দাওয়াত ও জিহাদ

উৎসের সন্ধানে

সকল মানুষ আদম ও হাওয়ার সন্তান। সেখান থেকে বংশ বিস্তৃত হয়ে পৃথিবী নামক এ ক্ষুদ্র গ্রহটি এখন মনুষ্যভারে জমজমাট। একই পিতা-মাতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাদের পরস্পরে মিল নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে পরস্পরে কিছু মিল-ভালোবাসা থাকলেও নেতৃস্থানীয় লোকদের অধিকাংশের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। তাদের পারস্পরিক লড়াইয়ে বিশ্ব আজ অশান্ত। অথচ বিশ্বশান্তি নির্ভর করে পারস্পরিক আস্থা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপরে। মানব সমাজে পারস্পরিক বিভেদ ও অশান্তির মূল কারণ হিসাবে আমরা দু’টি বিষয়কে চিহ্নিত করতে পারি। ১- আক্বীদা ও আমলের বৈপরীত্য ২- পারস্পরিক হিংসা ও অহংকার। মানব সমাজে বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি মূলতঃ বিশ্বাসের বৈপরীত্যের কারণেই হয়েছে। আদম (আঃ) থেকে নূহ (আঃ) পর্যন্ত সময়কালের মধ্যেই আদম সন্তানদের মধ্যে বিশ্বাসের সংঘাত শুরু হয়। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ও তাঁর বিধানকে ভুলে মানুষ প্রবৃত্তিপূজারী হয়ে পড়ে। ফলে সৃষ্টি হয় অসীলা পূজার শিরক। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন শিরক হ’ল কবরপূজা ও মূর্তিপূজার শিরক। আদমপুত্র ক্বাবিলের বংশের জনৈক ব্যক্তি সর্বপ্রথম মৃত সৎলোকের মূর্তি তৈরী করে তার অসীলায় পরকালে মুক্তি কামনায় শিরক চালু করে। অতঃপর বুরদ বিন মিহলাঈলের শাসনকালে মূর্তিপূজার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। তখন নূহ (আঃ) প্রেরিত হন। কিন্তু তাঁকে লোকেরা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে নূহ (আঃ)-এর অভিসম্পাতে ও আল্লাহ্র গযবে দুনিয়া গারত হয়ে যায়।

নূহ (আঃ)-এর কিশতীতে ওঠে বেঁচে যাওয়া নেককার সাথীদের বংশধরগণের মধ্যে পুনরায় দেখা দেয় আক্বীদার সংঘাত। যদিও তারা সকলেই ছিল নূহের তিন ছেলে হাম, সাম ও ইয়াফিছ-এর বংশধর। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে সাম-এর বংশধর সেমেটিক জাতির মানুষের বাস। কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। তারকাপূজারী ও মূর্তিপূজারীদের সঙ্গে ইব্রাহীম (আঃ)-এর বিতর্ক পবিত্র কুরআনে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর সাথে নমরূদের বিরোধ এবং মূসা (আঃ)-এর সাথে ফেরাঊনের বিরোধ ছিল মূলতঃ বিশ্বাসজনিত। ইহূদীরা যে যীশু খ্রীষ্টকে নুশবিদ্ধ করে হত্যা (?) করেছিল, তার কারণ এটা ছিল না যে, তিনি তাঁর ১০/১২ জন নিরীহ হাওয়ারীকে নিয়ে সম্রাট তুতইয়ানূস-এর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন। বরং তাঁর মূল অপরাধ ছিল এই যে, তিনি ইহূদীদের বিকৃত আক্বীদা ও আমলের সংশোধন ও পরিমার্জন কামনা করেছিলেন। বিগত যুগে বহু দার্শনিক ও বিজ্ঞানী যে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন, তারও প্রধান কারণ ছিল বিকৃত খৃষ্টীয় বিশ্বাসের জন্য তারা ছিলেন বাধা ও উপদ্রব স্বরূপ।

