ছোটগল্প/উপন্যাস

প্রশান্তি

সকালে নাস্তার টেবিল পরিস্কার করতে করতে হঠাৎ সমাধানটা মাথার ভেতর বিদ্যুতের মত খেলে গেল নূরের মায়ের। নাবাকে বিয়ে দেয়ার পর থেকে ঘরটা খা খা করছে। নূর ওদের ভালোই দেখা শোনা করে। কিন্তু ছেলেটা এমনিতেই চাপা স্বভাবের, তার ওপর ছেলেদের যত্ন করার ধরনটাই হোল সোজাসাপ্টা, তা না যায় দেখা না যায় ছোঁয়া। মেয়েরা যেমন সারাঘরে ঘুর ঘুর করে ঘরটাকে মাতিয়ে রাখে তেমন কি আর ছেলেদের দিয়ে হয়? সুতরাং, তাঁর একটা মেয়ে লাগবে। বুড়ো বয়সে সন্তান হলে তার আদর হয় আলাদা। তেমনই একটা সন্তান আনবেন তিনি, নূরকে বিয়ে করিয়ে। নূরের বয়স ক’দিন পরই ছাব্বিশ হবে, মাস্টার্স শেষ হোল মাস দুই আগে, চাকরী নেই তো কি যেকোন সময় হয়ে যাবে, টিউশনী তো আছেই। তাছাড়া তিনজনের জন্য রান্না করলে চারজন অনায়াসে খেতে পারে। একটা বাড়তি মুখ কোন ব্যাপার?

যেমন ভাবা তেমন কাজ। ফোন ঘুরালেন মেয়ের বাসায়। ছোট মেয়েটা কেবল তাঁর সন্তানই নয়, বান্ধবী এবং পরামর্শদাত্রীও। নিজের ছেলের ভারিক্কিপনায় যখন তিনি ভড়কে যান তখন নূরের সাথে সেতুবন্ধন হিসেবেও নাবা চমৎকার। মনে মনে তিনি যখন মেয়ে ঠিক করে, নাবাকে দিয়ে নূরকে রাজী করিয়ে, বিয়ের আসরে ছলছল নয়নে নিজের হাতের চুড়ি খুলে বৌকে পরিয়ে দিচ্ছেন তখন নাবা ফোন তুলল, ‘আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছ?’
‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি মা। তুই কেমন আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ’।
‘আজ বিকালে ফ্রি আছিস?’
‘হুমম। তোমাকে বলেছিলাম না, তোমার জামাইকে যেকোন সময় চট্টগ্রাম যেতে হতে পারে? ও গত রাতে চট্টগ্রাম চলে গিয়েছে। আমারও আজ ক্লাস নেই। আমি ভাবছিলাম এদিকে গুছিয়ে বিকালে চলে আসব। রাতে থাকব তোমাদের সাথে’।
‘তাহলে তো ভালোই হয়। তুই বরং আরেকটু আগে চলে যায়। দুপুরে খাবি বাসায়’।
‘উমম, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কি বলতে ফোন করেছিলে বললে না তো!’
‘তুই বাসায় এলে তখনই বলব নাহয়’।

