কুরআনের কথা

কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর অনুমতিতে —আল-বাক্বারাহ ২৪৬-২৫২

মুসলিমদের উপর যখন অমুসলিমরা নির্যাতন করে, তাদের সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়, কর্তৃত্ব দখল করে নেয়, বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়, তখন মুসলিমরা কীভাবে যুদ্ধ করে তাদের অধিকার আদায় করবে, তা আল্লাহ تعالى আল-বাক্বারাহ’তে তালুত এবং দাউদ عليه السلام-এর ঘটনার মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। এই আয়াতগুলো থেকে আমরা জানতে পারি: তারা কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করেছিলেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে একটি মুসলিম সম্প্রদায় হাতে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করতে পারে। মাত্র ছয়টি আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ইতিহাসের সেই অসাধারণ ঘটনার পরিষ্কার বর্ণনা দেবেন, যেই ঘটনা নিয়ে বাইবেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিভ্রান্তিকর বর্ণনা আছে। এই আয়াতগুলো থেকে একজন নেতা অনেক উপলব্ধির বিষয় পাবেন। একই সাথে অনুসারীরাও বিভিন্ন প্রকারের নেতাদের সম্পর্কে সাবধান হতে পারবেন—

 

 

বনি ইসরাইলের ওই গোত্র প্রধানদের কথা ভেবে দেখেছ, যারা তাদের নবীকে বলেছিল, “আমাদের জন্য এক রাজা নির্ধারণ করে দিন, যেন আমরা আল্লাহর تعالى পথে যুদ্ধ করতে পারি।” তিনি বলেন, “যদি এমন হয় যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কিন্তু তারপরেও তোমরা যুদ্ধ করলে না, তখন?” তারা বলল, “কেন আমরা আল্লাহর تعالى পথে যুদ্ধ করবো না, যখন কিনা আমাদের ঘরবাড়ি থেকে আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কয়েকজন বাদে বেশিরভাগই পিঠটান দিলো। আল্লাহ تعالى অন্যায়কারীদের ভালো করে চেনেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৬]

এই আয়াতে বেশ কিছু শেখার ব্যাপার রয়েছে। কখন আল্লাহ تعالى যুদ্ধ করার অধিকার দেন? যখন মুসলিমদের উপর আক্রমণ হয়, তাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল হয়ে যায়, তখন তারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করার জন্য পরিষ্কার প্রমাণ কু’রআনে রয়েছে। এথেকেই দেখা যায়, ক্বিতাল বা যুদ্ধ হচ্ছে মূলত আত্মরক্ষামূলক।

এর আগের আয়াতগুলোতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ক্বিতাল বা যুদ্ধ করার কঠিন আদেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে সাবধান করেছেন, আমরা যেন যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন না করে পালিয়ে না যাই। ঠিক এরপরেই তিনি আমাদেরকে যুদ্ধের একটি ঘটনা বলে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, কখন কোন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করার অনুমতি তিনি দিয়েছেন।

কিছু উগ্রপন্থী নেতা এর আগের আয়াতগুলো, যেমন: “তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা মৃত্যুর ভয়ে হাজারে হাজারে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল? তখন আল্লাহ تعالى তাদেরকে বললেন, “মরো”। তারপরে একদিন তিনি তাদেরকে জীবিত করলেন। আল্লাহ تعالى মানুষের অনেক কল্যাণ করেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কৃতজ্ঞতা দেখায় না। [আল-বাক্বারাহ ২৪৩] আর আল্লাহর تعالى পথে যুদ্ধ (ক্বিতাল) করো। জেনে রেখো, আল্লাহ تعالى সব শুনছেন, সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৪]” —এগুলো বলে মানুষকে আক্রমণাত্মক জিহাদের দোহাই দিয়ে মুসলিমদেরকে দিয়ে অবৈধ হামলা, নিরীহ মানুষ হত্যা ইত্যাদির দিকে উস্কে দেয়। কিন্তু তারা খুব সাবধানে এরপরের আয়াতগুলো এড়িয়ে যায়, কারণ পরের আয়াতে আল্লাহ تعالى পরিষ্কার করে কখন, কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করা বৈধ, সেটা জানিয়ে দিয়েছেন।