সবশেষে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথে মক্কার পৌত্তলিক ও মদীনার ইহূদী-নাছারাদের যে সংঘাত হয়, সেটাও ছিল মূলতঃ বিশ্বাসের সংঘাত। কেননা তাদের লালিত শিরকী আক্বীদার সঙ্গে সামান্য আপোষ করতে পারলেই তিনি মক্কার নেতৃত্বে খুব সহজেই আসীন হ’তে পারতেন। কিন্তু তিনি আপোষ না করাতেই তাদের হিংসা ও যুলুমের শিকার হন। যদিও আললাহ ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস তাদের মধ্যে সব সময় অটুট ছিল। মানুষ হিসাবে তারা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহকে তাদের বংশের সেরা সন্তান হিসাবে মেনে নিয়েছিল। তাঁকে ‘আল-আমীন’ হিসাবে বিশেষিত করেছিল। কিন্তু বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আক্বীদা-বিশ্বাসের উপরে যিদ করায় অহংকার বশে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যামানার শেষ দিকে মাথা চাড়া দেয় আভ্যন্তরীণ আক্বীদা ও আমলের সংঘাত। ইহূদী-খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের লালিত বহু কুসংস্কার ইসলামের লেবাস পরে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। সৃষ্টি হয় খারেজী, শী‘আ, ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মু‘তাযিলা, মুর্জিয়া ইত্যাদি বিভ্রান্ত মতবাদ সমূহ। আরও পরে চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে সুন্নী দল ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় হানাফী, মালেকী, শাফেঈ, হাম্বলী প্রভৃতি দল ও তন্মধ্যকার অসংখ্য উপদল। আল্লাহ, রাসূল, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসগত মিল থাকলেও আক্বীদা ও আমলের বিস্তীর্ণ ময়দানে মৌলিক ও প্রশাখাগত অসংখ্য বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি হয় দুস্তর প্রভেদ। যা আজও রয়েছে এবং দিন দিন প্রলম্বিত হচ্ছে।

নূহ (আঃ)-এর যুগে ফেলে আসা অসীলা পূজার শিরক বর্তমানে পীরপূজা ও কবরপূজার মাধ্যমে এবং মূর্তিপূজার শিরক কথিত শহীদ মিনার, স্মৃতিস্তম্ভ, ছবি ও চিত্র, ভাস্কর্য ইত্যাদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদনের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন নামে ও বেনামে মুসলিম সমাজে নমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে চলেছে। ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে আমর বিন লুহাই নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত নেতা প্রথম সিরিয়া থেকে ‘হোবল’ মূর্তি মক্কায় এনে স্থাপন করেন ও সকলকে তার অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য তাকে পূজা করার আহবান জানান। তারপর থেকে কুরায়েশের সকল গোত্রের মধ্যে নমে মূর্তিপূজা বিস্তার লাভ করে। যা রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাবকালে ৩৬০টিতে উপনীত হয়।

সেদিনের ৩৬০টির স্থলে এখন মুসলিম বিশ্বের ঘরে ঘরে, মাঠে-ময়দানে, রাস্তার ধারে, শহরে-বন্দরে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে লক্ষ লক্ষ শিরকী প্রতিমা নামে-বেনামে বিরাজ করছে। আল্লাহ্র প্রতি একক বিশ্বাস ও তাঁর প্রতি অটুট ভরসা বিভিন্ন অসীলা পূজার মাধ্যমে সকল যুগে যেভাবে ভঙ্গুর হয়েছে, এমনকি শিরকের বিরুদ্ধে আপোষহীন নবী ইবরাহীমের নিজ হাতে গড়া বায়তুল্লাহ শরীফে আল্লাহতে বিশ্বাসী লোকদের দ্বারা মূর্তিপূজার মাধ্যমে যেভাবে তাওহীদকে অপদস্থ করা হয়েছিল, একইভাবে আজ আল্লাহতে বিশ্বাসী মুসলমানদের হাতেই রকমারী শিরক ও বিদ‘আতের মাধ্যমে আল্লাহ্র একচ্ছত্র তাওহীদ ও রাসূলের একচ্ছত্র রিসালাতকে অপদস্থ করার অপচেষ্টা চলছে। সেদিন যেভাবে আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের মত কিছু মুনাফিক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ভিতর থেকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করেছিল। আজও তেমনি দুনিয়াবী স্বার্থদুষ্ট কিছু লোক ভিতর থেকে ইসলামের ক্ষতি সাধন করে চলেছে।