দুপুরে খেতে বসে নূরের মা সতর্ক দৃষ্টি রাখেন নূরের বাবার প্লেটের দিকে। একবার গরুর মাংস দিয়ে ভাত শেষ করে আবার মাংসের বাটিটার দিকে হাত বাড়াতেই হুংকার ছাড়েন তিনি, ‘আবার মাংস নিচ্ছো তুমি? তোমাকে না ডাক্তার মাংস খাওয়া কমাতে বলেছে?’
মুখ কাঁচুমাচু করে বাটিটা মেয়ের দিকে ঠেলে দেন তিনি, ‘আমি তো আমার মেয়েকে বেড়ে দিতে যাচ্ছিলাম। মেয়েটা এতক্ষণ কেবল মাছের কাঁটাই বাছল। এখন না দিলে মেয়েটা মাংস না খেয়েই উঠে যাবে। নে মা, তুই নিজে নিয়ে নে, আমার তো বাটিতে হাত লাগানোও বারণ!’
নাবা কিছু না বলে দু’টুকরো মাংস পাতে তুলে নিয়ে দু’টুকরো বাবাকে তুলে দেয়, মায়ের শ্যেণদৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে, ‘একবেলা দু’টুকরো বেশী খেলে কিচ্ছু হবেনা। রাতে নাহয় মাংস বাদ দিয়ে খেয়ো’।
মেয়ের কাছে স্ত্রীকে পরাস্ত হতে দেখে নূরের বাবা সাহস করে সন্তর্পণে বাটিতে হাত না লাগিয়ে শুধু চামচ দিয়ে ছেলেকেও দু’টুকরো মাংস তুলে দেন। নূরের মা আর কিছু বলেন না।
খাওয়া শেষে নিজের সিদ্ধান্তের কথাটা পাড়লেন তিনি। নূরের ফর্সা গাল দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। হাত ধোয়ার উসিলা দিয়ে সে টেবিল থেকে উঠে গেল। নূরের বাবা ছেলের লজ্জা দেখে পানির গ্লাস মুখে হাসতে গিয়ে বিষম খেলেন, নূরের মা উঠে তাঁর পিঠে মালিশ করতে লাগলেন, এর মধ্যে তিনি কাশতে কাশতেই বললেন, ‘যাক, সে আপত্তি করেনি মানে রাজী আছে। দেখ দেখ, আমার ছেলের জন্য আমার বৌয়ের মত একটা লক্ষ্মী বৌ দেখ’।
নূরের মা লজ্জা পেয়ে গজগজ করতে থাকেন, ‘ধ্যাত, বুড়ো বয়সে ছেলেমেয়ের সামনে …’
নাবা বলে, ‘বাবা, আমি তো ভেবে এসেছিলাম আমি ভাইয়াকে বিয়ে দেয়ার কথা বলব। ভাল হোল, মা’ই কথাটা তুলল। আমার মাথায় একটা চমৎকার মেয়ে আছে। আমি জানি তোমরা দু’জনই তাকে ভীষণ পছন্দ কর’।
নূরের মা উৎসুক হয়ে বলেন, ‘কার কথা বলছিস?’
‘এখন বলব না মা, আমি জানি তোমরা দু’জনই রাজী হবে। কিন্তু ভাইয়া রাজী হবে কি’না …। দেখি, ভাইয়ার সাথে কথা বলে, তারপর তোমাদের বলব’।
‘সে কি বলবে? ওর কি বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার মত বয়স হয়েছে নাকি?’
নূরের বাবা অবাক হয়ে বলেন, ‘কি যে বল না তুমি! আমার ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে আর সিদ্ধান্ত নেয়ার বয়স হয়নি? যে সংসার করবে তার পছন্দ হতে হবে তো!’
মাকে ইতস্তত করতে দেখে নাবা আশ্বস্ত করে, ‘মা, বললাম তো। মেয়েকে তোমরা দু’জনই চেন এবং পছন্দ কর। কিন্তু আমি ভাইয়ার ব্যাপারে বুঝতে পারছিনা, ভাইয়া রাজী হবে কি’না। আমি ওর সাথে আলাপ করেই তোমাদের মেয়ের নাম জানাব। নামেই পরিচয়। বাকী আর কিছুই জানাবার দরকার হবেনা’।
বিকালে নাবা ভাইয়ের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ভাইবোন কি আলাপ করে শোনার জন্য দরজার বাইরে আড়ি পাততে গিয়ে নূরের মা দেখেন ভাইবোন ঝলমলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বেরিয়ে আসছে। এত সংক্ষিপ্ত আলাপ! যাক, বোঝাই যাচ্ছে প্রস্তাবটা ছেলের পছন্দ হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকান। সে লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে ডয়িংরুমের সোফায় বসে পড়ে। তিনি গিয়ে সামনাসামনি সোফাটায় পা তুলে আয়েশ করে বসেন। মেয়ের দিকে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তো?’

নাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে বলে, ‘ভাইয়া রাজী!’
‘আলহামদুলিল্লাহ! তা মেয়েটা কে?’
নাবা বলে, ‘দাঁড়াও, আগে বাবাকে ডাকি’।
‘সে তো খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছে। তাঁকে উঠলে বলিস। কিন্তু আমি জানতে চাই, হু ইজ দিস মিস্ট্রি গার্ল?’
মেয়ের ওপর তাঁর অগাধ আস্থা। বয়সে ছোট হলেও মেয়ের বিবেচনায় তিনি আজ অবধি কোন ত্রুটি দেখেননি। কিন্তু কাকে পছন্দ করা হোল সেটা জানার জন্য স্বামী জেগে ওঠা পর্যন্ত কৌতুহল চেপে রেখে ধৈর্য্য ধরে থাকা তাঁর ধাতে কুলোবে না।

ভাইবোন পরস্পরের দিকে তাকায়, নূরের গন্ডযুগল আবার রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।
নাবা বিজয়ীর হাসি হেসে শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করে, ‘আফরিন’।

নূরের মায়ের চেহারা হঠাৎ দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, ‘কোন আফরিন?’
ভাইবোন ‘আল্লাহু আকবার!’এর জন্য প্রস্তুত ছিলো, হাততালির জন্য প্রস্তুত ছিলো, হাসিমুখে মায়ের বাহুবন্ধনে পিষ্ট হবার জন্য প্রস্তুত ছিলো, মুচকি হাসির জন্য প্রস্তুত ছিলো, কিঞ্চিত ইতস্তত ভাবের জন্যও প্রস্তুত ছিলো, কিন্তু এর জন্য প্রস্তুত ছিলোনা মোটেই।
নাবা সামান্য ইতস্তত করে জবাব দেয়, ‘বড়ফুপুর আফরিন’।
নূরের মা গলা চড়িয়ে বলেন, ‘কোন আফরিন?’
নূর মায়ের ভাব বুঝতে পারে, খুব স্বাভাবিকভাবে বলে, ‘রাশেদ ভাইয়ার বিধবা, আফরিন ভাবী’।
নূরের মা রাগের মাথায় সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গলা সপ্তমে চড়িয়ে অষ্টম মেজাজে বলেন, ‘আমার ছেলে জীবনে প্রথমবার বিয়ে করবে একটা বিয়ে করা মেয়েকে?!’
ভাইবোন দু’জনই মায়ের রণমূর্তি দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু নাবা দমে যাবার পাত্রী নয়। সে মাকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দেয়, তারপর তাঁর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলে, ‘মা, ছোটবেলা থেকে তুমি সবসময় আমাদের আফরিনের উদাহরণ দিয়ে এসেছ, ‘তোমরা ওর মত হবার চেষ্টা কর’। বড়ফুপু যখন রাশেদ ভাইয়ার সঙ্গে আফরিনের বিয়ে দিলেন তখন তুমি ফুপুর ভূয়সী প্রশংসা করলে, বললে, ‘তিনি একজন মহীয়সী রমণী। তিনি কেবল একটা এতিম মেয়েকে পেলেপুষে বড়ই করেননি, বরং নিজের ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছেন’। বিয়ের তিনমাস পর যখন রাশেদ ভাইয়া মটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেল, তখন তুমি বললে, ‘ওর কষ্ট আমি বুঝি। একটা মেয়ে যখন অবিবাহিত থাকে তখন সে একাকীত্ব কি বোঝেনা। কিন্তু একবার সংসার করার পর যখন একটা মেয়ে আবার একা হয়ে পড়ে তখনকার একাকীত্ব সে কাউকে বোঝাতে পারেনা’। তার ওপর সে আছে বড়ফুপুর বাসায়, চারপাশে যেদিকেই তাকায় সবখানেই কেবল রাশেদ ভাইয়ার স্মৃতি, ও বেচারী তো দুঃখ ভোলারও সুযোগ পাচ্ছেনা! তুমি একবার ওকে এই বাসায় এনে রাখতে চাইলে কিছুদিন, কিন্তু বাসায় ভাইয়া আছে দেখে সে এলোনা। ভাবো তো, গত সাতটা মাস কি নিদারুণ যন্ত্রনায় দিন কাটছে ওর! আমি ভেবেছিলাম, ভাইয়ার হয়ত কোন শখ আহ্লাদ থাকতে পারে। ও রাজী না হতে পারে। কিন্তু তোমার এই প্রতিক্রিয়া আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা’।