আরেকটি শেখার ব্যাপার হলো: মানুষের মধ্যে অনেক নেতা থাকবে, যারা নির্যাতিত মানুষদেরকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য, যুদ্ধ করার জন্য অনেক রক্ত গরম করা বক্তৃতা দেবে। কিন্তু যখনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার পরিস্থিতি হবে, তখন তাদের আসল চেহারা বের হয়ে যাবে। এরা যুদ্ধের আদেশ আসলে নিজেরা পিঠটান দেবে, অথবা সুকৌশলে নিজেরা যুদ্ধে না গিয়ে, অন্যদেরকে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে।

এথেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই, যেসব তথাকথিত নেতারা ‘জিহাদ! জিহাদ!’ করে মুসলিমদেরকে এত ডাকাডাকি করছেন, তারা নিজেরা কেন জিহাদে যাচ্ছেন না? বসে বসে এত বই না লিখে, এত লেকচার না দিয়ে, নিজেরা কেন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন না? যখনই কেউ আমাদেরকে জিহাদে যাওয়ার জন্য বুদ্ধি দেওয়া শুরু করবে, কীভাবে বর্ডার পার হতে হয়, কীভাবে প্লেনে করে গোপনে অমুক দেশে যেতে হয়, কীভাবে হোটেলে হামলা করতে হয়, তাদেরকে আমাদের প্রথম প্রশ্ন করতে হবে, “আমাকে যেই বুদ্ধি দিচ্ছেন, সেটা নিজে করছেন না কেন? গলাবাজি না করে আগে নিজে করে দেখান?”

 

তাদের নবী তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ تعالى তালুত-কে তোমাদের রাজা নির্ধারণ করেছেন।” কিন্তু তারা বলল, “সে কীভাবে আমাদের রাজা হতে পারে, যেখানে রাজত্ব করার অধিকার তার থেকে আমাদের বেশি? তার তো অনেক সম্পত্তিও নেই?” তিনি বললেন, “তোমাদের চেয়ে তাকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত আল্লাহই تعالى নিয়েছেন এবং তাকে তিনি تعالى অনেক জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তি দিয়েছেন।” আল্লাহ تعالى যাকে চান, তাকেই রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ تعالى সবকিছুর ব্যাপারে সব জ্ঞান রাখেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৭]

একজন নবী ঘোষণা দিলেন যে, আল্লাহ تعالى নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন রাজাকে! নবী বেঁচে থাকতেও কোনো এক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব একজন রাজা দিতে পারে। এথেকে দেখা যায়, নবী থাকার সময়ও রাজতন্ত্র বৈধ, এবং রাজার আনুগত্য করতে মানুষ বাধ্য, যতক্ষণ না রাজা মানুষকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করতে বলছে। একজন নবীর মতো সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের ধর্মীয় নেতা রাজত্বের নেতৃত্ব নিজে না নিয়ে যে অন্য কোনো যোগ্য নেতাকে দিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই আয়াত। এই আয়াত থেকে প্রমাণ মেলে যে, ধর্মীয় দিক থেকে একজন অনেক উপরে উঠলেই সে সব কিছুর যোগ্য হয়ে যায় না। একটি দেশের রাজা বা খালিফা হওয়ার যোগ্যতা শুধুই একজন আলেমের থাকবে, তা নয়। বরং অন্য কারো আরও বেশি যোগ্যতা থাকতে পারে।[১৭]

