পরিবার ও দাম্পত্যসমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

সমাজে যৌতুকের কুপ্রভাব

যৌতুক একটি ঘোরতর অপরাধ। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনাশী এ প্রথা পরিবার বিধ্বংসী বোমা সদৃশ। একজন ইংরেজ লেখক যথার্থই বলেছেন, ‘When Marriage is formed with money, its nothing but a leagal prostitution for which goverment is giving openly license for the sake of a tax’. ‘বিবাহ যখন টাকা-পয়সার (যৌতুক) মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, তখন এটা বিবাহ হয় না, এটা হয় পতিতাবৃত্তি, কর লাভের জন্য সরকার যার উন্মুক্ত লাইসেন্স প্রদান করেছেন’।

প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে হিন্দু সমাজে নারীর কোন সামাজিক ও আর্থিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। পিতৃ সম্পত্তিতে মেয়ের ছিল না কোন উত্তরাধিকার। এজন্যই বোধ হয় হিন্দু মেয়েদের বিয়েতে যৌতুক দেয়া ছিল অপরিহার্য। খুব সম্ভব এ উপমহাদেশে দীর্ঘদিন হিন্দু-মুসলিম এক সঙ্গে বসবাস করার ফলে যৌতুক নামক সমাজ বিধ্বংসী এই কুপ্রথা ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজে ঢুকে পড়েছে।

বর্তমানে আমাদের সমাজে যৌতুক একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিয়ের ঘোষিত বা অঘোষিত শর্ত হিসেবে মেয়ে পক্ষের নিকট থেকে ছেলে পক্ষের যৌতুক আদায়ের এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা চলছে। ছেলেরা টাকার বিনিময়ে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বিয়ের বাজারে কুরবানীর পশুর দামে বিঙি হচ্ছে। ফলে জামাই রূপী লোভী নরপশুদের আবদার পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। অনেক দরিদ্র বাবা তাদের মেয়েদের সুখের আশায় ভিটে-মাটি বিঙি করেও জামাইয়ের উদর পূর্তি করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। যৌতুকলোভী স্বামীর নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে কত নারীকে তার কোন ইয়ত্তা নেই। অনেককে বিসর্জন দিতে হচ্ছে প্রাণ। একটি তথ্য থেকে জানা গেছে, ১৯৮২-১৯৯২ পর্যন্ত দশ বছরে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৪৪ জন নারী। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে প্রাপ্ত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউ.এন.ডি.পি.)-র এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে ৫০% নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে সারাদেশে অন্তত ১২৮ জন মহিলা খুন হয়েছে যৌতুকের কারণে। স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করেছে ১৮ জন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪০ জন। যৌতুক দিতে অক্ষম হওয়ায় তালাকপ্রাপ্তা হয়েছে ১৪ জন।[1]

২০০৩ সালের জানুয়ারী থেকে ২০০৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে ২৬২ জনকে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৪ জন। ১২ জনকে করা হয়েছে এসিডদগ্ধ। আত্মহত্যা করেছে ৯ জন।[2]

প্রচলিত যৌতুক প্রথাকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। এ সংঙান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ, মিশকাতের আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর রচয়িতা আল্লামা ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী (১৯০৯-৯৪) বলেন, ‘বিয়ে ঠিক করার সময় পাত্রের পক্ষ হতে পাত্রী পক্ষের নিকট থেকে কোন জিনিসের দাবি করা এবং বিয়ের জন্য উক্ত দাবি পূরণকে শর্ত রাখা শরী‘আতের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ। জিনিসপত্রের মাধ্যমে, নগদ টাকার মাধ্যমে কিংবা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মাধ্যমে হৌক। এ ধরনের শর্ত আরোপকারী ব্যক্তি বা তার সহযোগীরা দ্বীনের দিক থেকে ঘোরতর পাপী ও কাবীরা গুনাহগার। পাত্রী পক্ষ থেকেও আগে বেড়ে পাত্র পক্ষকে কিছু দেওয়ার ওয়াদা করা বা প্রলোভন দেখানো শরী‘আতের দৃষ্টিতে অন্যায়’। তিনি আরো বলেন, ‘বিয়েতে দেওয়া-নেওয়ার এই প্রথা যার নাম পণ, ডিমান্ড, প্রেজেন্টেশন, যৌতুক যাই-ই রাখা হৌক না কেন, ইসলামে তা হারাম ও অবৈধ। এ থেকে বেঁচে থাকা একান্তভাবে অপরিহার্য’।[3]

সমাজদেহের দুষ্টক্ষত যৌতুক প্রথাকে নির্মূল করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সরকারী আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়াও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, জুম‘আর খুতবা, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

– নূরুল ইসলাম


[1] শেখ মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, যৌতুক একটি অপরাধ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৭), পৃ. ৩৭-৩৮।

[2] ঐ, পৃ. ৩৮।

[3] ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী, পণপ্রথা ও ইসলাম, অনুবাদ: মুহাম্মাদ ইসমাঈল (পশ্চিমবঙ্গ: জামঈয়্যাতুশ শুববানিল মুসলিমীন, তা.বি.), পৃ. ৩-৪।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button