মেয়ের কথায় নিজের আচরনে নিজেই লজ্জা পেলেন নূরের মা। নিজেকে সামাল দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, সে নাহয় হাতে থাকুক। আমরা আরো কয়েকটা মেয়ে দেখি। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে’।
নূর বলল, ‘মা, তোমার মেয়ে দেখার ক্রাইটিরিয়া কি?’
‘ক্রাইটিরিয়া আবার কি? মেয়েটা যেন ভাল বংশের হয়, দ্বীনদার হয়, ভদ্র এবং মিশুক হয়, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী হয়, আর দেখতে শুনতে মোটামুটি ভাল হয়। এই তো’।
‘আচ্ছা, আফরিনকে এর কোন ক্রাইটিরিয়ায় বাদ দেয়া যায়?’
‘উফফ’, রাগে নিজের অজান্তেই হাঁটুর কাছে বসে থাকা নাবাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ান তিনি, ‘ওর তো আগে একবার বিয়ে হয়েছে!’
নূর খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘মা, উত্তেজিত হয়োনা। বোস, শোন আমার কথা। তুমিই আমাদের ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছ সাম্যের কথা, ন্যায়ের কথা, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চিন্তা মাথায় নিয়ে প্রতিটি কাজ করার কথা। আজ যখন আমরা তোমার শিক্ষাকে কর্মে প্রতিফলিত করতে চাইছি, তুমি আমাদের উৎসাহ দেয়ার পরিবর্তে বিব্রত হচ্ছ। বলছ একটা মেয়ের একবার বিয়ে হয়েছে, সে বিধবা হয়েছে, তাই সে জীবনে দ্বিতীয়বার সুখী হবার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে! মেয়ে তো চাইলে হাজারটা দেখা যায় মা, দেখতে অসুবিধা কি? কিন্তু আমাদের হাতের কাছেই যখন এমন একটা মেয়ে রয়েছে যাকে আমরা ছোটবেলা থেকেই আদর্শ মেয়ে হিসেবে জেনে এসেছি, যে পরিপূর্ণভাবে আমাদের পরিবারের সাথে খাপ খায়, যার একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন, তখন আমরা তাকে বাদ দিয়ে বাইরে মেয়ে দেখার যৌক্তিকতা কি?’
নূরের মা ধপাস করে সোফায় বসে পড়েন, ‘মেয়েটাকে আমি আন্তরিকভাবেই ভালোবাসি। খুবই ভালোবাসি। কিন্তু একটা অবিবাহিত ছেলের জন্য একটা বিধবা মেয়ে … লোকে কি বলবে?’
নাবা মায়ের পাশে সোফার হাতলে উঠে বসে, মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘বুঝলাম। এই হোল আসল কথা। মা, আমাদের জন্মদাতা লোকটা যখন একদিন তোমাকে ভাইয়াকে আমাকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, লোকে অনেক কথা বলেছে। বল তো, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়জন? কেউ না। ওরা কেবল তোমার দুঃখের বোঝাই বাড়িয়েছিল, আর কোন কাজে আসেনি। আবার যখন বাবা অবিবাহিত যুবক হয়ে দু’টো সন্তানসহ তোমাকে বিয়ে করল তখনো লোকে অনেক কিছু বলাবলি করেছিল। ওদের কথা শুনে বাবা যদি পিছিয়ে যেতেন তাহলে আজ আমরা কোথায় থাকতাম, বল তো? আমার বিয়ের সময়ও তো কতজনে টিপ্পনী কাটলো, ‘পরের মেয়ের বিয়েতে কি ধুমধাম করছে লোকটা দেখ! পাগল কি আর গাছেবাঁশে ধরে?’ কিন্তু তাই বলে কি বাবা আমার জন্য করা থেকে বিরত থেকেছেন? লোকে যদি ভাল কথা বলতে না পারে, ভাল কিছু করতে না পারে, এমনকি কারো ভাল সহ্য করতে না পারে তবে সেটা তাদের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু আমরা যদি তাদের কথা শুনে নিজেদের বিবেকের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেই তাহলে সেটা আমাদের পরাজয়। কে কি বলল তাতে এত পাত্তা দেয়ার দরকার কি মা? বড়ফুপুকে দেখ। তিনি কাউকে উপদেশ দিতে যাননা, কারো উপদেশ নিতেও যাননা, নিজের মত ভাল কাজ করে যান। আমাদেরও কি মানুষের গলার আওয়াজের ওপর নিজেদের বিবেকের আওয়াজকে প্রাধান্য দেয়া উচিত নয়?’

