই আহবান জানাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button