ভ্রমণ কাহিনী

হতভাগাদের আলো-হাওয়া

ঘটনার শুরু সুইডেন থেকে আসা কিছু ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার মাধ্যমে। আল আমিন মাসজিদ থেকে বেরিয়ে নানা ব্যাপারে আলাপ হলো। কে কি ব্যাপারে পড়াশোনা করছে শুনলাম। অভ্যাসমত উপদেশও দিয়ে ফেললাম—ভালো করে পড়েন। আমরা বর্তমান সময়ের মুসলিমরা বুঝে পড়ি না, শিখি না। কোন কিছু উদ্ভাবন তো দূরে থাক, দেখে দেখেও বানাতে পারি না। সেদিন বাসায় গিয়ে মারুফকে একটা মেসেজ দিলাম:

আমাকে অল্টারনেট এনার্জির উপরে কোন প্রজেক্ট প্রপোজাল দিতে পারবেন। ধরুন আমি একটা কারেন্ট নেই এমন একটা মাদ্রাসাতে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে চাই। পল্লি বিদ্যুতের উপরে ভরসা করতে চাই না, কবে আসবে ঠিক নেই। এমন একটা প্রজেক্টে কী কী জিনিস লাগবে, কত টাকা লাগবে, কেমন এক্সপারটিস লাগবে–সব কিছু মিলিয়ে একটা প্রজেক্ট প্রফাইল। কাজটা ঠিক ছোট না, আপনাকে বেশ খাটতে হবে। তবে যদি রেডি করে দিতে পারেন তবে আমি টাকা-পয়সা যোগাড় করে কাউকে দিয়ে কাজটা করাতে পারব ইন শা আল্লাহ। চরের একটা গ্রামের মাঝখানের মাদ্রাসাটা আলোতে ভরে উঠেছে–কেমন লাগছে ভাবতে?

মারুফ জবাব দিল,

মাশাআল্লাহ ভাইয়া, খুবই ভালো একটা আইডিয়া। যদি ঠিকমতন বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে খুব ভালো একটা কাজ হবে ইনশাল্লাহ। প্রোজেক্টের ব্যাপারটায় আসি— ইনশাল্লাহ ভাইয়া,

প্রপোজালটা বানিয়ে দিতে পারবো। খাটাখাটনি করা যাবে, সমস্যা হবে না আশা রাখি। আমার আর আনাস অল্টারনেট এনার্জির উপরে বেশ কিছু কাজ করেছি। আর আমি এইমাত্র আরো একজন বন্ধুর সাথে কথা বললাম, (সে এই ব্যাপারগুলোতে বেশ এক্সপার্ট বলা চলে) সেও হেল্প করতে রাজি আছে। কি কি জিনিস লাগবে তা মোটামোটি জানা আছে, দাম এর ব্যাপারটা লোকাল মার্কেট থেকে জেনে নিতে হবে। আশা করি, খুব সহজেই জিনিসটা তৈরী করে দেয়া যাবে ইনশাল্লাহ।

কাজ শুরুর আগে কয়েকটা ব্যাপার একটু জানা দরকার ভাইয়া। # আপনি কতদিনের মাঝে প্রপোজালটা রেডি চাচ্ছেন? # মাদ্রাসাটা কোথায় হবে? (লোকেশান থেকে আবহাওয়ার ডাটা নিতে হবে।)

# কত বড় হবে? কতজন মানুষ থাকবে? (সিভিল ডাটা)

রমাদান উপলক্ষ্যে মাদ্রাসার বাচ্চাদের খাওয়ানোর একটা প্রজেক্ট ছিল। সেটার সাথে এই কাজটাও ঢুকিয়ে একটা লালমনিরহাট টুরের ব্যবস্থা করে ফেললাম। তারপর কী হলো? যারা গিয়েছিলেন তাদের জবানিতেই শুনুন:

———————————————-

৩য় রমজানে অপু ভাইয়ার মাধ্যমে লালমনিরহাট যাওয়া। উদ্দেশ্য ছিলো সেখানকার সুবিধাবঞ্চিত মাদ্রাসাগুলোর জন্য প্রথমত ইফতারের ব্যবস্থা করা, সাথে সাথে তাদের বর্তমান অবস্থাটা একটু দেখা আসা। ওখানকার ১৭টি মাদ্রাসার সার্বিক তত্ত্বাবধায়নের অত্যন্ত কঠিন কাজটি প্রায় একাই করে আসছেন হুসাইন ভাই। আমি এমন ডায়নামিক মানুষ খুব কমই দেখেছি, অসাধারণ কর্মঠ একজন লোক। দ্বীনের পথে লড়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। মাদ্রাসাগুলোকে সঠিকভাবে চালানো থেকে শুরু করে হাজারো সমস্যা, প্রশাসনিক ঝামেলা একাই সামলাচ্ছেন। যাই হোক, হুসাইন ভাইয়ের সাথে প্রায় সবগুলো মাদ্রাসাতে গেলাম।

যাবতীয় সুবিধার কেন্দ্রবিন্দুতে, ঢাকায় বসে থেকে কিছু ব্যাপার উপলব্ধি করা আসলেই অনেক কঠিন। দেশের প্রান্তিক একটা ছোট মফঃস্বল শহর আর তদসংলগ্ন অজপাড়াগাঁ, সেখানকার জীবনযুদ্ধ কি জিনিস তা নিজচোখে দেখে না আসলে হয়ত কখন বুঝতামই না। আমরা দুঃখ নিয়ে বিলাস করি, কত অল্পতেই না মন খারাপ করে বসে থাকি, আর দুঃখ ওখানকার মানুষদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বিলাস করছে। বেশিরভাগ মানুষই হতদরিদ্র, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত জীবন, আছে দুর্বিত্তদের অত্যচার, ভণ্ড পীরফকিরদের দৌরাত্ত আর বিপথে যাবার হাজারো প্ররোচনা। আর এইসবকিছুর মাঝে আরেকটা বড় অ্যালার্মিং ব্যাপার হলো মিশনারিদের তৎপরতা। একটা গ্রামে দেখলাম প্রায় ৫০টা পরিবারের সবাই ধর্মান্তরিত, এমন প্রত্যেকটা এলাকায়ই কম বেশি আছে। এর পেছনের মূল কারণ যতটা না অর্থাভাব, তার থেকে বেশি মনে হলো সঠিক জ্ঞানের অভাব, দ্বীন সম্পর্কে ভালোভাবে জানার মাধ্যমের অভাব। তাই ওই মাদ্রাসাগুলো ঠিকমতন চলার দরকার অনেক বেশি। গত সাত বছর ধরে অসাধারন কিছু মানুষের হাত ধরে দাঁড়িয়েও গেছে ওই মাদ্রাসাগুলো। কিছু হয়ত আগেই ছিল, কিন্তু অর্থাভাব, শিক্ষক সঙ্কট, প্রশাসনিক চাপ সবমিলেই বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্, মানুষের সাহায্যে আর হুসাইন ভাইদের মতন কিছু লোকের অসামান্য শ্রমে সবগুলো মাদ্রাসাই এখন সুন্দরভাবে চলছে। প্রায় প্রতিটি মাদ্রাসাতেই ৯০ থেকে শুরু করে ১৮০জন পর্যন্ত ছাত্র আছে, মাশাআল্লাহ অসাধরণ একটি ব্যাপার। আশেপাশের জেলাগুলো থেকেও আছে অনেকে, আছে হতদরিদ্র, ইয়াতিম ছোট ছোট ছেলে। বেতন নেয়ার কোনো ব্যবস্থা তো নেই-ই, বরং মাদ্রাসাগুলো থেকেই উল্টো তাদের যতটা সম্ভব সাহায্য করা হয়।

সমস্যা অনেক, প্রতিকূলতাও। খুব কম দিনই যায়, যখন এতোগুলো ছাত্রের তিনবেলা ঠিকমতন খাবার জোটে। কখনো হয়ত দুবেলাই কষ্টকর হয়ে যায়। তারপরেও কোনো না কোনোভাবে ব্যবস্থা হয়েই যায়। আপাত দৃষ্টিতে সব থেকে বড় সমস্যাটা হলো— কারেন্টের সমস্যা, আলোর ব্যবস্থা করা। এতগুলো ছোট ছোট ছেলে, সন্ধ্যার পর থেকেই অসহায়ের মতন একটা কি দুটো কুপির আলোতে বসে থাকতে হয়। অসহ্য গরমের ব্যাপারটা নাহয় বাদই দিলাম, দিন শেষ তো পড়াশুনাও বন্ধ। মাত্র ৩টা মাদ্রাসায় পল্লীবিদ্যুৎ এর কানেকশন আছে, কিন্তু তা আসলে না থাকারই সমতুল্য। মাদ্রাসার শিক্ষকদের সাথেও কথা বললাম। এতো সমস্যা এতো অভাব অথচ মুখ ফুঁটে কেউ কিছুই বললেন নাহ। সবাই শুধু একটা ব্যাপারেই বারবার সাহায্য চাইলেন, রাতে আলোর ব্যবস্থাটা যাতে হয়, বাচ্চাগুলার পড়াশুনা যাতে থেমে না থাকে। শুনে নিজের কাছেই অনেক ছোট হয়ে গেলাম। এতটুকু সাহায্যও কি করতে পারবো না?

ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে, বিভিন্ন মানুষের সহায়তায়। আলহামদুলিল্লাহ্, বেশ ভালোই কাজ চলছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে, হিসেব করে দেখলাম আরো ১৩টি সোলার প্যানেল (প্রতিটি ৮৫ ওয়াট করে) যদি বসানো যায়, তবে মোটামোটি প্রায় সবগুলো মাদ্রাসাতেই প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থাটা করে ফেলা সম্ভব। এক একটি প্যানেলের ইন্সটলেশনের খরচ পরবে ৪৫,০০০ টাকা করে, সেই হিসেবে সব মিলেই ৫,৮৫,০০০ টাকা দরকার। সত্যি করে বলতে গেলে, খুব ছোট কোনো পরিমাণ না আবার খুব বেশিও কিন্তু না। বড় বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ছাড়া নিজেরাই এই টাকাটা যোগাড় করে ফেলা যায়। আমরা ইতোমধ্যেই কাছের পরিচিতজনদের কাছ থেকে যতটুকু পারা যায়, সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করছি। এখন ফেসবুকেও সবার কাছে ওপেনলি এই নিবেদনটা থাকবে। আর সাথে সাথে সবাই দু’আ করবেন, চেষ্টা থাকবে, ইনশাআল্লাহ এই রমজানের মাঝেই যাতে কাজটা শেষ করে ফেলতে পারি। একটু ভেবে দেখুন, আপনার আমার অল্প একটু অনুদান হয়তো কাউকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত হতে, পবিত্র কুরআনে হাফেয হতে সাহায্য করছে। নিজেরা যতটুকু পারি, নিজেদের পরিচিতদের থেকে যা পারি, অল্প অল্প করে সবাই মিলে করলে মুহূর্তেই বেশ বড় একটা কাজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

ছোট একটু কথা বলে শেষ করি। কাউকে আঘাত করতে বা কটাক্ষ করতে নয়, নিজের উপলব্ধি থেকে বলা। মন থেকে চাইলে, একটু চেষ্টা করে দেখলেই কিন্তু হয়ে যায়। আমরা বন্ধুরা মিলে ইফতারে বাইরে কোথাও খেতে গেলেও হাজার খানেক টাকা বের হয়ে যায়। একজন মানুষের কতই বা খেতে হয়? নাহয় এবার বন্ধুরা সবাই মিলে একটু সাদামাটা খেয়েই ইফতার করলাম, বেঁচে যাওয়া টাকাটা একটা উত্তম কাজে দিয়ে দিলাম, সবাই মিলে একটা বিশাল কিছুর অংশীদারও হয়ে গেলাম। এই পরিতৃপ্তিটা, মনের প্রশান্তিটা নিশ্চয়ই দামী জায়গায় ভরপেট খাওয়া থেকেও হাজারগুণ দামী।

আবার প্রতি ঈদেই তো নতুন একটা পাঞ্জাবী কেনা হয়। কেনার জায়গার উপর নির্ভর করে হয়ত তার দাম হাজার থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত গড়ায়। কয়দিনই বা ওইটা পরা হয়? আলহামদুলিল্লাহ্, অনেক তো আছে। এই ঈদে নাহয় আগের বারেরটাই ধুয়ে, ইস্ত্রি করে পরে ফেললাম। কিই বা হবে? নতুন চমকটা হয়তো থাকবে নাহ, কিন্তু মনভর্তি প্রফুল্লতা তো থাকবে। আলহামদুলিল্লাহ্, সেটাই কি ঈদের আসল আনন্দ না?