রাজার কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে, সেটাও আল্লাহ تعالى এখানে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অনেক সম্পত্তি থাকাটা রাজা হওয়ার জন্য মোটেও দরকার নেই। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বেশিরভাগ রাজারা ছিলেন বিরাট ধনকুবের। বিপুল পরিমাণের সম্পদ নিয়ে তারা জৌলুশের জীবন পার করে গেছেন। কিন্তু ইসলামে সম্পত্তির সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নেতৃত্বের জন্য দরকার জ্ঞান এবং শক্তি। যদি রাজার জ্ঞান না থেকে শুধুই শক্তি থাকে, তাহলে সেই শক্তি ব্যবহার হবে বিরাট অন্যায় ঘটাতে। আর যদি জ্ঞান থাকে, শক্তি না থাকে, তাহলে শুধু জ্ঞান দিয়ে শত্রুকে পরাজিত করা যাবে না, এবং সে একজন অনুসরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব হবে না।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাসুল عليه السلام। তিনি পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও নিয়মিত প্রচণ্ড গরমে মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজে যুদ্ধ করার মতো সবল ছিলেন। মরুভূমিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এক কথা, আর যুদ্ধের সরঞ্জাম পরে দিনের পর দিন যুদ্ধ করা আরেক কথা। এর জন্য যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্য দেহ থাকা দরকার। অথচ আজকে আমরা হাজ্জ করতে গেলে এয়ারকন্ডিশন্ড হোটেল থেকে বের হয়ে মসজিদ পর্যন্ত গিয়েই হাঁপিয়ে যাই। আমরা অনেকেই রাসুলের عليه السلام খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়ার সুন্নাহ মানি, যেটা একটা ভুয়া সুন্নাহ। মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে, দিনের বেশিরভাগ সময় বসে থেকে ভুঁড়ি বানাই। অথচ রাসুল عليه السلام যে নিয়মিত শারীরিক চর্চা করতেন, নিজেকে শক্ত সামর্থ্য রাখতেন, সেই সুন্নাহ আমরা ভুলে গেছি। যুদ্ধে যাওয়া তো দূরের কথা, মসজিদে দিনে পাঁচবার যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যও আমাদের অনেকের নেই।

 

তাদের নবী তাদেরকে বললেন, “তার নেতৃত্বের প্রমাণ হলো যে, তাদের কাছে তাবুত (সিন্দুক) আসবে, যাতে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রশান্তি, এবং মুসা ও হারুনের অনুসারীদের রেখে যাওয়া কিছু জিনিস। সেটা ফেরেশতারা বয়ে আনবে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে তাদের জন্য এক বিরাট নিদর্শন রয়েছে, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।” [আল-বাক্বারাহ ২৪৮]

এই তাবুত বা সিন্দুক নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। বাইবেলে এনিয়ে অনেক কাহিনী আছে, যেগুলোর শুদ্ধটা যাচাই করা কঠিন। Arc of Covenant নামে পরিচিত অলৌকিক ক্ষমতার এই সিন্দুকের ইতিহাস রক্তাক্ত। বেশ কয়েকবার এটি হাত বদল হয়েছে এবং যে রাজত্ব এটা জয় করেছে, সেই রাজত্ব শান্তি এবং বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছে বলে বাইবেলে অনেক ঘটনা আছে। একারণে এই অলৌকিক সিন্দুকের দখল নিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তবে মুসলিমদের জন্য এই সব ইতিহাস জানার প্রয়োজন নেই। আমাদের শুধু দেখতে হবে, এই আয়াতে আমাদের উপলব্ধি করার কী রয়েছে। কু’রআন মানুষকে গল্প বলে মনোরঞ্জন করার জন্য পাঠানো হয়নি। কু’রআনের প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি শব্দ বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যেন মানুষ নিজেদের সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে।

আমরা এই আয়াত থেকে উপলব্ধি করতে পারি যে, তালুত-কে যখন নবী রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন, তখন তারা তা মেনে নিলো না। একজন নবীর নির্দেশ মানতেও তারা রাজি ছিল না। যতক্ষণ না তাদেরকে এই সিন্দুক অলৌকিকভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এথেকে শেখার হলো, কিছু নেতা থাকবে, যাদেরকে বাইরে থেকে দেখে ধর্মের অনুসারী মনে হবে। কিন্তু যখনই ধর্ম তাদেরকে নিজেদের সম্মান, স্বার্থ বিসর্জন দিতে বলবে, তখনি তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে যাবে। পরিষ্কার প্রমাণ থাকার পরেও তারা সেটা মানতে চাইবে না।

 

তারপর যখন তালুত তার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তখন তিনি বললেন , “আল্লাহ تعالى তোমাদেরকে একটি নদী দিয়ে পরীক্ষা করবেন। যে সেই নদী থেকে পান করবে, সে আর আমার দলের নয়। কিন্তু যে সেটার স্বাদ নেবে না, সে আমার দলের। তবে যে এক আঁজলা পান করবে, তার দোষ হবে না।” কিন্তু কয়েকজন বাদে বাকি সবাই পেট ভরে পানি খেলো। তারপর যখন সে এবং তার সাথের বিশ্বাসীরা পার হলো, তখন তারা বলল, “আমাদের কোনো ক্ষমতাই নেই জালুত এবং তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।” কিন্তু যারা নিশ্চিত ছিল যে তারা আল্লাহর تعالى সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, তারা বলল,“কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর تعالى অনুমতিতে। আল্লাহ تعالى ধৈর্য-নিষ্ঠাবানদের সাথে আছেন।” [আল-বাক্বারাহ ২৪৯]