আজকের বিশ্বে সন্ত্রাস নির্মূলের বাহানায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ‘নুসেড’ ঘোষণার আস্ফালন, আফগানিস্তানের উপর বেহায়া আনমণ ও ইরাকের বিরুদ্ধে হামলার সকল আয়োজন ও উন্মত্ততার বিশ্বস্ত সহযোগী কেবল খ্রিষ্টান, ইহূদী ও পৌত্তলিক অধ্যুষিত দেশগুলিই নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রনেতা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরাও রয়েছেন। এমনকি ‘রিস্ক’ নিয়ে হক কথা বলার মত বুকের পাটা ধর্মীয় নেতাদেরও অধিকাংশের মধ্যে নেই।

ভারতবিজয়ী বীর সুলতান মাহমূদকে যখন সোমনাথ মন্দিরের পুরোহিতেরা তাদের হাতে গড়া মূর্তিগুলি ভাঙ্গার বিনিময়ে অঢেল সোনা-রূপা, হীরা-জহরত দিতে চেয়েছিল, তখন সুলতান দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘ম্যায় বুত শিকন হুঁ, বুত ফুরোশ নেহী হুঁ’ ‘আমি মূর্তি ধ্বংসকারী, মূর্তি বিনেতা নই’। তিনি তাঁর তাওহীদ বিশ্বাসকে অর্থের বিনিময়ে বিনি করেননি। অথচ আজ সেই ভারতবর্ষের মুসলিম রাষ্ট্র নেতারা নিজেদের গরীব প্রজাদের রাজস্বের পয়সা দিয়ে নামে-বেনামে স্থানে-অস্থানে মূর্তি ও স্তম্ভ তৈরী করছে। আর সেখানে গিয়ে পবিত্র ফুল সমূহ ছিঁড়ে এনে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছে। দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করছে। ওদিকে কবর ব্যবসায়ী ধর্মনেতারা মৃতব্যক্তির অসীলায় মুক্তি পাওয়ার ধোঁকা দিয়ে নযর-নিয়াযের পাহাড় গড়ছেন। অথচ তার মনের আয়নায় একবারও ভেসে ওঠে না সেই অভুক্ত মানুষগুলির কথা, যারা না খেয়ে না পরে প্রচন্ড শীতে, গ্রীষ্মে ও বর্ষায় কাতর হয়ে অনতিদূরে অধোমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের বা ঐ মৃত পীরের সমাধিসৌধের একখানা ইটের মূল্য দিলে ঐ অনাহারক্লিষ্ট প্রজাটির বেঁচে থাকার সংস্থান হ’ত। অথচ সবকিছুই চলছে রাজনীতির নামে। চলছে ধর্মের নামে। কে বলবে সাহস করে যে, এগুলি ধর্ম নয়, এগুলি আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন নয়। এগুলি আমাদের বানানো মেকী রাজনীতি ও মেকী ইসলাম।

নীটশের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হিটলার ও মুসোলিনী লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। কার্লমার্কসের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাশিয়া ও চীনে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জীবন গেছে। পুঁজিবাদী মিত্রবাহিনীর হামলায় নাগাসাকি-হিরোশিমায় লাখো মানুষের রক্ত ঝরেছে। আজও যার ধ্বংসের রেশ চলছে। এইভাবে শক্তিবাদ, সমাজবাদ, পুঁুজিবাদ, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি মতবাদ ও বিশ্বাসের সংঘাতে যুগে যুগে হাযার হাযার মানুষের জীবনাহুতি ঘটেছে। অথচ মানুষ যদি মানুষের সৃষ্ট মতবাদের পিছনে না ছুটে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত দ্বীনের পথে দৃঢ় থাকত, তাহ’লে অশান্তি থেকে বিশ্ব মুক্তি পেত। নবীগণ সর্বদা সেই সত্য ও মুক্তির পথে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। যার সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ রূপ হ’ল ইসলাম। যা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে মানবজাতি প্রাপ্ত হয়েছে। যা নির্ভেজালরূপে রক্ষিত আছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে। সেই নির্ভেজাল দ্বীনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানবজাতির ইহকাল ও পরকালের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে ছাহাবায়ে কেরামের যুগ হ’তে চলে আসা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আন্দোলনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করার মত কেউ আছেন কি? আমরা এসেছিলাম জান্নাত থেকে। চলুন ফিরে চলি জান্নাতের দিকে। আসুন ঝাঁপিয়ে পড়ি সেই পবিত্র উৎসের সন্ধানে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button