– আহমেদ মারুফ

——————————————-

কিছুদিন আগে জর্ডানে আশ্রয় নেয়া সিরিয়ানদের উপর মিশনারীদের তৎপরতার একটি রিপোর্ট দেখে আমরা খুবই হা-হুতাশ করলাম। নিরুপায়ের একটি শ্বাস ফেললাম কারণ সাধ্যের মধ্যে নেই সাহায্য করার। কিন্তু আমাদের সাধ্যের মধ্যে যে আমাদের দেশ আছে, সেইখানেই বহুগুনে মিশানারিরা তাদের ধোকাবাজি অব্যাহত রেখেছে। দেশের অন্যান্য জায়গার অবস্থার কথা জানিনা কিন্তু লালমনিরহাট এ যা দেখে আসলাম… ইয়া সালাম, আল্লাহ আমাদের সহায় হোক। এখানে একটি এলাকার নামই মিশনারী!!, আর তার সংলগ্ন মোড়ের নাম মিশন মোড়। এমন কোন কাজ নেই যে তারা বাকি রাখে নাই, অর্থ দিয়ে তো আছেই এর সাথে আছে কুরআনের নকল করে বাইবেল, নিজস্ব রেডিও স্টেশন, মাসিক পত্রিকা, শিশুদের গল্পের বই থেকে শুরু করে মসজিদ পর্যন্তও! যেখানে ইমাম সেজে একজন মিশনারীরা কাজ করে যাচ্ছে।

এসবের বিরুদ্ধে একাই লড়ে যাচ্ছে হুসাইন ভাই। আমরা যেখানে সারা জীবনে একটি মাদ্রাসা বা মসজিদ দিতে পারলে মহা খুশি সেখানে তিনি অর্ধশতাধিক মসজিদ মাদ্রাসা দিয়েও ক্ষান্ত নয়। যেখানে আমরা সারা জীবনে একজনকে ইসলামের পথে আনতে পারলে মনে করি প্রায় সফল হয়ে গেছি সেখানে তিনি কতজন ধর্মান্তরিদের ইসলামের পথে ফিরিয়ে এনেছেন তার হিসাব নেই। কিছুদিন আগেও তিনি ৩৮ টি পরিবারকে ফিরিয়ে এনেছেন। যেখানেই মিশনারীদের আগুন জ্বলে উঠেছে সেখানেই তিনি মসজিদ ও মাদ্রাসা তুলে দিয়েছেন তা নিভানোর জন্য।

গিয়ে দেখলাম মাদ্রাসার অবস্থা খুবই করুন। অধিকাংশ মাদ্রাসায় বিদ্যুৎ নেই। কিছু মাদ্রাসায় সোলার প্যানেল আছে কিন্তু তা দিয়ে ফ্যান এর ব্যবস্থা করা যায় না। অত্যাধিক গরমের কারনে এক মাদ্রাসায় দেখলাম ৭০ জনের মধ্যে ৪০ জনই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ছাড়ায় আর হুসাইন ভাই এর অত্যাধিক চলাফেরার কারণে তার শরীরের অবস্থা নাজুক। ডাক্তার বলেছে ৬ মাসের বিশ্রাম ছাড়া তার আরোগ্যের উপায় নেই। এই one man army এর হাত আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। আর্থিক আর জনবলের দিক থেকে মিশনারীদের তুলনায় তার কিছুই নেই বলতে গেলে। প্রচুর অর্থ আর কিছু ত্যাগী ভাই এর প্রয়োজন সেখানে।

– আনাস সাঈদ

———————————–

পুরো প্রজেক্টের খুটিনাটি আর কত টাকা উঠল সেটা দেখার জন্য— https:/docs.google.com/spreadsheet/ccc?key=0Ah-NCsFzfs8OdDd2S2Z4NnZJbG1BcWd6REhHZVNVYUE#gid=0

————————————

আল্লাহ আমাদের কাজ কোনোদিন আটকে রাখেননি, এবারও রাখবেন না। আমার বিশ্বাস ওরা সুইডেন ফিরে যাওয়ার আগে আরেকবার লালমনিরহাট যাবে। সবগুলো মাদ্রাসাতে সোলার প্যানেল, এক্সহস্ট ফ্যান আর টিনের চালের নীচের চাটাই বসানোর ব্যবস্থা করে আসবে ইন শা আল্লাহ।

http:/www.facebook.com/l.php?u=http%3A%2F%2Fon.fb.me%2F12Oe2E9&h=jAQFeo8oz

– শরীফ আবু হায়াত অপু

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button