একজন নেতার জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ হলো তার বাহিনীর ভেতরে নিষ্ঠাবান অনুসারীদের চিহ্নিত করা এবং কারা তাকে প্রয়োজনের সময় অনুসরণ করবে না, সেটা আগেভাগেই বের করে ফেলা। এই মানুষগুলোকে যত আগে সম্ভব বাহিনী থেকে বের করে দিতে হবে। না হলে তারা বাহিনীর সম্পদ নষ্ট করবে, মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দেবে, তারপর দরকারের সময় নিজেরা তো পালাবেই, অন্যের মনোবলও ভেঙ্গে দেবে।

তালুত তার বাহিনীর মধ্যে কে নিষ্ঠাবান, আর কে বিপদে পড়লে পিঠটান দেবে, সেটা বের করার জন্য তাদেরকে এক পরীক্ষা দিলেন। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীকে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এই যাত্রা পথে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী হলো পানি। বাহিনীর ঘোড়া, উট, গরু, হাতি, মানুষ সবার জন্য পানি দরকার। পানি হলো একটি সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই সেনাবাহিনী যখন কোনো নদী বা জলাশয় খুঁজে পায়, তারা যতটুকু পারে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে নেয়।

কিন্তু তালুত তার বাহিনীকে এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষা দিলেন। চোখের সামনে নদী ভর্তি পানি টলটল করছে, কিন্তু তারা সেই পানি পান করতে পারবে না। এবং তারা সেটা করবে না শুধুই তাদের সেনাপতিকে বিশ্বাস করে, তার প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের কাছে মনে হয়েছিল যে, সেটা কোনো যৌক্তিক দাবি নয়। বাস্তবতা দেখতে হবে। এখন যুদ্ধ চলছে। সবাই তৃষ্ণার্ত। পানির এত বড় একটা সুযোগ ছেড়ে দেওয়াটা বিরাট বোকামি। এই সব ভেবে তারা সেনাপতির নির্দেশকে অমান্য করলো। এথেকেই বেড়িয়ে পড়লো তাদের মধ্যে কে সত্যিই সেনাপতির প্রতি পুরোপুরি অনুগত, আর কে নিজের প্রবৃত্তির প্রতি অনুগত। যারা এত বড় লোভ, পিপাসার কষ্ট সামাল দিতে পেরেছিল শুধুই সেনাপতির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে, তারাই ছিল প্রকৃত বিশ্বাসী অনুসারী। তারাই যুদ্ধে এসেছিল সঠিক নিয়ত নিয়ে — আল্লাহর تعالى সন্তুষ্টি অর্জন এবং নেতার প্রতি আনুগত্যের দায়িত্ববোধ থেকে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তালুত বলেছিলেন, “কিন্তু যে সেটার স্বাদ নেবে না, সে আমার দলের।” তিনি বলেননি, যে সেটা ‘পান’ করবে না। তিনি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এক দুই আঁজলা পানি পান পান করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেটা দেখতে চাইছিলেন সেটা হলো, কে আছে যে নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে, তার আদেশ অমান্য করে পেট ভরে পানি খাবে। —এথেকেই তার বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পানি ছুঁয়ে না দেখার অবাস্তব পরীক্ষা দেননি। তার পরীক্ষা ছিল শুধুই মুনাফিক, প্রবৃত্তির দাসদের বাছাই করে ছেঁটে ফেলার পরীক্ষা।

এই পরীক্ষা থেকে তালুত বাছাই করে নিলেন সেই সব নিষ্ঠাবান সৈন্যদেরকে, যারা তার সাথে যুদ্ধ করার যোগ্য। তাদেরকে নিয়ে তিনি নদী পার হয়ে যুদ্ধের ময়দানে গেলেন। সেখানে গিয়ে তাদের অনেকে জালুত  এবং তার বিশাল বাহিনী দেখে আশা হারিয়ে ফেললো। অনেকেই সেখান থেকে পালিয়ে গেল, এইভেবে যে, দুই বাহিনীর মধ্যে লোকবলের এত বিশাল পার্থক্য থাকলে কোনোভাবেই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। এটা বরং আত্মহত্যা। কিন্তু তারপরেও তালুতের সাথে কয়েকজন ইস্পাত দৃঢ় মনোবলের সৈন্য ছিলেন, যারা ঈমানের এই ভয়ঙ্কর কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে তালুতের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেন। এরা এক অসাধারণ কথা বললেন—

“কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর تعالى অনুমতিতে।”

আমরা অনেক সময় সঙ্ঘবদ্ধ অমুসলিম শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের তুচ্ছ মনে করি। আশা হারিয়ে ফেলি এই ভেবে যে, আমাদের পক্ষে কোনোদিনও ওদের বিরুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। ওদের আছে বিশাল বাহিনী, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ওদের দখলে। ইউনাইটেড নেশন্স ওদের কথায় ওঠাবসা করে। ওরা কোনো জায়গায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে অন্য দেশগুলোও তাদের সাথে যোগ দেয়। আর এদিকে মুসলিমরা বড়ই একা, বিভক্ত, প্রযুক্তিতে একেবারেই পিছিয়ে, অর্থনীতিতে দুর্বল, সারা পৃথিবীতে অপমানিত, ঘৃণিত। এই দুর্বল বিশ্বাস থেকে আমরা অনেকেই নিজেদের উপর অন্যায় হলে, এমনকি আক্রমণ হলেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করি না। কোনো ধরনের প্রতিরোধ করাটা আমাদের কাছে আত্মহত্যার সামিল বলে মনে হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা সময় নষ্ট মনে হয়।

কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে অসাধারণ এক শিক্ষা দিয়েছেন। ইতিহাসে এক বার, দুইবার নয়, বহুবার ছোট একটি দল বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেছে, যখন সেই ছোট বাহিনী ইসলাম সমর্থিত উপায়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছে। তালুত-এর যুদ্ধ, বদর-এর যুদ্ধ এগুলো সবই উজ্জ্বল উদাহরণ যে, আল্লাহ تعالى নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সত্যিকারের ঈমানদার বান্দাদেরকে নিজে সাহায্য করেন। তার সাহায্যে ঈমানদার বান্দারা বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও অলৌকিকভাবে জয়ী হয়। সুতরাং যারা ইসলাম সম্মত আত্মরক্ষামূলক ক্বিতাল বা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, তাদের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ تعالى তাদেরকে জয়ী করবেনই। কু’রআনেই সেই অঙ্গীকার রয়েছে। আর যারা ইসলাম সম্মত যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন না, তাদের নিয়ত যতই ভালো থাকুক না কেন, তারা আসলে নিজেরা আত্মহত্যা করে পুরো মুসলিম জাতির জন্য বিরাট ফাসাদ তৈরিতে সহযোগিতা করতে যাচ্ছেন।

আয়াতের এই অংশটি উগ্রপন্থী দলরা অপব্যবহার করে মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে। তারা তাদের অবৈধ মারামারিতে সরল প্রাণ মুসলিমদের বাগিয়ে নেওয়ার জন্য আয়াতের এই অংশ ব্যবহার করে। আয়াতে এই অংশ কোট করার আগে আমাদেরকে দেখতে হবে, তারা আমাদেরকে যেই যুদ্ধে অংশ নিতে বলছে, তার সাথে এই আয়াতে তালুত-এর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কতখানি মিল রয়েছে। এই আয়াতের প্রেক্ষাপটের অনুরূপ অবস্থা তৈরি হয়েছে কি? মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে কি কোনো কাফির বাহিনী যুদ্ধ করতে এসেছে? আমরা কি সত্যিই আত্মরক্ষায় যুদ্ধ করছি? মুসলিম বাহিনীর নেতা কি রাসুল عليه السلام এর এক আদর্শ অনুসারী? যিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনো নবী বা রাসুল নন। তাহলে তিনি কি তালুত-এর মতো একজন মুসলিম রাজা, যাকে আল্লাহ تعالى এবং রাসুল পরিষ্কার কর্তৃত্ব দিয়েছেন? মুসলিম জাতি কি তার আনুগত্য মেনে নিয়েছে? —এই সব শর্ত পূরণ না করে কেউ এই আয়াতের দোহাই দিয়ে কোনো ধরনের হামলা করতে বললে বুঝতে হবে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজের কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করা। না হয় সে নিজেই ব্যাপক বিভ্রান্ত। ইসলামের সঠিক জ্ঞান তার মধ্যে নেই, অথবা তার ব্যক্তিগত আক্রোশ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে।