মায়ের চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠে। নূর ধীরে এগিয়ে এসে নাবার হাতটা আলতো করে ধরে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। একটা সংসারে কিছু কথা অনুচ্চারিত থেকে যায়, থেকে যাওয়াই ভাল, ছোটগুলো বড়গুলোর চেয়ে বুদ্ধিমান হলেও অনেক সময় এই সহজ ব্যাপারগুলো বুঝতে পারেনা।
কিছুক্ষণ পর নূরের মা সোফা থেকে উঠে ধীরপায়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। রুমে ঢুকে দেখেন স্বামী তখন আড়মোড়া ভাঙ্গছেন। তাঁকে দেখেই নূরের বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘কি সৌভাগ্য আমার! ঘুম ভেঙ্গেই তোমার মুখচন্দ্রখানি দর্শন করিলাম! প্লিজ এই মুডটা নষ্ট কোরোনা। আমি এক্ষুণি উঠে আসর নামাজ পড়ছি। কিছুক্ষণ আমার প্রিয়ার মুখখানি দর্শন করতে দাও’।
অন্যসময় হলে নূরের মা স্বামীর আদিখ্যেতা দেখে গজগজ করতেন। কিন্তু এতদিন পর তাঁর মাথায় উদয় হোল, এইসব হাস্যরসিকতার কারণেই তাঁর বিগত বিশ বছরের সংসার জীবন হাসিখেলায় কেটে গিয়েছে, তিনি কোনদিন একটি মূহূর্তের জন্যও ভারাক্রান্ত হবার, এক ফোঁটা অশ্রু ঝরাবার সুযোগ পাননি। এই লোকটা বিয়ের দিন থেকে আজ অবধি এমনই হাসিখুশি উচ্ছ্বলতায় ভরিয়ে রেখেছেন তাঁর জীবন। অভিযোগ করার, অসন্তুষ্ট হবার কোন সুযোগ কি তিনি স্বামীকে দেননি? হাজারবার ঘটেছে এমন ঘটনা, কিন্তু তিনি সেগুলোকে কখনো উসিলা বানাননি। আসলে অভ্যস্ততা অনেক সময় মানুষকে অন্ধ এবং অনুদার বানিয়ে ফেলে। হৃদয় আপ্লুত হয়ে মন বিগলিত হয়ে যায় নূরের মায়ের, ‘শোন!’
‘আমি উৎকর্ণ হয়ে আছি হে প্রিয়া’
‘এখন থেকে আমি তোমাকে বকাবকি করলে তুমি আমাকে উল্টো বকে দেবে, কেমন?’
নূরের বাবা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কে তুমি? তুমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে কি করেছ?’
তারপর হাসতে হাসতে বলেন, ‘কেন গো প্রিয়া, তোমার বকাঝকা তো আমার কাছে অমৃতের মত লাগে!’