তালুতের সাথে শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়া সেই সম্মানিত বিশ্বাসীরা যুদ্ধে যাওয়ার সময় আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চেয়ে যে দু’আ করেছিলেন, সেই দু’আ আল্লাহ تعالى কু’রআনে সারা মানবজাতির জন্য বাধাই করে রেখেছেন, যা মানুষ যুগ যুগ ধরে কিয়ামত পর্যন্ত পড়ে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাইবে—

 

তারপর যখন তারা জালুদ আর তার বাহিনীর সামনে দাঁড়ালো, তারা বলল, “ও আমাদের রব, আমাদের উপর ধৈর্য-নিষ্ঠা বর্ষণ করুন। আমাদেরকে দৃঢ় পায়ে অবিচল রাখুন। আমাদেরকে কাফিরদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করুন।” [আল-বাক্বারাহ ২৫০]

তাদের প্রথম চাওয়া ছিল, أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا “আমাদের উপর সবর বর্ষণ করুন।” أَفْرِغْ হচ্ছে ঢেলে দেওয়া, বোতল ঢেলে খালি করে ফেলা।[৫][১] আল্লাহর تعالى কাছে তারা শুধু সবর চাইলেন না, বরং বললেন তাদের উপর ক্রমাগত সবর বর্ষণ করে, তাদের অন্তর পূর্ণ করে দিন। যত সবর আছে, সব দিয়ে দিন। —কষ্টের সময় সবর বড়ই প্রয়োজন। আর সবর সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা আছে।

আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাঁড়িওলা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুম্মার খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।” ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামাজ পড়লেই আল্লাহ تعالى আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা এবং কু’রআনের এই আয়াতে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু শব্দের অর্থগুলো ঠিকমত না বোঝা।

সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাবো, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করবো না, এই ভেবে যে: একদিন আল্লাহ تعالى সব ঠিক করে দেবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৭] আছে—

তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল।

আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৭] এর লেখা—

শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার মেয়ে-জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল।

উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা।[৫][৭] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর تعالى আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪]

 

তারপর তারা আল্লাহর تعالى অনুমতিতে ওদেরকে পরাজিত করলেন। দাউদ জালুতকে হত্যা করলেন। আল্লাহ تعالى তাকে রাজত্ব, প্রজ্ঞা দিলেন, এবং তাকে তিনি যা চাইলেন শেখালেন। যদি আল্লাহ تعالى কিছু মানুষকে দিয়ে অন্যদেরকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হতো। কিন্তু আল্লাহ تعالى বিশ্ববাসীর প্রতি অনেক কল্যাণ করেন। [আল-বাক্বারাহ ২৫১]

পৃথিবীতে কোনো জাতি অঢেল ক্ষমতা, সমৃদ্ধি, প্রাচুর্যতে থেকে ন্যায়, নিষ্ঠা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। বেশিরভাগ জাতি কয়েক যুগ যেতে না যেতেই অন্যায়, অশ্লীলতায় ডুবে গেছে। সেটা অমুসলিমদের বেলায় যেমন হয়েছে, মুসলিমদের বেলায়ও হয়েছে। একারণেই আল্লাহ تعالى মানুষের মধ্যে কিছু দল তৈরি করেন, যারা সেই সমৃদ্ধশালী অন্যায়কারী জাতিগুলোকে পরাজিত করে আবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। আরেক জাতি তৈরি হয়। তারপর যুগ পার হয়। একসময় দেখা যায় সেই জাতি নিজেরাই আবার অন্যায়ে ডুবে গেছে। তখন আরেক দল এসে তাদেরকে পরাজিত করে আবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে। আল্লাহ تعالى যদি এভাবে শক্তিশালী অন্যায়কারী জাতিগুলোকে বার বার পরাজিত না করতেন, তাহলে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক অন্যায় ছড়িয়ে পড়তো।

 

এই হচ্ছে আল্লাহর تعالى নিদর্শন, যা তিনি তোমার (মুহাম্মাদ) উপর যথাযথভাবে তিলাওয়াত করেন। তুমি অবশ্যই রাসুলদের একজন। [আল-বাক্বারাহ ২৫২]

– ওমর আল জাবির


সূত্র:

[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button