উফফ, এই লোকটাকে নিয়ে যে কি করবে নূরের মা! কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে তাঁর, একটা মানুষ এত সুখী হয় কি করে? যে মানুষটাকে আল্লাহ এত সুখ দিয়েছেন, সে অপরকে সুখী করতে কার্পণ্য করে কি করে? তাঁর সন্তানরা কত সুন্দর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথচ তিনি মা হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন না দিয়ে কিভাবে এমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলেন? নাহ, তিনি আজই তাঁর ননদের সাথে কথা বলবেন। এই ননদটি নিজের ননদের মেয়ে আফরিনকে নিজের সন্তানের মত করে বড় করেছেন, কোনদিন বাবামায়ের অভাব বুঝতে দেননি, কিন্তু আজ আফরিন এমন এক দুঃখে ভারাক্রান্ত যা তিনি চাইলেও মুছে দিতে পারছেন না। আফরিনকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসতে চান নূরের মা। ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ আগে নিজের সংকীর্ণতায় আক্ষেপস্বরূপ তাঁর দু’চোখ থেকে নিজের অজান্তে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে।
তাঁর চোখে অশ্রু দেখে ভড়কে যান নূরের বাবা, ‘ওমা! আমার সুন্দরী বৌটার কি হোল গো?
কে মেরেছে, কে বকেছে, কে দিয়েছে গাল?
আমায় বল লক্ষ্মীসোনা, মারব ছুঁড়ে তাল’।
স্বামীর অন্তমিলে হেসে ফেলেন নূরের মা।
নূরের বাবা বোকাসোকা হাসি হেসে বলেন, ‘কি করব বল? ছন্দ মিলাতে গিয়ে অর্থ ঠিকমত মিলাতে পারলাম না’।
‘কে বলেছে মেলেনি? চমৎকার মিলেছে! মেসেজটাও ক্লিয়ার। নো চিন্তা। তোমার তালের পিঠা রেডি। টেবিলে এসো, গরম গরম পরিবেশন করা হবে। ওদিকে তোমার ছেলেমেয়ে তোমাকে খুশখবর শোনানোর জন্য অস্থির হয়ে পায়চারী করছে’।
‘ওহ, নূর তাহলে আফরিনকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে!’, বলেই নিজের মুখ দু’হাতে চেপে ধরলেন নূরের বাবা।
‘তার মানে?’, হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন নূরের মা, ‘নাবা নূরকে বলার আগে, আমাকে বলার আগে তোমাকে জানিয়ে গিয়েছে!’
একটা চিৎকারের অপেক্ষায় শক্ত করে চোখ বন্ধ করে রাখলেন নূরের বাবা। এর পরিবর্ত শুনলেন নূরের মা বাচ্চাদের মত হাতপা ছুঁড়ে বলছেন, ‘হবেনা, আমি খেলবনা। ছেলে মেয়ে সব তোমার পক্ষে!’

স্ত্রীকে এমন নরম মেজাজে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন নূরের বাবা, আবেগের সাথে তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘ওগো, আমি কিন্তু তোমার পক্ষে!’
নিজেকে সামলানোর জন্য কপট রাগ দেখান নূরের মা, ‘হুমম, তাড়াতাড়ি ডাইনিং রুমে এসো সবাই, তোমাদের আমি দেখাচ্ছি মজা’, বলে এক বুক প্রশান্তি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা দিতে দিতে আনন্দাশ্রু মোছেন তিনি।


-রেহনুমা বিনত আনিস

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button